রবিবার, ৩ জানুয়ারি, ২০১৬ ০০:০০ টা

হোয়াইট হাউস একজন আব্রাহাম লিংকন চায়

তুষার কণা খোন্দকার

হোয়াইট হাউস একজন আব্রাহাম লিংকন চায়

২০১৭ সালের নভেম্বর মাসে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচন। আমেরিকার ফেডারেল ইলেকশন কমিশনে এ পর্যন্ত ১৪৩৬ জন প্রার্থী প্রেসিডেন্ট পদে তাদের প্রার্থিতা ঘোষণা করেছেন। আগামী নভেম্বরের আগেই প্রেসিডেন্ট পদের দৌড়ে ১৪৩৪ জন ঝরে গিয়ে শেষ পর্যন্ত টিকে থাকবেন দুজন প্রার্থী। তাদের একজন রিপাবলিক্যান, আরেকজন ডেমোক্র্যাট।  এ দুজনের বাইরে আরও দুই একজন প্রার্থী কাগজে-কলমে টিকে থাকার চেষ্টা করলেও তাদের দিকে কেউ চোখ তুলে চেয়ে দেখবে না, কারণ আমেরিকার নির্বাচনে তাদের কোনো গুরুত্ব নেই।

আগামী নভেম্বরের নির্বাচনে যিনি জিতবেন তিনি একটি আতঙ্কিত আমেরিকা এবং রক্তাক্ত দুনিয়ার ভার কাঁধে নিয়ে হোয়াইট হাউসে পা রাখবেন। কে আসবেন এবার হোয়াইট হাউসে, ডেমোক্র্যাট নাকি রিপাবলিক্যান? ডেমোক্র্যাট প্রেসিডেন্ট ক্ষমতায় এলে কি দুনিয়ায় শান্তি ফিরে আসবে? নাকি রিপাবলিক্যান প্রার্থী ভোটে জিতলে দুনিয়ায় অশান্তির আগুন আরও বেগে জ্বলে উঠবে? ডেমোক্র্যাট কিংবা রিপাবলিক্যান পার্টি ক্ষমতায় থাকার কারণে দুনিয়ায় আমেরিকার ভূমিকার কখনো কি কোনো হেরফের ঘটেছে? আমি এ দুই দলের নীতির মধ্যে কোনো ফারাক পাই না। বিশেষ করে ডেমোক্র্যাট ওবামার আমেরিকা শাসন দেখার পরে আমার মনে হয়, হোয়াইট হাউসের অধিকর্তা ডেমোক্র্যাট কিংবা রিপাবলিকান যে-ই হোন না কেন তাতে দুনিয়ায় শান্তি প্রতিষ্ঠার কোনো সুযোগ সৃষ্টি হবে না। দুনিয়াজুড়ে রক্তপাত বন্ধ করতে হলে একজন সত্ মানুষকে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হতে হবে। হোয়াইট হাউস আব্রাহাম লিংকনের মতো একজন সাহসী প্রেসিডেন্ট চায়, যে মানুষ দুনিয়ায় রক্তপাত দেখতে চায় না।

জর্জ ওয়াশিংটন ১৭৮৯ সালে আমেরিকার প্রথম প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। জর্জ ওয়াশিংটনের কোনো পার্টি পরিচয় ছিল না। জন অ্যাডামস ১৭৯৭ সালে প্রথম ফেডারেল পার্টির পরিচয় নিয়ে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হলেন। এরপর আমেরিকার রাজনীতিতে দলীয় বিভাজন পুরোপুরি স্পষ্ট হতে অনেক বছর পার হয়ে গেছে। ডেমোক্র্যাট এবং রিপাবলিক্যান এ দুটি রাজনৈতিক দল আলাদা পরিচয় নিয়ে দাঁড়িয়ে যাওয়ার পরে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট পদ প্রায় তিন দশক ডেমোক্র্যাটদের দখলে ছিল। এরপর বেশির ভাগ সময় রিপাবলিক্যানরাই হোয়াইট হাউস দখলে রেখেছে। ১৮৬১ সালের এপ্রিলে রিপাবলিক্যান পার্টির নেতা আব্রাহাম লিংকন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হলেন। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট এ পরিচয়ের মধ্যে আব্রাহাম লিংকনকে বেঁধে রাখলে তার এক জীবনের বিশাল অর্জনকে ছোট করে দেখা হয়। সংবিধানের ১৩তম সংশোধনীর মাধ্যমে আমেরিকার দাসদের তিনি যেমন মুক্ত করেছিলেন সেই সঙ্গে আমেরিকার রক্তাক্ত গৃহযুদ্ধেরও তিনিই অবসান ঘটিয়েছিলেন। রিপাবলিক্যান আব্রাহাম লিংকন একজন মহাপুরুষ। আমেরিকার রাজনীতিতে রিপাবলিক্যান পার্টির ভূমিকা মাথায় রেখেই এ পার্টিকে গ্রান্ড ওল্ড পার্টি (ঙেচ) বলা হয়ে থাকে। ভেবে দেখুন, ঐতিহ্যবাহী গ্রান্ড ওল্ড পার্টি অর্থাত্ রিপাবলিক্যান পার্টির উত্তরাধিকার এখন কাদের হাতে। এ দলের নেতা জর্জ ডব্লিউ বুশ দুই মেয়াদে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে নিজের দেশ আমেরিকা এবং সেই সঙ্গে সারা দুনিয়াকে সীমাহীন সংকট উপহার দিয়ে ২০০৯ সালের জানুয়ারি মাসে হোয়াইট হাউসের পেছন দরজা দিয়ে বিদায়  হলেন। আগামী বছর নভেম্বর মাসে হোয়াইট হাউসের সিংহ দরজা দিয়ে কে ঢুকবেন আমরা জানি না, তবে নির্বাচনের দৌড়ে যাদের দেখছি তাদের কারও চোখের দিকে চেয়ে আশার আলো দেখতে পাচ্ছি না।

আজকের দিনে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের এক বছর আগে থেকেই দুনিয়াজুড়ে সাজসাজ রব পড়ে যায়। আমেরিকার ফেডারেল নির্বাচন কমিশনে নির্বাচনের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হওয়ার এক বছর আগেই দেশের বড় দুই দল ডেমোক্র্যাটিক এবং রিপাবলিক্যান পার্টির নিজেদের দলের জন্য প্রার্থী মনোনয়নের তোড়জোড় শুরু হয়ে যায়। ডেমোক্র্যাট এবং রিপাবলিক্যান উভয় দলের মনোনয়ন প্রত্যাশীরা নির্বাচনী প্রচারণা অফিস খুলে নিজ নিজ যোগ্যতার পক্ষে প্রচার শুরু করেন। দলীয় মনোনয়নের সময় নিজ দলের মনোনয়ন প্রত্যাশীরা এ সময়ে বিপক্ষ দলকে খুব বেশি আক্রমণ করেন না। প্রেসিডেন্ট পদে নিজের মনোনয়ন নিশ্চিত করার মতলবে তারা নিজ দলের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের ঘায়েল করার ধান্ধায় ব্যস্ত থাকেন। ২০০৮ সালের কথা স্মরণ করে দেখুন। হিলারি ক্লিনটন সেবার বারাক ওবামার শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে ডেমোক্র্যাট শিবিরে ঝড় তুলেছিলেন। প্রচার-প্রচারণার সময় হিলারি নিজের যোগ্যতাকে বড় করে দেখিয়ে ডেমোক্র্যাট কাউন্সিলরদের কাছে ভোট চাইলে কারও কিছু বলার ছিল না। তিনি সেটা না করে বোকার মতো প্রতিদ্বন্দ্বী ওবামার নামে নিন্দা কটুকাটব্যের বন্যা বইয়ে দিয়েছিলেন। একবার তিনি বলেছিলেন, ওবামা আফ্রিকান আমেরিকান। ওবামার বাবা সিনিয়র ওবামা কেনিয়ার মানুষ। কাজেই ওবামাকে আমেরিকার প্রতি অনুগত বলে বিশ্বাস করা যায় না। তার নির্বাচনী প্রচারণা টিম এমন কথাও বলেছিল, ওবামার জন্ম আমেরিকায় নয়, কেনিয়ায়। তাদের দাবি ছিল, ওবামার আমেরিকান জন্মসনদ নকল। এমন উদ্ভট প্রচারের নাটের গুরু ছিলেন আজকের রিপাবলিক্যান দলের নাটুকে প্রার্থী ডোনাল্ট ট্রাম্প। ক্লিন্টন দম্পতির ঘনিষ্ঠ বন্ধু হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্প ওবামার বিরুদ্ধে উদ্ভট মিথ্যা প্রচারের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। প্রসঙ্গত বলে রাখি, আমেরিকার সংবিধান অনুযায়ী আমেরিকার প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হলে তাকে জন্মসূত্রে আমেরিকার নাগরিক হতে হয়। ওবামা জন্মসূত্রে মার্কিন নাগরিক নয় এমন প্রচার হালে পানি না পাওয়ায় হিলারি শিবির আরও নোংরা অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিল। হিলারি শিবির বলেছিল, বারাক হোসেন ওবামা একজন মুসলমান।

বারাক হোসেন ওবামা মুসলমান, হিলারি শিবিরের এমন নোংরা প্রচার শুনে আমি আহত হয়েছিলাম। ভেবেছিলাম, আমেরিকানরা নিজ দেশের মাটিতে নিশ্চয়ই সাম্প্রদায়িক ভাবনাকে প্রশ্রয় দেবে না। আমেরিকানরা তাদের দেশের অসাম্প্রদায়িক ভাবমূর্তির প্রশ্নে এতখানি সচেতন যে, তারা নাগরিকদের তথ্যভাণ্ডারে কারও ধর্মীয় পরিচয় উল্লেখ করে না। তার অর্থ রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে নাগরিকের নাগরিক অধিকার রাষ্ট্রের আইনে নির্ধারণ হয়ে থাকে। এতে কারও ধর্ম পরিচয়ের কোনো গুরুত্ব নেই। আমেরিকা নিজেদের দেশ থেকে দূরে গিয়ে কার সঙ্গে কী আচরণ করছে সেটি ভিন্ন বিচার্য বিষয়। আমেরিকার সংবিধান অনুযায়ী একজন প্রেসিডেন্ট প্রার্থীকে জন্মসূত্রে আমেরিকার নাগরিক হতে হয়; কিন্তু তাই বলে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হওয়ার জন্য কারও ধর্মীয় পরিচয়ের কোনো আইনগত বাধ্যবাধকতা নেই। ওবামা হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রিস্টান যে ধর্মের অনুসারী হন না কেন তাতে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতে তার কোনো বাধা ছিল না। ওবামার মুসলমান পরিচয় নিয়ে বিতর্ক উঠতে আমি ভেবেছিলাম, এমন আইনবিরুদ্ধ নোংরা প্রচারকে তিনি সাহসের সঙ্গে মোকাবিলা করবেন। ওবামা বুক ফুলিয়ে বলবেন, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হওয়ার জন্য আমার ধর্মীয় পরিচয় অবান্তর। আমি খ্রিস্টান না মুসলমান এ অবান্তর প্রশ্নের জবাব আমি কাউকে দেব না। কিন্তু ওবামা আমাকে হতাশ করে নিজের খ্রিস্টান পরিচয়ের পক্ষে নির্লজ্জ সাফাই গাইতে শুরু করেছিলেন। কোথায় কোন চার্চে ওবামার সাদা চামড়ার খ্রিস্টান নানা-নানী তাকে ব্যাপটাইজড করিয়ে সহি খ্রিস্টান বানিয়েছেন জনসমক্ষে বারবার সেই জবাবদিহি করে ওবামা নিজেকে নিচে নামিয়েছিলেন। আমার মনে হয়েছিল, ওবামা আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হতে চলেছেন। তিনি তার ধর্মীয় পরিচয়ের মতো তুচ্ছ একটি বিষয় নিয়ে এসে তাকে জবাবদিহি করতে যাচ্ছেন কেন?। ওবামার দুর্বল আচরণ দেখে আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, ওবামা মানুষটি স্বভাবগত আপসকামী। কালো চামড়ার মানুষ হিসেবে হোয়াইট হাউসে জায়গা করে নিয়ে তিনি ইতিহাসের পাতায় তার আসন পাকা করে নিলেন। কিন্তু বুকের মধ্যে অমন একটি বুজদিল নিয়ে তিনি দুনিয়ার ইতিহাসে ভালো কিছু সংযোজন করতে পারবেন না। আমি বিশ্বাস করি, আপসকামী মানুষ দুনিয়ায় বড় কাজ করতে পারে না। আমার অনুমান সঠিক ছিল তার প্রমাণ গত আট বছরে ডেমোক্র্যাট ওবামা অনেক ভালো কথা বলেছেন কিন্তু একটি ভালো কাজও সফলভাবে করতে পারেননি। ওবামার বক্তৃতা শুনে মনে হয়েছে সেগুলো আব্রাহাম লিংকনের গেটিসবার্গ বক্তৃতাকেও হার মানায়। কিন্তু ওবামার রাজনীতি কথামালায় শুরু কথামালায়ই শেষ। এখন দুনিয়াজুড়ে শুধু রক্ত আর রক্ত। আগামী বছর জানুয়ারিতে তিনি রক্তের ওপর পা দিয়ে হোয়াইট হাউস থেকে বেরিয়ে যাবেন।

গত কয়েক দশকের মধ্যে আমেরিকার সফল প্রেসিডেন্ট হিসেবে প্রথম যে নাম উচ্চারিত হয়ে থাকে তিনি ডেমোক্র্যাট নেতা বিল ক্লিনটন। তার সময়ে দুনিয়াজুড়ে যুদ্ধবিগ্রহ মোটামুটি সহনীয় পর্যায়ে ছিল এবং আমেরিকার অর্থনীতি চমত্কার গতি পেয়েছিল। সেই বিবেচনায় বিল ক্লিনটনের ব্যক্তি ইমেজ এবং তার স্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের নিজস্ব রাজনৈতিক ইমেজ এ দুটোকে পুঁজি করে হিলারি ক্লিনটন এবার ডেমোক্র্যাট দলের সম্ভাব্য প্রার্থী। আমেরিকার সার্বিক পরিস্থিতি এবার ডেমোক্র্যাটদের অনুকূলে নেই। সেজন্য বোধ হয় হিলারির প্রতিদ্বন্দ্বীর সংখ্যা মাত্র দুজন। তার কাছের প্রার্থী বার্নি স্যান্ডার্সকে পিছনে ফেলে হিলারি অনেক ভোটে এগিয়ে আছেন। আগামী নির্বাচনের হাওয়া রিপাবলিকানদের অনুকূলে থাকলেও রিপাবলিক্যান কাউন্সিলররা যদি যাচ্ছেতাই দুর্বল কোনো প্রার্থী নির্বাচন করে ফেলে তাহলে নির্বাচনের ফল ডেমোক্র্যাট হিলারির পক্ষে চলে আসার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। আমার মনে হচ্ছে, হিলারি ক্লিনটনের জন্য ঠিক তেমন একটি সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।

ক্লিনটন দম্পতির বন্ধু ডোনাল্ড ট্রাম্প এবার রিপাবলিক্যান দলের প্রেসিডেন্ট মনোনয়ন পাওয়ার জন্য দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছেন। ইতিমধ্যে অন্যান্য রিপাবলিক্যান প্রার্থী টেড ক্রুজ, কালো মানুষ বেন কারসেন কিংবা জর্জ বুশের ছোট ভাই জেব বুশকে পিছনে ফেলে তিনি তরতর করে সামনে এগিয়ে চলেছেন। নির্বাচনী প্রচারণার শুরুতে ট্রাম্পকে খেলো স্বভাবের গুরুত্বহীন মানুষ বলে মনে হয়েছিল। শুরুতে তিনি তার টাকার হাম্বড়ামি নিয়ে মজে ছিলেন। দুনিয়াকে শোনানোর জন্য বারবার বলছিলেন, তিনি সাড়ে বার বিলিয়ন ডলারের মালিক। ট্রাম্পের কথা শুনে মনে হচ্ছিল তিনি টাকা দিয়ে আমেরিকানদের ভোট কিনতে চাচ্ছেন। শুধু টাকার গল্প যথেষ্ট হচ্ছিল না বলে মাঠ তাতিয়ে তোলার আশায় গত কয়েক মাস তিনি মেক্সিকানদের পিছনে হায়েনার মতো লেগে ছিলেন। মেক্সিকানদের বিরুদ্ধে বিষোদগার করে ডোনাল্ড বলছিলেন, মেক্সিকানরা সবাই মাদক ব্যবসায়ী, খুনি এবং ধর্ষক। উনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে আমেরিকায় যত মেক্সিকান অভিবাসী আছে তাদের সবাইকে ঘাড় ধরে আমেরিকা থেকে বের করে দেবেন। তারপর, আমেরিকা এবং মেক্সিকো সীমান্তের মাঝখানে শক্ত ইটের দেয়াল তুলে দেবেন। লোকে এ কথা শুনে হাসাহাসি করেছে। লোকের হাসাহাসিতে ডোনাল্ড ট্রাম্প পিছু হটার বান্দা নন, কারণ তিনি নির্বাচনের মাঠে নামার পরে একের পর এক ফালতু কথা বলে ইতিমধ্যে নিজেকে একজন নির্লজ্জ ভাঁড় প্রমাণ করে বসে আছেন। তার মনে চাইলে তিনি মানুষকে প্রকাশ্যে ‘মোটা শুয়োর’ বলতে দ্বিধা করেন না। একজন মহিলা ইন্টারভিউয়ের সম্পর্কে তার নোংরা মন্তব্য গত সেপ্টেম্বর মাসের পয়লা সপ্তাহে দি ইকোনোমিস্ট পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, এমন অর্ধউন্মাদ একজন প্রার্থীর পালে এখন অনুকূল হাওয়া।

গত নভেম্বর মাসে প্যারিসে মুসলিম সন্ত্রাসীদের সিরিজ বোমা হামলায় ১৩২ জন মানুষের মত্যুর ঘটনাকে পুঁজি করে রিপাবলিক্যান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প তার নির্বাচনী দৌড়ে অনেকখানি এগিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি তার প্রচার-প্রচারণায় বারবার প্যারিসের ঘটনা উল্লেখ করে আমেরিকানদের মধ্যে ভয় ঢুকিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন। প্যারিসের সন্ত্রাসী ঘটনা আমেরিকানদের চোখে গুরুত্বপূর্ণ ছিল তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তারপরও একথা সত্যি, আমেরিকার ভোটারদের চিন্তাভাবনা খোদ আমেরিকাকে ঘিরে ঘুরপাক খায়। খোদ আমেরিকার বুকে এক সন্ত্রাসী মুসলিম দম্পতির আক্রমণে ক্যালিফোর্নিয়ায় ১৪ জন নিরীহ মানুষ মারা যাওয়ার পরে ডোনাল্ড ট্রাম্প হাতে ট্রাম্পকার্ড পেয়ে গেছেন। ডিসেম্বর মাসের ১২ তারিখে জনমত জরিপে দেখা যাচ্ছে, রিপাবলিক্যান দলে তিনি তার কাছের প্রতিদ্বন্দ্বীর চেয়ে ২৬ শতাংশ ভোটে এগিয়ে গেছেন। ক্যালিফোর্নিয়ায় মুসলিম সন্ত্রাসীদের হাতে ১৪ জন মানুষ মারা পড়ায় ট্রাম্প মুসলমানদের প্রতি মারমুখী হয়ে ওঠার সুযোগ পেলেন। ক্যালিফোর্নিয়ার হত্যাকাণ্ডের পরে ট্রাম্প এখন দুনিয়ার সেরা মুসলিমবিদ্বেষী। তিনি বলেছেন, কোনো মুসলমানকে আমেরিকায় প্রবেশের ভিসা দেওয়া উচিত নয়। তার মতে, মুসলমান মাত্রেই সন্ত্রাসী। আমেরিকায় মুসলমানরা তেমন কোনো শক্তিশালী ভোট ব্যাংক নয়। আমেরিকার নাগরিকদের কত শতাংশ মুসলমান সে সম্পর্কে নিশ্চিত কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। আমেরিকার আদম শুমারিতে কোনো মানুষের ধর্মীয় পরিচয়ের তথ্য নেওয়া হয় না। সে কারণে আমেরিকার জনসংখ্যার কত শতাংশ মানুষ কোন ধর্মের অনুসারী সেটা জানা সম্ভব নয়। তবে একটি আনুমানিক তথ্যে দেখা যায় আমেরিকায় ২০ থেকে ৭০ লাখ মুসলমান বাস করে। ট্রাম্প তার দেশের মেক্সিকানদের আমেরিকা থেকে বের করে দেবেন বলে হুঙ্কার দিয়ে রেখেছেন। মুসলমানদের তিনি আমেরিকায় ঢুকতে দেবেন না সে কথাও সাফ জানিয়ে দিয়েছেন। তবে তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে আমেরিকায় বসবাসকারী মুসলমান নাগরিকদের আমেরিকা থেকে তাড়িয়ে দেবেন কিনা এমন সিদ্ধান্ত বিশ্ববাসীকে এখনো জানাননি।

ইসরায়েল এবং সৌদি আরব এ দুটি দেশ আমেরিকার কাছের বন্ধু। আগামী নির্বাচনের আগে কিংবা পরে ডোনাল্ড ট্রাম্প সৌদি আরব গিয়ে বাদশাহর সঙ্গে দেখা-সাক্ষাত্ করতে চাইলে সৌদি বাদশাহ মুখ ফুটে কিছু বলার সাহস পাবেন কিনা সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত নই। তবে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু ঘোষণা দিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্পের মুখের ওপর তার অফিসের দরজা বন্ধ করে দিয়েছেন। ট্রাম্প ডিসেম্বর মাসে ইসরায়েল ভ্রমণের পরিকল্পনা করেছিলেন। প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু ডোনাল্ড ট্রাম্পের মুসলিমবিদ্বেষী দায়িত্বহীন কথার প্রতিবাদ করে বলেছেন, লোকটার আরও সংযত হয়ে কথা বলা উচিত। নেতানিয়াহু এটাও বলেছেন, তিনি ট্রাম্পের মতো সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িক চিন্তার মানুষের সঙ্গে সাক্ষাত্ করবেন না।

ট্রাম্প আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জিতে গেলে তার মতো একজন উন্মাদের আঙ্গুল আমেরিকার পারমাণবিক অস্ত্র ভাণ্ডারের সুইচ টেপার মালিক হবে। বুদ্ধিমান আমেরিকানদের অনেকে আমেরিকাবাসীকে কথাটা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেছেন, ডোনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকার কমান্ডার ইন চিফ পদের জন্য যোগ্য কিনা সেটা আমেরিকাবাসীকে দ্বিতীয়বার ভেবে দেখতে হবে। নিজের দেশ আমেরিকা সম্পর্কে ডোনাল্ড ট্রাম্পের নিজের উক্তিও ভেবে দেখুন, ‘আমেরিকা দেশটা এখন নরকের গুহা। আমরা দ্রুত নিচে নেমে যাচ্ছি। আমরা কোনো কাজ সঠিকভাবে করতে পারি না। আমরা দুনিয়ার চোখে হাসির পাত্র। আমেরিকার স্বপ্ন এখন মৃত।’

আমি ট্রাম্পের সঙ্গে একমত। গত কয়েক দশক ধরে আমেরিকা কোনো কাজই সঠিকভাবে করতে পারেনি। সব ঝোল নিজেদের পাতে টানতে গিয়ে তারা বাটির ঝোল পাতে না ঢেলে বরং নিজেদের গায়ে মেখে নিয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে আরব বসন্তের পরিণাম বিবেচনা করুন। বিশেষ করে সিরিয়ার দিকে চেয়ে দেখে বলুন, আমেরিকা কি দুনিয়ার চোখে হাসির পাত্র নয়? বাশার আল আসাদকে গদি থেকে ফেলে দেবে নিয়তে আমেরিকা সিরিয়ায় বোমাবৃষ্টি শুরু করেছিল। এখন সেই আমেরিকা রাশিয়ার সঙ্গে মিলে বাশারের গদি বাঁচানোর জন্য আইসিসবিরোধী যুদ্ধে শামিল হয়েছে। আল কায়েদা ভূত ঘায়েল হওয়ার পরে আইসিস দানব এখন দুনিয়াকে গিলে খাওয়ার উপক্রম করেছে। সব মিলিয়ে আমেরিকা ঘরে-বাইরে সবখানে নাস্তানাবুদ। আমেরিকা নিজেদের মন মর্জিমাফিক সব সমস্যার সমাধান করতে গিয়ে দুনিয়াজোড়া সমস্যার পাহাড় সৃষ্টি করে বসে আছে। আমেরিকার তৈরি সমস্যার পাহাড় সরানোর জন্য ট্রাম্প কী উপায় ঠাওর করেছেন? তিনি কি ভেবেছেন, মুসলমানদের আমেরিকা প্রবেশের ভিসা বন্ধ করে দিলে আমেরিকা দেশটি নরকের গুহা থেকে স্বর্গের উদ্যানে রূপান্তরিত হবে? মেক্সিকানদের মারধর করে তাড়িয়ে দিলে আমেরিকা ড্রাগ কিংবা অপরাধ থেকে মুক্ত হয়ে তরতর করে উন্নতির শিখরে উঠে যাবে?

আগামী নির্বাচনে হিলারি কিংবা ট্রাম্প যিনিই জেতেন না কেন তাদের দুজনের হাত দিয়ে আমেরিকার নিজের কিংবা বাকি দুনিয়ায় ভালো কিছু ঘটার সম্ভাবনা নেই। আমেরিকা অনেক বছর ধরে দুনিয়ায় নরক গুলজার করেছে। এ নরকের আগুন নেভানোর সাধ্য হিলারি, ট্রাম্প কিংবা টেড ক্রুজ কারোরই নেই। বারাক ওবামার আপসকামিতার কারণে দুনিয়াবাসী তপ্ত তাওয়ায় ভাজা হচ্ছিল। ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হলে দুনিয়া জ্বলন্ত চুল্লিতে পড়বে। হিলারি ক্লিনটন নির্বাচিত হলে পরিস্থিতির ইতর বিশেষ ঘটবে না। পৃথিবীজুড়ে যেভাবে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়েছে তাতে নতুন নতুন দেশ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে অবাক হওয়ার কিছু নেই। ডোনাল্ড ট্রাম্প একটি কথা সত্য বলেছেন, ‘আমেরিকা ক্রমাগত নিচের দিকে নামছে’। আমি বিশ্বাস করি, আমেরিকা যদি যুদ্ধের মধ্যে ঐশ্বর্য খুঁজে মরে তাহলে আগামী এক দশকে দেশটি নরকের তলায় পৌঁছে যাবে। যুদ্ধের পথ থেকে সরে শান্তির পথে আসতে পারলে আমেরিকা নিজে বাঁচবে। সেই সঙ্গে তাদের মিত্র ইউরোপ বেঁচে থাকার পথ খুঁজে পাবে।  দুনিয়াকে যুদ্ধের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য অদূরদর্শী হিলারি কিংবা দায়িত্বজ্ঞানহীন ডোনাল্ড ট্রাম্প নয়, শক্তির ভর কেন্দ্র হোয়াইট হাউসে এখন একজন আব্রাহাম লিংকনের উপস্থিতি খুব জরুরি হয়ে পড়েছে।

     লেখক : কথাসাহিত্যিক।

সর্বশেষ খবর