শিরোনাম
সোমবার, ২১ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই

সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত

রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই

রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই। পশ্চিমবঙ্গে সে কথা আবার প্রমাণিত হলো। তৃণমূলের একদা নম্বর টু, পরে দল এবং নেত্রীর সঙ্গে দূরত্ব বাড়ানো মুকুল রায়ের ফের দলীয় সাংসদদের সঙ্গে দহরম-মহরমে নতুন করে জল ঘোলা শুরু হয়েছে রাজ্য রাজনীতিতে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের একদা বিশ্বস্ত সৈনিক মুকুল সারদা কেলেঙ্কারিতে ফেঁসে যাওয়ার পরই দিদির সঙ্গে দূরত্ব বাড়িয়েছিলেন। সেই দূরত্ব অনেকটাই ঘুচে গিয়ে এখন আবার মমতা-মুকুল কাছাকাছি।

রাজ্যের রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, মুকুলের ফের দলনেত্রীর কাছাকাছি আসার পেছনে বেশ কয়েকটা অঙ্ক কাজ করেছে। প্রথমত, আসন্ন বিধানসভা ভোটের আগে বিধায়ক কেনার কাজে তার চেয়ে দড় তৃণমূলে আর কেউ নেই। তাই এখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দরকার মুকুল রায়কে। এ ছাড়াও দলের জন্য নির্বাচনী তহবিল বাড়ানোর কাজেও মুকুল সিদ্ধহস্ত। তার নিজের কাছেও রয়েছে সারদার মালিক সুদীপ্ত সেনের কাছ থেকে নেওয়া বিপুল অঙ্কের টাকা। তৃণমূলের অন্দরের খবর এই টাকার বখরা নিয়েই দলনেত্রীর সঙ্গে দূরত্ব বেড়েছিল মুকুলের। তৃণমূলের অন্দরেই তাই নিত্যনতুন করে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে তাহলে কি টাকার বখরা নিয়ে মিটমাট হয়ে গেল দুজনের? এতদিন সারদাসহ অন্যান্য চিট ফান্ড থেকে দলের তহবিল সংগ্রহ করতেন মুকুল। ভোটের আগে বিভিন্ন সন্দেহজনক সংগঠক থেকে টাকা তোলার দায়িত্ব কি ফের মুকুলের ওপরই দিতে চাইছেন বঙ্গেশ্বরী?

দ্বিতীয় যে বিষয়টি নিয়ে মুকুল-মমতা ঘনিষ্ঠতা বাড়তে পারে তা হলো দলীয় সংগঠন। সম্প্রতি রাজ্যে চারটি জেলায় (উত্তর ২৪ পরগনা, দক্ষিণ ২৪ পরগনা, মালদহ ও মুর্শিদাবাদ) দলের সংগঠন শক্তিশালী করার দায়িত্ব দলনেত্রী দিয়েছিলেন পূর্ব মেদিনীপুরের দাপুটে নেতা শুভেন্দু অধিকারীর ওপর। দলে বরাবর মমতাবিরোধী বলে পরিচিত শুভেন্দু অধিকারী এই সুযোগকে কাজে লাগিয়েছেন পুরোপুরিভাবে। এই চারটি জেলায় আস্তে আস্তে সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে নিজের পছন্দের লোকদের বসাতে শুরু করেছিলেন। উত্তর ও দক্ষিণবঙ্গে দলের রাশ অধিকারী পরিবারের হাতে চলে যেতে বসেছে বুঝতে পেরেই সম্ভবত মুকুলকে ফেরাতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন মমতা। তার নিজের ভাইপো অভিষেক ব্যানার্জির আপত্তিও আপাতত দূরে সরিয়ে রাখছেন তিনি।

কিন্তু কে এই মুকুল? একদা কংগ্রেসের শীর্ষ নেতাদের ছায়াসঙ্গী উত্তর ২৪ পরগনার বীজপুরের মুকুল রায় নির্বিকার চিত্তে করতে পারেন না এমন কোনো কাজ নেই। তৃণমূলের জন্মলগ্ন থেকেই মমতার ছায়াসঙ্গী তিনি। দলটিকে চেনেন হাতের তালুর মতো। তাই গাত্রদাহ হলেও এখন মুকুলকে ঘরে না ফিরিয়ে উপায় নেই মমতার। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা এও মনে করছেন, মমতা-মুকুল বিরোধ পুরোটাই লোক দেখানোও হতে পারে। সারদা কাণ্ডে সিবিআই থেকে বাঁচতে যুদ্ধের নাটক করছিলেন দুজনে।

তৃণমূলের প্রাক্তন মহানায়ক মুকুল রায়ের কথাবার্তা ও গতিবিধি নিয়ে ধোঁয়াশা ক্রমশ বাড়ছে। দিল্লিতে মুকুল জানিয়েছেন, নতুন দলের সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। আমি এখনো তৃণমূলের সাংসদ। পদত্যাগ করিনি। উনি (মমতা) তৃণমূল কংগ্রেসের সভানেত্রী। দেখা হলে কথা হতেই পারে। কিন্তু মুখে এ কথা সত্ত্বেও তার অনুগামীদের কাছে মুকুল এখনো যে বার্তা পাঠিয়ে চলেছেন তার মর্মার্থ ভিন্ন। তা হলো যথাসময়ে তিনি তৃণমূলের সঙ্গে যাবতীয় অফিসিয়াল সম্পর্ক চুকিয়ে খোলাখুলিভাবে বেরিয়ে আসবেন, তারপর ঝাঁপিয়ে পড়বেন তার পরবর্তী রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে। সে নতুন দল গড়েই হোক বা অন্য কোনো দলে যোগদানের মাধ্যমেই হোক।

রায় সাহেবের গতিবিধি দেখে ক্রমশ জোরালো হচ্ছে যে প্রশ্নটি, তা হলো— তৃণমূল নেত্রীর কাছাকাছি হতে চলেছেন কি তিনি? আবার কি তিনি তৃণমূলের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হতে চলেছেন? এ ব্যাপারে তৃণমূল দলেরই বা কী ভাবনা? কী ভাবনা মুকুল অনুগামীদেরও? আর মুকুলের চিন্তা-ভাবনা নিয়ে সব পক্ষেরই ধোঁয়াশা বাড়ছে। দিল্লিতে এক কথা, এ রাজ্যে এসে অন্য কথা। এক মুখে দুকথা বলার কারণ কী ভেবে পাচ্ছে না যেমন মুকুল অনুগামীরা, তেমনি তৃণমূল কংগ্রেসের একাংশও। অতি সম্প্রতি সংসদ ভবনের সেন্ট্রাল হলে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে মুকুল রায় বলেন, তৃণমূল নেত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের পিছনে অন্য কিছু খোঁজা ঠিক হবে না। আমি তার দলের সাংসদ। উনি নেত্রী। আমায় ডাকলে আবার যাব, এতে জল্পনার কী? মুকুল জানান, দল ভালো মনে করেছিল বলে আমাকে রেলমন্ত্রী করেছিল। খারাপ মনে করায় আবার ব্যাক বেঞ্চে পাঠিয়ে দিয়েছে। আজ বললেন সেন্ট্রাল হলে সবাই সৌজন্য বজায় রাখে। আমিও রেখেছিলাম।

মুকুল নতুন দল গঠনের ব্যাপারে অনেক এগিয়ে গিয়েছিলেন অনুগামীদের কথা মাথায় রেখে। মুকুল বলছেন তিনি তৃণমূলের সাংসদ এখনো।  দল ও পদত্যাগের কথা ঘুণাক্ষরেও বলছেন না। মুকুলের এক মুখে দুকথার বিষয়টি লঘু করতে তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেন, মুকুল তো এখনো আমাদের সাংসদ। তার সঙ্গে সংসদ ভবনের নৈশভোজে গিয়ে আমরা অন্য কিছু ভাবব কেন? শুধু মুকুল কেন, মুকুলের পুত্র শুভ্রাংশুও বলেছেন, তৃণমূল দলের জন্য বাবা তার রক্ত-ঘাম ঝরিয়েছেন। তিনি দলে ফিরলে তো ভালোই।

মুকুল তৃণমূলে যদি ফিরে আসেন তাহলে তার সাংগঠনিক ক্ষমতা কাজে লাগাবে তৃণমূল। গতবার বিধানসভা নির্বাচনে মুকুল তার সাংগঠনিক ক্ষমতার চূড়ান্ত রূপ দেখাতে পেরেছিলেন। তাতে খুশি ছিল তৃণমূল নেতৃত্ব। তৃণমূল রাজ্যে ক্ষমতায় আসার কৃতিত্ব ঠারে ঠুরে নেত্রী বুঝিয়েছিলেন তিনি ও মুকুল এই জয়লাভের প্রধান মুখ।

মুকুল যদি দলে ফিরে আসে তাহলে কি সেই সাংগঠনিক ক্ষমতা দেখাতে পারবেন? এতদিন তৃণমূল দলে থেকেও দলে ছিলেন না মুকুল। নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলেন। নানাভাবে তার অনুগামীদের চাঙ্গা করার চেষ্টায় নানা পরিকল্পনা নিচ্ছিলেন। নতুন দল গঠনের কথা ভেবেছিলেন। কথা উঠেছিল তৃণমূল দলেই মুকুলের জায়গায় কে আসবেন? অনেকের নাম উঠলেও স্থায়ী হয়ে দাঁড়ায় অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম। মুকুল আবার ফিরে আসছে এই সংবাদের আভাসে আর কেউ না হোক মনে মনে ক্ষুব্ধ, বিরক্ত অভিষেক নিজেই। শুধু অভিষেক নয়, গুরুত্বপূর্ণ আরও তিন নেতা ক্ষুব্ধ। কিন্তু মুখ ফুটে তারা কিছু বলছেন না। দলের এক শীর্ষ নেতা ঘনিষ্ঠদের কাছে মন্তব্য করেছেন, নেত্রী ঠিক কী চাইছেন বুঝতে পারছি না। এ নিয়ে আমাদের সঙ্গে কোনো আলোচনা করেননি। তিনি হয়তো ভেবেছেন মুকুলকে ফেরানো দরকার। সেই সিদ্ধান্ত তিনি নিতেই পারেন। কিন্তু তা নিয়ে যে সংশয়, ক্ষোভ দেখা দিয়েছে, মুকুল রায় নতুন দল গঠন নিয়ে যে ধোঁয়াশা কথাবার্তা বলছেন তাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে দলের নিচুতলার কর্মীদের ওপর।

এ ছাড়া মুকুল বিভিন্ন রাজনৈতিক দলে যোগ দেবেন বলে তাদের ভরসাও দিয়েছিলেন। কংগ্রেসে যোগ দেবেন বলে অধীর চৌধুরীর সঙ্গে তার কথাবার্তা পাকা হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সারদা কেলেঙ্কারিতে মুকুলের নাম ওঠায় কংগ্রেস তাকে কাঠগড়ায় তুলেছিল। বিজেপিতেও মুকুল যেতে পারেন এরকম একটা শোরগোল উঠেছিল। সেখানেও ওই সারদা কলঙ্কের জন্য সবাই একমত হতে পারেননি মুকুলকে দলে নিতে। দুর্নীতির প্রশ্নে অভিযুক্ত মুকুলকে সমর্থন করার কোনো প্রশ্ন ওঠেনি বাম দলগুলোর পক্ষ থেকে। অতএব, মুকুল চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন নতুন দল গড়তে।

প্রসঙ্গত, মুকুল যে নতুন দল গঠনের আবেদনপত্র দিয়ে দিল্লিতে নির্বাচন কমিশনের অফিসে পাঠিয়েছিলেন দুই প্রতিনিধিকে সে ব্যাপারে নির্বাচন কমিশন ২৩ ডিসেম্বর আরেকটি শুনানির জন্য ডেকেছেন। তাই মুকুল অনুগামীদের মধ্যে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। মুকুলের গড়া নতুন দলে যোগ দেবেন বলে প্রস্তুত ছিলেন প্রদীপ ঘোষ। এ ব্যাপারে মুকুলের সঙ্গে তার পাকা কথাও হয়ে গেছে। হঠাৎ এখন মুকুল যদি অবস্থান বদল করেন, অন্য অনুগামীদের মতো তার-ই বা কী হবে?

     লেখক : ভারতীয় প্রবীণ সাংবাদিক।

সর্বশেষ খবর