বৃহস্পতিবার, ২৮ জানুয়ারি, ২০১৬ ০০:০০ টা

এই দেশে অস্তাচলে সূর্য সন্তানরা

সুলতানা মোসতাফা

একটি  জাতিকে চিরতরে পরমুখাপেক্ষী করে রাখার অন্যতম হাতিয়ারটি হচ্ছে সে দেশে বুদ্ধিজীবী তৈরির পথ রুদ্ধ করে দেওয়া। বাংলাদেশে কি শুরু হয়েছে এ পন্থাটি? পৃথিবী বিস্ময়ের সঙ্গে অবলোকন করছে কেবল শিক্ষক নয়, সাধারণ দেশবাসী যাদের সমাজে ‘ক্রিম’ মনে করে সেই চিকিৎসক, প্রকৌশলী এবং গবেষকরাও আজ মর্যাদার দিক থেকে শীর্ষস্থানীয় নন। মর্যাদা অবনমনের কারণে মেধাবীরা যদি ভবিষ্যতে এসব পেশায় আর না যায় তবে কি এ দেশে মৃত্যুর মহোৎসব শুরু হবে? স্থাপনা ভেঙে পড়বে? খাদ্য সংকট তীব্রতর হবে? নাকি এসব ক্ষেত্রে বিদেশ থেকে দক্ষ জনবল আমদানি করা হবে এবং তাদের বেতন ও সম্মানী বাবদ জাতীয় আয়ের একটি বড় অংশ আবারও দেশের বাইরে পাচার করা হবে অনুন্নত অনেক দেশের মতোই। আঁন্দ্রে গুণ্ডার ফ্রাঙ্কের সেই ‘মেট্রোপলিট-স্যাটেলাইটের’ শোষণের গ্রন্থি নতুন করে ফাঁস পরাবে এ স্বাধীন, মধ্য আয়ের দেশে প্রায় উন্নীত এ প্রিয় ভূমিকে? (ফ্রাঙ্ক বর্ণনা করেছেন এ গ্রন্থির ফলে এলিটদের মাধ্যমে কীভাবে তৃতীয় বিশ্বের সম্পদ উন্নত বিশ্বে পাচার করা হয়।)

আর শিক্ষকদের, বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কথা না হয় বাদই দিলাম। কারণ তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তারা ‘ফাঁকিবাজ’, সারা সপ্তাহে দুই-তিনটা ক্লাস নেন, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়ে বা অন্যত্র কনসালট্যান্ট হিসেবে অবারিত উপার্জন করেন, তারা যোগদানের ১২ বছরের মধ্যে প্রফেসর হন। এ শিক্ষকরা কী কাজ করেন তার ক্ষুদ্র কিছু অংশ তুলে ধরেছেন অনেক শিক্ষকই। কারণ একটি মাত্র লেখায় এ ব্যাপক বিষয়টি কম পরিসরে তুলে ধরা সম্ভব নয়। এ বর্ণিত কাজের বাইরে শিক্ষকদের আর কী কাজ করতে হয় তার সামান্য না হয় এ লেখায় তুলে ধরি। ক্লাস, পরীক্ষা, খাতা দেখা, ফলাফল প্রস্তুতকরণ, ছাত্রদের মনোগ্রাফ ও প্রজেক্ট তত্ত্বাবধান, সরকারের গুরুত্বপূর্ণ প্রজেক্ট মূল্যায়ন, কোনো প্রকল্পে পরামর্শদান বা গবেষকরূপে সংশ্লিষ্ট থাকা, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের প্রকল্প মূল্যায়ন, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাস তৈরি/রিভিউ, বিভিন্ন জার্নালের সম্পাদনা পরিষদের সদস্য/রিভিউয়ার হিসেবে কর্মরত, বিসিএস পাস করে কর্মক্ষেত্রে নিয়োজিত কর্মকর্তাদের ফাউন্ডেশন ক্লাস গ্রহণ, নিজের গবেষণা— এসবের বাইরে একজন শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে যদি দুই-তিনজন পিএইচডি ফেলো থাকেন, তবে অধিকাংশ শিক্ষককেই তাদের সময় দিতে হয় অফিস সময়ের বাইরে, নিজের বাসায়। বিশেষ করে ছুটির দিনগুলোতেও। এ শীতের ছুটি আমরা কীভাবে অতিবাহিত করেছি? প্রায় প্রতিদিন সকাল এবং বিকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত এ গবেষকদের তত্ত্বাবধানে, তাদের সাহচর্যে। কারণ তাদের নির্ধারিত শিক্ষা-ছুটি শেষ হয়ে যাচ্ছে কিংবা এ ডিগ্রিটি হলে পরবর্তী প্রমোশনটি যেন হাতছাড়া না হয়ে যায় সেই সময়টি নিশ্চিত করার জন্য। এ গবেষকদের মধ্যে চিকিত্সক, পুলিশ কর্মকর্তা এবং আমলাও রয়েছেন। আরও একটি কাজ করেছি এ ছুটির মধ্যে। দেশবাসী কি জানেন এখন পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণ অফিসের পরীক্ষাসংক্রান্ত যাবতীয় কাজও শিক্ষকদেরই করতে হয়। প্রশ্নপত্র তৈরি, কম্পোজ, ছাপানো, সংরক্ষণ, পরীক্ষক ও বহিঃপরীক্ষকদের কাছে উত্তরপত্র প্রেরণ ও গ্রহণ এবং তার সংরক্ষণও শিক্ষকদেরই করতে হয়। সকাল থেকে বিরতিহীনভাবে রাত পর্যন্ত প্রশ্নপত্র ছাপানোর কাজে ন্যূনতম সম্মানী তো দূরে থাক এক কাপ চায়ের খরচটিও নিজেকেই বহন করতে হয় নিজ ব্যবস্থাপনায়। শিক্ষকদের আরও একটি কাজ করতে হয়। বিশ্বব্যাংকের আশীর্বাদপুষ্ট ‘উচ্চশিক্ষার মান উন্নয়ন প্রকল্প’ যেসব বিভাগে রয়েছে সেখানে প্রবীণতম শিক্ষকদেরও প্রায় বাধ্যতামূলকভাবে তাদের ‘রিসার্চ ক্যাপাবিলিটি’ বৃদ্ধি বা উন্নয়নের জন্য মাঝে মাঝেই অপেক্ষাকৃত তরুণ শিক্ষকদের কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নিতে হয় সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত। এখন শিক্ষকদের ওপর আরেকটি দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে— ‘বিশ্বদ্যািলয়ের নিজস্ব আয় বৃদ্ধির মাধ্যমে তাকে স্বাবলম্বী করে তোলা— সান্ধ্যকালীন মাস্টার্স কোর্স’। কোনো কোনো সেমিস্টারে/শিক্ষাবর্ষে একজন শিক্ষার্থীর জন্য সিংহভাগ শিক্ষককে প্রায় বাধ্যতামূলকভাবে ব্যস্ত থাকতে হয় শীতের কনকনে রাতেও। তাহলে কী দাঁড়াল? বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা এখন শিক্ষক-কাম কেরানি কাম পিয়ন কাম প্রহরী কাম মেজবান কাম বণিক কাম শিক্ষার্থী।

এখন আসা যাক শিক্ষকদের প্রফেসর হওয়ার বিষয়ে। এটি স্বয়ংক্রিয় প্রমোশন নয়, প্রতিটি ধাপে নির্দিষ্ট যোগ্যতা/শর্ত পূরণ সাপেক্ষে নতুন নিয়োগ। এ নিয়োগের ক্ষেত্রে বিভাগীয় প্ল্যানিং কমিটি, বাইরের বিশেষজ্ঞ দ্বারা পর্যবেক্ষণ, নিয়োগ/নির্বাচন বোর্ড দ্বারা পুনঃপরীক্ষণের পর সিন্ডিকেট দ্বারা পুনঃপরীক্ষণ ও অনুমোদন প্রয়োজন। একজন শিক্ষককে প্রফেসর পদে পৌঁছানোর জন্য ২১ বছর সময় লাগে নির্দিষ্টসংখ্যক প্রকাশনাসহ। আর পিএইচডি থাকলে ১৩ বছর (প্রকাশনাসহ)। ১২ বছরে প্রফেসর হওয়া একটি দুর্লভ অর্জন, ক্ষুদ্র অংশই এটি অর্জনে সক্ষম হন। আমাকে ১২ বছরে প্রফেসরশিপ অর্জনের জন্য যে কাজগুলো করতে হয়েছে তার অন্যতম হলো চারটি প্রথম শ্রেণিসহ তিন বছরের মধ্যে বিলেতের পিএইচডি, চার বছরের মধ্যে ‘এ’ ক্যাটাগরির আন্তর্জাতিক বিদেশি জার্নালে ১৮টি প্রকাশনা (সেই সময় পর্যন্ত মোট প্রায় সিকি শত, এর মধ্যে ঙীভড়ত্ফ থেকে প্রকাশিত বইয়ে লেখাও রয়েছে, যা ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়, জার্মানির কোলন বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত) একাধিক আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রকল্পে সংশ্লিষ্ট থাকা।

আমি নিশ্চিত, যারাই এ প্রণোদনাটি অর্জন করেছেন তাদের ৯৯ ভাগ শিক্ষককেই ন্যূনতম এ কাজগুলো করতে হয়েছে। এটি প্রকৃতপক্ষেই একটি দুর্লভ প্রণোদনা, যা শিক্ষকদের মেধার বিকাশ, জ্ঞান অর্জন, সৃষ্টি ও তার বিতরণ এবং শিক্ষার্থী ও সহকর্মীদের মধ্যে এ সংক্রান্ত আলোচনায় নিমগ্ন রাখে এবং তাদের দলীয় রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তি থেকে মুক্ত রাখে। হ্যাঁ, প্রশ্ন উঠতে পারে এর ব্যত্যয় কি নেই? আছে এবং তা আছে বাকি ১ ভাগ শিক্ষকের মধ্যে, যারা কোনো না কোনোভাবে দলীয় রাজনীতির আশীর্বাদপুষ্ট। তবে তাদেরও একটি কাঠামোর মধ্য দিয়েই এ ব্যত্যয় ঘটাতে হয়। অনেক ক্ষেত্রে তারা এ নির্ধারিত সংখ্যক প্রকাশনা (নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ৫টি বা ১০টি) ঠিকই করেন, তবে তা প্রথিতযশা আন্তর্জাতিক জার্নালে নয়, কম মানসম্পন্ন দেশীয় জার্নাল বা গ্রন্থে। এ ব্যত্যয় দূরীকরণের প্রধানতম উপায়টি হচ্ছে নিয়োগ এবং প্রমোশনসংক্রান্ত কমিটিগুলোকে বাইরের প্রভাবমুক্ত রাখা, যে দায়িত্বটি রাষ্ট্রকেই নিতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরপেক্ষ, জ্ঞানী ও নির্মোহ শিক্ষকদের সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠিত হতে পারে, যারা সিলেকশন গ্রেডে উন্নীতকরণের মাপকাঠি ও শর্ত নির্ধারণ এবং পূরণের বিষয়টিও দেখবেন। তবে সিলেকশন গ্রেডে যাওয়ার ক্ষেত্রে মেধা, শ্রম ও দায়বদ্ধতা অবশ্যই অপরিহার্য শর্ত হবে। প্রফেসর হওয়ার পর ‘পিয়ার-রিভিউড’ আন্তর্জাতিক প্রকাশনার সংখ্যা, গবেষণা, গবেষণা সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টতা, পিএইচডি ফেলোর তত্ত্বাবধান, শিক্ষার্থীদের পাঠদান ও তাদের প্রয়োজনীয় পুস্তক, জার্নাল, তথ্যাবলি সরবরাহের মাধ্যমে তাদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা, বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের সঙ্গে যোগাযোগ— এসব অবশ্যই মাপকাঠির অন্তর্ভুক্ত হতে হবে।

‘ডেমোগ্রাফিক ডেভিডেন্ট’ বলতে বুঝায় একটি দেশের মোট জনসংখ্যার বৃহত্তম অংশটি তরুণ ও কর্মক্ষম থাকা। প্রতিটি রাষ্ট্রের জীবনে মাত্র একবার এ সুযোগটি আসে এবং তা স্থায়ী হয় ২০-৩০ বছর পর্যন্ত। মালয়েশিয়া একজন সত্ ও বুদ্ধিদীপ্ত রাষ্ট্রনায়কের মাধ্যমে এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে উন্নয়নের শিখরে উপনীত হয়েছে, আর কেনিয়া এ সুযোগটিকে যথাযথভাবে ব্যবহারে ব্যর্থ হওয়ায় আজও তার খেসারত দিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে বাংলাদেশ এ চরম কাঙ্ক্ষিত ‘ডেমোগ্রাফিক ডেভিডেন্ট’ সমৃদ্ধ সময়ে উপনীত হয়েছে। এখন রাষ্ট্রকেই বেছে নিতে হবে তার কর্মপন্থা— এ তরুণ অরুণদের, এ সূর্য সন্তানদের কীভাবে নিয়োজিত রাখবে। মেধাবী কিশোর-তরুণরা মেধার স্বীকৃতি আছে যেসব উন্নত দেশে সেখানে অভিবাসী হতে থাকবে; বুদ্ধিজীবীরা, বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের সেসব শিক্ষক যারা যোগ্যতা ও সুযোগ থাকা সত্ত্বেও শত প্রলোভনকে উপেক্ষা করে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থায়, বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয় এমনকি দেশের প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়েও পাঠদানে সম্পৃক্ত না হয়ে সম্পূর্ণ শ্রম ও মেধাটুকু ব্যয় করেন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য কেবল এ প্রতিষ্ঠানের প্রতি অসীম মমতা ও দায়বদ্ধতার কারণে— তারা পেশাচ্যুত হবেন, শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ আরও সংহত হবে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পরিণত হবে মেধাহীনদের অভয়ারণ্যে, তৈরি হবে মেধাহীন এক প্রজন্ম, মেধাহীন নীতি নির্ধারক, মেধাহীন রাষ্ট্রনায়ক এবং পরমুখাপেক্ষী এক রাষ্ট্র। নাকি এ তরুণ অরুণদের, বুদ্ধিজীবীদের ফেরানো হবে তাদের শিকড়ে, যাদের মেধা, জ্ঞানচর্চা ও বুদ্ধির বিকাশে নিশ্চিত হবে ২০২১-এর রূপরেখার বাস্তবায়ন? বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বর্তমান আন্দোলন বিশ্ববিদ্যালয়ে, রাষ্ট্রে, সমাজে বুদ্ধির জাগরণ নিশ্চিতকরণের জন্য— বেতন বৃদ্ধির জন্য নয়। এ আন্দোলন মর্যাদা বৃদ্ধির দাবিতে নয় বরং হূত মর্যাদা পুনরুদ্ধারের জন্য।

লেখক : সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

ঊ-সধরষ : [email protected]

সর্বশেষ খবর