বুধবার, ২ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা
দৃষ্টিপাত

উপজেলার চাকরিতে ওদের আপত্তি কেন?

মোশাররফ হোসেন মুসা

সম্প্র্রতি মন্ত্রী পরিষদের এক সিদ্ধান্তের মাধ্যমে ১৭টি দফতর উপজেলা পরিষদে ন্যস্ত করা হয়েছে। সেই সঙ্গে ওসব দফতর প্রধানদের বেতন-ভাতা উপজেলা চেয়ারম্যান ও ইউএনওর যৌথ স্বাক্ষরে প্রদান করার নিয়ম চালু করা হয়েছে। অন্যদিকে প্রকৌশলী-কৃষিবিদ-চিকিৎসক (প্রকৃচি) ও ১৬ দফতরের প্রধানরা ইউএনওর কর্তৃত্ব বিলোপ করার জন্য ছয় দফা দাবি নিয়ে আন্দোলন শুরু করেছেন। ফলে শুরু হয়েছে চতুর্মুখী দ্বন্দ্ব। আমরা জানি, উপজেলা প্রশাসনের ১৭টি দফতরের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা উপজেলা পরিষদ নামক কথিত স্থানীয় সরকারের অধীনে চাকরি করতে বাধ্য থাকবেন এমন ঘোষণা দিয়ে চাকরিতে যোগ দেননি। যেমনিভাবে ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনের কর্মচারীরা করে থাকেন। তবে এদেশে একটি মাত্র ‘সরকার ব্যবস্থা’ বহাল থাকায় সরকার যে কোনো কর্মকর্তা/কর্মচারীকে স্থানীয় সরকারে ন্যস্ত করতে পারেন। এটি আইনত অবৈধ নয়; কিন্তু নীতিগত দিক থেকে কতটুকু সঠিক তা প্রশ্ন করার অবকাশ রয়েছে।

এরশাদ সরকার ১৯৮২ সালে প্রশাসনিক নীতি বিকেন্দ্রীকরণের লক্ষ্যে (গণতান্ত্রিক নীতি বিকেন্দ্রীকরণের লক্ষ্যে নয়) ‘উপজেলা পরিষদ এবং উপজেলা প্রশাসন পুনর্গঠন’ অধ্যাদেশ জারি করেন। এ অধ্যাদেশ অনুযায়ী একজন নির্বাচিত চেয়ারম্যান, প্রতিনিধি সদস্য, অফিসিয়াল সদস্য এবং মনোনীত সদস্য নিয়ে উপজেলা পরিষদ গঠন করা হয়। ১৯৮২ সালে সরকারি রেজুলিউশন অনুযায়ী উপজেলা পর্যায়ে সরকারি কার্যাবলি মূলত দুই ভাগে ভাগ করা হয়, তা হলো ১৩টি সংরক্ষিত কাজ ও ১০টি হস্তান্তরিত কাজ। এ পদ্ধতির আওতায় সংরক্ষিত ও হস্তান্তরিত কাজগুলোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে উপজেলা পরিষদে ন্যস্ত করা হয়। তখন বিধান অনুযায়ী সংরক্ষিত বিষয়াদির কর্মকর্তাদের (মুন্সেফ এবং ম্যাজিস্ট্রেট ছাড়া) উপজেলা পরিষদের কাছে জবাবদিহি করতে হতো। উপজেলা গ্রামীণ স্থানীয় সরকারের মধ্যবর্তী স্তর হলেও এ পদ্ধতিটি নতুন হওয়ায় এর প্রয়োজনীয়তা ও অপ্রয়োজনীয়তা তেমন বোঝা যায়নি। তাছাড়া সে সময় উপজেলাতে বিপুল পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়। সে অর্থ দ্বারা উপজেলায় ন্যস্তকৃত বিভাগগুলোর অফিস, আদালত ভবন, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ইত্যাদি নির্মাণ ছাড়াও উপজেলামুখী রাস্তাঘাট নির্মাণ করা শুরু হয়। সরকারের এসব উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে বিভিন্ন দলের রাজনৈতিক নেতা-কর্মীরা জড়িয়ে পড়েন। ফলে এটি স্থানীয় সরকার না কেন্দ্রীয় সরকারের মাঠ প্রশাসন সেটি বুঝে উঠতে অনেকেই সক্ষম হননি। কিন্তু ১৯৯২ সালে বিএনপি সরকার এটির বিলুপ্তি ঘোষণা করলে এটির গোমর ফাঁস হতে শুরু করে। যেমন- এ স্তরটি ইউনিয়ন পরিষদের (এবং যদি পৌরসভা থাকে তাদের) নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত পরিষদ দ্বারাও পরিচালনা করা সম্ভব- তা প্রমাণ হয়ে পড়ে। আবার স্থানীয় সরকার হতে হলে তার নিজস্ব আয়ের ব্যবস্থা থাকতে হয়। প্রথমে সে তার আয় দ্বারা অফিস খরচ নির্বাহ করবেন, নিজেদের সম্মানী ভাতা নেবেন ও কর্মচারীদের বেতন-ভাতা প্রদানের ব্যবস্থা করবেন। তারপর অবশিষ্ট আয় দ্বারা (প্রয়োজনে কেন্দ্রীয় সরকারের সহযোগিতা নিয়ে) এলাকার উন্নয়ন সাধন করবেন। কিন্তু উপজেলার নিজস্ব কোনো আয় না থাকায় এটিকে কেন্দ্রীয় সরকার ও ইউনিয়ন পরিষদের আয়ের ওপর নির্ভর করতে হয়। ফলে শত বছরের ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান ইউনিয়ন পরিষদগুলো দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়ে পড়ে। অন্যদিকে ‘প্রকৃচি, ২৬ ক্যাডার ও উপজেলা পরিষদে ন্যস্ত ১৬ দফতর’ নামে নবগঠিত একটি সংগঠন ইউএনও’র কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেছে। তাদের দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে- (১) তাদের বেতন-বিল উত্তোলনে ইউএনওর স্বাক্ষর করার ক্ষমতা প্রত্যাহার করতে হবে; (২) আধিপত্যবাদী প্রশাসন ব্যবস্থার বিলুপ্তি করতে হবে; (৩) একজন গেজেটেড কর্মকর্তার বেতন-বিলে আরেকজন গেজেটেড কর্মকর্তার স্বাক্ষর মর্যাদাহানিকর (উল্লেখ্য, এরশাদ সরকারের আমলে উপজেলা পরিষদের সব কর্মকর্তা/কর্মচারীর বিলে একজন সহকারী কমিশনার স্বাক্ষর করতেন); (৪) স্ব-স্ব ক্যাডারের হাতে স্ব-স্ব বিষয়ভিত্তিক ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা প্রদান করতে হবে; (৫) উপজেলা, জেলা, অঞ্চল, বিভাগ ও কেন্দ্রীয় পর্যায়ের কর্মকর্তাদের পদমর্যাদাক্রম (warrant of Precedence) একই হতে হবে ইত্যাদি। এখান লক্ষণীয়, প্রকৃচির সঙ্গে প্রশাসন ক্যাডারের দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছে বেতন-ভাতার বিষয় নিয়ে, কোনো কাজ নিয়ে নয়। চিকিৎসকরা জনগণের কী সেবা দিচ্ছেন তা বোঝার জন্য জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতাল এবং তাদের নিয়ন্ত্রিত ক্লিনিকগুলোর দিকে দৃষ্টি দিলেই এর প্রমাণ পাওয়া যাবে। তারা স্থানীয় কোনো কর্তৃপক্ষের অধীনে চাকরি করতে রাজি নন। অথচ উন্নত বিশ্বে গিয়ে তারা নগর সরকারের অধীনে চাকরি করেন। উপজেলাতে ‘স্থানীয় সরকার প্রকৌশল’ নামে একটি দফতর রয়েছে বটে। দফতরটির নাম ‘স্থানীয় সরকার প্রকৌশল’ না হয়ে ‘কেন্দ্রীয় সরকার প্রকৌশল’ হওয়াই অধিক যুক্তিযুক্ত। যেহেতু এটি স্থানীয় সরকারের অধীনস্থ কোনো প্রতিষ্ঠান নয়। এটিতে প্রয়োজনের চেয়ে অতিরিক্ত কর্মকর্তা/কর্মচারী রয়েছেন। এসব কর্মকর্তা-কর্মচারী স্থানীয় সরকারকে সহযোগিতার নামে এক ধরনের প্রভুত্ব কায়েম করেছেন। তবে কৃষিবিদরা কৃষকদের কাছাকাছি থেকে কিছুটা হলেও সেবা দিচ্ছেন। যেমন- উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তারা ইউনিয়ন পরিষদের সঙ্গে জড়িত থেকে চাষিদের সহযোগিতা করছেন। এদেশের আয়তন, ভৌগোলিক অবস্থান, ইতিহাস-ঐতিহ্য, চিন্তাভাবনা ইত্যাদি বিবেচনায় নিলে এদেশে দুই প্রকারের কাজ রয়েছে। তা হলো জাতীয় কাজ ও স্থানীয় কাজ। জাতীয় কাজ কেন্দ্রীয় সরকারের জন্য এবং যাবতীয় স্থানীয় কাজ স্থানীয় সরকারের জন্য নির্দিষ্ট করে দিতে হবে। তখন স্বাভাবিক কারণে জাতীয় কাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে এবং স্থানীয় কাজের সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা স্থানীয় সরকারের অধীনে চাকরি করতে বাধ্য থাকবেন।  উন্নত বিশ্বে তেমনটিই চালু রয়েছে। এদেশেও সত্যিকার স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা চালু হলে তখন যোগ্য ও উপযুক্ত ব্যক্তিরাই স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধি নির্বাচিত হবেন- তাতে কোনো সন্দেহ নেই।      লেখক : গবেষক। 

সর্বশেষ খবর