শনিবার, ৩০ জানুয়ারি, ২০১৬ ০০:০০ টা

একটি রাজকীয় আরবি ঘোড়ার আত্মকথা!

গোলাম মাওলা রনি

একটি রাজকীয় আরবি ঘোড়ার আত্মকথা!

আমার বয়স যখন মাত্র ছয় মাস ঠিক তখন হঠাৎ করেই আমার মালিকের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। সিরিয়ার আলেপ্পো নগরীর অদূরে পাহাড়ের পাদদেশে আমি যখন মায়ের সঙ্গে দুষু্বমি করছিলাম তখন সূর্য পশ্চিম দিগন্তে অস্ত যাওয়ার জন্য ইতিউতি করছিল। মরুভূমির উত্তপ্ত পরিবেশে বৈকালিক সূর্যের স্বর্ণালি আভা আমার নরম এবং কচি শরীরের মিচমিচে কালো পশমের ওপর আছড়িয়ে পড়ছিল।  আমার মালিক দূর থেকে সেই দৃশ্য দেখলেন এবং তার অসাধারণ প্রজ্ঞা বলে বুঝতে পারলেন আগামী দিনে আমি অবশ্যই একটি বিশ্ববিখ্যাত যুদ্ধ ঘোড়ায় রূপান্তরিত হব। তিনি হুকুম করলেন আমাকে তার কাছে হাজির করানোর জন্য। আমার বয়স খুব অল্প হওয়া সত্ত্বেও আমি মালিকের ক্ষমতা, পদ-পদবি এবং অবস্থান আন্দাজ করতে পারলাম, মালিকের সামনে গিয়ে আমি প্রথমে একটু মুচকি হাসলাম তারপর কৃতজ্ঞতাস্বরূপ মাথা নুইয়ে ঘাড় ঝাঁকিয়ে চিঁহিঁহিঁ শব্দে ডেকে উঠলাম। আমার মালিক আমার ঘাড়ে হাত রেখে আদর করলেন এবং আমার নাম রাখলেন খালিদ। মালিকের হুকুমে সে রাত থেকেই আমার এবং আমার মায়ের স্থান হলো কেন্দ্রীয় শাহী আস্তাবলের সংরক্ষিত স্থানে।

সম্মানিত পাঠক আমার কথা শুনে মনে মনে ভাবতে পারেন, ঘোড়া আবার মুচকি হাসে কীভাবে। অথবা এ কথাও বলতে পারেন, আমাদের কি খেয়ে দেয়ে কাজ নেই যে, ঘোড়ার বকবকানি শুনতে হবে। প্লিজ! আমার প্রতি দয়া করুন এবং আমার কথাগুলো শুনুন, কথা দিচ্ছি আমি অবশ্যই আপনাদের হতাশ করব না। কারণ দামেস্ক, আলেপ্পো, মসুল, জেরুজালেম, কায়রো, আলেকজান্দ্রিয়া, ত্রিপোলি, মক্কা-মদিনা এবং ইয়েমেনবাসী গত প্রায় নয়শ বছর ধরে আমার দুই পৃথিবী বিখ্যাত মালিকের সঙ্গে আমার নামটিও শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে। আমার মালিকদের নাম শুনলে ইংল্যান্ড, জার্মানি, ফ্রান্স, অস্ট্রিয়া, রোমসহ পুরো ইউরোপের রাজরাজাদের সিংহাসন ফেঁপে উঠত। অন্যদিকে, আমার খুরের আওয়াজ এবং চিত্কার শুনলে যুদ্ধক্ষেত্রের শতসহস্র অশ্বারোহী পিছুটান দিয়ে পালানোর জন্য উদগ্রীব হয়ে পড়ত। আজ আমি আপনাদের বলব কীভাবে আমার মালিক খালিদ নাম দিয়ে ছয় মাসের ঘোড়াকে যুদ্ধজয়ী ঘোড়ায় রূপান্তরিত করেছিলেন এবং কী করে সেই ঘোড়াটি দুজন মহান ব্যক্তিকে ইতিহাসে অমরত্ব পেতে সাহায্য করেছিল। অন্যদিকে আমার মুচকি হাসির বিষয়টি আমি অবশ্যই উল্লেখ করতাম না যদি না আমার জানা থাকত, ঢাকার ঘোড়াগুলো শহরবাসীর কথাবার্তা, চাল-চলন এবং অঙ্গভঙ্গি দেখে হাসি-তামসা করে।

আমার প্রথম মালিকের নাম নুরউদ্দিন জঙ্গী এবং দ্বিতীয় মালিকের নাম সালাউদ্দিন আইয়ুবী। ইউরোপ এবং এশিয়ার সম্মিলিত রাজা-বাদশাহদের নেতৃত্বে পরিচালিত ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধে জয়ী হয়ে তারা সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যকে খ্রিস্টান আগ্রাসন থেকে যেমন রক্ষা করেছিলেন তেমনি পবিত্র জেরুজালেম পুনরুদ্ধারের মাধ্যমে মুসলমানদের মানসম্মান এবং আত্মমর‌্যাদা পুনরুদ্ধার করেছিলেন। আজ আমি আপনাদের সেই কাহিনী শুনাব না— কারণ তাবৎ দুনিয়ার হাজার হাজার নামকরা ঐতিহাসিক ক্রুসেডের ইতিহাস লিখে গেছেন। উইলিয়াম মুর, পিকে হিট্টি, সৈয়দ আমির আলী প্রমুখ মহান ব্যক্তির বর্ণিত ইতিহাস শোনার পর একটি ঘোড়ার মুখের বর্ণিত ইতিহাস যে কারও ভালো লাগবে না তা আমি দিব্যি করে বলে দিতে পারি। সুতরাং মানুষের কাহিনীর ইতিহাস বাদ দিয়ে আমি বরং একটি ঘোড়ার বেড়ে ওঠা এবং কর্মযোগী হয়ে ওঠার কাহিনী বর্ণনা করি যাতে আপনি ঘোড়া-গাধা এবং খচ্চরের পার্থক্য হূদয়ঙ্গম করতে পারেন এবং নিচের রুচি অনুযায়ী পছন্দের বাহনটি সংগ্রহ করে নিতে পারেন নির্ভুলভাবে।

শাহী আস্তাবলের অন্যান্য রাজকীয় ঘোড়ার সঙ্গে আমাকেও কঠোর পরিশ্রম, ভার বহনে সক্ষমতা অর্জন এবং অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে ছুটে চলার কলাকৌশল শেখানো হতো।

এই তিনটি কাজের জন্য প্রথমে দরকার পড়ল আমার দেহটিকে সুস্থ, সবল এবং নীরোগ করা। পরবর্তী ধাপে আমার অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে পেশিবহুল এবং কষ্ট সহ্য করানোর মতো শক্তিশালী করে গড়ে তোলা। ডাক্তার-কবিরাজ, বৈদ্য, পুষ্টিবিদ, সেবক-কর্মচারী ছাড়াও বেশ কয়েকজন শিক্ষককে নিয়োগ হলো আমাকে গড়ে তোলার জন্য। সাম্রাজ্যের যুবরাজের শরীর স্বাস্থ্য এবং শিক্ষাদীক্ষার ব্যাপারে যেরূপ সতর্কতা অবলম্বন করে যত্নআত্তি করা হতো আমাদের ক্ষেত্রেও তার চেয়ে কোনো অংশে কম করা হতো না। উত্তম আহার, প্রয়োজনীয় বিশ্রাম এবং নিদ্রার মাঝে আমাদের দিয়ে কঠোর পরিশ্রম করানো হতো। উত্তপ্ত মরুভূমির মধ্য দিয়ে কোনো বিরতি ছাড়াই আমরা যেদিন নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পিঠে সওয়ার নিয়ে দুইশ মাইল পথ অতিক্রম করতে পারলাম সেদিন রাজকীয় বাহিনীতে রাজপরিবারের সেনাপতিদের জন্য আমাদের কমিশন প্রদান করা হলো। অন্যান্য প্রশিক্ষণার্থীর মধ্যে আমিই ছিলাম সবচেয়ে দ্রুতগামী, কষ্ট সহিষ্ণু এবং অধিক ভার বহনে সক্ষম। এই কারণে সর্বশ্রেষ্ঠ ক্যাডেট হিসেবে আমাকে মহামান্য সুলতান নুরউদ্দিন জঙ্গীর সেবায় মনোনীত করা হলো।

প্রশিক্ষণের দ্বিতীয় ধাপে আমাকে জ্ঞান-বুদ্ধি এবং আত্মমর‌্যাদার বিভিন্ন বিষয়াদি আত্মস্থ করানো হলো।  যুদ্ধ, যুদ্ধাস্ত্র, খাদ্যদ্রব্য, পথঘাট ইত্যাদি সম্পর্কে ধারণা দেওয়া হলো। আমাকে শিখানো হলো কখন দানা-পানি খেতে হবে এবং কখন ক্ষুধা লাগলেও খাওয়া যাবে না। আবার বিশ্রাম এবং নিদ্রার স্থান-কাল-পাত্র সম্পর্কে সচেতন এবং সজাগ থাকার জন্য কঠোর শিক্ষা দেওয়া হলো। পশুপাখি এবং লোকজনের মধ্যে কারা আমার শত্রু এবং কারা আমার মিত্র হতে পারে তাও হাতে-কলমে শিক্ষা দেওয়ার পাশাপাশি শত্রু-মিত্রের সঙ্গে সঠিক সময়ে সঠিক আচরণের তালিম আমাকে আত্মস্থ করানো হলো। ঘোড়ার আত্মমর‌্যাদা এবং মানসম্মান রক্ষার বিষয়ে কোনো রকম ছাড় না দেওয়ার প্রশিক্ষণ পাওয়ার পর আমার আত্মবিশ্বাস বেড়ে গেল বহুগুণে। ফলে প্রতিটি ক্ষণ আমার কাছে মোহনীয় এবং আনন্দময় বলে মনে হতে লাগল। আমি ঘোড়া হয়ে জন্মানো এবং বেঁচে থাকার সার্থকতা অনুভব করতে শিখলাম।

আমাকে শেখানো হলো, আমার লজ্জাস্থান এবং লেজে কেউ হাত দিলে কষে লাথি মারতে হবে। আমার মুখমণ্ডলে চড়-থাপ্পড় মারলে লাথি অথবা কামড় দিতে হবে। আমি আরও শিখলাম— জমিনে সতর্ক নজর রেখে চলতে-ফিরতে হবে। ঘুমন্ত মানুষ এবং বিশ্রামরত দুর্বল পশুকে পাড়ানো যাবে না। ফসলি জমি, কঙ্করময় পর্বত এবং কাদাযুক্ত নরম মাটিতে সতর্ক পা ফেলতে হবে। চলতি পথের দুই ধারের দৃশ্য দেখতে হবে এবং স্মরণে রাখতে হবে। সঙ্গীদের ছেড়ে খুব বেশি এগোনো যাবে না আবার তাদের থেকে পিছিয়ে পড়া যাবে না। স্বজাতি অর্থাৎ অন্য ঘোড়াদের সঙ্গে মারামারি দ্বন্দ্ব সংঘাত এড়িয়ে যেতে হবে। তৃষ্ণার্ত অবস্থায় পানির নহর দেখলে মালিকের অনুমতি ছাড়া সেদিকে এগোনো যাবে না এবং কোনো সুন্দরী ঘুড়িমনিকে দেখে কামাতুর হয়ে নিজের পিঠের সওয়ারিকে ভুলে যাওয়া চলবে না। উপযুক্ত সওয়ারি কিংবা পরিচিত সওয়ারি না হলে অবাধ্য হওয়ার কৌশলও আমাকে শেখানো হলো। প্রশিক্ষণের দ্বিতীয় ধাপ শেষ হওয়ার কয়েক দিন পর আমার জীবনে হঠাৎ করেই চরম এক বিপদ এসে উপস্থিত হলো। ঘটনার দিন সকালে আমি শাহী আস্তাবলে নাশতা সেরে আয়েশ করে শক্তিবর্ধক হুরমতি শরবত পান করছিলাম। এমন সময় সেখানে একজন কিশোর বয়সী শাহজাদা এলেন। তিনি অতি আশ্চর্য হয়ে ঘুরে ঘুরে আমার সৌন্দর্য অবলোকন করতে থাকলেন। আমার পিঠ, ঘাড়, মুখমণ্ডল এবং পেটে হাত বুলিয়ে আদর করতে লাগলেন। আমি বেশ পুলক অনুভব করলাম এবং শরবতের বালতি থেকে মুখ তুলে শাহজাদাকে ক্ষণিকের তরে দেখে নিলাম— বেশ নাদুস-নুদুস সরল সোজা মায়াবী চেহারা। আমি পুনরায় শরবতের বালতিতে মুখ ঢোকালাম এবং শাহজাদা আগের মতোই আমাকে আদর করতে থাকলেন। যদিও আমার মাঝেমধ্যে সুড়সুড়ি লাগছিল কিন্তু শাহজাদার সম্মানে আমি নড়াচড়া না করে যথাসম্ভব স্থির থাকার চেষ্টা করলাম। সম্ভবত তিনি আমার এই ভদ্রতাবোধকে দুর্বলতা এবং নাদানি বলে ধরে নিলেন। আদর করতে করতে তিনি একবার আমার কান মলে দিলেন। রাগে আমি দিশাহারা হয়ে পড়লাম। খাওয়া বন্ধ করে আমি ক্ষুব্ধ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে দাঁত বের করে হুঙ্কার দিলাম। আফসোস! তিনি আমায় ভুল বুঝলেন। মনে করলেন আমি হয়তো খুশির চোটে বত্রিশ পাটি দাঁত বের করে হাসছি।

শাহজাদা আমার শরীরে হাত বুলাতে বুলাতে আমার পশ্চাৎ দিকে চলে এলেন। তারপর কি মনে করে আমার লেজটি ধরে মুচড়িয়ে দিলেন। আমি এক মুহূর্ত অপেক্ষা করলাম না। কষে লাথি মেরে শাহজাদাকে উত্তম জবাব দিয়ে দিলাম। তিনি অন্তত ২৫ হাত দূরে ছিটকে পড়লেন। সঙ্গে সঙ্গে নয়টি দাঁত পড়ে গেল এবং ওরে বাবারে, মরে গেলাম, বাঁচাও বলে চিত্কার করে সংজ্ঞা হারালেন। পুরো রাজপ্রাসাদে হৈচৈ পড়ে গেল। আমার ওস্তাদ যিনি কিনা ছিলেন শাহী আস্তাবলের প্রধান সহিস তিনি প্রচণ্ড ভয়ে কলাপাতার মতো কাঁপতে লাগলেন। ঘটনা শোনার সঙ্গে সঙ্গে আমার মালিক ঘটনাস্থলে এলেন। সবাইকে অবাক করে দিয়ে তিনি আমাকে আদর করলেন এবং আমার ওস্তাদকে ধন্যবাদ দিলেন একটি ঘোড়াকে আত্মমর‌্যাদাশীল হিসেবে গড়ে তোলার জন্য। তিনি শাহজাদা এবং তার শিক্ষকদের ভর্ত্সনা করলেন এবং খুব তাড়াতাড়ি ঘোড়া-গাধা এবং খচ্চর সম্পর্কে ধারণা লাভের জন্য নির্দেশ দিলেন।

প্রশিক্ষণের তৃতীয় ধাপে আমাকে মালিক এবং তার ব্যবহার্য জিনিস সম্পর্কে জ্ঞানদান করা হলো। মালিকের চেহারা, গায়ের গন্ধ, তলোয়ার, সামরিক পোশাক, তার বাসভবন, বিশ্রামাগার ইত্যাদি সম্পর্কে আমার ধারণা স্পষ্ট হওয়ার পরই রাজা তার রাজকীয় ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই সংগ্রামে বের হলেন। আমার মালিক আলেপ্পোর শাসক হলেও তামাম আরব উপদ্বীপে তার বীরত্ব, ন্যায়পরায়ণতা, সুশাসন এবং অপরাপর রাজ্য আক্রমণ না করে সবাইকে বন্ধু বানানোর মনোভাবের কথা ছড়িয়ে পড়েছিল। তার বাবা ইমামউদ্দিন জঙ্গী মারা যাওয়ার পর তিনি অতীব ভালো মানুষের মতো পুরো রাজ্য তার একমাত্র ভায়ের সঙ্গে সমান ভাগে ভাগ করে নেন। দামেস্কের আমিরের সঙ্গে তার পিতার আমলের বিরোধ মিটিয়ে ফেলেন এবং আমিরের কন্যাকে বিয়ে করে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠিত করেন। বাগদাদের আব্বাসীয় খলিফা, মিসরের মামলুক খলিফা, আনাতোলিয়ার শাসকবৃন্দসহ উত্তর আফ্রিকার সব রাজা-বাদশাহ আমার মালিককে ভালোবাসতেন, শ্রদ্ধা করতেন এবং বিপদ-আপদে সাহায্য-সহযোগিতা গ্রহণ করতেন।

আমার মালিক সিংহাসনে আরোহণের পরপরই শুরু হয়ে যায় দ্বিতীয় ক্রুসেড। ইউরোপের রোমান ক্যাথলিকরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে ধর্মযুদ্ধ ঘোষণা করে। পোপ তৃতীয় এগুইনীর আহ্বানে ফ্রান্সের সম্রাট সপ্তম লুইস এবং জার্মান সম্রাট তৃতীয় কর্নাডের নেতৃত্বে ১৩ হাজার ইউরোপীয় সৈন্য জাহাজযোগে মধ্যপ্রাচ্যে অবতরণ করে। ১১৪৮ সালে ক্রুসেডাররা সিরিয়ায় হামলা চালায়। আমার পিঠে সওয়ার হয়ে ভুবনজয়ী সুলতান নুরউদ্দিন জঙ্গী ইউরোপের সম্মিলিত বাহিনীকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করে জাজিরাতুল আরবের মহান ত্রাণকর্তা হিসেবে আবির্ভূত হন। এরপর থেকে ওই অঞ্চলের কোনো রাজা বিপদে পড়লেই আমার মালিকের সাহায্য চাইতেন। ১১৬৩ সালে মিসরে শুরু হয়ে যায় ভয়ানক গণ্ডগোল। মামলুক খলিফা আল আদিদের অনুরোধে আমার মালিক তার দুই বিশ্বস্ত সেনাপতি শেরকুহ এবং গাজী সালাউদ্দিনকে মিসর প্রেরণ করেন। মিসর রওনা হওয়ার প্রাক্কালে আমার মালিক তার প্রাণপ্রিয় বিশ্বস্ত সেনাপতি গাজী সালাউদ্দিনকে সম্মানিত করার জন্য উপহার হিসেবে আমাকে প্রদান করেন। এর ফলে আমি আরও একটি ক্রুসেডে জয়লাভ এবং পবিত্র জেরুজালেম নগরী দখল ইতিহাসের অংশ হওয়ার সৌভাগ্য লাভ করলাম।

আমার কর্মজীবনে কোনো দিন আমি মালিকদের বিরক্তির কারণ রূপে বিবেচিত হইনি। আমাকে কোনো দিন চাবুক মারতে হয়নি। চলতি পথে কিংবা যুদ্ধের ময়দানে আমাকে কী করতে হবে তা নিয়ে আমার মালিকগণকে কোনো দিন চিন্তা করতে হয়নি। স্থান-কাল-পাত্র ভেদে আমি স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারতাম। আমার সুদীর্ঘ কর্মজীবনে আমার লাগাম টেনে ধরার ঘটনাও খুব বেশি ঘটেনি। একজন উত্তম মালিকের অধীনে উত্তম শিক্ষা এবং উত্তম শরীর লাভ করে আমি সারাটি জীবন শুধু উত্তম সেবাই দিয়ে এসেছি। ফলে আমি যেমন মালিকদের  প্রতি বেজায় খুশি এবং কৃতজ্ঞ ছিলাম, তদ্রূপ তারাও আমার প্রতি সন্তুষ্ট ছিলেন। আমি আমার আত্মকথনের একদম শেষ প্রান্তে চলে এসেছি। এ পর‌্যায়ে মিসরের শাহী আস্তাবলের একটি গাধার কাহিনী বলে আপনাদের কাছ থেকে বিদায় নেব।

গাধাটির সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতেই সে নিজেকে দুলারী নামে পরিচয় দিল। আমি বললাম, দুলারী তো গাধীদের নাম। কিন্তু তোমাকে তো গাধা বলেই মনে হচ্ছে। সে বলল, আমার কি দোষ! আমার মালিক উজির জামসেদ আমাকে গাধী বানিয়ে রাখতেই বেশি পছন্দ করেন। আমাকে সব সময় অদ্ভুত জায়গায় নিয়ে যায় এবং হররোজ অদ্ভুত সব কর্ম করায়। সারা দিন আস্তাবলে বন্দী করে রাখে এবং রাত হলে আমাকে নিয়ে প্রমোদ ভ্রমণে বের হয়। গাধার পিঠে চড়ে প্রমোদ ভ্রমণ! তাও আবার রাত বিরাতে। আমি বেশ আশ্চর্য হলাম এবং বেচারাকে সব কিছু খুলে বলার জন্য অনুরোধ করলাম।

আমার কথা শুনে গাধাটি বেশ খানিকটা সময় নিয়ে কাঁদল। শান্ত হওয়ার পর বলল জানেন! আমার পুরুষত্বের প্রতি ঘৃণা ধরে গেছে, আর বাঁচতে ইচ্ছে করে না, মনে হয় মরে যাই। আমাকে কেবল খচ্চর পয়দা করার কাজে বাধ্য করা হয়। জীবনে একবারের জন্য কোনো গাধীর সান্নিধ্য পাইনি। রাজ্যের যত্তসব দুর্বল এবং কুিসত টাট্টু ঘোড়ীকে আমার কাছে আনা হয় প্রজননের জন্য। অন্যদিকে উজির যখন রাতে গোপন অভিসারে বের হন তখন ঘোড়ার পরিবর্তে আমাকে সওয়ার হিসেবে ব্যবহার করেন। ঘোড়ার খুরের আওয়াজ, ডাকাডাকি এবং কথায় কথায় লাথি মারার অভ্যাসের কারণে নিষিদ্ধ পল্লীর বাসিন্দারা ঘোড়ার আরোহীর পরিবর্তে গাধার সওয়ারিকে অধিক পছন্দ করে। দিনের বেলায় খচ্চর পয়দার বিরক্তিকর কসরৎ এবং রাতের বেলার নিষিদ্ধ পল্লীর বিষাক্ত পরিবেশ আমার আর সহ্য হচ্ছে না। এ কথা বলে গাধাটি পুনরায় কান্না আরম্ভ করল।  আমি অনেকক্ষণ ধরে গাধার কথা শুনছিলাম এবং মনে মনে তার মালিক এবং আমার মালিকের পার্থক্য নিরূপণের চেষ্টা করছিলাম।

লেখক : কলামিস্ট।

সর্বশেষ খবর