শুক্রবার, ২০ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

চাকচিক্যময় দুনিয়ার প্রতারণা

মুফতি আমজাদ হোসাইন

চাকচিক্যময় দুনিয়ার প্রতারণা

পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হচ্ছে- মানবকুলকে মোহগ্রস্ত করেছে নারী, সন্তান-সন্ততি, রাশিকৃত সোনা-রুপা, চিহ্নিত অশ্ব, গবাদি পশুরাজি এবং ক্ষেত-খামারের মতো আকর্ষণীয় বস্তুসামগ্রী। এসবই হচ্ছে পার্থিব-জীবনের ভোগ্যবস্তু। আল্লাহর কাছেই হলো উত্তম আশ্রয়। (সূরা আল্-ইমরান : ১৪)। অর্থাৎ নারী, সন্তান, সোনা, রুপা, ঘোড়া, চতুষ্পদ জন্তু শস্যক্ষেতসহ এমন কতিপয় বস্তুসামগ্রী আছে যেগুলোকে আল্লাহপাক সুন্দর ও সজ্জিত করে সৃষ্টি করেছেন। কৃত্রিমভাবে সুন্দর করতে হয় না। যেমন মণিমুক্তা, হীরা-ডায়মন্ড এবং সুন্দরী নারী যেগুলো নিজে নিজেই সুন্দর এগুলোকে সুন্দর করার প্রয়োজন হয় না। আলোচ্য আয়াতের ব্যাখ্যায় তাফসিরে মা’রেফুল কোরআনে আল্লামা মুফতি শফি সাহেব (রহ.) বলেন, এই আয়াতের সারমর্ম তিনটি, এক. আল্লাহতায়ালা কর্তৃক বর্ণিত বস্তুসমূহের প্রতি মানবকুলের স্বভাবগত আকর্ষণ ও মোহ সৃষ্টি করে দিয়েছেন। কারণ মানুষের যদি এগুলোর প্রতি আকর্ষণ না থাকে তাহলে কেয়ামত পর্যন্ত দুনিয়া টিকে থাকার ক্ষেত্রে ব্যাঘাত সৃষ্টি হবে, বিশ্ব পরিচালনায় বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে, প্রেমিক প্রেমিকার জন্য সর্বস্ব উৎসর্গ করবে না। স্বামী তার স্ত্রীর যাবতীয় ভরণ-পোষণের ভার নিজের কাঁধে নেবে না, পিতা সন্তানদের আহার্য জোগাড় করার জন্য, ভোরে রিজিক তালাশের উদ্দেশ্যে ঘর থেকে বের হবে না। কৃষক লাঙল জোয়াল কাঁধে নিয়ে কুয়াশাঘেরা সকালে কৃষিকাজের উদ্দেশ্যে মাঠে বের হবে না এবং ধনী ব্যক্তি সম্পদের জন্য বিশ্ব ভ্রমণ করবে না ইত্যাদি ইত্যাদি। তাই দুনিয়াকে কেয়ামত পর্যন্ত টিকিয়ে রাখার জন্য আল্লাহতায়ালা ওই বস্তুসমূহের প্রতি বান্দার আকর্ষণ ও মোহ তৈরি করে দিয়েছেন। দুই. জাগতিক বস্তুসমূহের প্রতি যদি বান্দার আকর্ষণ সৃষ্টি না হয় তাহলে জান্নাতের অফুরন্ত নেয়ামতের প্রতিও বান্দার আকর্ষণ জাগবে না। আর জান্নাতের প্রতি আকর্ষণ সৃষ্টি না হলে বান্দা পরকালমুখী হবে না এবং জাহান্নাম থেকে মুক্তির ব্যাপারে কোনো পেরেশানিও থাকবে না। তিন. জাগতিক সুস্বাদু ও মোহনীয় বস্তুসমূহকে আল্লাহপাক মানুষকে দান করেছেন তার পরীক্ষা নেওয়ার জন্য। তিনি দেখতে চান যে, বান্দারা তার দেওয়া নেয়ামত পেয়ে নেয়ামতদাতাকে স্মরণ করে নাকি পৃথিবীর মোহে অন্ধ হয়ে যায়? বান্দা বস্তুর পেছনে পড়ে নিজেকে বস্তুবাদী বানায় নাকি এগুলো পেয়ে আল্লাহর শুকরিয়া জ্ঞাপনার্থে সেজদায়ে লুটিয়ে পড়ে। আয়াতের শেষাংশের সারমর্ম হলো, আল্লাহ বলেন, হে দুনিয়ার মানুষ তোমরা শুনে রাখ, দুনিয়ায় আমার সৃষ্ট বস্তুসমূহ শুধু ভোগ করার জন্য, মন দেওয়ার জন্য নয়, আমার শুকরিয়া আদায়ের জন্য নাফরমানি করার জন্য নয়, পরকালের সামানা তৈরি করার জন্য পরকালকে ভুলে যাওয়ার জন্য নয়। আল্লাহর কাছে পরকালে দুনিয়াবী নেয়ামত থেকে অনেক বেশি স্থায়ী নেয়ামত রয়েছে। যে নেয়ামত সম্পর্কে হাদিসে বলা হয়েছে, ‘দুনিয়ার কোনো চক্ষু কখনো দেখেনি, কোনো কান কখনো শুনেনি এবং কোনো অন্তর কখনো কল্পনাও করেনি’। সুতরাং সেই স্থায়ী ভুবনে আমাদের অবশ্যই যেতে হবে।

আল্লাহতায়ালা সে ভুবনে যাওয়ার সঠিক ও সুশৃঙ্খল ব্যবস্থা করে রেখেছেন। যুগে যুগে নবীদের পাঠিয়েছেন। বিভিন্ন গ্রন্থের মাধ্যমে বান্দাদের সহনীয় বিধিবিধান দিয়েছেন যেন মানুষের সেখানে গিয়ে কষ্ট ভোগ করতে না হয়। মনে রাখতে হবে আল্লাহতায়ালা বান্দার ইবাদতের মুখাপেক্ষী নন। তিনি সর্বদিক থেকে স্বয়ংসম্পূর্ণ। বান্দা দুনিয়াতে যা কিছু করবে পরকালের জন্য তাঁর বিনিময় পরকালে পুঙ্খানুপুঙ্খ পেয়ে যাবে। দুনিয়াতে বান্দা কৃষিকাজ করে, ব্যবসা-বাণিজ্য করে, চাকরি করে নিজেদের উপকারের জন্য। ঠিক অনুরূপভাবে বান্দার তামাম ইবাদত যেমন- নামাজ, রোজা, হজ, যাকাত ইত্যাদি ইবাদতও বান্দা নিজের জন্যই করে থাকে। ইবাদতের ফল সে দুনিয়া ও আখেরাতে পেয়ে যায়। দুনিয়ার সূচনা থেকে কেয়ামত পর্যন্ত আগত সব মানুষ যদি আল্লাহর নাফরমানি করে তাহলে আল্লাহর রাজত্বে ও প্রভুত্বে সামান্যতম সমস্যা হবে না। সব মানুষ যদি তাঁর ইবাদত করে, এর দ্বারা আল্লাহর রাজত্ব সমৃদ্ধশালী হবে না। আবার দুনিয়ার সব সৃষ্টির তামাম চাহিদা পুরা করলেও আল্লাহর নেয়ামতের অফুরন্ত ভাণ্ডার মশা-মাছির ডানা পরিমাণও খালি হবে না। প্রিয় পাঠক! একটু চিন্তা করুন, অমুখাপেক্ষী প্রভু আল্লাহ তাঁর বান্দার সুখ-শান্তির জন্য মাতৃগর্ভ থেকে দুনিয়াতে আগমন এবং মৃত্যু পরবর্তী জীবনের জন্য কত কিছুই না সৃষ্টি করেছেন যা লিখে বা বয়ান করে শেষ করা যাবে না। কোনো এক দার্শনিক বলেন, আল্লাহপাক মানুষের আবেদন ছাড়াই মাতৃগর্ভে হাত, পা, নাক, কান, মুখসহ সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সহি-ছালেম সৃষ্টি করেছেন এমনকি প্রতিটি মানবদেহে আল্লাহপাক চার হাজার হেকমত লুকায়িত রেখেছেন যা প্রকাশিত হয়েছে। এ ছাড়াও মানবদেহে আরও কত অপ্রকাশিত হেকমত রয়েছে যা আজ পর্যন্ত কেউ উম্মোচিত করতে পারেনি। আল্লাহপাক বান্দার ওপর কতই না দয়াবান। বান্দা কি নিজের স্থায়ী সুখ-শান্তির জন্য কোনো চিন্তা করে? যদি চিন্তা করত তাহলে বান্দা চাকচিক্যময় দুনিয়ার প্রতি মনোনিবেশ করত না। বান্দা নিজের পরকালে আরাম-আয়েশের কি চিন্তা করে? যদি চিন্তা করত তাহলে আল্লাহ ও রসুল কর্তৃক প্রদর্শিত পথ ছাড়া তাগুতি পথের অনুসরণ করত না।  আল্লাহপাক আমাদের সব মুসলিম ভাইবোনকে দীনের সঠিক বুঝ দান করুন। আমিন।

                লেখক : মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও খতিব, বারিধারা, ঢাকা।

সর্বশেষ খবর