মঙ্গলবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

বাংলাদেশে গণতন্ত্র কেন দৃঢ় ভিত্তি পায়নি

আমীর খসরু

বাংলাদেশে গণতন্ত্র কেন দৃঢ় ভিত্তি পায়নি

গণতন্ত্রের যে সুষ্ঠু এবং মজবুত ভিত্তি নিয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি গড়ে ওঠার এবং সামনে এগিয়ে চলার কথা ছিল, তা দুর্ভাগ্যজনকভাবে এ দেশটিতে দেখা যায়নি। ফলে এর অনিবার্য পরিণতি এখনো পর্যন্ত এ রাষ্ট্রটির জনগণকে, দেশকে মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতে হচ্ছে। সুদীর্ঘ ভিত্তি প্রতিষ্ঠার গোড়ার দিকে যদি আমরা দৃষ্টি ফেরাই তাহলে দেখা যাবে তত্কালীন অবিভক্ত পাকিস্তান এবং পরবর্তীকালে বাংলাদেশে খুবই অল্প কয়েক বছর আমাদের বেসামরিক শাসন পাড়ি দিতে হয়েছে নানা সংকট এবং সমস্যার মধ্য দিয়ে। বাকি সুদীর্ঘ সময় কেটেছে সামরিক শাসনের মধ্যেই। ১৯৫৮ সালে অর্থাত্ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার নয় বছরের মাথায় পাকিস্তানে সামরিক শাসন প্রতিষ্ঠার পরে এটি বহাল ছিল দীর্ঘকাল। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে এ ভূখণ্ডটি সামরিক শাসন থেকে মুক্ত হয়েছে। এ ক্ষেত্রে এ কথাটি ভুলে গেলে চলবে না যে, বাংলাদেশ হয়ে ওঠার দীর্ঘকালের যে রাজনৈতিক আন্দোলন তার পেছনে সামরিক শাসনবিরোধী লড়াই-সংগ্রাম একটা বিশাল অংশ জুড়ে আছে। সে হিসেবে বাংলাদেশের স্বাধীনতাপ্রাপ্তির সঙ্গে জনগণের মধ্যে যে কোনো কর্তৃত্ববাদী শাসনের হাত থেকে মুক্ত একটি পূর্ণ গণতান্ত্রিক সমাজপ্রাপ্তির আকাঙ্ক্ষা প্রবল ছিল এবং তাদের ধারণা জন্মেছিল স্বাধীনতাপ্রাপ্তির পরে তারা এই পূর্ণ গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির মধ্যেই বসবাস করতে পারবেন।

কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, বাংলাদেশ কখনই শক্তপোক্ত গণতান্ত্রিক ভিত্তির ওপর দাঁড়াতেই পারেনি। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠার স্বল্পকালের মধ্যে বহুল আকাঙ্ক্ষিত বেসামরিক শাসনটি ক্রমান্বয়ে হয়ে ওঠে কর্তৃত্ববাদী। সংবিধানে একের পর এক সংযোজিত হতে থাকে অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থা। যেমন জরুরি অবস্থা ঘোষণার বিধানসহ নিবর্তনমূলক আইন সংবিধানে সন্নিবেশিত করা হয় প্রথম সংবিধানপ্রাপ্তির স্বল্পকাল পরই। চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে পুরো রাজনৈতিক ব্যবস্থা ওলট-পালট করে একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠা করা হয়। চারটি বাদে সব সংবাদপত্র বাতিল করা হয়। ক্রমে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাটি বিদায় নিতে থাকে। এরপরে অনাকাঙ্ক্ষিত এবং দুঃখজনক হত্যাকাণ্ডসহ নানা ঘটনার পর দেশটি সামরিক শাসনের মধ্যে পড়ে যায়। দেশটি স্বাধীন হওয়ার পর থেকে সাড়ে তিন বছরের মাথায় সেই যে সামরিক শাসনের মধ্যে পড়ে যায়, তা থেকে বের হতে সময় লাগে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত। অর্থাত্ প্রথম দফায় মাত্র সাড়ে তিন বছর বেসামরিক শাসন দেশটিতে বিদ্যমান ছিল। ১৯৯০-এ বেসামরিক শাসন ফিরে আসার পর জনগণের মধ্যে পুনরায় এমন তীব্র আকাঙ্ক্ষার জন্ম নিয়েছিল যে, তারা ভেবেছিলেন এবারে সত্যিকারভাবে গণতন্ত্র শক্তপোক্ত এবং মজবুত ভিত্তি পাবে। রাজনীতিবিদরা দীর্ঘকালের সামরিক শাসন থেকে নিশ্চয়ই শিক্ষা পেয়েছেন। কিন্তু তা-ও হয়নি। কেন হয়নি তার একটি বিচার-বিশ্লেষণ জরুরি।

সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে সামরিক শাসনোত্তর বেসামরিক শাসনে যেসব সংকট এবং সমস্যা থাকে অর্থাত্ সামরিক শাসকদের সৃষ্ট তীব্র সমস্যা ও সংকট, তা মোকাবিলা করে রাষ্ট্র ও সমাজকে আগের জায়গায় পুনঃস্থাপন এবং সত্যিকার অর্থে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার যে দক্ষতা, প্রজ্ঞা, যোগ্যতা এবং ইচ্ছা প্রয়োজন তা এ দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব তাদের কার্যক্রমে দেখাতে ব্যর্থ হয়েছেন নিদারুণভাবে। সামরিক শাসন একটি রাষ্ট্র এবং সমাজের কতটা ক্ষতির কারণ হয় তা স্বল্প পরিসরে বোঝার জন্য আর্জেন্টিনার একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। আর্জেন্টিনায় ১৯৫০-এর দশক এবং পরের দফায় ১৯৭৬ থেকে ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত সামরিক শাসন বিদ্যমান ছিল। পরবর্তীকালে সেই সামরিক শাসকদের বিচারের যে রায় (১৯৮৫ সাল) তাতে বলা হয়, সামরিক শাসকরা সমাজের শুধু রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য ক্ষতিসাধন করেই ক্ষান্ত থেকেছে তা নয়। তারা সমাজের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, স্বাভাবিক জীবনাচারসহ একটি সমাজ কাঠামোর জন্য যা কিছু ভালো তার সবকিছুই ধ্বংস করেছে— যা কিনা দীর্ঘ প্রচেষ্টার পরে ওই সমাজটি অর্জন করেছিল। (বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন :  Amnesty International : Argentina : The Military Juntas And Human Rights, 1987 : UK.)

কাজেই দেখা যাচ্ছে, সামরিক শাসনের কারণে সৃষ্ট ক্ষতি থেকে দেশ এবং সমাজকে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনার যে রাজনৈতিক দক্ষতা, প্রজ্ঞা, যোগ্যতা এবং ইচ্ছাশক্তি এ দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বের মধ্যে প্রয়োজন ছিল, তা তারা পালনে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছেন। আর পুঞ্জীভূত ব্যর্থতার ফলাফল হচ্ছে, আজকের পরিণতি। এ কথাটিও মনে রাখতে হবে, যেমনটা S E Finer তার ঞযব The Man on Horseback নামের বিখ্যাত বইয়ে এ কথাটি বার বার মনে করিয়ে দিয়েছেন যে, ‘সেই সমাজেই সামরিক শাসন আসে, যে সমাজে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিটি দুর্বল অবস্থায় থাকে।’

আমাদের শাসকরা বিশেষ করে প্রধান দুই দল ১৯৯০-এর পরে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার অবিরাম প্রচেষ্টা, সংগ্রাম এবং তীব্র আকাঙ্ক্ষা পোষণের বদলে ক্ষমতা দখলের লড়াইটিকেই বেশি প্রাধান্য দিয়েছে। তারা দলীয়ভাবে ক্ষমতা দখলকে যতটা প্রাধান্য দিয়েছে, তার চেয়েও অনেক অনেক গুণে কম চিন্তা করেছে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে। কিন্তু বাস্তবে হওয়া উচিত ছিল এর বিপরীতটি। এ ক্ষেত্রে পুরনো আরেকটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। মধ্য ৫০-এর দশকে দীর্ঘকালের সামরিক শাসনে জর্জরিত কলম্বিয়া এবং ভেনেজুয়েলার বেসামরিক শাসকরা ‘Punto-Fijo’ নামে একটি ঐতিহাসিক চুক্তি করেছিলেন। দুই দেশের চুক্তির ধরন ছিল একই। ওই চুক্তি অনুযায়ী সেখানকার বিবদমান দুটি রাজনৈতিক দলের নেতারা এমন সমঝোতায় পৌঁছেছিলেন যে, নিজেদের মধ্যকার ক্ষমতার দ্বন্দ্ব, মতদ্বৈধতা এবং লড়াই তারা মিটিয়ে ফেলেছিলেন ওই চুক্তির মাধ্যমে। তারা এমন চুক্তিতে পৌঁছলেন যে, চুক্তি মোতাবেক যে দলই নির্বাচিত হোক না কেন, প্রতি চার বছর পর পর অতিঅবশ্যই প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচন এবং পার্লামেন্টসহ অন্যান্য ক্ষেত্রেও সমতার ভিত্তিতে আসন ভাগাভাগিসহ নানা রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন। এর সুফলটি ছিল এমন যে, এতে দেশটির গণতান্ত্রিক ভিত্তি যেমন শক্তিশালী হয়েছিল, তেমন জনগণও অগণতান্ত্রিক শাসনের হাত থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন। এটা চলেছিল দীর্ঘকাল। বিশ্বের অনেক দেশ একই ধরনের চুক্তি না করলেও জাতীয় ঐক্যের একটি ব্যবস্থা গড়ে তোলে— রাজনীতির স্বার্থে গণতন্ত্রকে মজবুত করার জন্য।

তবে আমাদের দেশটিতে হয়েছে ভিন্ন কর্মকাণ্ড। স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে কখনো কোনো চেষ্টা করেছেন বা উদ্যোগ নিয়েছেন এমনটা দেখা যায়নি। বরং শাসকদল সব সময় বিরোধী দল, পক্ষকে বিনাশ ও নির্মূল করতে চেয়েছে এবং এমন চেষ্টা এখন অনেক বেশি প্রবল ও জোরালো হয়েছে।

বড় দুই দল ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন সব সময় চেয়েছে, যা কিনা সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনের আকাঙ্ক্ষার বিপক্ষে। এ বিষয়টিও গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে না পারার অন্যতম একটি কারণ। ১৯৯০-এর সামরিক শাসনোত্তর বেসামরিক নেতৃত্ব, বিশেষ করে প্রধান দুই দল ক্ষমতার বিকেন্দ্রায়নের বদলে ঠিক এর উল্টো কাজটিই করেছে। রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার থেকে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার প্রবর্তন করতে গিয়ে তারা আসলে প্রধানমন্ত্রী-শাসিত সরকারব্যবস্থা প্রবর্তন করলেন। শুধু করলেনই না, প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতাকে সর্বময় কর্তৃত্ববাদী হিসেবেই পরিণত করা হলো। এ কথাটি বলা প্রয়োজন যে, বর্তমানে বিশ্বব্যাপী প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্রের সংজ্ঞায়ই একটি বড় পরিবর্তন এসেছে। আর তা হচ্ছে— ক্ষমতার বিকেন্দ্রায়নের মাধ্যমে গণতন্ত্রের সুফল যাতে তৃণমূল পর্যন্ত জনগণের কাছে পৌঁছে দেওয়া যায়। কিন্তু ১৯৯০-এর পরে ঠিক এর উল্টো কাজই করা হয়েছে। ক্ষমতাকে এখন এতটাই কেন্দ্রীভূত করা হয়েছে যে, এখানে সব কিছুই এক এবং এককের কর্তৃত্বে চলছে। রাজনৈতিক দলের কোনো স্তরেও গণতন্ত্রের বালাই নেই। মনে রাখতে হবে, গণতন্ত্র হচ্ছে মনস্তাত্ত্বিক বিষয়। অর্থাত্ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার বিষয়টি শাসকদের মনোজগতে সব সময় ক্রিয়াশীল থাকতে হবে। এটা মৌখিক বা লোক দেখানো কোনো বিষয় নয়। এ ব্যাপারে নোবেল বিজয়ী প্রফেসর অমর্ত্য সেন The Idea of Justice বইয়ে বলেছেন, ‘আনুষ্ঠানিকভাবে কী কী প্রতিষ্ঠান আছে, শুধু তা দিয়ে গণতন্ত্রের মূল্যায়ন হয় না; ভিন্ন ভিন্ন গোষ্ঠীর বহু মানুষের কণ্ঠস্বরগুলো শোনা যাচ্ছে কিনা তা-ও দেখতে হবে।’

দুই দলের আরেকটি বড় সংকট হচ্ছে, নির্বাচনব্যবস্থাটিকে ভ্রান্ত দৃষ্টিতে দেখা। নির্বাচনই যে গণতন্ত্র নয়, গণতন্ত্রে উত্তরণের একটি উপায় এবং পন্থা মাত্র তা তারা কখনই মনে করে না। এ কারণে একদলীয় নির্বাচনের দিকে তারা যেমন যায় এবং ভোট কেন্দ্র দখল, কারচুপির সংস্কৃতিটি স্বাধীনতার পর থেকেই বেসামরিক শাসকদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে ও মনোজগতে স্থায়ীভাবে বসত গেড়েছে। আর গণতন্ত্রের উপায় এবং পন্থাকেই অর্থাত্ গণতন্ত্রকেই এখন বিদায় জানানোর মধ্য দিয়ে মানুষের বাক, ব্যক্তি, চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতাসহ সামগ্রিকভাবে মানুষের স্বাধীনতা এবং অধিকারকে চরমভাবে বিপন্ন করে ফেলা হয়েছে। এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হলে অনিবার্যভাবে রাজনীতির ক্ষেত্রে চরম এক শূন্যতার সৃষ্টি হয়। ইতিহাসের স্বতঃসিদ্ধ শিক্ষা হচ্ছে— শূন্যতা কখনই স্থায়ী হয় না। তবে তা পূরণ হবে কীভাবে তা-ও কেউ আগাম বলতে পারে না।

প্রথমেই আলোচনা করা হয়েছিল, সামরিক শাসনোত্তর বেসামরিক শাসকদের যে দক্ষতা, যোগ্যতা, প্রজ্ঞা দেখাতে হয় এবং প্রবল ইচ্ছাশক্তি থাকতে হয়, সে ক্ষেত্রে রাজনৈতিক নেতৃত্বের ব্যর্থতার অনিবার্য ফলাফল হচ্ছে গণতন্ত্রের বর্তমান পরিস্থিতি। ওই দক্ষতা, যোগ্যতা এবং প্রজ্ঞাশীল নেতৃত্বের উপস্থিতি থাকলে পরিস্থিতি এমন হতে পারত না। সঙ্গে সঙ্গে সামরিক স্বৈরশাসক এরশাদের পক্ষ থেকেও ‘কোথায় গণতন্ত্র’ বলে অবজ্ঞাসূচক প্রশ্ন উত্থাপনও সম্ভব হতো না। এরশাদের পরিণতি এখন সম্পূর্ণ ভিন্ন হতে পারত। প্রায় ৬০০ বছর আগে নিকোলো ম্যাকিয়াভেলির (১৪৬৯-১৫২৭) ঐতিহাসিক সত্য উচ্চারণ— ‘কোনো শাসকই স্থায়ী হতে পারে না শাসিতদের সন্তুষ্টি ছাড়া’ (No Government can be safe without the goodwill of the governed.)এ বিষয়টি আমাদের শাসক ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের মনোজগতে এবং চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের মধ্যেই নেই। আর নেই বলেই গণতন্ত্র দৃঢ় ভিত্তি নিয়ে কখনই দাঁড়াতে পারেনি।

     লেখক : সম্পাদক, আমাদের বুধবার ডটকম

সর্বশেষ খবর