সোমবার, ২২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ ০০:০০ টা

পুলিশের ওপর জনগণের আস্থা একান্ত প্রয়োজন

মেজর জেনারেল এ কে মোহাম্মাদ আলী শিকদার পিএসসি (অব.)

পুলিশের ওপর জনগণের আস্থা একান্ত প্রয়োজন

জনগণের ওপর পুলিশের কর্তৃত্ববাদী হওয়ার সুযোগ নেই। পুলিশ নিয়ে মানুষের মনে নেতিবাচক ধারণা জন্মেছে। জনগণের ট্যাক্সের টাকায় পুলিশের বেতন-ভাতা দেওয়া হয়। জনগণের সেবা দেওয়াই পুলিশের দায়িত্ব ও কর্তব্য বলে মন্তব্য করেছেন পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজি) এ কে এম শহীদুল হক (১০ ফেব্রুয়ারি, বাংলাদেশ প্রতিদিন)। আইজি আরও বলেন, মানুষের মধ্যে এখন পুলিশভীতি ও পুলিশের অপরাধভীতি কাজ করছে, আর এটা হয়েছে জনগণের সঙ্গে পুলিশের দূরত্ব বেড়ে যাওয়ার কারণে। ৯ ফেব্রুয়ারি কমিউনিটি পুলিশিং কমিটির রংপুর বিভাগীয় সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে যে মন্তব্যগুলো আইজি করেছেন এটি এখন সাধারণ মানুষেরও কথা এবং প্রতিনিয়ত মিডিয়ায় তার প্রতিফলন পাওয়া যাচ্ছে। পুলিশ প্রধানের মুখে নিজের বাহিনী সম্পর্কে সত্য উচ্চারণ প্রশংসনীয়। তিনি নৈতিক সাহস ও সততার পরিচয় দিয়েছেন। এখন মানুষের প্রত্যাশা তিনি বর্ণিত পরিবেশ ও পরিস্থিতি থেকে পুলিশ বাহিনীকে মুক্ত করতে যথার্থ ব্যবস্থা নেবেন। এ কাজের জন্য তিনিই উপযুক্ত ব্যক্তি এবং সর্বোচ্চ পদাধিকার।

যে কোনো দেশের জন্য সভ্যতা ও সুশাসনের প্রতীক পুলিশ। কোনো কোনো দেশে পুলিশকে রাষ্ট্রের দর্পণ বলা হয়। পুলিশের আচরণের সঙ্গে দেশের সুনাম ও মর্যাদা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। পুলিশ ছাড়া একদিন, এক ঘণ্টাও রাষ্ট্র চলবে না। যে যত বেশি অপরিহার্য, যার গুরুত্ব ও ক্ষমতা বেশি, তার প্রতি মানুষের দৃষ্টি এবং প্রত্যাশাও বেশি। পুলিশ অনেক ক্ষেত্রে যথেষ্ট ভালো কাজ করছে, তাদের সাফল্য কম নয়। তা না হলে এতদিন আমরা জঙ্গল রাষ্ট্রে পরিণত হতাম। অন্যায়, আইন ভঙ্গ, দুর্বৃত্ত, দুর্বৃত্তায়ন কম-বেশি সব দেশেই আছে, সে যত উন্নত ও সভ্য দেশ হোক না কেন। কিন্তু বিচার্য বিষয় হলো পুলিশের প্রতি মানুষের আস্থা কতখানি, পুলিশ কতটুকু জনবান্ধব। পুলিশের সাক্ষাতে মানুষের মনে ভয়ের সৃষ্টি হয়, নাকি সাহসের সৃষ্টি হয়। পুলিশের একটি থানা বা ফাঁড়ি হওয়া উচিত যে কোনো অসহায় মানুষের সর্বোত্কৃষ্ট নিরাপদ জায়গা। কিন্তু বাস্তবতা কি বলে। এ বিষয়ে পুলিশ প্রধানের উপলব্ধিই যথেষ্ট, আমাদের কিছু বলার প্রয়োজন নেই।

আমাদের কথা হলো এখান থেকে পুলিশকে বের হতে হবে। বের হওয়ার উপায়ও পুলিশ প্রধানকে বের করতে হবে। মানুষ প্রতিফলন প্রত্যাশা করে। পুলিশ প্রধানের প্রতি মানুষের আস্থা আছে।

১৬ কোটি মানুষের দেশে জনগণের আস্থা ব্যতিরেকে পুলিশের পক্ষে সময়ের চাহিদা মোতাবেক মানুষের প্রত্যাশা পূরণ করা সম্ভব নয়। গত ছয় মাস এক বছরে বেশ অনেকগুলো ঘটনায় পুলিশের প্রতি মানুষের আস্থা ভয়ানকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ২০১৪ সালের ৭ জানুয়ারি কালের কণ্ঠের একটি খবরের শিরোনাম ছিল ‘রাজশাহীতে আবারও অস্ত্র কেড়ে নিয়ে সেই অস্ত্র দিয়ে পুলিশকে পেটাল শিবির। খবরটি অন্যান্য দৈনিকেও গুরুত্ব সহকারে ছবিসহ ছাপা হয়। শিবিরের ক্যাডার বাহিনী ওই পুলিশ সদস্যকে পিটিয়ে রাস্তায় ফেলে দেয়। সঙ্গী অন্যান্য পুলিশ সদস্যরা ছিল অসহায়। পরে বিজিবি এসে পুলিশকে উদ্ধার করে। এরকম ঘটনা এর আগেও ঘটেছে। ২০১৫ সালের অক্টোবর মাসের শেষ দিকে মিরপুরের গাবতলীতে কর্তব্যরত অবস্থায় এএসআই ইব্রাহিম মোল্লাকে শিবির ক্যাডার এনামুল হক কুপিয়ে হত্যা করে। এএসআই ইব্রাহিম মোল্লার সঙ্গে অন্যান্য পুলিশ সদস্যরা নির্বাক হয়ে থাকে, কোনো পাল্টা অ্যাকশন নেয় না অথবা নিতে পারে না। মিরপুরের গাবতলী ঘটনার ১৩ দিনের মাথায় ৪ নভেম্বর আশুলিয়ার নবীনগর-কালিয়াকৈর রোডে নন্দন পার্কের কাছে কর্তব্যরত পুলিশ সদস্য মুকুল হোসেনকে দুর্বৃত্তরা কুপিয়ে হত্যা করে। সঙ্গে থাকা তিনজন পুলিশ সদস্য মুকুলের জীবন রক্ষার চেষ্টা না চালিয়ে ভয়ে অস্ত্রসহ নিকটস্থ গজারি বনের দিকে দৌড়ে পালায়। নিজেদের সঙ্গীকে দুর্বৃত্তরা ছুরি দিয়ে কুপিয়ে মারছে, আর অন্যদের হাতে অস্ত্র গোলাবারুদ থাকা সত্ত্বেও তারা নিষ্ক্রিয় থেকেছে, আর নয়তো ভয়ে পালিয়েছে। এ তিনটি ঘটনায় ব্যক্তি পুলিশ সদস্যের দায়বদ্ধতার চেয়েও বাহিনীর সার্বিক ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনার দুর্বলতাই প্রকটভাবে ধরা পড়ে। এ ঘটনায় পুলিশের প্রশিক্ষণ ও পেশাগত দক্ষতা প্রশ্নের মুখে পড়েছে। সংশ্লিষ্ট পুলিশ সদস্যরা কি অস্ত্র ব্যবহারে আত্মবিশ্বাসী ছিল না। তারা কি রুলস অব এনগেজমেন্ট (Rules of Engagement)সম্পর্কে যথাযথভাবে অবহিত নয়। এসব ঘটনায় নৈতিক মনোবলও প্রশ্নবিদ্ধ। অথচ এ গুণাবলি ফোর্সের কার্যকারিতার জন্য অপরিহার্য। একেবারে গোড়ায় গলদ, অর্থাত্ পাবলিক সার্ভিস কমিশনের বাইরে পুলিশের যে সব পদে রিক্রুটমেন্ট হয় তার ভিতর ভয়ানক দুর্বলতা চোখে পড়ে। জনশ্রুতি মোতাবেক পুলিশের সিপাহি পদে ভর্তি হতে একজনের প্রায় পাঁচ-সাত লাখ টাকা লাগে, আর এসআই পদের জন্য তা প্রায় পনেরো-ষোল লাখ। এই টাকা কাদের হাতে যাচ্ছে তাও মানুষের মুখে মুখে শোনা যায়। তবে নিশ্চয়ই তা শুধু পুলিশের ভর্তি কর্তৃপক্ষের পকেটে যাচ্ছে না। জন আস্থা অর্জন করতে হলে জনশ্রুতির মূল্যায়ন জরুরি। উপরোক্ত অভিযোগ কতখানি সত্য তা একটা প্রশ্ন হতে পারে। তবে এ কথা যদি পঞ্চাশ-ষাট ভাগও সত্য হয় তাহলে সেটি পুলিশের কার্যকারিতার ওপর বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে সেটাই স্বাভাবিক। সিপাহি, এসআই পদবির সদস্যরাই তৃণমূল পর্যায়ে, থানায় কাজ করে। এদের সঙ্গেই মানুষের সংশ্লিষ্টতা বেশি। এত পরিমাণ টাকা বিনিয়োগ করার পর যে কোনো ব্যক্তির জন্যই নৈতিক মনোবল নিয়ে কাজ করা প্রায় দুঃসাধ্য। সুতরাং পুলিশের রিক্রুটমেন্ট পদ্ধতি ও নীতিমালার আমূল সংস্কার অতি প্রয়োজন। পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ দৃঢ়তার পরিচয় দিলে এটা করা অসম্ভব নয়। সরকারের সদিচ্ছা, সমর্থন এবং সিদ্ধান্ত পাওয়া গেলে প্রক্রিয়া বের করা কোনো কঠিন কাজ নয়। ১৩ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ প্রতিদিনের প্রথম পৃষ্ঠায় একটা খবরের শিরোনাম ছিল—বিকল্প থানা বিকল্প টিমেই ডুবছে পুলিশ। পুলিশের সোর্সের অপেশাদারি এবং অপব্যবহারের কথা প্রতিবেদক তুলে ধরেছেন। মিরপুরের চা দোকানি বাবুল মাতব্বরের অপমৃত্যুকে কেন্দ্র করে সোর্সের অপেশাদারি ব্যবহারের চিত্রটি বের হয়ে আসছে। সোর্স থাকবে অতি গোপনে। সোর্সের পরিচয় প্রকাশ হয়ে পড়লে তার মূল্য জিরো হয়ে যায়। অথচ দেখা যাচ্ছে সোর্স বিকল্প পুলিশ হয়ে যাচ্ছে এবং পুলিশের থেকেও ক্ষমতাবান। দারোগার চেয়ে নৌকার মাঝির দাপট সব সময় বেশি হয়ে থাকে। এটা বন্ধ করা জরুরি। পুলিশের কার্যক্রমের মূল কেন্দ্র হচ্ছে থানা। আধুনিক উন্নতমানের প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহারে থানার ভিতরের কার্যক্রম সার্বক্ষণিক মনিটরিং করা সম্ভব। থানার বাইরে পুলিশের কার্যকারিতা ও আচরণ তদারকির জন্য কাউন্টার পদ্ধতির উদ্ভাবন ও প্রচলন করতে হবে। পুলিশের টপ লেভেলের দৃষ্টিভঙ্গি ও দায়বদ্ধতা নিয়ে কিন্তু প্রশ্ন উঠছে কম। কিন্তু চেইন অব কমান্ডের মধ্যম স্তর এবং তৃণমূল পর্যায়ে অর্থাত্ থানা পর্যায়ে এসে সেই দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন কতখানি ঘটে সেটাই অধিক গুরুত্বপূর্ণ। দুর্বৃত্ত এবং সমাজের টাউট-বাটপার নানা ছদ্মবেশে পুলিশের ভালো আচরণের সুযোগে উল্টো কাজ করার চেষ্টা করতে পারে। এখানে পুলিশের প্রশিক্ষণ, দক্ষতা ও পেশাদারিত্বের পরীক্ষা। সরকারের অন্যান্য বিভাগ ও সাধারণ মানুষ থেকে পুলিশের বিশেষত্ব এখানে এসে প্রমাণিত হয়। সুতরাং সমাজ ও রাষ্ট্রের অন্যান্য জায়গায় দুর্নীতি আছে, তাই সেটি পুলিশে থাকলেও কিছু করার নেই, এমন যুক্তি পুলিশের ঊর্ধ্বতন অফিসার কর্তৃক উত্থাপন ঠিক নয়। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক ও সিটি করপোরেশনের দুই কর্মকর্তাকে হয়রানির ঘটনায় পুলিশের ভাবমূর্তি ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আরেকটি ঘটনায় পুলিশের ভূমিকা খুবই রহস্যজনক মনে হয়েছে। ২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি বইমেলা থেকে বের হওয়ার সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের কাছে দুর্বৃত্তরা চাপাতির দ্বারা কুপিয়ে হত্যা করে অভিজিত রায়কে। হত্যাকাণ্ড যেখানে সংঘটিত হয় তার পাঁচ থেকে দশ গজের মধ্যে আট-দশজন পুলিশ অস্ত্র হাতে কর্তব্যে ছিলেন। সঙ্গে রাস্তায় পুলিশের গাড়িও ছিল। অনেক মানুষের আনাগোনাও ওই সময়ে সেখানে ছিল। অভিজিতের স্ত্রী অনেক চিত্কার করার পরেও এত কাছে থাকা পুলিশের কেউ এগিয়ে এলেন না। অভিজিতকে হাসপাতালে নেওয়ার জন্য পুলিশের গাড়িখানাও কাজে আসল না। অভিজিতের এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা মানুষকে বিমুখ করেছে, মানুষ ক্ষুব্ধ হয়েছে। জনস্বার্থে, জননিরাপত্তার জন্য পুলিশের ভাবমূর্তি জনগণের কাছে অমলিন থাকা দরকার। আমাদের পুলিশ বাহিনী ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি সময়ের ঔপনিবেশিক লেগোসি এখনো বহন করে চলছে। একটা ফোর্সের  Organization culture and Behavior ওই ফোর্সের মানসকাঠামো ও দৃষ্টিভঙ্গি তৈরিতে সবচেয়ে বড় উপাদান হিসেবে কাজ করে।

আর প্রতিষ্ঠানের সংস্কৃতির বিষয়টি এমন যে তার থেকে বের হয়ে নতুনভাবে সময়োপযোগী হওয়া অত্যন্ত কঠিন কাজ। খারাপ সংস্কৃতি সংক্রামক ব্যাধির মতো কাজ করে। পুলিশের মধ্যে নৈতিকভাবে সত্ ও আত্মবিশ্বাসী সদস্য আছে। কিন্তু তারা কিছু সংখ্যক প্রতিষ্ঠিত সংস্কৃতির বাইরে এসে তেমন কিছু করছে না। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো বাস্তবতার কারণেই পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ পুলিশের দ্বারা তদন্তে মানুষ পরিপূর্ণ আস্থা রাখতে পারছে না। এ কথাটি সরকারের অন্যান্য বিভাগের জন্যও সমানভাবে প্রযোজ্য। রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের কার্যপরিধি এখন বিশাল আকার ধারণ করেছে। তাই পুলিশসহ সরকারি অফিস এবং কর্মকর্তা কর্মচারীদের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ বিশ্বাসযোগ্যভাবে তদন্তের জন্য স্বাধীন ও স্বতন্ত্র সংস্থা এখন অপরিহার্য। এক্ষেত্রে ভারতের সিবিআইয়ের লাইনে চিন্তা করা যেতে পারে। আজকের লেখাটি শেষ করতে চাই এই বলে যে, আলোচ্য বিষয়ে পুলিশের আইজির উপলব্ধি আশাব্যঞ্জক। মানুষ প্রত্যাশা করে পুলিশের প্রতি জন আস্থা ফিরিয়ে আনতে তিনি যথার্থ পদক্ষেপ নেবেন।

লেখক : কলামিস্ট ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক

ই-মেইল : [email protected]

সর্বশেষ খবর