শিরোনাম
সোমবার, ২১ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

গুলি-বোমা-গ্রেনেড কি ধর্মের অংশ?

তুষার কণা খোন্দকার

গুলি-বোমা-গ্রেনেড কি ধর্মের অংশ?

বর্তমানে আমরা বাংলাদেশ নামের ভূখণ্ডের বাসিন্দা। বাংলাদেশের জন্ম ১৯৭১ সালে হলেও এ ভূখণ্ডে মানুষের বসবাসের ইতিহাস অনেক পুরনো। যখন থেকে এখানে মানুষের বসবাস শুরু হয়েছে তখন থেকেই মানুষের মধ্যে হরেক রকম ধর্মবিশ্বাসের জন্ম এবং লালন-পালনও শুরু হয়েছে। আদিকাল থেকেই এ দেশে জাতি-উপজাতি মিলিয়ে অনেক রকম ধর্মবিশ্বাসী মানুষের বসবাস। ধর্মের রীতিনীতি পালন করতে গিয়ে এক সম্প্রদায়ের মানুষ আরেক সম্প্রদায়ের মানুষের রীতি-নীতিকে বাঁকা চোখে দেখে থাকে এটা নতুন কিছু নয়। কারণ, কোনো একটি ধর্ম বিশ্বাস এবং সেই ধর্মের রীতিনীতি পালন করতে গিয়ে মানুষ ভাবে, আমি যা করছি এটি ধার্মিকতা এবং এটিই স্রষ্টার নির্দেশ। অন্যেরা যে ভিন্ন একটি ধর্ম বিশ্বাস করে এবং যেভাবে তাদের ধর্ম পালন করে সেটা বেঠিক পথ। ধর্মবিশ্বাস এবং রীতিনীতির ঠিক-বেঠিক মাপার কোনো মানদণ্ড নেই। ধর্ম বিশ্বাস এমন একটি ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত যার সত্য-মিথ্যা নির্ধারণের জন্য কোনো প্রমাণ হাজির করা যায় না। প্রমাণহীন বিশ্বাস নিয়ে তর্ক করা অবান্তর। কোনো বাহ্যিক প্রমাণের ভিত্তিতে নয়, জন্মসূত্রে পাওয়া পরিচয় এবং পারিবারিক পরিমণ্ডলে লালন করা সংস্কৃতিকে মানুষ ধর্ম বলে বিশ্বাস করে এবং সেটাকে আশ্রয় করে ধর্ম টিকে থাকে। নাগরিকের সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় আচার-আচরণের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করা চলে : কিন্তু ধর্মীয় বিশ্বাস-অবিশ্বাস মানুষের একান্ত নিজস্ব বিষয়। ধর্মকে কেন্দ্র করে কেউ আইন লঙ্ঘন করলে রাষ্ট্র তাকে শাস্তি দিতে পারে কিন্তু কারও মনের মধ্যে পুষে রাখা বিশ্বাস নিয়ে নাড়াচাড়া করার অধিকার রাষ্ট্রের নেই। একজন নাগরিক তার নিজের বিশ্বাসের ওপর ভর করে ভাবতে পারে সে যে ধর্ম পালন করছে সেটিই শ্রেষ্ঠ। ব্যক্তি মানুষ কিংবা কোনো সম্প্রদায় এমন বিশ্বাস মনের মধ্যে পুষতে থাকলে অন্যের তাতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। কোনো মানুষ এমন বিশ্বাস মনের মধ্যে লালন করলে সেই ব্যক্তিমানুষ অহমিকা রোগে ভুগবে। সেটি তার ব্যক্তিগত সমস্যা। এমন মানুষকে করুণা করে এড়িয়ে যাওয়া ছাড়া অন্যের আর কি করার আছে। ব্যক্তির মনের মধ্যে পুষে রাখা অহমিকার কারণে অন্যের আহত হওয়া কিংবা সমাজে ঘৃণা-বিদ্বেষ ছড়িয়ে পড়ার তেমন আশঙ্কা আমি দেখি না।

ধর্ম বিশ্বাস নিয়ে আলোচনার সময় আরও একটি সত্য আমাদের মনে রাখতে হবে, কিছু বিরল ব্যতিক্রম ছাড়া আমরা বেশির ভাগ মানুষ জন্মসূত্রে পাওয়া ধর্ম পরিচয় বয়ে বেড়াচ্ছি। আমরা কেউ দশ রকমের ধর্ম বিশ্বাস যাচাই-বাছাই করে নিজের জন্য একটি ধর্ম পরিচয় বেছে নেইনি। দুনিয়ার সিংহ ভাগ মানুষের জন্য এটিই সত্য। উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া ধর্ম বিশ্বাস এবং রীতিনীতিকে আশৈশব তারা শ্রেষ্ঠ বলে বিশ্বাস করতে শেখে বলে জন্মসূত্রে পাওয়া বিশ্বাসের প্রতি তারা অটল থাকে। একজন মানুষের মনের মধ্যে একটি ধর্ম বিশ্বাস লালন করার সঙ্গে অন্যকে আঘাত করার কোনো সম্পর্ক আছে বলে আমি মনে করি না। যদি এমন ঘটনা সত্য হতো তাহলে বাংলাদেশে হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান সব সম্প্রদায়ের মানুষ একই গ্রামের বাসিন্দা হয়ে হাজার বছর ধরে পাশাপাশি বসবাস করতে পারত না। এই সত্য বিবেচনায় নিয়ে ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করলে বোঝা যায়, বাংলাদেশে এখন যে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস হচ্ছে তার মূলে ধর্ম বিশ্বাসের ভিন্নতাকে দায়ী করা আহাম্মকি। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, কোনো দল কিংবা গোষ্ঠী রাজনৈতিক ক্ষমতা এবং সম্পদের লালসায় ধর্মকে ঢাল বানিয়ে নতুন করে মাঠে নেমেছে যেমন তারা আগেও অনেকবার করেছে।

বাঙালি কথার কূটচালাচালিতে দক্ষ এটা সবাই স্বীকার করে। আবার এটাও সত্য, বাঙালি সামাজিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে শান্তিপ্রিয়। ধর্ম কিংবা রীতিনীতির ফারাককে কেন্দ্র করে বাঙালি কখনো হিংস্র মারামারিতে মত্ত হয়নি। বাঙালির স্বভাবে পাঠান কিংবা আফগানদের মতো উগ্রতা নেই বলে তারা বন্দুক হাতে সব সমস্যার ফায়সালা  খুঁজতে বের হয় না। বাঙালি চরিত্রের অহিংস ঐতিহ্য বাঙালির রক্ষাকবচ। বাংলাদেশে যতবার সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ঘটেছে সে সব ঘটনার পেছনে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের শয়তানি ক্রিয়াশীল ছিল। রাজনৈতিক দুরভিসন্ধিকে হাতিয়ার হিসেবে লুফে নিয়ে একদল হিংস্র মানুষ প্রতিবেশী ভিন্নধর্মী মানুষটার ধানি জমি, বসতভিটা এবং তাদের সিন্দুকে সঞ্চিত সোনা-দানা, টাকা-পয়সা নিজেদের দখলে নিয়েছে। রাজনীতি এবং লুটপাটের সঙ্গে ধর্মের কোনো সম্পর্ক ছিল না এই সত্য সাধারণ মানুষও জানত। সে কারণে সাম্প্রদায়িক অসহিষ্ণুতা এ দেশে কখনো দীর্ঘস্থায়ী সার্বজনীন সহিংস রূপ নিতে পারেনি। আমাদের দেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নিয়ে প্রশ্ন তোলার আগে প্রতিটি মানুষের ভেবে দেখা উচিত, গত শতাব্দীর চল্লিশের দশকে দ্বি-জাতি তত্ত্বের জন্ম হওয়ার আগে এ দেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার খবর পাওয়া যায় না।

হিন্দু-মুসলমানের বিভেদ-বিভাজন নিয়ে এ দেশে অনেক বছর ধরে রাজনীতি চলছে। সাম্প্রদায়িক রাজনীতির কড়চায় কিছুদিন আগে বৌদ্ধ সম্প্রদায় যুক্ত হলো। রামুর বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ওপর অতর্কিত আঘাতে আমরা সত্যি বিস্মিত হয়েছি। রামুর বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মানুষের সঙ্গে স্থানীয় মুসলমানদের কোনো বিবাদ ছিল বলে কেউ শোনেনি। আক্রান্ত বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মানুষগুলো ঘটনার আকস্মিকতায় আমাদের মতোই হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল। রামুতে বৌদ্ধরা আক্রান্ত হওয়ার পরে মুসলমান প্রতিবেশীরা তাদের সাহায্যে এগিয়ে এসেছিল। তারা বৌদ্ধদের সঙ্গে মিশে সম্মিলিতভাবে দুর্বৃত্তদের রুখে দিয়েছিল। তা না হলে সেদিন দুর্বৃত্তরা মানুষের রক্ত ঝরাতে দ্বিধা করত না। রামুর বৌদ্ধদের রক্ষা করার জন্য মুসলমানদের প্রতিরোধ জোরালো না হলে সেখানে পরিস্থিতির আরও অবনতি হতো। এ তথ্য আক্রান্ত মানুষগুলোর বর্ণনায় উঠে এসেছিল। ইদানীং দুজন খ্রিস্টান ধর্মযাজককে হত্যা করার চেষ্টা করা হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে আর এক ধরনের সহিংসতার খবর আমাদের উদ্বিগ্ন করে তুলছে। গত কয়েক বছর ধরে পীর কিংবা মাজারের খাদেমদের হত্যা করার রেওয়াজ চালু হয়েছে। বেশ কয়েক বছর আগে কিশোরগঞ্জের রাউতির এক পীরকে দুর্বৃত্তরা হত্যা করেছিল। রাউতির পীর ছিলেন একজন অবসরপ্রাপ্ত মেজর। সামরিক বাহিনীর চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পরে তিনি পীরালি পেশায় এসেছিলেন। তাকে হত্যা করে তার জমানো টাকা-পয়সা লুট করার ধরন দেখে আমরা ভেবেছিলাম এটি স্রেফ ডাকাতি কিংবা পীরালি পেশার পেশাগত দ্বন্দ্বের কুফল। সে সময় এটাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে ধরে নেওয়ার কারণে আমরা উদ্বিগ্ন হওয়ার তাগিদ বোধ করিনি। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে পীর কিংবা মাজারের খাদেমদের যেভাবে হত্যা করা হচ্ছে সেটি ডাকাতি কিংবা পেশাগত দ্বন্দ্ব বলে মনে হচ্ছে না। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, পীরদের ধর্ম পালনের রীতিনীতিকে যারা অনুমোদন করছে না তারাই তাদের গলায় ছুরি চালাচ্ছে। গোপীবাগে একজন পীরের বাড়ির ছয়জন সদস্যকে বর্বর কায়দায় হত্যা করার পরে ফের ঢাকা শহরের রাজাবাজারে আহলে হাদিস সুন্নাতে ওয়াল জামাতের নেতাকেও একই কায়দায় হত্যা করা হলো। সম্প্রতি বাগেরহাট, চট্টগ্রাম এবং আরও কয়েক জায়গায় মাজারের খাদেমদের ওপর আক্রমণ হয়েছে। কিছুদিন আগে বাড্ডায় একজন পীরকে গলা কেটে হত্যা করা হয়েছে। প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের ধরন বিবেচনা করে দেখা যায়, খুব গোঁড়া কোনো গোষ্ঠী যারা পীর কিংবা মাজারকেন্দ্রিক ধর্মচর্চাকে অধর্ম বলে মনে করে অথবা পীরদের তাদের রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের পথে বাধা বলে ভাবে তারাই এমন হিংস্রতা দেখাচ্ছে।

পুরান ঢাকার তাজিয়া মিছিলে গ্রেনেড হামলা হওয়ার পরে সাধারণ মানুষ আর একটি ধাক্কা খেয়েছে। ঢাকার নাজিমুদ্দিন রোডে আশুরার দিনে তাজিয়া মিছিলের আয়োজন পুরান ঢাকার শত বছরের ঐতিহ্য। নাজিমুদ্দিন রোড এবং তার আশপাশের এলাকায় হিজরি মহররম মাসের ১০ তারিখের তাজিয়া মিছিলের জন্য বেশ আগে থেকে তোড়জোড় চলতে থাকে। মিছিল শুরু হওয়ার আগে থেকেই আশপাশের এলাকা দর্শকের উপস্থিতিতে সরগরম হয়ে ওঠে। মিছিলের মাঝখানে জওয়ান ছেলেরা সরু চেইনের আগায় ছুরির গোছা বেঁধে ঝপাং ঝপাং পিঠে মেরে নিজেদের পিঠ মৃদু রক্তাক্ত করে তোলে। সেই ছেলেগুলোই মূলত তাজিয়া মিছিলের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। তাজিয়া মিছিলে শামিল হওয়া মানুষ যে সবাই শিয়া তাও নয়। মহল্লার ঐতিহ্য হিসেবে সুন্নিরাও উত্সাহভরে তাজিয়া মিছিলে শামিল হয়। আমাদের সমাজে শিয়া এবং সুন্নির মধ্যে উল্লেখযোগ্য বিভেদ-বিভাজন আছে বলে আমরা শুনিনি।

মুসলমানদের দুই সম্প্রদায় শিয়া এবং সুন্নি উভয়ই কারবালার যুদ্ধ এবং ইমাম হোসেনের পরাজয় এবং তার নিষ্ঠুরভাবে নিহত হওয়ার ঘটনাকে আরব জাতির ইতিহাসে একটি বিয়োগান্ত অধ্যায় বলে বিবেচনা করে। যারা ইতিহাসের পাতা খুঁড়ে তর্ক-বিতর্ক হাজির করতে জানে না সেসব সাধারণ মানুষ শিয়াদের মুসলমান বলেই বিশ্বাস করে। শিয়াদের পরিচয় সম্পর্কে বাংলাদেশের সুন্নি সম্প্রদায়ের মানুষ খুব বেশি ওয়াকিবহাল না হলেও তারা জানে, শিয়ারা খলিফা হজরত আলী এবং ইমাম হোসেনের অনুসারী। সুন্নিরা  মনে করে, কুফার শাসক মুয়াবিয়ার ছেলে ইয়াজিদ হজরত আলীর ছেলে ইমাম হোসেনকে কারবালার যুদ্ধে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছে। সুন্নিরা হজরত মুহাম্মদ (স.)-এর নাতি হজরত ইমাম হোসেনের হত্যার প্রতিবাদ না করে ইয়াজিদের শাসন মেনে নিয়ে অন্যায় করেছে। ব্যস! এ পর্যন্তই। শিয়ারা মনে করে না সুন্নিরা ইমাম হোসেনের হত্যাকারী ইয়াজিদ কিংবা সিমারকে ধার্মিক কিংবা ইমাম বলে শ্রদ্ধা করে। সুন্নিরা ঐতিহাসিক বাস্তবতায় ইয়াজিদ এবং তার বংশধরদের শাসন মেনে নিয়েছিল। ইয়াজিদের শাসন মেনে নেওয়ার অর্থ এই নয়, সুন্নিরা ইয়াজিদপন্থি। ইমাম হোসেনের হত্যাকারী ইয়াজিদের শাসন মেনে নেওয়ার অপরাধে শিয়া সম্প্রদায় সুন্নিদের ইয়াজিদপন্থি বলে ধিক্কার জানায় এমন আচরণ দেখা যায় না। ধর্মীয় রীতি পালনের সামান্য হেরফের ছাড়া শিয়া এবং সুন্নিদের মধ্যে ধর্ম বিশ্বাসের কোনো হেরফের নেই। দুই সম্প্রদায়ের মানুষের কাছেই কারবালার যুদ্ধ একটি বেদনার স্মৃতি। তবে এ বেদনাকে ঘিরে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে রক্তাক্ত স্থায়ী শত্রুতার নজির নেই। এখন একবিংশ শতাব্দীতে সুন্নি-শিয়া বিভেদ টেনে এনে সুন্নিদের কেউ কেউ ইয়াজিদ, সিমারের মতো হিংস্র হয়ে শিয়া নিধনে নামল কেন সেটার জবাব কি আমাদের অজানা?

যিশুখ্রিস্টকে হত্যা করার কারণে খ্রিস্টানরা দুই হাজার বছর ধরে ইহুদিদের প্রতি আঙ্গুল তুলে বলেছে, ‘তোরা আমাদের প্রভুকে হত্যা করেছিস।’ ইউরোপের খ্রিস্টানরা ইহুদিদের সমাজে অস্পৃশ্য করে রাখার জন্য খ্রিস্টানদের বসবাসের এলাকা থেকে দূরে ঘেটো তৈরি করে সেখানে ইহুদিদের আটকে রাখত। খ্রিস্টীয় উত্সব-পার্বণে ইহুদিদের ঘেটো থেকে টেনেহিঁচড়ে বের করে তাদের ওপর কিল-ঘুষির বন্যা বইয়ে দিয়ে উত্সবের আনন্দ পুরা করত, এটি ইতিহাস পড়লে জানা যায়। ইহুদিরা প্রভু যিশুর হত্যাকারী এ অপবাদে ইহুদিদের প্রতি খ্রিস্টানদের ঘৃণার প্রকাশ কত নিষ্ঠুর হতে পারে হিটলার তার চূড়ান্ত রূপ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় দুনিয়াকে দেখিয়ে দিয়েছে। সুন্নিরা ইমাম হোসেনের হত্যাকারী এ কথা বলে শিয়ারা সুন্নিদের সঙ্গে নিষ্ঠুর কোনো আচরণ করেনি যা খ্রিস্টানরা ইহুদিদের সঙ্গে করেছিল। ৭৮০ সনে মরক্কোতে শিয়া রাজ্য ইদ্রিসীয় সাম্রাজ্যের সূচনার পরে দুনিয়ায় আরও অনেক জায়গায় শিয়া রাজ্যের প্রতিষ্ঠা হয়েছে। শিয়ারা তাদের সাম্রাজ্যে সুন্নিদের ঘেটোর মধ্যে আটকে রেখে নির্যাতন করার ঘৃণ্য নজির সৃষ্টি করেনি।

৬৩২ সনে হজরত মুহাম্মদ (স,)-এর মৃত্যুর পর তার উত্তরাধিকার নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আরবে উমাইয়া এবং হাশেমি বংশের মধ্যে মতবিরোধ চরম রূপ নিয়েছিল। আরবীয়  মুসলমানদের ক্ষমতার দ্বন্দ্বের হিংস্র প্রকাশ ঘটেছিল ৬৮০ সনে কারবালার যুদ্ধে। ৬৩২ সন থেকে শুরু করে ৬৮০ সন পর্যন্ত আরবীয়দের মধ্যে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত একদিনের জন্য থেমে ছিল না তার প্রমাণ মুসলিম যুগের উত্থানলগ্নে চারজন খলিফার তিনজনই আঁততায়ীর হাতে নিহত হয়েছিলেন। সুন্নি সম্প্রদায়ের লোকেরা চার খলিফা অর্থাৎ খোলাফায়ে রাশেদিন মানে। সিফফিনের যুদ্ধের পরে এক গোষ্ঠী বেদুইন বলল তারা কোনো খলিফার তোয়াক্কা করে না, তারা মানে ‘আল্লাহর শাসন’। ইতিহাসে তারা খারিজি বলে চিহ্নিত। খোলাফায়ে রাশেদিনের চতুর্থ খলিফা হজরত আলীকে কোনো সুন্নি হত্যা করেনি। তিনি নিহত হয়েছিলেন খারিজি আবদুর রহমানের ছুরির আঘাতে। কারবালার যুদ্ধের পরে জন্ম হলো শিয়া সম্প্রদায়ের। কারবালা যুদ্ধের একশ বছর পরে মরক্কোতে শিয়া নেতা ইদ্রিসের রাজত্ব শুরু হলেও শিয়ারা কখনো ক্ষমতার মূল কেন্দ্রে আসতে পারেনি। সে কারণে তারা কারবালা হত্যার এমন কোনো রক্তাক্ত প্রতিশোধ নেয়নি যে, সেই অপরাধে শিয়া-সুন্নি বিরোধ চিরস্থায়ী রক্তাক্ত পরিণাম ডেকে আনবে। সুন্নি, শিয়া এবং খারিজি কোনো সম্প্রদায় ইসলাম ধর্মের মূল বিষয় নিয়ে কখনো প্রশ্ন তোলেনি। তাদের বিরোধ ক্ষমতাকেন্দ্রিক। আরব দেশে ৬৩২ সনে তাদের শাসক নির্বাচন নিয়ে বিবাদ হয়েছিল, তারই জের ধরে ৬৮০ সনে কারবালায় যুদ্ধ হয়েছে। সেই বিবাদের রেশ ধরে ২০১৫ সালে ঢাকার নাজিমুদ্দিন রোডে শিয়াদের তাজিয়া মিছিলে গ্রেনেড হামলা হয়েছে এটা বিশ্বাস করাও এক আহাম্মকি।

নাজিমুদ্দিন রোডের তাজিয়া মিছিলে গ্রেনেড হামলার শিকার কিশোর ছেলেটি সুন্নি পরিবারের। ছেলেটি হিংস্র হায়েনাদের গ্রেনেড হামলায় মারা যাওয়ার আগে জানতে পারল না তার অপরাধ কি! তাজিয়া মিছিলে অংশ নেওয়া তার খেলার অংশ ছিল। মৃত কিশোরের মা বাবাও কিশোরটির মতোই হামলার কারণ সম্পর্কে চিরকাল অন্ধকারে রয়ে যাবে। তাজিয়া মিছিলে রক্তাক্ত গ্রেনেড হামলার রক্ত শুকিয়ে যাওয়ার আগেই বগুড়ায় শিয়া মসজিদে নামাজরত মুসল্লিদের ওপর এলোপাতাড়ি গুলির ঘটনা ঘটে গেল। শিয়া মসজিদের মুয়াজ্জিনসহ দুজন মুসল্লিকে মেরে হামলাকারীরা ইসলামের কোন তরক্কি সাধন করেছে সেটি তারাই জানে। কিন্তু এমন হিংস্র ঘটনায় দেশের ধর্মবিশ্বাসী সাধারণ মানুষ ভয়ে সিটিয়ে গেছে। তারা জেনে গেছে, ধর্ম বিশ্বাস কিংবা ধর্ম পালনের সঙ্গে এসব রক্তাক্ত ঘটনার কোনো সম্পর্ক নেই। ধর্মের ঢাক বাজিয়ে কোনো হিংস্র শক্তি ক্ষমতা দখলের স্বপ্ন দেখছে। এমন ভয়ঙ্কর অপশক্তিকে আমাদের দেশের সরকার রুখতে পারবে না, কারণ জনগণের মঙ্গল চিন্তা ছাপিয়ে তাদের মাথায় ভোটের হিসাব বেশি কাজ করে। কাজেই জনগণকেই শিয়া-সুন্নি-খারিজি-সুফি-মুরতাদ ইত্যাদি বিভেদের ফন্দি-ফিকির সমাজ থেকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে হবে। দেশ অশান্ত হলে রাজনীতিকরা ভিন দেশে তাদের নিজ নিজ ঠিকানায় আশ্রয় নিয়ে বেঁচে যাবে। কিন্তু সাধারণ মানুষ যাবে কোথায়? সাধারণ মানুষের বাঁচার ঠিকানা একটি সেটি তাদের নিজের দেশ। কাজেই নিজেদের বাঁচার তাগিদে নিজের দেশে সামাজিক শান্তি রক্ষার দায়িত্ব সাধারণ মানুষের।

     লেখক : কথাসাহিত্যিক।

সর্বশেষ খবর