রবিবার, ৬ মার্চ, ২০১৬ ০০:০০ টা

পারিবারিক আইন সংশোধনের পথে বাধা কোথায়?

তুষার কণা খোন্দকার

পারিবারিক আইন সংশোধনের পথে বাধা কোথায়?

সম্প্রতি বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ একটি মতবিনিময় সভার আয়োজন করেছিল। প্রিন্টিং এবং ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় যেসব মহিলা কলামিস্ট নিয়মিত কিংবা অনিয়মিত কলাম লিখে থাকেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ তাদের এ সভায় ডেকেছিল। নারীর সমস্যা এবং তার সমাধান নিয়ে খোলামেলা আলোচনা হবে এমন ধারণা নিয়ে আমি সেখানে গিয়েছিলাম।  বাংলাদেশ মহিলা পরিষদকে আমি প্রায় শৈশব থেকে চিনি। আগে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির অঙ্গসংগঠন ছিল বলে আমার মনে পড়ে। বর্তমানে রাজনৈতিক অঙ্গনে কমিউনিস্ট পার্টির অস্তিত্ব তেমন জানান দেওয়ার মতো চোখে পড়ে না। কাজেই কোনো একটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে মহিলা পরিষদের রাজনৈতিক ঘনিষ্ঠতা বর্তমানে কতটুকু সেটা আমি জানি না। আমি অনুমান করছি, বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে মহিলা পরিষদ হয়তো নারী অধিকার নিয়ে স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ করার অধিকার ভোগ করছে এবং সেই স্বাধীনতা তারা নিশ্চয়ই নারীর স্বার্থে কাজে লাগাবে। রাজনৈতিক মতলবের ঊর্ধ্বে উঠে আমাদের দেশে নারীর সমস্যা, সংকট এবং তাদের অধিকার নিয়ে আন্তরিকতার সঙ্গে কথা বলে এমন একটি সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা আমি অন্তর থেকে অনুভব করি কারণ বাংলাদেশের বেশির ভাগ নারী সংগঠন কোনো না কোনো রাজনৈতিক দলের নারী ফ্রন্ট হিসেবে কাজ করে থাকে। নামে নারী সংগঠন হলেও রাজনৈতিক দলের অঙ্গসংগঠন হিসেবে কাজ করার কারণে নারীদের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিষয়ে স্বাধীনভাবে নীতিনির্ধারণ কিংবা স্বাধীন কর্মসূচি ঘোষণার অধিকার সেসব সংগঠনের নেই। দেশের মহিলা সমাজের স্বার্থ বিবেচনা করে কিছু বলার আগে রাজনৈতিক দলের অঙ্গ মহিলা সংগঠনকে তাদের মূল দলের নারী-নীতির কথা শতবার ভেবে নিতে হয়। মূল রাজনৈতিক দলের এজেন্ডা বাস্তবায়নের বাইরে নারীর চাওয়া-পাওয়া নিয়ে কোনো কর্মসূচি ঘোষণা দূরে থাক, সংগঠনগুলো নারী অধিকার নিয়ে স্বাধীন মত প্রকাশের অধিকার ভোগ করে বলে আমার মনে হয় না।

আওয়ামী লীগ, বিএনপি কিংবা জামায়াতে ইসলামী যে দলই হোক, তাদের মহিলা শাখা মূল রাজনৈতিক দলের নীতিমালায় নারী অধিকার নিয়ে যা বলা হয়েছে মহিলা শাখা সেই নীতি বাস্তবায়নের দায়িত্ব পালন করে থাকে। রাজনৈতিক দলের অঙ্গ মহিলা সংগঠনগুলোর কাছে আমি ভালো কিছু আশা করি না। তাদের মূল রাজনৈতিক দল ভোটের রাজনীতি করে। নারীবিষয়ক নীতিমালা বানানোর সময় নারীর মর্যাদা কিংবা অধিকার নিয়ে দলগুলো মাথা ঘামায় না। তারা ভাবে, দেশীয় সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং ধর্মীয় মূল্যবোধকে অগ্রাধিকার দিলে সামনের নির্বাচনে আমাদের ভোটের বাক্স কানায় কানায় ভরে যাবে। ফলে তারা নারী স্বার্থকে বিসর্জন দিয়ে ভোটের ফায়দা লোটার ধান্ধায় মত্ত হয়ে পড়ে। মহিলা পরিষদ যদি কোনো রাজনৈতিক সংগঠনের অঙ্গসংগঠন না হয়ে থাকে তাহলে নারীর স্বার্থে সাহসী ভূমিকা পালনের সুযোগ তাদের আছে।

মহিলা পরিষদ আয়োজিত ৬ ফেব্রুয়ারির সভায় মূল্যবান মত প্রকাশের জন্য নারী কলামিস্টদের পাশাপাশি গণ্যমান্য অনেক পুরুষকে ডাকা হয়েছিল, যারা আমাদের মতো সাধারণ কেউ নন। উপস্থিত গণ্যমান্য একজন পুরুষ নারী অধিকার প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে তার নিজের মায়ের কথা মনে পড়ে নষ্টালজিয়ায় আক্রান্ত হলেন। সেই সঙ্গে তিনি জানালেন, ধর্মে মায়ের স্থান কত উপরে, কত সম্মানের। আমি চরম বিস্ময়ে তার আবেগি মুখের দিকে চেয়ে ভেবে পাচ্ছিলাম না, আসলে আমাদের সেদিনের আলোচনার বিষয়বস্তু কী ছিল? সরকারের আইন এবং নীতিমালার দুর্বলতার কারণে নারীর যে সমস্যা এবং সেই সমস্যা সমাধানের উপায় নিয়ে সেখানে আলোচনা হওয়ার কথা। মায়ের সঙ্গে সন্তানের সম্পর্কের মধ্যে যে ভালোবাসা এবং আবেগ সেটি নিয়ে আলোচনা করার জন্য মহিলা পরিষদ কেন মতবিনিময় সভার আয়োজন করল সেটা আমি কিছুতেই ভেবে পাচ্ছিলাম না। মা এবং সন্তানের মধ্যে যে আবেগ কাজ করে সেটি কোনো মানুষের সচেতন সৃষ্টি নয় কিংবা রাষ্ট্রের আইনের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই। মা এবং সন্তানের ভালোবাসা নিখাদ প্রাকৃতিক। যারা টিভি চ্যানেল ডিসকভারি কিংবা অ্যানিম্যাল প্লানেট দেখে থাকেন তারা নিশ্চয়ই বাঘ, সিংহ কিংবা অন্যান্য প্রাণীর মধ্যে মাতৃস্নেহের আবেগ দেখে নির্মল আনন্দ উপভোগ করে থাকেন। সম্মানিত বক্তার বোঝা উচিত, মাতৃস্নেহের ওপর মতবিনিময় সভা করার প্রয়োজন নেই। প্রকৃতিতে আলো-বাতাসের অস্তিত্ব যেমন সত্য, প্রকৃতিতে মাতৃস্নেহের অস্তিত্বও তেমনি সত্য। আলোচনা করে মাতৃস্নেহ যেমন বাড়ানো যাবে না কিংবা সমালোচনা করে সেটি কমানো যাবে না। 

আরেকজন শ্রদ্ধেয় পুরুষ সাংবাদিক সেদিনের মতবিনিময় সভায় আলোচক ছিলেন। গণপরিবহনে চলাচল করতে গিয়ে মেয়েদের কী ভীষণ বিড়ম্বনার মুখোমুখি হতে হয় সেই তথ্য তিনি সবাইকে জানালেন। বর্তমানে তিনি তার মিশনারি জিল নিয়ে কীভাবে মেয়েদের চলাচলের সমস্যা দূর করার জন্য প্রাণপাত করছেন সেই সংবাদও তিনি উপস্থিত সবাইকে বুঝিয়ে বললেন। বললেন, তিনি পরিবহন মন্ত্রীকে দিয়ে আইন করে বাংলাদেশের গণপরিবহনকে নারীবান্ধব করার উদ্যোগ নেবেন। গণপরিবহনে সিটের মাথায় মহিলা লিখে দিলে বাংলাদেশের পুরুষরা মহিলাদের জন্য জায়গা ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে অস্বীকার করে সে কথাও সেই আলোচক স্বীকার করলেন। পরিস্থিতি যদি এমন হয়ে থাকে তাহলে গণপরিবহনের সব সিটের মাথায় মহিলা লিখে দিলেও কোনো লাভ হবে বলে মনে হয় না। তবুও একজন মন্ত্রীর ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে তাকে দিয়ে বাসের গায়ে মহিলা লেখানোর জন্য কেন তিনি প্রাণপাত করছেন সেটি আমার মাথায় ঢুকল না। এ প্রসঙ্গে আমার বুঝ আপনাদের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার জন্য আমি সবাইকে গার্মেন্ট শিল্পের শুরুর দিকের ঘটনাগুলো স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। গার্মেন্ট শিল্পের শুরুর দিকে সেখানে কর্মরত মেয়েরা সকালে কাজে যাওয়ার পথে কিংবা সন্ধ্যায় কাজ শেষে বাড়ি ফেরার পথে ধর্ষণ থেকে শুরু করে সব ধরনের শারীরিক মানসিক লাঞ্ছনার শিকার হয়েছে। গার্মেন্ট শিল্পের মেয়েরা এখন আগের চেয়ে ভালো আছে। কোনো ব্যক্তিবিশেষ অথবা অনেক সুধীজন প্রাণপণ চেষ্টা করে গার্মেন্ট শিল্পে কর্মরত শ্রমিকদের অবস্থার উন্নতি ঘটিয়ে দিয়েছে কেউ নিশ্চয়ই এমন কৃতিত্ব দাবি করবে না। বরং গার্মেন্ট শিল্পের শুরুর দুর্দিনে সাংবাদিকরা কী ভূমিকা পালন করেছিলেন সেটিও আপনারা মনে করে দেখুন। গার্মেন্ট শিল্প যখন বড় হতে শুরু করেছে সে সময় কোনো গার্মেন্ট কর্মী ধর্ষিত হলে আমার দেশের সুধী সাংবাদিকরা লিখতেন ‘ষোড়শী গার্মেন্টস বালা ধর্ষিতা’। প্রমোদ বালা শব্দটির সঙ্গে মিল রেখে সাংবাদিকরা যখন এমন বিদ্ঘুটে নারকীয় মনোভাবের পরিচয় দিতেন তখনো আমি কোনো সুধী সাংবাদিককে ‘গার্মেন্টস বালার’ মতো জঘন্য শব্দ চয়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে দেখিনি। তারপরও গার্মেন্ট শ্রমিকদের পরিস্থিতি আংশিক বদলে গেছে এবং বাকিটাও বদলাবে। কারণ, শ্রমিকদের কাজের প্রয়োজন এবং শিল্প মালিকদের শ্রমিক নিয়োগের তাগিদ এ দুইয়ের সম্মিলনে পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। গার্মেন্ট শিল্পের মেয়েরা দেশের অন্য নারীদের জন্য উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। এ কথা প্রমাণিত সত্য, দেশের শিল্প উৎপাদনে মেয়েদের সম্পৃক্ততা যত জোরালো হবে সমাজের প্রতিটি ব্যবস্থা তত বেশি নারীবান্ধব হয়ে উঠবে।

তারপরও নারীর প্রতি পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গি বদলানোর জন্য যেসব উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন সেগুলো যত তাড়াতাড়ি নেওয়া যায় সেটা সমাজের সব মানুষের জন্য মঙ্গল। সমাজে নারীর প্রতি পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে পারলে তার সুফল কতদূর যাবে সেটি ব্যাখ্যা করার জন্য আমি স্মৃতি থেকে দুটি রাজনৈতিক ঘটনা উল্লেখ করতে চাই। ২০১৪ সালের বিশ্ব নারী দিবসের অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘দুইজন রাজনৈতিক নেত্রী যখন রাজনৈতিক বিতর্ক কিংবা বিবাদে জড়িয়ে পড়ে তখন লোকে বলে দুই মহিলার ঝগড়া। অথচ একই ঝগড়া দুজন পুরুষ রাজনীতিবিদ করলে সেটিকে কেউ দুজন পুরুষের ঝগড়া বলে উপহাস করে না।’ একজন নারী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী পদে থেকেও নারীর প্রতি পুরুষের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির আক্রমণ থেকে রেহাই পান না। সেখানে আমরা সাধারণ নারীরা সমাজে কী ভীষণ বিড়ম্বনায় আছি সেটা সহজেই অনুমান করা চলে। আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটবদ্ধ রাজনৈতিক দল জাতীয় পার্টির নেতা এইচ এম এরশাদ ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের জনগণ দুই মহিলার হাত থেকে মুক্তি চায়। এই দেশে নারী শাসনের অবসান ঘটিয়ে এখন পুরুষের শাসন কায়েম করা প্রয়োজন।’ সম্ভবত এরশাদ পুরুষের শাসনকে সুশাসনের সমার্থক অর্থে ব্যবহার করেছিলেন। এরশাদের নয় বছরের শাসন আমলের দুর্নীতি আর দুঃশাসনের আমলনামা স্মরণ করুন এবং বলুন নারীর প্রতি পুরুষের ধৃষ্টতার এর চেয়ে জঘন্য উদাহরণ আর কী হতে পারে!

আমাদের দেশের নারী রাজনীতিকরা নারীর ক্ষমতা এবং মর্যাদার প্রশ্নে কি আন্তরিক? বাংলাদেশের দুই বড় রাজনৈতিক দলের দুই শীর্ষ নেত্রীর কথা এবং কাজ ব্যাখ্যা করলে নারীর অধিকার এবং মর্যাদা বিষয়ে তাদের সচেতন বলে মনে হয় না। রাষ্ট্রের ক্ষমতা ধরে রাখা কিংবা রাষ্ট্রক্ষমতা ফিরে পাওয়ার জন্য তারা উভয়ে সব মহলের সমর্থন চান। হেফাজতে ইসলামের বয়োবৃদ্ধ নেতা যিনি নারীকে তেঁতুলের সঙ্গে তুলনা করে সমাজে তেঁতুল হুজুর বলে পরিচিতি পেয়েছেন তাকে বেগম খালেদা জিয়া প্রশ্রয় দিয়েছিলেন। একজন আধুনিক নারী হিসেবে বেগম জিয়া কি হেফাজতের ১৩ দফা সমর্থন করেন? নাকি রাজনৈতিক ফায়দা লোটার মতলবে তিনি তার নারী অস্তিত্ব বেমালুম ভুলে গিয়ে এমন কাণ্ড ঘটিয়েছিলেন সে হিসেব তাকেই মেলাতে হবে। দেশে প্রচলিত পারিবারিক আইনে নারী বৈষম্যের শিকার। ধর্মভিত্তিক পারিবারিক আইনে নারীর অধিকার অস্বীকৃত হয়েছে এ কথা বললে অল্প বলা হয়। নারী সমাজের পক্ষ থেকে আইনটি সংশোধনের দাবি উঠলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তৎকালীন আইনমন্ত্রী ক্ষণে ক্ষণে হেফাজতি মৌলভীদের আশ্বস্ত করে বলতেন, আওয়ামী লীগ এ ধরনের কোনো আইন প্রণয়ন করবে না। কী আশ্চর্য! সেই আইনমন্ত্রী একজন ব্যারিস্টার ছিলেন। এ ব্যারিস্টার আদালতে যেসব মামলা পরিচালনা করতেন এবং এখনো করেন সেগুলো কি তিনি শরিয়া আইনের আওতায় উপস্থাপন করেন? ব্যারিস্টার হিসেবে আদালতে দাঁড়িয়ে তিনি কি কখনো বলেছেন, ‘আমি একজন সহি মুসলমান। অতএব আমি কোনো তাগুতি আইনের অধীনে বিচার প্রক্রিয়ায় অংশ নিয়ে নিজেকে গুনাহগার করতে চাই না।’ তিনি নিশ্চয়ই জানেন, দেশে প্রচলিত পারিবারিক আইন ছাড়া আর সব আইন ধর্ম নিরপেক্ষ এবং সব নাগরিকের জন্য সমভাবে প্রযোজ্য। প্রচলিত সব আইনকে পাস কাটিয়ে শুধু পারিবারিক আইনকে কেন ধর্মভিত্তিক হতে হবে সে বিষয়ে নারী সমাজের পক্ষ থেকে একজন নারী শেখ হাসিনা আইনমন্ত্রীর কাছে ব্যাখ্যা দাবি করতে পারতেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কাজটি করেননি কারণ নারী অধিকার আদায়ের চেয়ে আরেকবার বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়া তার কাছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ।

নারী অধিকারের প্রশ্ন সামনে এলেই আমাদের দেশের বুদ্ধি পেশাজীবীরা ধর্মগ্রন্থ খুলে বসেন। তাদের ভাব দেখে মনে হয় আমরা এখনো রাজা রামমোহন রায় কিংবা ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগরের আমলে বসবাস করছি। রাজা রামমোহন রায় সতিদাহ রোধ করার জন্য শাস্ত্র ঘেঁটে সতিদাহের বিপক্ষে প্রমাণ হাজির করার চেষ্টা করেছেন। ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর যখন হিন্দু বিধবাদের বিয়ে দেওয়ার আয়োজন করলেন তখন তাকেও শাস্ত্র ঘেঁটে বিধবা বিয়ের পক্ষে যুক্তিতর্ক জড়ো করতে হয়েছে। আজ একবিংশ শতাব্দীতে নারী-পুরুষের অধিকারের সমতা আনার কথা বললে বুদ্ধি পেশাজীবীরা কেন শাস্ত্রের দ্বারস্থ হন সেটা তারাই ভালো বলতে পারবেন। সিভিল সোসাইটির মানুষগুলো সব বিষয়ে দিব্যি প্রগতিশীল কিন্তু বাপ-মায়ের সম্পত্তিতে নারী-পুরুষ সমান ভাগ পাবে এ কথা শুনলে তাদের কথাবার্তা ভিন্ন খাতে চলে যায়। তাদের এমন দ্বিমুখী আচরণের পেছনে অন্যরা কী কারণ খুঁজে পান আমি জানি না। তবে আমার মনে হয় সিভিল সোসাইটির মানুষগুলো ব্যক্তিগত লাভ-ক্ষতির বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে দেখে থাকেন। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, নারী অধিকারের কথা উঠলে যারা ধর্মগ্রন্থ রেফার করেন তারা মাকে মান্য করেন তবে বোনকে সম্পত্তির সমান ভাগ দিতে চান না। কথাটা সরাসরি বললে তাদের গা থেকে প্রগতির তকমা খসে পড়বে ভয়ে কথাটি ঘুরিয়ে বলেন।

রাজনীতিকরা ভোট বাক্সের দিকে চোখ রেখে পথ চলেন। কাজেই তাদের কাছে নিরপেক্ষ বিবেচনা আশা করি না। স্বাধীনতার পরে যেসব রাজনৈতিক দল ঘুরেফিরে ক্ষমতায় এসেছে তারা সবাই পারিবারিক আইনের ব্যাপারে মুখে কুলুপ এঁটে রেখেছে। পারিবারিক আইনের প্রসঙ্গে বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের নীরবতা দেখে আমি মনে কষ্ট পাই। মনে পড়ে, আজ থেকে কত বছর আগে ১৯৬১ সালে পাকিস্তানের সামরিক শাসক আয়ুব খান উল্লেখ করার মতো একটি সাহসী কাজ করেছিলেন। সেই সময় আয়ুব খান মোল্লা মৌলভীদের মতামতের তোয়াক্কা না করে পাকিস্তানের পারিবারিক আইন আংশিক সংশোধন করেছিলেন যার সুফল আমরা বাংলাদেশের নারীরা আজও ভোগ করছি। আয়ুব খান আর একটু সাহস করে পারিবারিক আইন পুরোটা সংশোধন করলে এত দীর্ঘ সময় ধরে আমাদের নিজ দেশের রাজনীতিকদের হাতে লাঞ্ছিত হতে হতো না। বর্তমান রাজনীতিকদের ভীরুতার সঙ্গে তুলনা করলে আয়ুব খানকে একজন সাহসী মানুষ বলে আমার শ্রদ্ধা করতে ইচ্ছা করে। আমার সাধ্য থাকলে ঢাকা শহরের কোনো গুরুত্বপূর্ণ স্পটকে নারী চত্বর নাম দিয়ে সেখানে আমি আয়ুব খানের মর্মর মূর্তি বানিয়ে তার পায়ে নিয়মিত ফুল দিতাম। নারী অধিকার প্রশ্নে আমাদের বর্তমান রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ আয়ুব খানের চেয়ে পেছনে পড়ে আছেন। কয়েক দশক ধরে দেশে বড় দুটি রাজনৈতিক দলের শীর্ষ আসনে নারী নেত্রী থাকার পরে আজও দেশের পারিবারিক আইন সংশোধন করে রাষ্ট্রের চোখে নারী-পুরুষ সমান এটি প্রমাণ করা গেল না।

আমাদের দেশের নামিদামি বুদ্ধিজীবীরা কত ভালো ভালো কাজের পেছনে ছুটে জীবনপাত করছেন। তাদের ত্যাগ-তিতিক্ষার কথা তারা নিজেরাই শত মুখে বর্ণনা করে আমাদের বাহবা কুড়িয়ে নিয়ে যান। তারা নিজের মাকে কত সম্মান করেন জেনে আমরা আবেগ মথিত না হয়ে পারি না। অথচ কী দুঃখজনক, তারা বোনকে সম্পত্তির সমান ভাগ দিতে কী ভীষণ কুণ্ঠাবোধ করেন। বাংলাদেশের সংবিধান দেশের নারী-পুরুষ সব নাগরিকের জন্য সমান অধিকার নিশ্চিত করেছে অথচ দেশের প্রচলিত পারিবারিক আইন নারী অধিকারের স্বীকৃতি দিচ্ছে না। আমরা আর কতদিন বৈষম্যমূলক পারিবারিক আইনের গ্লানি বয়ে বেড়াব কে জানে। আমি বিনয়ের সঙ্গে সুধী সমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। দেশে প্রচলিত পারিবারিক আইন সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক এ সত্য সুধী সমাজকে মানতে হবে। পারিবারিক আইনে নারীর প্রতি যে বৈষম্য করা হয়েছে সেটার প্রতিকার করার প্রশ্নে সুধী সমাজকে সততার সঙ্গে একটি পক্ষ নিতে হবে।  নারী অধিকারের প্রশ্নে কথার মারপ্যাঁচ না রেখে তারা প্রকাশ্যে হেফাজতের ছত্রছায়ায় চলে যেতে পারেন অথবা নারীর ন্যায়সঙ্গত, সাংবিধানিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য পারিবারিক আইন সংশোধনের পক্ষে অবস্থান নিতে পারেন।  হয় এসপার নয় ওসপার। পারিবারিক আইনের প্রশ্নে কথার ফুলঝুরি ছুটিয়ে মাঝামাঝি অবস্থান নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

লেখক : কথাসাহিত্যিক

সর্বশেষ খবর