শিরোনাম
সোমবার, ২১ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

শেষ বইটি লিখেছিলেন আটানব্বই বছর বয়সে

সমরেশ মজুমদার

শেষ বইটি লিখেছিলেন আটানব্বই বছর বয়সে

সেদিন একজন প্রকাশক আক্ষেপ করে বললেন, ‘একে একে লেখকরা চলে যাচ্ছেন, এই যে সুনীল বাবু, হাসিখুশি মানুষটা, যার বই ছাপলেই ভালো বিক্রি, তিনিও চলে গেলেন। এরপর কী হবে? বছর সাত-আটের মধ্যেই দিনটা এসে যাবে যখন বইয়ের ব্যবসা বন্ধ করার কথা আমাকে ভাবতে হবে।’

ভদ্রলোকের মুখ দেখে বুঝতে পারছিলাম তিনি কথার কথা বলছেন না। বললাম, ‘এখনো অনেক বিখ্যাত লেখক বেঁচে আছেন, যাদের বই পাঠকরা উত্সাহের সঙ্গে কেনেন।’

‘আছেন। কিন্তু ক’জন আর লিখতে চাইছেন! এই ধরুন, শঙ্কর বাবু, সেই ‘কত অজানারে’ থেকে যা লিখেছেন তাই হটকেকের মতো বিক্রি হয়েছে। বাঙালি পাঠক তাকে মাথায় করে রেখেছে। তিনিও আশি পেরিয়ে গিয়েছেন। গল্প উপন্যাসের চেয়ে ধর্মবিষয়ক লেখা লেখেন। বিবেকানন্দকে নিয়ে লিখতে পছন্দ করেন। তার উপন্যাস লেখার মনটা বোধহয় হারিয়ে গেছে। এখনো লেখালেখিতে আছেন প্রফুল্ল রায়। তার বয়সও আশি ছাড়িয়েছে। শরীর সবসময় সুস্থ থাকছে না। সেই ‘কেয়াপাতার নৌকো’ থেকে অনেক বিখ্যাত উপন্যাসের লেখককে পাঠকরা ভালোবেসে গ্রহণ করেছেন। ওঁর বই প্রকাশ করলে বিক্রির জন্য চিন্তা করতে হয় না। কিন্তু বয়স তো সবকিছুকেই শ্লথ করে দেয়। তাই না?’

কয়েকদিন আগে সৌমিত্রদার সঙ্গে কথা হচ্ছিল। আশি পেরিয়ে গিয়েও দিন-রাত খাটছেন। একটার পর একটা ছবি, নাটকে অভিনয় করে চলেছেন। বললেন, ‘বয়সের কথা ভাবি না। ওটা স্রেফ একটা সংখ্যা। তার বেশি কিছু নয়।’

শুনে খুব ভালো লেগেছিল। নীরদ সি চৌধুরী একশ পার করে চলে গিয়েছিলেন। কিন্তু শেষ বইটি তিনি লিখেছিলেন আটানব্বই বছর বয়সে। অবশ্য এটা প্রমাণ করে না যে সবাই ওই বয়স পর্যন্ত লিখতে পারেন। নীরদ সি চৌধুরীর ক্ষেত্রে আটানব্বই একটা সংখ্যা হতে পারে কিন্তু অনেকেরই মস্তিষ্ক এবং শরীর তখন কাজ করে না। যাদের করে তাদের একজন হলেন নীরেনদা। কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। নব্বই-এর ঘরে পৌঁছে গিয়েও তিনি সমানে লিখে যাচ্ছেন। অথচ রমাপদ চৌধুরী কলম বন্ধ করেছেন শরীর যখন সুস্থ ছিল তখন থেকেই।

কিন্তু প্রকাশক যাদের কথা বলছেন, যাদের লেখা বই ভালো বিক্রি হয় তারা তো এখনো আছেন। আমার কথা শুনে প্রকাশক মাথা নাড়লেন, ‘আছেন। বুদ্ধদেব গুহ চোখের সমস্যায় ভুগছেন। শরীরও সুস্থ নেই। লেখালেখি ইদানীং পেরে উঠছেন না। সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় একসময় জনপ্রিয় লেখক ছিলেন। হঠাৎ তার মনের পরিবর্তন হলো। তিনি রামকৃষ্ণ সারদামণিতে মগ্ন হয়ে গেলেন। দীর্ঘকাল ওঁদের কথাই লিখে গেলেন। ফলে তার যে পাঠক ছিল যারা হাস্যরসে মুগ্ধ হতো তারা হতাশ হলো। ইদানীং সঞ্জীব বাবু আবার আগের লেখায় ফিরে গেছেন। কিন্তু যে দিন গেছে সে দিন হুট করে কি ফিরে আসে!’

আমি বললাম, ‘আপনি একজনের কথা বেমালুম ভুলে গেছেন।’

‘ভুলিনি। তিনি আমাদের কাছে আকাশকুসুম। চাইলেও যখন পাব না, তখন মনে রেখে লাভ কী!’ প্রকাশক এবার গম্ভীর।

‘বুঝলাম না।’

‘শীর্ষেন্দু বাবু এমনিতেই কম লেখেন। শুনেছি সম্পাদকরা ধাক্কা দিয়ে দিয়ে ওঁর কাছ থেকে লেখা আদায় করে। আপনি ভালো বলতে পারবেন, আমার শোনা কথা, সাগরময় ঘোষ যখন ‘দেশ’ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন তখন ঠিক সময়ে লেখা দিতে পারেননি বলে ওঁকে বাদ দিয়ে পুজোসংখ্যা বের করেছিলেন। তারপরও তিনি যা লেখেন, তা আনন্দ পাবলিশার্স বই করে ছাপে। আমাদের দেওয়ার মতো কোনো লেখাই থাকে না। তাই ওঁকে ‘আকাশকুসুম’ বললাম।’

‘আপনি এসব বলছেন বটে কিন্তু খবরের কাগজের পাতায় যে বেস্ট সেলারের তালিকা ছাপা হয় তাতে দেখি অনেক জনপ্রিয় লেখক আছেন যাদের বয়স আশির অনেক নিচে। তারা তো আগামী ২০ বছরে বৃৃদ্ধ হয়ে যাচ্ছেন না।’ বিরক্ত হয়ে বললাম।

‘আপনি একটা রসিকতা নিয়ে রসিকতা করছেন।’

‘কথাটার মানে কী?’

‘খুব সহজ। ধরুন একজন নবীন লেখকের কোনো বই বাহান্ন সপ্তাহের মধ্যে চল্লিশ সপ্তাহ ওই বেস্ট সেলার তালিকায় ছাপা হয়েছে। আপনার যদি মনে হয় সপ্তাহে অন্তত একশ কপি বিক্রি হয়েছে ওই বই, তাহলে চল্লিশ সপ্তাহে চার হাজার কপি। বেস্ট সেলার বলে কথা। কিন্তু এত বই কোথায় বিক্রি হয়েছে, তা খুঁজে বের করা ফেলুদার পক্ষেও সম্ভব নয়। প্রকাশক সত্যি কথা বললে অন্য গল্প শুনতে পাবেন।’ রহস্যের হাসি হাসলেন প্রকাশক।

‘আমি আপনার সঙ্গে একমত নই। কয়েক বছর ধরে সবাইকে সরিয়ে দিয়ে এক বিশিষ্ট লেখকের তিনটি বই ওই তালিকার গোড়ার দিকে থাকছে। প্রকাশক জানিয়েছেন একের-পর-এক সংস্করণ বেরিয়ে যাচ্ছে। এ মুহূর্তে তিনি ‘সুপারহিট’ লেখক। যতদূর জানি ওঁর বয়স সত্তরের কোঠায়। ওঁকে বাদ দিচ্ছেন কেন?’

খুব নরম গলায় প্রকাশক জিজ্ঞাসা করলেন, ‘উনি কী লেখেন?’

‘রম্যরচনা, জীবনী।’

‘রম্যরচনার বই হু হু করে বিক্রি হচ্ছে, এ খবর আগে কখনো শুনেছেন?’

‘হয়েছে। তবে এরকম হয়নি।’

‘বইগুলো সত্যি বিক্রি হয়েছে। কারণ বাঙালির সহজাত আকর্ষণ আছে কেচ্ছাগল্পের দিকে, আর গোপন আগ্রহ আছে মনীষীদের ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে। তাই প্রাতঃস্মরণীয় কোনো বাঙালির ব্যক্তিগত জীবনে কোনো বই উঁকি মারলে, হু হু করে সেগুলো বিক্রি হয়। এটাই প্রধান কারণ।’

‘কিন্তু...।’

‘দেখুন, বিশিষ্ট মানুষদের নিয়ে বই লিখলে সব বইতেই যে কেচ্ছা-কেলেঙ্কারির কথা থাকবে তা অবশ্যই নয়। অনেক ভালো ভালো তথ্যও থাকে। যা ওসব বিশিষ্ট মানুষ সম্পর্কে আমরা জানি না। তবু কিছু পাঠক প্রত্যাশা করেন যে, ‘গোপন খবর’ কিছু না কিছু ঠিক পাওয়া যাবে। না পেয়ে হতাশ হচ্ছেন।’

‘তাহলে তো সবাই জেনে যাবে। বিক্রি কমবে।’

‘না। আমরা অল্প বয়সে কোনো সিনেমা দেখে খুব খারাপ লাগলে বন্ধুদের কাছে এত প্রশংসা করতাম যাতে ওরাও সিনেমাটা দেখে। আমাদের একার পয়সা নষ্ট হবে কেন!’

এরপর ওই প্রকাশক বললেন, ‘আশায় আশায় আছি। যদি প্রচেত গুপ্ত, তিলোত্তমারা আরও ভালো লেখেন, পাঠকরা যদি ওঁদের লেখায় মুগ্ধ হয়, তাহলে বাংলা বইয়ের ব্যবসা বেঁচে যাবে। নইলে একের পর এক দোকান হয় উঠে যাবে, নয় রচনাবলি ছাপতে বাধ্য হবে।’

এই সেদিন, মাত্র পঞ্চান্ন বছর আগে, যারা লিখতেন, যাদের অজস্র পাঠক ছিল, তাদের নামগুলো এখন স্বপ্নের মতো মনে হয়। তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়, বিমল মিত্র, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, প্রেমেন্দ্র মিত্র, প্রমথনাথ বিশী, হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়, সমরেশ বসু, বিমল কর, রমাপদ চৌধুরী, শঙ্কর, আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, নীহাররঞ্জন গুপ্ত, আশাপূর্ণা দেবী। বাংলা সাহিত্যের স্বর্ণযুগের এসব লেখকের অভাব বোধ করছে কলেজ স্ট্রিট।

     লেখক : কথাসাহিত্যিক।

সর্বশেষ খবর