বৃহস্পতিবার, ২৮ জানুয়ারি, ২০১৬ ০০:০০ টা

অপার সম্ভাবনাময় বাংলাদেশের পর্যটন

সন্তোষ কুমার দেব

পর্যটন এখন একটি শিল্প, যা অনেক দেশের অর্থনীতির একটি মুখ্য উপাদান। ইতিমধ্যে এ শিল্প বিশ্বব্যাপী একটি দ্রুত বিকাশমান খাত হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি ছাড়াও বহুমাত্রিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে পর্যটন বর্তমানে অনেক দেশেরই শীর্ষ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী শিল্পে পরিণত হয়েছে।

মালয়েশিয়া এবং চীন ২০১৫ সালকে তাদের পর্যটন বর্ষ ঘোষণা করছে। তাদের Campaign বা প্রচারণা ছিল বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত। যদিও পর্যটন বিশ্বে আজ এক দ্রুত বর্ধনশীল খাত কিন্তু বাংলাদেশ পর্যটনে তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনে সক্ষম হচ্ছে না। তাই সর্বাগ্রে আমাদের বহির্গামী বাজারসমূহ চিহ্নিত করতে হবে। আমাদের পার্শ্ববর্তী এবং সর্ববৃহত্ প্রতিবেশী দেশ ভারত বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম বহির্গামী পর্যটক উত্পাদনকারী দেশ। ২০১৩ সালে সে দেশের ১৫ মিলিয়ন পর্যটক বিদেশে ভ্রমণ করেছেন। ভারতের সঙ্গে আমাদের একটি বৃহত্ সীমান্ত। তাই আমাদের বাংলাদেশ ভ্রমণ বা Visit Bangladesh Campaign কে সফল করতে হলে ভারতীয় পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে হবে। এ খাতে আমাদের প্রাক্কলিত সম্পদের সিংহভাগ এই বাজারটিতে নিয়োজিত করতে হবে। দ্বিতীয় স্থানে বিশ্বের সর্ববৃহত্ বহির্গামী পর্যটক উৎপাদনকারী দেশ চীন। ২০১৪ সালে এ দেশের ১০৭ মিলিয়ন পর্যটক দেশের বাইরে ভ্রমণ করেছেন। এই ১০৭ মিলিয়ন পর্যটকের ৯০% প্রতিবেশী দেশ এবং এশিয়ার মধ্যে ভ্রমণ করেছেন। বিদেশে ভ্রমণের ক্ষেত্রে বাজেট বা ব্যয় একটি প্রধান বিবেচ্য বিষয়। চীনের কুনমিং থেকে আমাদের কক্সবাজারের আকাশপথের দূরত্ব মাত্র ৫৫ মিনিটের উড্ডয়ন, যা ঢাকা থেকে কক্সবাজারের দূরত্বের প্রায় সমান।

আমাদের তৃতীয় বৃহত্তম বাজারটি হতে পারে বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন দেশে বসবাসরত আমাদের অনাবাসী বাংলাদেশি গোষ্ঠী (NRBs)। এই অনাবাসী বাংলাদেশি গোষ্ঠী বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। এদের বৃহৎ অংশ যুক্তরাজ্যে। তার পরের অংশ রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে। বাকিরা ইউরোপ এবং অস্ট্রেলিয়ায় রয়েছে। এতক্ষণ আমি বাজার চিহ্নিত করলাম। এখন আমাদের বিশ্বমানের ব্যান্ডির কৌশল উন্নয়ন করা খুবই প্রয়োজন। প্রথমত, ভারত বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম Outbound Tourist Generating Country। এটি আমাদের সর্ববৃহৎ Inbound Market। বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন কর্তৃক ২০০৭ সালে প্রকাশিত একটি পরিসংখ্যানে দেখা যায়; ওই বছর বাংলাদেশে সর্বমোট ২ লাখ ৮৯ হাজার ১১০ জন পর্যটকের আগমন ঘটে। এর মধ্যে ৭৯ হাজার পর্যটক আসেন ভারত থেকে। শতকরা হিসাবে যা প্রায় ২৭%। দ্বিতীয় অবস্থানে ৫১ হাজার ৩১৪ জন পর্যটক আসেন যুক্তরাজ্য থেকে। এই ৫১ হাজারের বেশির ভাগই আমাদের বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত। তৃতীয় অবস্থানে যুক্তরাষ্ট্র, যেখান থেকে আসে ৩৫ হাজার ৬৩৮ জন পর্যটক। এখানেও অনাবাসী বাংলাদেশি গোষ্ঠীই বড় অংশ। চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে পাকিস্তান। আগত পর্যটকের সংখ্যা ১২ হাজার ২২৪ জন। পঞ্চম স্থানে ১১ হাজার ৮২৫ জন পর্যটক নিয়ে রয়েছে চীন। পাকিস্তানি পর্যটকের অধিকাংশই বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত বা বাংলাভাষাভাষী। কিন্তু শুধু চীনা পর্যটকদের মধ্যেই কোনো বাংলাদেশি বংশোদ্ভূতের থাকার সম্ভাবনা নেই। এটা প্রমাণ করে চীনারা বাংলাদেশ ভ্রমণে কতটা আগ্রহী। সেই হিউয়েসানের সময় থেকেই বাংলাদেশ চীনাদের কাছে পর্যটন এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের এক আকর্ষণীয় গন্তব্য। এ দেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে হিউয়েসান মন্তব্য করেছিলেন, ‘এ দেশে প্রবেশের অনেক পথ থাকলেও বের হওয়ার কোনো পথ নেই।’ উপর্যুক্ত পরিসংখ্যান থেকে অনুধাবন করা যায়, অন্যান্য দেশের মতোই বাংলাদেশের বাজার সুস্পষ্টভাবে নির্ধারিত। আমাদের প্রধানতম বাজার ভারত। শুধু এই একটি বাজারকে সঠিকভাবে পরিচর্যা এবং ব্যবহার করতে পারলে আমাদের মোট বিদেশি পর্যটকের অর্ধেক এ দেশটি থেকে আসতে পারে।

অন্যান্য পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ভিয়েতনাম : ২০১৩ সালে ভিয়েতনাম ৭৫ লাখ ৭২ হাজার ৩৫২ জন বিদেশি পর্যটক গ্রহণ করেছে। তার মধ্যে চীন থেকে এসেছে ১৯ লাখ ৭ হাজার ৭৯৪ জন। প্রতিবেশী এশিয়ান দেশসমূহ থেকে এসেছে ৬২% পর্যটক। কম্বোডিয়া : ২০১৩ সালে সে দেশে আগত বিদেশি পর্যটকের সংখ্যা ৪২ লাখ ১০ হাজার ১৬৫ জন। যার ৮ লাখ ৫৪ হাজার ১০৪ জন এসেছে ভিয়েতনাম থেকে। ৬৫% পর্যটক এসেছেন প্রতিবেশী এশিয়া থেকে। লাওস : আগত পর্যটকের সংখ্যা ৩৭ হাজার ৭৯ হাজার ৪৯০ জন। শুধু থাইল্যান্ড থেকে এসেছে ২০ লাখ ৫৯ হাজার ৪৩৪ জন। প্রতিবেশী অন্যান্য এশিয়া দেশ থেকে মোট আগত সংখ্যা ৮৮.৫%। এ থেকে বোঝা যায় মানুষ সবসময়ই প্রতিবেশী দেশে বেশি ভ্রমণ করে। এতে যাতায়াত ব্যয় ও সময় দুটোই কম। এবার আসা যাক ভারত আমাদের সর্ববৃহত্ ও বন্ধুপ্রতিম প্রতিবেশী। বিশ্বের ৬০টিরও বেশি দেশকে আগমনী ভিসা দিলেও তা আমরা ভারতকে দিচ্ছি না। সম্ভবত দ্বিপক্ষীয়তাই এখানে প্রধান বাধা। কিন্তু আমি আগেই লিখেছি পর্যটন বিশ্বব্যাপী একক বৃহত্তম বাণিজ্যিক খাত এবং দ্বিতীয় বৃহত্তম কর্মসংস্থানের খাত। সুতরাং দ্বিপক্ষীয়তা এখানে অনেকটাই অচল। আমাদের বিমানবন্দরে যে আগমনী ভিসার সুযোগ রয়েছে, তা সব স্থলবন্দর এবং নৌবন্দরে প্রসারিত করতে হবে। একটি স্মার্ট সফটওয়্যারের মাধ্যমে এসব বন্দরকে সংযুক্ত করতে হবে। বিদেশি পর্যটকদের বাংলাদেশে অবস্থানের বিষয়টি যে বাহিনী পর্যবেক্ষণ করবে তাদের কাছেও এর একটি টার্মিনাল থাকলে ভালো। কোনো পর্যটক বাংলাদেশ তার অবস্থানকাল অতিক্রম করলে তার নামের পাশে একটি বিশেষ সংকেত জ্বলে উঠবে। তাই ২০১৬ সালে মাত্র ১০ লাখ পর্যটক নন, কম করে ২০ লাখ পর্যটক গ্রহণ করার লক্ষ্যমাত্রা স্থির করে এবং তা অর্জনের জন্য সর্বশক্তি নিয়োজিত করা জরুরি। বাংলাদেশের সম্ভাবনাময় পর্যটন শিল্প বহুমুখী সমাধানে নিয়োগ পদক্ষেপ জরুরি। যে সব দেশকে আমরা আগমনী ভিসা দিচ্ছি ঢাকায় অবস্থিত সে সব দেশের দূতাবাসকে আমন্ত্রণ করে একটি জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বাংলাদেশের পর্যটনের সুযোগ-সুবিধার প্রচার করে দেশীয়ও আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিতে হবে, যাতে এটি আন্তর্জাতিক প্রচার মাধ্যমের দৃষ্টি আকর্ষণের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী প্রচারণা চালাতে হবে। ভারতীয়দের জন্য ভিসা সহজীকরণ করা। ভারতীয় সাংবাদিক এবং চীনা সাংবাদিকদের নিয়ে দুটো আলাদা ফ্যামট্রিপ করা যেতে পারে এবং ইমিগ্রেশন কর্মকর্তাদের সঙ্গে মাসে দু-একবার বৈঠক করে তাদের পর্যটকবান্ধব মানসিকতায় উদ্বুদ্ধ করা। সর্বোপরি বাংলাদেশ যে পরিমাণে প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর, তবে প্রচারণার জায়গায় কিছুটা ঘাটতি রয়েছে। বিশ্বব্যাপী আমাদের পর্যটন শিল্পকে তুলে ধরতে হলে  E-Publicity  খুব প্রয়োজন। উপর্যুক্ত পদক্ষেপগুলোর যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমেই বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পের উন্নয়ন এবং ওই খাত বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের এক উল্লেখযোগ্য খাতে পরিণত হতে পারে, যা বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল সহায়ক শক্তি হিসেবে গণ্য হবে।

লেখক : পর্যটক বিশেষজ্ঞ ও সহকারী অধ্যাপক, ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

ই-মেইল : [email protected]

সর্বশেষ খবর