মঙ্গলবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

ভূত-প্রেত অথবা প্রেতাত্মা

সৈয়দ বোরহান কবীর

ভূত-প্রেত অথবা প্রেতাত্মা

শীতের সময় নানী নানারকম পিঠা বানাতেন। কিন্তু সন্ধ্যায় ওই পিঠা খাওয়া বারণ ছিল। পিঠা খেলে ভূত আসে। নানীর মুখে শুনতাম নানারকম ভূতের গল্প, প্রেতের গল্প, প্রেতাত্মাদের কাণ্ড। মানুষের অস্বাভাবিক মৃত্যু হলে নাকি তার আত্মা ঘুরে বেড়ায়, এর নাম প্রেতাত্মা। মানুষ ভূত হয়ে ঘোরে। মানুষের ওপর আসর করে। তখন ভূত যে রকম ইচ্ছা করে, ওই মানুষটি সে রকমই কাজ করে। বড় হতে হতে নানীর এ গল্পগুলো স্রেফ ভূতের গল্প হিসেবেই মেনে নিয়েছি। কিন্তু ইদানীং মনে হয় ভূত, প্রেত কিংবা প্রেতাত্মার অস্তিত্ব আছে। ভূত কখনো কখনো মানুষের ওপর ভর করে। তখন মানুষ ভূতের মতো আচরণ করে। ৩০ লাখ শহীদের রক্তের মূল্যে পাওয়া বাংলাদেশে যখন পাকিস্তানপ্রীতি দেখি তখন মনে হয় পাকিস্তানের ভূত এখনো আমাদের ঘাড়ে চেপে আছে। পাকিস্তান রাষ্ট্রের মৃত্যু হয়েছিল অপঘাতে, তাই বোধ হয় পাকিস্তানের অশীরী আত্মা ঘুরে বেড়ায়, সুযোগ বুঝে কারও কারও ওপর সওয়ার হয়। তারা তখন পাকিস্তানিদের মতো আচরণ করে। যে পাকিস্তান আমাদের ওপর জঘন্যতম বৈষম্য করেছে, নিপীড়ন করেছে। যে পাকিস্তান বাংলাদেশে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সবচেয়ে নৃশংসতম গণহত্যা চালিয়েছে। যে পাকিস্তান তিন লাখ মা-বোনের সম্ভ্রম বিনষ্ট করেছে। সেই পাকিস্তানের জন্য ঘৃণার উদিগরণ নেই। কারণ পাকিস্তানের প্রেতাত্মারা এখনো বাংলাদেশের চারপাশে ঘুরে বেড়ায়। এসব কিছু পাকিস্তানি বশংবদের জন্যই, বিজয়ের ৪৪ বছর পর পাকিস্তান বলতে পারে ’৭১-এ বাংলাদেশে কোনো গণহত্যা হয়নি। আমাদের হাইকমিশনারকে ডেকে ধমকে দেয়।

’৭১-এর নয় মাস পাকিস্তান বাঙালিদের ওপর কী অমানবিক গণহত্যা, নিষ্ঠুরতা এবং বর্বরতা করেছে তা নতুন করে প্রমাণের কিছু নেই। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের গবেষণার কথা বাদই দিলাম। বাদ দিলাম ’৭১-এ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের রিপোর্টগুলোর কথা। পাকিস্তানি কয়েকজন জেনারেল তাদের স্মৃতিচারণমূলক লেখায়ই এর বিশদ বিবরণ দিয়েছেন। পাঠকদের সূত্র ধরিয়ে দেওয়ার জন্য এখানে দু-একটি উদাহরণ তুলে ধরছি। মেজর জেনারেল (অব.) খাদিম হুসেইন রাজা ’৭১-এ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সদস্য হিসেবে বাংলাদেশের ভূখণ্ডে ছিলেন। ২০১২ সালে ‘এ স্টেনজার ইন মাই ওন কান্ট্রি’ শিরোনামে তিনি এক স্মৃতিচারণমূলক বই লেখেন। বইয়ের শুরুতেই তিনি বলেছেন, ‘প্রায়ই বলা হয় ইতিহাস হলো বিজয়ীর লেখা কিন্তু এ গ্রন্থটি লেখা পরাজিতদের দ্বারা।’

ভূমিকায় রাজা আরও বলেছেন, ‘আমরা পূর্ব পাকিস্তানের ওপর নিপীড়ন চালিয়েছি, যখন বাঙালিরা তাদের অধিকার আদায়ে সোচ্চার হলো তখন পাকিস্তানি সেনাবাহিনী গণহত্যা চালাল’... বইটির অষ্টম অধ্যায়ে ‘অপারেশন সার্চলাইট’-এর বিশদ বিবরণ দেওয়া আছে।

পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অন্যতম হোতা লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিয়াজি। যিনি ইস্টার্ন কমান্ড্যান্ট হিসেবে গণহত্যায় নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। আত্মসমর্পণ করেছিলেন ’৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর। তিনিও ১৯৯৮ সালে লেখা ‘THE BETRATAL OF EAST PAKISTAN গ্রন্থে গণহত্যা কবুল করেছেন। এ ছাড়াও লেফটেন্যান্ট কর্নেল আজিজ আহমদ খান, হামুদুর রহমান কমিশনের সামনে জবানবন্দিতে গণহত্যার কথা স্বীকার করেন। সায়মন ড্রিংয়ের প্রতিবেদনসহ আন্তর্জাতিক সব প্রতিবেদনের কথা না হয় নতুন করে আলোচনা না-ই করলাম। অথচ তার পরও আমাদের বিজয়ের ৪৪ বছর পর পাকিস্তান ক্ষমা চায়নি। আমাদের প্রাপ্য সম্পদের হিস্সা দেয়নি। আটকে পড়া পাকিস্তানিদের ফেরত নেয়নি। যে ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীকে ফেরত নিয়েছিল তাদের দেশে বিচার করবে বলে, এখনো বিচার করেনি। এখন তারা বলছে, বাংলাদেশে ’৭১-এ কোনো গণহত্যা হয়নি। কী বিচিত্র! কী মিথ্যাচার! কী ধৃষ্টতা!

আমরা ভারতের সঙ্গে অমীমাংসিত ইস্যুগুলো নিয়ে তীব্র সোচ্চার। কথায় কথায় মহান মুক্তিযুদ্ধের অকৃত্রিম বন্ধু রাষ্ট্রটির আমরা সমালোচনা করি। পানি নিয়ে হাহাকার করি। ভারতের সঙ্গে বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে ঝগড়া-ফ্যাসাদ করতে আমরা যতটা না উত্সাহী, ততটাই নিরুত্সাহী পাকিস্তানের সঙ্গে অমীমাংসিত ইস্যু নিয়ে আলাপ করতে। এটাও ওই পাকিস্তানি ভূতের আসরের কারণেই সম্ভবত। যদিও ’৭৩-এ ভুট্টো বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন কিন্তু পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয় জাতির পিতার হত্যাকাণ্ডের পর, জানুয়ারি ১৯৭৬ সালে। গোটা আশির দশকে বাংলাদেশজুড়ে ছিল ‘পাকিস্তানি ভূতের নৃত্য’। পাকিস্তানি প্রেতাত্মারা আমাদের রাজা, মহারাজের ঘাড়ে জেঁকে বসেছিল। এ সময়জুড়ে বাংলাদেশ প্রায় সব ক্ষেত্রে পাকিস্তানকে নিঃশর্ত সমর্থন দেয়। আফগানিস্তান ইস্যুতে সোভিয়েত অবস্থানের বিরোধিতা— এ ক্ষেত্রে একটি বড় উদাহরণ। ১৯৭৯ সালে দুই দেশের মধ্যে সাংস্কৃতিক বিনিময় চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ১৯৭৮ সালে যৌথ অর্থনৈতিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। কিন্তু পাকিস্তানের সঙ্গে অমীমাংসিত বিষয়ে কেউই মুখ খোলেননি। খুলবেন কী করে, নীতিনির্ধারকদের তো চালাচ্ছিল পাকিস্তানি প্রেতাত্মারাই। মুক্তিযুদ্ধের পর জাতির পিতার নির্দেশে পাকিস্তানের কাছে বাংলাদেশের পাওনার একটি হিসাব করা হয় যার পরিমাণ ৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এ নিয়ে বেশ কয়েক দফা কূটনৈতিক আলোচনার পর ১৯৭৫-এ বাংলাদেশ ২ বিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ গ্রহণে সম্মত হয়। কিন্তু আজ পর্যন্ত পাকিস্তান একটা ফুটো পয়সাও বাংলাদেশকে দেয়নি।

পাকিস্তানের সঙ্গে দ্বিতীয় অমীমাংসিত বিষয় ছিল আটকে পড়া পাকিস্তানিদের ফেরত নেওয়া প্রসঙ্গ। যাদের আমরা ‘বিহারি’ বলে ডাকি। এরা ঢাকা, সৈয়দপুরে ‘জেনেভা ক্যাম্পে’ থাকেন। আন্তর্জাতিক রেড ক্রস সোসাইটির হিসাবমতে ৫ লাখ ৪০ হাজার আটকে পড়া পাকিস্তানি স্বদেশে যাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করে নিজেদের নাম নিবন্ধন করেন। ১৯৮২ সাল পর্যন্ত এদের মধ্যে ১ লাখ ২৭ হাজার জনকে ফিরিয়ে নেওয়া হয়। এরপর এ প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৮৫ সালে পাকিস্তানের জান্তা প্রেসিডেন্ট জেনারেল জিয়াউল হক, এদের ফিরিয়ে নেওয়ার অঙ্গীকার করেন। কিন্তু তারপর আর কোনো অগ্রগতি নেই।

আর তৃতীয় বিষয়টি হলো, পাকিস্তানের ক্ষমা চাওয়া। ’৭১-এর গণহত্যা, লুণ্ঠন ও বিভীষিকার জন্য বাংলাদেশের কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা। পাকিস্তান কোনো দিন তাদের অপকর্মের জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করেনি। ২০০২ সালে পাকিস্তানের জান্তা প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফ বাংলাদেশে এসে ’৭১-এর জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন। মনে রাখা প্রয়োজন, দুঃখ প্রকাশ আর ক্ষমাপ্রার্থনা এক নয়। বর্তমান সভ্যজগতে এ ধরনের মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য ক্ষমা চাওয়া একটি স্বাভাবিক শিষ্টাচার, শুধু দুঃখ প্রকাশ নয়।

যে রাষ্ট্র যত সভ্য তারা এ ব্যাপারে তত সচেতন। এ ক্ষেত্রে জাপানের উদাহরণ দেওয়া যায়। জাপান দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তাদের কৃতকর্মের জন্য বার বার ক্ষমা চেয়েছে। ১৯৫৭ সালে জাপানের প্রধানমন্ত্রী কিসি নবুসুকি বার্মার কাছে এবং অস্ট্রেলিয়ার কাছে আলাদাভাবে ক্ষমা চান। ১৯৬০ সালে জাপানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ক্ষমা চান দক্ষিণ কোরিয়ার কাছে। ১৯৭২-এর ২৯ সেপ্টেম্বর জাপানের পক্ষ থেকে চীনের কাছে ক্ষমা চাওয়া হয়। ক্ষমা চাওয়া প্রসঙ্গে জাপানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী জিনকো সুজকি ১৯৮২ সালের ২৪ আগস্ট বলেন, ‘অপকর্মের জন্য, বিশেষ করে মানবতার ক্ষতি করে এমন কাজের জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা যথেষ্ট নয়, তবে তা ন্যূনতম সভ্যতার স্মারক।’

শুধু জাপান কেন, এ রকম ক্ষমাপ্রার্থনার নজির বিশ্বে ভূরি ভূরি। ১৯৭০ সালে তত্কালীন পশ্চিম জার্মানির চ্যান্সেলর উইলি ব্যানডিট জার্মানির গণহত্যার জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করেন। ১৯৯০ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন পোল্যান্ডে আগ্রাসনের জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করে। ৪০ বছর অস্বীকৃতির পর ১৯৯০ সালের ১৩ এপ্রিল পূর্ব জার্মানির পার্লামেন্টে আনুষ্ঠানিক দুঃখ প্রকাশ ও ক্ষমাপ্রার্থনা অনুমোদিত হয়। ১৯৯৩ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার তত্কালীন প্রেসিডেন্ট ক্লার্ক আফ্রিকার জনগণের ওপর নিপীড়নের জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করেন।

এ রকম অনেক উদাহরণ দেওয়া যায়। যেসব দেশ বা ব্যক্তি ক্ষমা চেয়েছেন তারা ছোট হননি বরং তাদের গ্লানিমুক্তি ঘটেছে। ১৯৯৭ সালের জুনে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার আয়ারল্যান্ডের প্রতি করা নৃশংসতার জন্য ক্ষমা চেয়ে বলেছিলেন ‘আমাদের বুক থেকে যেন একটা ভারী পাথরের বোঝা নেমে গেল।’ কিন্তু পাকিস্তান ক্ষমা চায়নি বরং তারা স্বীকৃত ইতিহাসকে অস্বীকার করছে।

কারণ পাকিস্তান এখনো সভ্য হতে শেখেনি। পাকিস্তান সম্পর্কে সবচেয়ে তাত্পর্যপূর্ণ মন্তব্য করেছিলেন ভারতের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু— ‘পাকিস্তান নিজের উন্নতির দিকে যতটা না মনোযোগী তার চেয়ে বেশি মনোযোগী অন্যের অনিষ্টে। পাকিস্তান অন্য রাষ্ট্রের ক্ষতি করার জন্য যে পরিমাণ ব্যয় করে, তার অর্ধেকও যদি নিজেদের উন্নতির জন্য ব্যয় করত তাহলে দেশটির অবস্থা এত দৈন্য হতো না।’

এখনো পাকিস্তান রাষ্ট্র যেটি সব সামষ্টিক সামাজিক সূচকে দক্ষিণ এশিয়ার দরিদ্রতম রাষ্ট্র (বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তানের এখন কোনো তুলনাই চলে না) সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার পেছনে বাজেটের ১০ শতাংশ ব্যয় করে। (সূত্র : ইন্টারন্যাশনাল মিলিটারি জার্নাল, ২০১৩ সংস্করণ)। সে জন্যই যখন নিজের দেশে গড়ে প্রতিদিন ২০ জন করে পাকিস্তানি হত্যা হয় তখন তারা নির্বিকার অথচ কাদের মোল্লার ফাঁসিতে তাদের হূদয় উথলে ওঠে। যখন পাকিস্তানে ধর্মান্ধ মৌলবাদীরা অনেক স্থান দখল করে রাখে, তখন তাদের সেদিকে মনোযোগ নেই। তাদের মনোযোগ সাকা চৌধুরী, মুজাহিদের ফাঁসি ঠেকাতে। এটাই ইতিহাসের কৌতুক।

কিন্তু কৌতুক নয়, এটা কৌতুক হতো যদি আমরা সবাই সম্মিলিতভাবে পাকিস্তানের জন্য ‘ঘৃণা’ বর্ষণ করতে পারতাম। জার্মানিতে যেমন এখনো ‘নািস’ নাম নিষিদ্ধ, তেমন বাংলাদেশে যদি ‘পাকিস্তান’ শব্দটি নিষিদ্ধ হতো। আমি তো মনে করি, আমাদের সবচেয়ে বড় কূটনৈতিক পরাজয় হলো পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের অমীমাংসিত বিষয়গুলো সুরাহা না করা। পাকিস্তানের কাছে ন্যায্য পাওনা আদায়ে শেষ কূটনৈতিক উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল ১৯৯৬ সালে। আওয়ামী লীগ সরকারের তত্কালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রয়াত আবদুস সামাদ আজাদ এ ইস্যুতে বেশ সোচ্চার ছিলেন। ২০০৮-১৩ মেয়াদে ডা. দীপু মনিও পাকিস্তানের ক্ষমা চাওয়ার ইস্যুতে সরব ছিলেন। কিন্তু তিস্তার পানি চুক্তির জন্য যেমন আমাদের সমাজের সুশীলরা মাথা কুটে মরেন, পাকিস্তানের কাছে পাওনা আদায়ে টুঁশব্দ করেন না। কেন? তাদের শরীরেও কি পাকিস্তানি ভূত ভর করেছে?

পাকিস্তানে কেউ খেলতে যায় না। খেলা তো দূরের কথা, বিপদে না পড়লে বাধ্য না হলে কেউ পাকিস্তান যায় না। অথচ আমরা আমাদের নারী ক্রিকেট দলকে পাকিস্তানে পাঠালাম। কেন? এ সফরে কার লাভ হলো? পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ড তো রীতিমতো ধমক দিয়ে বাংলাদেশের নারী দলকে পাকিস্তানে নিল। আমাদের ক্রিকেট এখন তরতর করে এগিয়ে যাচ্ছে। এ সময় ক্রিকেট বাণিজ্যের আসর বসানো হলো বিপিএল। ভালো কথা। বিপিএলে পাকিস্তানি ভূতের নৃত্য শুরু হলো। বস্তাপচা সব পাকিস্তানি প্লেয়ারকে নিয়ে এসে টিমগুলো যেন ধন্য হয়ে গেল। ভারতে একই ধরনের খেলা হয়, যেখানে আমাদের সাকিব আল হাসান খেলেন। আইপিএলে পাকিস্তানি খেলোয়াড়রা নিষিদ্ধ। ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড এর কারণও ব্যাখ্যা করেছে। পৃথিবীজুড়ে সবচেয়ে বেশি ম্যাচ ফিক্সিং এবং স্পট ফিক্সিংয়ে জড়িত পাকিস্তানি খেলোয়াড়রা। আমাদের সুন্দর সাজানো ক্রিকেটবাগানে দূষণ ধরাতেই কি আমরা পাকিস্তানি ভূতদের আমন্ত্রণ জানাচ্ছি? কদিন আগে দেখলাম, শহীদ আফ্রিদিকে একদল ভাড়ায় আনল। বেচারা কদিন আগে আমাদের পুঁচকে বাঘ মুস্তাফিজের কাছে নাকানিচুবানি খেয়ে গেছেন। অথচ রেডিওর ধারাভাষ্যে (অবশ্যই বাংলাদেশ বেতার) যে উচ্ছ্বাস তাতে মনে হলো ওই ধারাভাষ্যকারকেও পাকিস্তানের ভূত ধরেছে।

আমাদের ঢাকা শহরের দুই মেয়র অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে যুদ্ধ করছেন। আমি তাদের স্বাগত জানাই। তাদের কাছে বিনীত অনুরোধ, ‘পাকিস্তানি আউটফিট’, ‘পাকিস্তানি সালোয়ার-কামিজের মেলা’ ইত্যাকার অবৈধ স্থাপনা ও সাইনবোর্ডগুলো দয়া করে উচ্ছেদ করবেন কি?

আমাদের বাণিজ্যমন্ত্রী বীর মুক্তিযোদ্ধা, জাতির পিতার স্নেহধন্য। আসছে জানুয়ারিতে রপ্তানি মেলায় পাকিস্তানি স্টলের অনুমোদন দেবেন না প্লিজ। কিছু পাকিস্তানি আচার আর সালোয়ার-কামিজ না থাকলে মেলার কোনো অপূর্ণতা থাকবে না।

এভাবে ছোট ছোট করে আমরা শুরু করি না কেন। আমাদের শহীদদের আত্মার শান্তির জন্য, সম্ভ্রম হারানো মায়েদের খুশির জন্য আমরা এতটুকু কষ্ট করতে পারি না?

১৯৯৭-৯৮ সালের কথা। আমি তখন ‘পরিপ্রেক্ষিত’ অনুষ্ঠানটি করি। অনুষ্ঠানটির সম্পাদনার কাজ করি সিদ্ধেশ্বরীতে ইমপ্রেস টেলিফিল্ম অফিসে। দুটি প্যানেলে কাজ হয়। একদিন একজন গেস্ট পাকিস্তানি জুস আনার জন্য পিয়নকে টাকা দিলেন। ইমপ্রেসের ম্যানেজার তখন হেলাল খান। তিনি দৌড়ে গিয়ে বললেন, ‘পাকিস্তানি কোনো জিনিস এ অফিসে আনা যাবে না। এটা বসের নির্দেশ।’ বস মানে ফরিদুর রেজা সাগর। আমার আনন্দে, খুশিতে গর্বে চোখে পানি এসে গিয়েছিল। শুধু একটি কারণে আমি ফরিদুর রেজা সাগরকে শ্রদ্ধা করব সারা জীবন। ঘটনাটি উল্লেখ করলাম এ কারণে যে আমরা চাইলেই পারি। আসুন না, আমাদের বাড়ি থেকেই শুরু করি। আজই সিদ্ধান্ত নিই, আমরা পাকিস্তানি পণ্য আমাদের বাসায় আনব না। পাকিস্তানি চ্যানেল দেখব না, পাকিস্তানি কাপড় পরব না। কাজটি কি খুবই কঠিন? জাতির পিতা তার ৭ মার্চের ভাষণে বলেছিলেন, ‘ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল’। আজ আমরা পাকিস্তানি আস্ফাালন, মিথ্যাচার এবং ধৃষ্টতার বিরুদ্ধে কি ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলতে পারি না?

পাকিস্তানকে আমরা ’৭১-এ পরাজিত করেছি রাজনৈতিকভাবে। ২০০০ সালে পাকিস্তানের চেয়ে আমরা ভালো অর্থনৈতিক অবস্থায় উপনীত হয়েছি। অর্থাত্ অর্থনৈতিকভাবে পাকিস্তানকে পরাজিত করেছি। এখন আমাদের প্রয়োজন মনস্তাত্ত্বিক বিজয়। পাকিস্তানি ভূত-প্রেত অথবা প্রেতাত্মাদের এখন আমাদের তাড়াতে হবে। ভূত-প্রেত তাড়ানোর এক অসম্ভব সুন্দর পথ বাতলেছিলেন আমার নানী। তিনি আমাদের ফুঁ দিতেন, যেন ভূত আমাদের ওপর আসর না করে। তেমনি পাকিস্তানি ভূত তাড়াতে আমাদের একটিই মন্ত্র প্রয়োজন, সেটা হলো— আমাদের দেশপ্রেম জাগ্রত করা। পাকিস্তান যতক্ষণ ’৭১-এর বর্বরতার জন্য ক্ষমা না চাইবে ততক্ষণ পাকিস্তানি পণ্য বর্জন করা। শহীদদের শান্তির জন্য এ কাজটা কি খুব কঠিন?

 

লেখক : নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত

ইমেইল : [email protected]

সর্বশেষ খবর