মঙ্গলবার, ২৯ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

মা-বাবা মামার দেশে টিউলিপকে অভিনন্দন

বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম

মা-বাবা মামার দেশে টিউলিপকে অভিনন্দন

ভারাক্রান্ত হৃদয়ে আনন্দের কথা লিখতে গেলে কেন যেন বীণার তারে বেমানান বাজে। স্বাধীনতার মাসে শহীদের সংখ্যা নিয়ে একজন জাতীয় নেতার দুর্ভাগ্যজনক মন্তব্য দেশবাসীকে ভাবিয়ে তুলেছে। শহীদের সংখ্যা ৩০ লাখ নয়। তবে কি ২৯ লাখ, নাকি আরও কিছু কম বা বেশি? ৩৫, ৪০ লাখ, কিংবা ২-৪-১০-২০ লাখ? কোনটা ঠিক? ছোটখাটো ডালপালারা এসব বললে না হয় ধর্তব্যের মধ্যে পড়ে না, না শোনার ভান করে এড়িয়ে যাওয়া যায়। স্বাধীনতার বিরোধী দালাল, রাজাকার, জামায়াত বললে তা-ও না হয় বোঝা যায়। কিন্তু যিনি বেশ কয়েকবার প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন, বীরউত্তম জিয়াউর রহমানের স্ত্রী, এখনো প্রধান বিরোধী দলের নেতা, তার মুখে এমন কথা কি মানায়? মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি বর্বররা যে রক্তগঙ্গা বইয়েছে, আজ শহীদের সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন তুলে সেই মুক্তিযুদ্ধকেই কি অস্বীকারের এ এক প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত? মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা না থাকলে তো জিয়াউর রহমান থাকেন না, আমি থাকি না, আমরা কেউ থাকি না। এটা তো ভালো কথা হতে পারে না।

মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর অবদান বা ভূমিকা যদি অস্বীকারের চেষ্টা করা হয় তাহলে তো বাংলাদেশকেই অস্বীকার করা হয়। আর বাংলাদেশকে অস্বীকার করলে সেই দেশে বসবাস, সেই দেশে নেতৃত্ব-কর্তৃত্ব করার সুযোগ কোথায়? যারা এসব বলেন তারা কি কিছুই ভাবেন না? নিশ্চয়ই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কর্মকাণ্ডের শতকণ্ঠে বিরোধিতা বা সমালোচনা করা যায়। কিন্তু একইভাবে বঙ্গবন্ধুর কন্যা ব্যক্তি শেখ হাসিনার সমালোচনা বা গালাগাল করা যায় না। গালাগাল আর সমালোচনা এক কথা নয়। বাঙালি নারী মায়ের জাতি। তাদের মায়ের মতো বিবেচনা করেই কথা বলা দরকার, উলঙ্গ গালাগাল নয়। দুর্ভাগ্য, আমরা কেউ তেমন করি না। যার জন্য আমাদের নেতাদের ভাবীকালে অবশ্যই জবাব দিতে হবে। আমাদের রক্ত টিউলিপ ব্রিটিশ এমপি হিসেবে প্রথম এসেছে। বিরোধী দলও তাকে সংবর্ধনা দিতে পারত কিন্তু দেয়নি বা দেবে না। সাদা চামড়া হলে অবশ্যই কাড়াকাড়ি করত। আজ এ পর্যন্তই থাক। প্রিয় ভাগিনী টিউলিপ তার মাতৃ-পিতৃ ভূমিতে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সদস্য হিসেবে প্রথম এসেছে, বুকভরা ভালোবাসার ডালি সাজিয়ে তাকে গ্রহণের এটাই উপযুক্ত সময়। তাই ওই প্রসঙ্গ অন্য কোনো দিন অন্য কোনো পর্বে আলোকপাত করব।

নেপোলিয়ন বোনাপার্ট বা আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের বিশ্বজয় দেখিনি। বইপত্রে পড়েছি। সেসব জয়-পরাজয় আমার দেহ-মনে তেমন কোনো আসর করেনি। কিন্তু স্নেহের ভাগিনী টিউলিপের নির্বাচনী জয় আমার দেহ-মনে এক অনাবিল আনন্দের শিহরণ সৃষ্টি করেছে। আমার কাছে তার ব্রিটিশ পার্লামেন্টে জয় নেপোলিয়ন বোনাপার্ট বা আলেকজান্ডারের বিশ্বজয়ের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়, বরং বেশি। যে ব্রিটিশ আমাদের ২০০ বছর শাসন-শোষণ-নির্যাতন করেছে, কত মায়ের কোল খালি করেছে, কত মানুষকে দ্বীপান্তর দিয়েছে, সেই ব্রিটিশ ভারত থেকে হাত গুটিয়ে নেওয়ার ৬৮ বছরের মাথায় আমাদের রক্ত, বীর বাঙালির ব্রিটিশ পার্লামেন্টে প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হওয়ায় আমি এতই আনন্দিত ও অভিভূত যা প্রকাশের ভাষা নেই। আগে ছিল একজন রুশনারা আলী, এখন রুশনারা আলী, রুপা আশা হক ও টিউলিপ রেজওয়ান সিদ্দিক। ২-৪-১০ বছর পর ৪০ জন যে হবে না, কে বলতে পারে? আমার দৃঢ় বিশ্বাস শতবর্ষ পরে আমাদেরই কোনো সুসন্তান ব্রিটিশ বাঙালি ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী হবেন। তাই ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সদস্য হিসেবে প্রথম বাংলার পবিত্র মাটিতে পা রাখায় টিউলিপ, তার স্বামী ও পরিবার-পরিজনকে ১৬ কোটি দেশবাসীর পক্ষ থেকে হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা ও আন্তরিক অভিনন্দন জানাচ্ছি। টিউলিপের জন্মভূমি ইংল্যান্ড কিন্তু মাতৃ-পিতৃ ভূমি বাংলাদেশ। তার জন্ম-কর্ম ইংল্যান্ডে হলেও সে আমাদের সন্তান। তাই তার জন্য আমাদের গর্বের সীমা নেই। সে একা নয়, জীবনসঙ্গী নিয়ে পিতা-মাতার ঘরে এসেছে। তাই তার স্বামীকেও আন্তরিক অভিনন্দন। মেয়েদের নানার বাড়ি ভীষণ প্রিয়। কামাল, জামাল, রাসেল নেই, মামা হিসেবে আমি তো আছি। বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যার পর সবাই যখন ইঁদুরের গর্তে তখন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মুক্তকণ্ঠে বলেছিলাম, ‘খুনিরা কামাল, জামাল, রাসেলকে হত্যা করতে পারলেও বঙ্গবন্ধুকে নির্বংশ করতে পারেনি। আমি কাদের সিদ্দিকী বঙ্গপিতার চতুর্থ সন্তান। যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ যুদ্ধ হবে বাংলায়। পিতৃহত্যার বদলা আমরা নেবই নেব।’ টিউলিপের মামা হিসেবে আজ তাই আমি গর্বিত। মেয়েরা স্বামী নিয়ে বাপের বাড়ি, নানা-নানীর বাড়ি নাইয়র এলে তাদের শতগুণ কদর বাড়ে। আমরা টিউলিপের স্বামী উইলিয়াম এস টি জন পার্সিকে যথাযথ আদর-সোহাগে ভরিয়ে দিতে পারব কিনা জানি না, কিন্তু তাদের সর্বোচ্চ সম্মান দেওয়া উচিত। টিউলিপের সৌভাগ্য রাজধানী ঢাকায় পা রাখার আগেই হযরত শাহজালাল, শাহ পরাণের পুণ্যভূমি সিলেটের মাটি স্পর্শ করেছে। প্রথম তার সিলেটের মাটি স্পর্শ করা যথাযথ হয়েছে। টিউলিপের ব্রিটিশ পার্লামেন্টে নির্বাচিত হওয়ায় সারা দেশের মানুষের দোয়া বা অবদান তো ছিলই কিন্তু সিলেট বা সিলেটবাসীর ভূমিকা ছিল অসাধারণ। তারা নিজেরা ভোট দিয়েছে, অন্যকে দিতে অনুপ্রাণিত করেছে। তাই তার প্রথমেই সিলেটবাসীর প্রতি কৃতজ্ঞতা ও শ্রদ্ধা জানানোয় আমি অভিভূত। দেশের মাটিতে পা দিয়ে সে আরও এক অসাধারণ উচ্চারণ করেছে, ‘ব্রিটিশ পার্লামেন্টে একসময় আমাদের দেশের পুরুষরাও জায়গা করে নেবে।’ খুবই যথার্থ। প্রকৃতি ও পুরুষের পৃথিবীতে একা চলার উপায় কোথায়? দুই পায়ে সমান ভর দিতে না পারলে সে তো অধরা।

আমি এমনিতেই ভাগিনা-ভাগিনীদের দিকে একটু বেশি ঘেঁষা। যখন একেবারে নিঃস্ব-রিক্ত ছিলাম, তখন ভারতে আমাদের ঘর আলো করে ছোট বোন শাহানার মেয়ে ইয়া আসে। ওকে নিয়েই ছিল তখন আমাদের দিনমান সকাল-সন্ধ্যা। যে কারণে মেয়েটা একটু আদুরে হয়েছে। এখনো সে বদলায়নি। নির্বাসিত জীবনে দিল্লি আমাদের ওপর এক বিরাট প্রভাব ফেলেছিল। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ছেলে-মেয়ে জয়-পুতুল তখন খুবই ছোট। এক বিকালে ওদের বাড়ি গেলে পুতুল বলেছিল, ‘Mama, Mama, Are you coming or going?’ যা কোনো দিন ভুলিনি। পুতুলের মতো যদি আমার কোনো শিক্ষক থাকত, যার কথা হৃদয়ঙ্গম করতে পারলে সারা দুনিয়ার আলো আমার চোখে ভেসে থাকত। এখন আবার এক পুতুল পেয়েছি। প্রতি পদে পদে ভুল ধরে। অধিকাংশ ইংরেজি শুদ্ধ করে। সে হচ্ছে আমার বুকের ধন, জিয়নকাঠি কুশিমণি। তার সামনে কোনো ভুল উচ্চারণের উপায় নেই। যা বলবে শুদ্ধ বলবে, কোনো ভুলভাল চলবে না।

 

 

দিল্লিতে রেহানা খুব বেশি দিন থাকেনি। সে সময় রেহানার আজকের এমন দিন ছিল না। সেটা ছিল অনেক কষ্টের দিন। লন্ডনে দোকানে কাজ করে চলেছে। খোকা কাক্কা সে সময় খুব সহযোগিতা করেছেন। কত মানুষ গা বাঁচিয়ে চলেছে, কথা পর্যন্ত বলেনি। এখন তারা ঘনিষ্ঠ সুহৃদ হওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করে— এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু রেহানার অভাবনীয় সহমর্মিতা মেধা আমায় দারুণ মুগ্ধ করে। ছোটবেলা থেকেই ওকে চিনি, জননেত্রীকেও। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৬ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় উন্মাদের মতো ধানমন্ডির ৩২শে যাই। সেখানে মা-ভাই-বোনদের না পেয়ে ১৯ নম্বরে গিয়েছিলাম। যে ভদ্রলোক পাগলের মতো পথ দেখিয়ে নিয়ে গিয়েছিল, ১৯ নম্বর রোডের বাড়ির গেটে যেতেই পাকিস্তান হানাদাররা গুলি চালিয়েছিল। তাতে সে সেখানেই নিহত হয়। আমি ছিলাম এক গাড়ি পেছনে। আমার গাড়িতেও গুলি লাগে। একটি ইঞ্জিনে, অন্যটি মাথার উপরে ডান পাশের দরজায়। কেন গুলি লেগে সেদিন মারা যাইনি সে আল্লাহ রাব্বুল আলামিনই জানেন। পাকিস্তানিরা আত্মসমর্পণ করেছে অনেক চেষ্টা করেও এটা বোঝাতে না পেরে ভারতীয় এক কর্নেল এবং দুই মেজরের জিম্মায় গাড়িগুড়ি ফেলে গভীর রাতে টাঙ্গাইল ফিরেছিলাম। পরদিন আবার গিয়েছিলাম ঢাকায়। ততক্ষণে ভারতীয় বাহিনী অনেক চেষ্টাচরিত করে বঙ্গবন্ধুর পরিবার-পরিজনকে হানাদার কবলমুক্ত করেছিল। আমি প্রথম ১৯ নম্বর বাড়িতে যাই ১৮ ডিসেম্বর দুপুর আড়াই-তিনটায়। দিনটি ছিল শনিবার। কাদেরিয়া বাহিনীর উদ্যোগে পল্টনে প্রথম জনসভা। সভায় যাওয়ার আগে বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছাকে সালাম করে দোয়া নিতে গিয়েছিলাম। সেদিন বঙ্গমাতা দোয়া করে জামালকে সঙ্গে দিয়েছিলেন। পল্টনে আড়াই-তিন লাখ লোক হয়েছিল। এরপর কত দিন কতবার গেছি ধানমন্ডির ৩২-এর বাড়ি, কত কিছু খেয়েছি। সুখ-দুঃখের সাক্ষী সেই বাড়ি। কিন্তু হঠাৎই আসমান ভেঙে পড়ে। আমাদের সবাইকে অথৈ সাগরে ভাসিয়ে বঙ্গবন্ধু চলে যান। প্রধানমন্ত্রী, মায়ের মতো বোন শেখ হাসিনা আর ছোট বোন রেহানা ছেলেমেয়ে নিয়ে দুলাভাই ড. ওয়াজেদ মিয়ার সঙ্গে জার্মানি ছিলেন বলে বেঁচে যান। অনেক কষ্ট করে সেখান থেকে দিল্লিতে এসে পান্ডারা রোডের বাড়িতে ওঠেন। সেখান থেকে একদিন রেহানা চলে যায় লন্ডনে। সেখানে রাত-দিন কষ্ট করে। আমার বোন শুশুমার মতো সে সময় তার বিয়ের পাত্র পাওয়া যাচ্ছিল না। স্বাধীনতার পর বয়স না হলেও আমার বোনের জন্য পাত্রের কত ছড়াছড়ি। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর দেখা দিয়েছিল পাত্রের মহা আকাল। রেহানার জন্যও তখন ঠিক তেমনি। এরই এক ফাঁকে শফিক সিদ্দিকীর সঙ্গে রেহানার বিয়ে হয়। আপা আমাকে পত্র দিয়ে জানিয়েছিলেন। বিয়েতে তিনি যেতে পেরেছিলেন কিনা এখন আর মনে করতে পারছি না। তখন আমাদের সবার ছিল খুবই দুর্দিন। শফিক সিদ্দিকীকে সেই ছোটবেলা থেকে চিনি। আমাদের বাড়ির পাশেই তাদের বাড়ি। তার বাবা টাঙ্গাইলে ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। সব ভাইয়েরা আমাদের বাড়িতে যাতায়াত করত। তাদের বাড়িতে এক এলসেশিয়ান কুকুর ছিল। যার গলার আওয়াজ কয়েক মাইল দূর থেকে শোনা যেত। আস্তে আস্তে দিন গড়াতে থাকে। ববির জন্ম হয়। রেহানা লন্ডন থেকে কার্ড পাঠায় যা আজও আমার কাছে আছে। তারপর টিউলিপ, তারও কার্ড পাই। রেহানার সব থেকে প্রিয় ছোট মেয়ে রূপন্তী। এখন রেহানার সব কিছুর দেখাশোনা খোঁজখবর সে-ই নাকি করে।

গত বছর দিল্লি থেকে ফেরার পথে বিমানে রেহানার সঙ্গে দেখা। রেহানা বসেছিল একেবারে সামনে, আমি চার-পাঁচ সিট পেছনে। হঠাৎ ববি এসে সালাম দিয়ে বলল, ‘মামা, কেমন আছেন? মা পাঠিয়ে দিলেন। বললেন, গিয়ে দেখ তোর মামা ভাগ্নেকে চিনে কিনা।’ ওর ১০-১৫ মিনিট আগে একেবারে শেষ প্যাসেঞ্জার হিসেবে রেহানাকে উঠতে দেখেছিলাম। প্লেন কিছুক্ষণ উড়তেই রেহানা এসেছিল আমার কাছে। কতদিন রহিমা-শুশুমাকে দেখি না। ওরা একজন থাকে কানাডা, অন্যজন ইরানে। মনে হচ্ছিল রহিমা-শুশুমাই যেন পাশে বসেছে। বাড়ির খবরাখবর জিজ্ঞাসা করছিল। পাঁচ-সাতবার বলেছিল, ‘ভাই, আমাদের ভুলে যাবেন না। পানি কাটলে কি ভাগ হয়? আপনার জায়গা আমাদের বুকের ভিতর। যত কিছুই হোক এটা কেউ কেড়ে নিতে পারবে না।’

জীবনের শুরুতে কোথায় যেন শুনেছিলাম, ‘কথাই কর্তৃত্ব করে, কথাই নেতৃত্ব করে।’ সেদিন আকাশে রেহানার কথাগুলো তেমনই শক্তিশালী মনে হয়েছিল। জেড এয়ার সেদিন কয়েক মিনিট আগেই ঢাকায় অবতরণ করেছিল। যেহেতু পেছনে ছিলাম, হুড়োহুড়ি করে নামিনি, তাই বহু যাত্রীর পর নেমে দেখি নাতি-পুতি, ছেলে, ছেলের বউ নিয়ে সিঁড়ির গোড়ায় রেহানা দাঁড়িয়ে আছে। সে আমায় নিয়ে ভিআইপি লাউঞ্জে যায়। পাশাপাশি বসে অনেক কথা জিজ্ঞাসা করে। একসময় বলেছিলাম, এমনি তো মোটামুটি আছি। ছেলেমেয়ে বড় হয়েছে। কেউ বিয়ে করছে না। ব্যাপারটা নিয়ে কিছুটা অস্বস্তিতে আছি। বলতে গেলে একেবারে মায়ের মতো রেহানা বলেছিল, ‘ভাই, কোনো চিন্তা করবেন না। এই যে ববি-টিউলিপ ওদের নিয়ে কত চিন্তায় ছিলাম। আল্লাহর রহমতে ওদের বিয়ে হয়ে গেছে। নিজেরাই ছেলেমেয়ে পছন্দ করেছে। ববির বউকে নামাজ-কালাম শিখিয়েছি। একবার মক্কা-মদিনা ঘুরিয়ে আনতে পারলেই আমার কর্তব্য শেষ। টিউলিপের বরকে ডেকে বলেছিলাম, আমরা মুসলমান। তুমি যদি আমার ধর্ম গ্রহণ করতে পার তাহলে কোনো আপত্তি নেই। ছেলে তা-ই করেছে। মেয়ের বিয়ে হয়েছে। আপনি চিন্তা করবেন না। দেখবেন আল্লাহ আপনার ছেলেমেয়েদেরও নিশ্চয়ই ভালো গতি করবেন।’ সেদিন ওর সঙ্গে বিমানবন্দরে বেশি সময় দিতে পারিনি। নারায়ণগঞ্জে এক বধ্যভূমিতে গিয়েছিলাম। আগে থেকেই ঠিক ছিল। জিনিসপত্র এসে গেলে চলে আসছিলাম, রেহানা বলেছিল, ‘ভাই, দোয়া করে গেলেন না?’ থমকে গিয়ে মাথায় হাত দিয়ে দয়াময় আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেছিলাম তিনি যেন তাদের দুই বোনসহ পরিবারের সবাইকে হেফাজত করেন। কিছু দিন পর পিতার বাড়ি ধানমন্ডিতে রেহানার সঙ্গে আবার দেখা। সেদিন নাসরীন সঙ্গে ছিল। গিয়ে দেখি, একদল এসএসএফ তাকে ঘিরে। আমরা যাওয়ার পর তারা চলে যায়। অনেক কথাবার্তা হয়। আমার বউকে পেয়ে সে খুবই খুশি হয়। তার সেদিনের সে আন্তরিকতা, সহমর্মিতা এবং আত্মভোলা ভাব আমায় নাড়া দিয়েছিল। মাঝেমধ্যেই ওর সঙ্গে কথা হয়। কখনো কখনো যে মানুষের হৃদয়ের খোরাকের প্রয়োজন হয় রেহানার সঙ্গে কথা বলে সেটা আমার পূরণ হয়। দোষে-গুণে মানুষ। যেটা আমাদের সবারই আছে। ছেলেবেলা থেকেই মানুষের দোষ না ধরে গুণ বিচার করার চেষ্টা করেছি, এখনো করি।

টিউলিপ নির্বাচনে জয়ী হলে অভিনন্দন জানিয়েছিলাম। পেয়েছিল কিনা জানি না। কারণ জবাব পাইনি। হঠাৎই এক রাতে ফোন বেজে ওঠে। সাধারণত রাতে তেমন একটা ফোন ধরি না। কিন্তু ফোনে চোখ পড়তেই দেখি রেহানা। ‘হ্যালো’র জবাবে সালাম দিয়ে বলেছিল, ‘ভাই, অসময়ে ঘুম ভাঙালাম না তো? আপনার ভাগিনী যাকে কোলে-কাঁখে নিয়েছেন সে আজ আপনাদের মুখ উজ্জ্বল করেছে। তাই ভাবলাম খবরটা আপনাকে দিলে খুশি হবেন। তাই ফোন করলাম।’ সত্যিই আমি সেদিন খুবই খুশি হয়েছিলাম। ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ীর বেশে নিয়াজীকে আত্মসমর্পণ করিয়ে যেমন খুশি হয়েছিলাম, ১৮ ডিসেম্বর বঙ্গমাতার দোয়া নিয়ে যেমনি হয়েছিলাম, সর্বোপরি হানাদারদের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে পিতা ও নেতা দেশে ফিরলে তার সান্নিধ্য পেয়ে যেমনটা হয়েছিলাম, ভাগিনী টিউলিপের ব্রিটেনের পার্লামেন্টে বিজয়ী হওয়ার খবর রেহানার মুখে শুনে ততধিক খুশি হয়েছিলাম। সেই বিজয়ী টিউলিপ প্রথম তার জননীর মাতৃভূমি, পিতৃভূমিতে এসেছে। কী দিয়ে তাকে বরণ করব? সেই বরণডালা সাজানোর সাধ্য আমার কোথায়? আমরা পুরুষের তরবারির জয় দেখেছি, বীরগাথা গেয়েছি, নারীর জয়, জয়গাথা গাওয়ার সুযোগ তেমন খুব একটা পাইনি। টিউলিপের জয় তাই আমার কাছে বাঙালি জাতির ভবিষ্যতের শ্রেষ্ঠ জয়ের ইঙ্গিত। জয়তু টিউলিপ, টিউলিপ দীর্ঘজীবী হও, সফল হও, বিশ্বমানবতার কল্যাণে বিশ্বশান্তির অগ্রদূত হও। আমরা তোমায় অশান্ত দুনিয়ায় শান্তির দূত হিসেবে উৎসর্গ করলাম— আমিন।

লেখক : রাজনীতিক

সর্বশেষ খবর