রবিবার, ১৩ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

বেগম জিয়া কি পৌর নির্বাচনও বর্জন করবেন?

কাজী সিরাজ

বেগম জিয়া কি পৌর নির্বাচনও বর্জন করবেন?

পৌরসভা নির্বাচনে শেষ পর্যন্ত কি হবে এক্ষুনি তা বলা মুশকিল। দেশে জাতীয় নির্বাচন হোক আর স্থানীয় সরকার নির্বাচন হোক, সে নির্বাচন যদি সবার কাছে গ্রহণযোগ্য না হয় তার কোনো মূল্য নেই। গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচনের জন্য সবার অংশগ্রহণ একটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত বটে, কিন্তু অন্যান্য শর্তাবলী পূরণ না হলে কোনো অবস্থাতেই একটি নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য ও আদর্শ নির্বাচন বলা যাবে না। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত ৪০টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি এবং তাদের জোটসঙ্গী জামায়াতে ইসলামীসহ ৩০টি রাজনৈতিক দলই অংশগ্রহণ করেনি। গণতান্ত্রিক দুনিয়ার প্রায় সব রাষ্ট্র, বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগীরা এবং ইইউ, কমনওয়েলথ, জাতিসংঘ সবাই ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হয়নি বলে আনুষ্ঠানিক মতামত দিয়ে বাংলাদেশে দ্রুত একটি অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের তাগিদ এখনো দিয়ে যাচ্ছে।

পৌরসভা নির্বাচনটি কিন্তু অংশগ্রহণমূলক হচ্ছে। বিএনপিসহ সব বিরোধী দলই এতে অংশগ্রহণ করছে। নির্বাচন কমিশনে জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল অবস্থায় তারাও দলগত সিদ্ধান্ত নিয়ে দলীয় পরিচয়েই ৪০ পৌরসভার মেয়র পদে এবং বিভিন্ন পৌরসভায় শতাধিক কাউন্সিলর পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। এই নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা বা অগ্রহণযোগ্যতার বিষয়টি বিবেচিত হবে সবার অংশগ্রহণের শর্তপূরণ দিয়ে নয়, অংশগ্রহণকারী দল বা প্রার্থীর অংশগ্রহণের সব সাংবিধানিক এবং গণতান্ত্রিক শর্তসমূহ পূরণ হয়েছে কিনা তা দিয়ে। ইতিমধ্যে এ ব্যাপারে জোরালো নেতিবাচক কথাবার্তা শুরু হয়েছে। বিতর্কের সূচনা হয় দলীয় ভিত্তিতে, দলীয় প্রতীকে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের আকস্মিক সিদ্ধান্ত নিয়ে। এমন একটি জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে, তথা রাজনৈতিক দলসমূহ, স্থানীয় সরকার নির্বাচন বিশেষজ্ঞ, বুদ্ধিজীবী এবং দেশের বিশিষ্টজনদের সঙ্গে এমনকি নির্বাচন কমিশনের সঙ্গেও কোনো ধরনের আলোচনা করেনি সরকার। প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিবউদ্দিন আহমদ সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, বিষয়টি তিনি জানতে পেরেছেন সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর মিডিয়ার মাধ্যমে। পৌরসভা নির্বাচন নিয়ে আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আলোচনায় উঠে আসে। পৌরসভার মেয়র পদে নির্বাচন হচ্ছে দলীয় প্রতীকে, কিন্তু কাউন্সিলর পদে নির্বাচন হচ্ছে নির্দলীয়ভাবে। কোনো একটি পৌরসভায় মেয়র যদি আওয়ামী লীগ বা বিএনপি কিংবা স্বতন্ত্রভাবে জামায়াতের হয় এবং সব কাউন্সিলর স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচন করলেও যদি ভিন্ন দলের হয় সে ক্ষেত্রে ওই পৌরসভায় কি কোনো কাজ করা যাবে? মেয়রের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব পাস হলে প্যানেল মেয়র হিসেবে একটি ওয়ার্ড থেকে নির্বাচিত একজন কাউন্সিলর গোটা পৌরসভার ভোটারের প্রতিনিধিত্ব করবেন কোনো আইনের বলে? তৃণমূল পর‌্যায়ে মনোনয়ন বেচাকেনার যে আশঙ্কার কথা বলা হয়েছিল ইতিমধ্যে তা অনেক ক্ষেত্রে সত্য বলে মিডিয়ায় খবর এসেছে। কোনো কোনো পৌরসভায় শাসক দলের মেয়র প্রার্থী এবং সরকার দলের সমর্থক স্বতন্ত্র সব কমিশনার বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে যাওয়ার খবর বেশ উদ্বেগের। কোনো কোনো পৌরসভার সরকারদলীয় প্রার্থীকে জেতানোর জন্য বা বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত ঘোষণার জন্য প্রতিপক্ষের, প্রতিদ্ব›দ্বীর মনোনয়নপত্র অস্বচ্ছভাবে বাতিল করে দেওয়ার অভিযোগও উঠেছে। এই নির্বাচনে নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব ও ভূমিকা নিয়েও কঠোর সমালোচনামূলক কথা উঠেছে যুক্তিসঙ্গতভাবে। অধিকাংশ পৌরসভা নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব থাকবে প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের ওপর। অথচ এখন ২৩৫ পৌরসভার নির্বাচন ব্যবস্থাপনার সব দায়িত্ব পালনের মতো যথেষ্ট লোকবল নির্বাচন কমিশনের আছে। সরকারের এই সিদ্ধান্তকে দুরভিসন্ধিমূলক বলে ভাবা হচ্ছে। এমন ভাবার পেছনে যুক্তিসঙ্গত কারণ তো আছেই। এর আগে বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার এবং রকিবউদ্দিন নির্বাচন কমিশনের অধীনে অনুষ্ঠিত প্রায় সব নির্বাচনেই জনগণ ইসি, প্রশাসন, নির্বাচন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর ন্যক্কারজনক ভূমিকা প্রত্যক্ষ করেছে। ‘মর্নিং শোজ দ্য ডে’ বলে ইংরেজি প্রবাদটির সঙ্গে আমরা সবাই পরিচিত। পৌর নির্বাচনের ‘বিসমিল্লাহ’ থেকে যেসব খারাপ আলামত লক্ষ্য করা যাচ্ছে তাতে শেষ পর্যন্ত কি হবে ভবিতব্যই বলতে পারে।

তবে এই নির্বাচনের রাজনৈতিক গুরুত্ব এখানে যে, দেশের যে গুরুত্বপূর্ণ দলটি নির্বাচন বর্জন করে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং সেই প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনকে পুঁজি করে গঠিত সরকারকে দেশে-বিদেশে নৈতিকতার সংকটে হাবুডুবু খাওয়াচ্ছে, সেই বিএনপি আসন্ন পৌর নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে। নির্বাচনটি একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হচ্ছে। কিন্তু অংশগ্রহণমূলক হলেই তা গ্রহণযোগ্য হবে কিনা প্রসঙ্গটি আগেই উল্লেখ করেছি। এ নির্বাচন সরকার অদল-বদলের কোনো নির্বাচন নয়। ২৩৫ পৌরসভার সব মেয়র, সব কমিশনার পদে নৌকা প্রতীকের এবং শাসকলীগের সমর্থকরা হেরে গেলেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার বহাল তবিয়তেই থাকবে। এটা জেনে-বুঝেও সংসদ নির্বাচন বর্জনকারী ক্ষমতাপ্রত্যাশী বেগম খালেদা জিয়া কেন গেলেন এই নির্বাচনে? অনেকের সঙ্গে আমিও একমত যে, অনেক ক্ষেত্রে মারাÍক মারাÍক ভুলভ্রান্তি করলেও বেগম জিয়ার এ সিদ্ধান্তটি একটি বিজ্ঞজনোচিত রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত হিসেবে বিবেচিত হবে। সরকারপক্ষ হয়তো ভাবেনি বিএনপি এবং তার মিত্ররা এই নির্বাচনে অংশ নেবে। বিএনপির নির্বাচিত বিভিন্ন সিটি মেয়রকে হঠিয়ে দিয়ে যেভাবে দলীয় লোকদের বসিয়ে দেওয়াই শুধু নয়, বিএনপির নির্বাচিত মেয়রদের জেলে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে ‘নাশকতা’ মামলায়; উপজেলা নির্বাচনে তৃতীয় ধাপ থেকে শেষ ধাপ পর্যন্ত নির্বাচন কমিশন যে ‘ভানুমতির খেল’ দেখিয়েছে, ঢাকা-চট্টগ্রামের তিন সিটি নির্বাচনে যে নির্লজ্জ প্রহসন নির্বাচনের নমুনা দেখিয়েছে, সেই অভিজ্ঞতায় পৌর নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণের ব্যাপারে উৎসাহ না-ও দেখাতে পারত। সরকারি দলের লোকজন উসকানিমূলক কথাবার্তাও কম বলেনি। স্বাস্থ্যমন্ত্রী মো. নাসিম, খাদ্যমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম, মাহবুব-উল আলম হানিফ, হাছান মাহমুদ প্রমুখ এ উপলক্ষে বেগম জিয়াকে রাজনীতি শেখানোর ‘ঔদ্ধত্য’ দেখানোর অর্থ তো এই দাঁড়ায় যে, ক্ষিপ্ত-বিরক্ত হয়ে তিনি যেন নির্বাচনেই না আসেন। বেগম জিয়ার উদ্দেশে তাদের ‘মহা-উপদেশমূলক’ বক্তব্য শুনে মনে হয়েছে, ‘হাতি-ঘোড়া গেল তল/ভেড়া বলে হাঁটুজল।’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘দেখি বিএনপি নির্বাচনে আসে কি না!’ তার বক্তব্যে শ্লেষ-বিদ্রƒপের গন্ধ না খুঁজে বেগম খালেদা জিয়া পৌর নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়ে শাসকলীগকে একটি কঠিন পরীক্ষায় ফেলে দিয়েছেন বলেই পর্যবেক্ষকরা মনে করেন। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, গণতান্ত্রিক সংগ্রামের অংশ হিসেবেই তারা এই নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন। বেগম খালেদা জিয়াও নির্বাচনটি কেমন হবে সে ব্যাপারে নেতিবাচক মনোভাব ব্যক্ত করেছেন। তারপরও তারা নির্বাচনে আছেন।

 

সরকার কেন তড়িঘড়ি করে দলীয় ভিত্তিতে দলীয় প্রতীকে নির্বাচন দিল এবং সরকারের মনোভাব সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা নিয়ে এবং সরকারের ধামাধরা ও মেরুদণ্ডহীন বলে সমালোচিত বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীনেই পৌর নির্বাচনে বিএনপি কেন রাজি হলো, এর বিশ্লেষণের মধ্যেই খুঁজতে হবে মূল প্রতিদ্ব›দ্বী দুই দলের উদ্দেশ্য। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে দুপক্ষের উদ্দেশ্যই পরিষ্কার। তৃণমূল পর‌্যায়ে অর্থাৎ ইউনিয়ন, ওয়ার্ড লেভেল তথা গ্রাম পর‌্যায়ে নির্বাচন দলীয় ভিত্তিতে এবং দলীয় প্রতীকে অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে রাষ্ট্র কাঠামোর একেবারে সর্বনিম্ন স্তরে বিস্তৃত করার একটি প্রগতিশীল ধারণা বলে মেনে নিতে কারও আপত্তি থাকার কথা নয়। কিন্তু যেখানে রাষ্ট্র কাঠামোর উপরে-নিচে, প্রশাসনের সর্বত্র, এমন কি রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরেও গণতন্ত্রের অর্থবহ চর্চা ও অনুশীলন নেই, গণতন্ত্রের শর্ত ভঙ্গ করে জাতীয় সংসদেও ভোট ছাড়াই আসন ভাগাভাগির এক বিচিত্র গণতন্ত্রের নমুনা হাজির করা হয়, সেই সংসদ সদস্যদের মাধ্যমে গঠিত সরকার গণতন্ত্রকে তৃণমূলে ছড়িয়ে দেওয়ার ‘শুভ কামনায়’ দলীয় ভিত্তিতে, দলীয় প্রতীকে নির্বাচন দিচ্ছে, এ বিষয়ে জনমনে সন্দেহ-সংশয় জাগতেই পারে। সরকারের উদ্দেশ্যটা একান্তই তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বলে ধারণা করছেন অনেকে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর থেকে বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে সরকার নিজেই ‘গণভীতির’ আতঙ্ক প্রকাশ করছে। দশম সংসদ নির্বাচনের আগে থেকেই সরকার সঠিকভাবে তাদের দুর্বলতা চিহ্নিত করতে পেরেছে বলে পর্যবেক্ষকরা মনে করেন। তারা বুঝতে পেরেছেন, জনগণ থেকে সরকার বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। নির্বাচনে জিততে হলে তাদের এমন একটা ব্যবস্থা করতে হবে যাতে ‘বিজয়’ নিশ্চিত হয়। তাই সর্বদলীয়ভাবে গৃহীত ও সংবিধানের ৫৮(গ) অনুচ্ছেদে সন্নিবেশিত নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার বিধানটি তারা বাতিল করে দেয়। এই ইস্যুতে প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ও তার মিত্রদের সঙ্গে দ্বন্দ্ব ও বিরোধের কাহিনী সবার জানা। এরপর উপ-নির্বাচন, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে (৫ সিটি নির্বাচন ও উপজেলা নির্বাচনের প্রথম দুই ধাপসহ যেসব নির্বাচনে শাসক লীগের প্রার্থীরা অধিকাংশ স্থানে ধরাশায়ী হয়েছিলেন সেগুলো ছাড়া) কি হয়েছে সবাই তাও প্রত্যক্ষ করেছে। এসব থেকে ক্ষমতাসীনদের গণবিচ্ছিন্নতার বিষয়টি দেশে-বিদেশে যেমন স্পষ্ট হয়ে গেছে, সরকারও তা উপলব্ধি করছে। সারা গণতান্ত্রিক দুনিয়ায়ই সরকারের ভাবমূর্তির এখন ‘ভাবটা’ আছে ‘মূর্তি’ ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। সরকারের প্রতি জনগণের সমর্থন আছে এটা প্রমাণ করা জরুরি হয়ে পড়েছে সরকারের জন্য। দুটো উপায় ছিল- এক. মধ্যবর্তী জাতীয় নির্বাচন দিয়ে জনপ্রিয়তা যাচাই ও প্রমাণ করা, দুই. আপাতত সেই ঝুঁকি না নিয়ে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে জনপ্রিয়তা প্রমাণের ‘সুযোগ’ গ্রহণ করা। প্রাসঙ্গিকভাবে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহম্মদের ১৯৯২ সালে প্রদত্ত একটি রায়ের অংশবিশেষ উল্লেখ করতে চাই। উপজেলা চেয়ারম্যানের দায়িত্ব সংক্রান্ত এক মামলার রায়ে এক জায়গায় তিনি লেখেন, ‘ব্রিটিশ আমল থেকেই আমাদের স্থানীয় সরকারব্যবস্থা দলীয় (পার্টিয়ার্কি অর্থে) রাজনীতি বা স্বৈরশাসকদের অশুভ রূপকল্পের (ইভিল ডিজাইন) শিকার হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানকে সরকারি কর্মকর্তা কিংবা ক্ষমতাসীন দলের মনোনীত চাকরবাকর  (Henchman)  দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। এটাই যদি করা হয় তাহলে এসব প্রতিষ্ঠান থাকা বা না থাকায় কোনো পার্থক্য নেই। এতে তারা সময়ে সময়ে যে পরিবর্তন আনে তা জনগণ ও আন্তর্জাতিক মহলকে ধাপ্পা দেওয়ার জন্য। সভ্যতার এ পর‌্যায়ে স্বৈরশাসক তা তিনি হোন রাজনৈতিক নেতা বা সামরিক ব্যক্তি, তারা বিশ্বময় নিন্দা ও হাসিঠাট্টার পাত্র। একটি স্বৈরশাসন দেখতে যতই শক্তিশালী মনে হোক, তারা চেতনাগতভাবে অত্যন্ত দুর্বল ও গণবিচ্ছিন্ন থাকে। সুতরাং স্বৈরশাসকরা এক ধরনের রাজনৈতিক ভিতের প্রত্যাশী হয়। আর সে উদ্দেশ্যে ‘গণতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠার জন্য তারা গ্রাম, ইউনিয়ন ও থানায় ছুটে যায়।’ আমার মনে হয়, রায়ের এই অংশটি একেবারেই স্বব্যাখ্যাত।

পাকিস্তান আমলে স্বৈরশাসক আইউব খানকে আমরা ‘আসল গণতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠার নামে ইউনিয়নে ইউনিয়নে ছুটে বেড়াতে দেখেছি। নাম দিয়েছিলেন ‘মৌলিক গণতন্ত্র’। কখনো বলেছেন ‘বুনিয়াদি গণতন্ত্র।’ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও মেম্বারদের সমন্বয়ে ৮০ হাজার ‘ফেরেশতা’ জোগাড় করেছিলেন তিনি। এদের হাতে রিলিফের গম গেল, কম্বল গেল, ঢেউটিন গেল, নানা কাজের অসিলায় আর্থিক বরাদ্দ গেল। ওই ‘ফেরেশতারা’ আইউব-বন্দনা না করে কি পারে! কিন্তু টিকে থাকেনি আইউবের গদি। একসময় এই ৮০ হাজার ফেরেশতার অধিকাংশই উল্টে গেল। পর্যবেক্ষকরা মনে করেন বর্তমান সরকারও তৃণমূল স্তরে স্থানীয় সরকার প্রতিনিধিদের ওপর ভর করে একটা ভিত্তি নির্মাণ করতে চাচ্ছে। নির্দলীয়ভাবে নির্বাচনের মাধ্যমে দলীয় প্রার্থীদের জিতিয়ে আনার ব্যবস্থা করা গেলেও তার মাধ্যমে দলীয় জনপ্রিয়তা প্রমাণের আইনগত সুবিধা নেই। তাই হয়তো দলীয় প্রতীকে নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। দলীয় প্রতীকে নির্বাচনে কারওই নীতিগত কোনো আপত্তি নেই। বলা হচ্ছে, সিদ্ধান্ত অন্যদের সঙ্গে কোনো প্রকার আলোচনা ছাড়া আকস্মিক নিয়ে ফেলা হয়েছে অন্যদের অপ্রস্তুত রেখে কাজটি সেরে ফেলার উদ্দেশ্যে। দলীয় প্রতীকে অধিকাংশ মেয়র জিতিয়ে আনার পর বলা যাবে শাসকলীগ দেশে দারুণ জনপ্রিয়! প্রশ্ন করতে পারেন, অধিকাংশ মেয়র সরকারি দলেরই জিতবে তার গ্যারান্টি কোথায়? একটি প্রশ্ন দিয়েই বোধহয় উত্তরটি দেওয়া যায়। ২৩৫ পৌরসভায় নির্বাচনের সব কাজ সম্পন্ন করার জনবল নির্বাচন কমিশনের থাকার পরও অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের ব্যবহার করার উদ্দেশ্য কি? বর্তমান তৃণমূল পর্যন্ত প্রশাসন কাদের নিয়ন্ত্রণে সবারই জানা আছে। কাজেই সরকারের উদ্দেশ্যটা বোধহয় পরিষ্কার করা গেল। শুরুর কর্মকাণ্ড কিন্তু জনমনে মোটেই ভরসা জাগায় না।

বেগম খালেদা জিয়া এবং তার দলের অভিমত ইতিমধ্যে ব্যক্ত হয়েছে। তারা মোটেই ভরসা পাচ্ছেন না। তারপরও এই নির্বাচনে অংশগ্রণের পেছনে তাদের উদ্দেশ্যও অপরিষ্কার নয়। সাংগঠনিক বিপর্যয়ের মধ্যে আছে দলটি। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচনে সরকার যখন নির্বাচনকালীন সরকার প্রশ্নে দলীয় সরকারের দৃঢ় অবস্থান পরিবর্তন করে ‘সর্বদলীয় সরকারে’ সম্মত হলো এবং বিরোধী দলকে পছন্দের মন্ত্রণালয় বেছে নেওয়ার প্রস্তাব দিল, বিএনপির উচিত ছিল তাদের অবস্থানও পরিবর্তন করা এবং নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা। কিন্তু তারা ভুল করেছে। নিজেদের ভঙ্গুর সাংগঠনিক অবস্থা নিয়ে নির্বাচন প্রতিহত করার সিদ্ধান্তও ভুল ছিল। নির্বাচন প্রতিহত করার ক্ষমতা তো দেখাতেই পারেনি, উল্টো শত শত নিষ্ঠাবান কর্মীকে বিপদে ফেলেছে। কোনো কিছু বিবেচনায় না নিয়ে হেফাজতের সমাবেশকে ঘিরে হঠকারিতা (হেফাজত এখন কার সঙ্গে? বেগম জিয়ার সঙ্গে আছে কি?), তারপর জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত তিন মাসের ব্যর্থ অবরোধ-আন্দোলন আরও সর্বনাশ করেছে দলটির। পেট্রলবোমা সন্ত্রাসের দায়ে অভিযুক্ত এখন বিএনপি। অসংখ্য নেতা-কর্মী এখন এই অভিযোগে কারারুদ্ধ। হাজার হাজার মামলা। অনেকের ব্যবসা-বাণিজ্য লাটে উঠেছে। পালিয়ে বেড়াচ্ছে একজায়গা থেকে অন্য জায়গায়। ভুল রাজনীতির চরম খেসারত এভাবেই দিচ্ছে বিএনপি। দলের ভিতর গণতন্ত্র চর্চা না থাকায় মেধাবী, তরুণ নেতৃত্বের বিকাশ হচ্ছে না। কেরিয়ার রাজনীতিবিদের মূল্য নেই। দল চালানো হয় কর্মচারী দিয়ে। গুরুত্বপূর্ণ কোনো ব্যক্তি গুরুত্বপূর্ণ কোনো বিষয়ে আলোচনা করতে চাইলেও দলের প্রতি কমিটমেন্টহীন কোনো কোনো কর্মচারীর সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেওয়া হয়। দলের সর্বস্তরের নেতা-কর্মী থেকে মূল নেতৃত্ব বিচ্ছিন্ন। দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান কিছু ভুল-ত্রুটি সত্ত্বেও তৃণমূল সংগঠনে প্রাণের যে স্পন্দন তুলেছিলেন, সে স্পন্দন এখন থেমে গেছে। পৌর নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্তে নতুন প্রাণ ফিরে পেয়েছে তৃণমূল। আপাতত মামলা-হামলা কমেছে। কর্মীরা ঘরে যেতে পারছে। আস্থা ও সাহস বাড়ানোর জন্য পৌর নির্বাচনে অংশগ্রহণ একটি ভালো সিদ্ধান্ত। পালিয়ে থাকা পদধারীদের একটা পরীক্ষা হবে। কেন্দ্রে ও বিভাগে মনিটরিং সেল করলেই হবে না, পদাধিকারীদের ‘ছাগলপেটা’ করে তৃণমূলে পাঠানোর ব্যবস্থাও করতে হবে। এখন পৌর এলাকায় যেতেই হবে। বেগম খালেদা জিয়াও ১০-১৫টি বড় সমাবেশ এবং রোডমার্চের মতো কর্মসূচি নিয়ে অনেক পৌর এলাকায় জাগরণ সৃষ্টি করতে পারেন। বেগম জিয়ার সেই ক্যারিশমা এখনো আছে। সরকার তাতে দিশাহারা হয়ে যেতে পারে। ভুল করতে পারে- বড় ভুল। তাতে সরকারের অন্তরালের চেহারা প্রকাশ করে দিতে পারেন খালেদা জিয়া। এই নির্বাচন তৃণমূলের। জনগণ চোখ-কান খোলা রাখবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীকে কাজে লাগিয়ে, প্রশাসনকে ব্যবহার করে, ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং করে, পোলিং বুথ দখল করে, বিরোধী প্রার্থী ও তাদের এজেন্টদের হঠিয়ে দিয়ে সিল মারার উৎসব করে ফলাফল পাল্টাতে চাইলে দেশে-বিদেশে সরকারের বদনাম বাড়বে বৈ কমবে না। সরকার যদি সব তাদের অনুকূলে নেওয়ার জন্য আরও খারাপ পদক্ষেপ গ্রহণ করে তখন বেগম জিয়া এই নির্বাচনও বর্জন করতে পারেন বলে একটা গুঞ্জন আছে। পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, সেটা ভুল সিদ্ধান্ত হবে। এরা বলতে চান, নির্বাচন করুন, শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে থাকুন। হয় জিতুন, অন্তত জেতার দৃশ্যমান চেষ্টা করুন। বাড়াবাড়ি করলে সরকারের মুখোশ উম্মোচন করার গণতান্ত্রিক সুযোগটি কাজে লাগান। নেতা-কর্মীদের মনে আশা জাগান। গণতন্ত্রের নতুন যাত্রারও সূচনা হতে পারে এখান থেকে।

লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট

ই-মেইল : [email protected]

সর্বশেষ খবর