রবিবার, ৬ মার্চ, ২০১৬ ০০:০০ টা
আইন-আদালত

ফুল কোর্ট রেফারেন্স

অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর আলম সরকার

ফুল কোর্ট রেফারেন্স সম্পর্কে আমাদের অনেকেরই ধারণা পরিষ্কার নয়। যারা আদালতে মামলা পরিচালনার সঙ্গে জড়িত এবং যারা কোর্ট স্টাফ তারা এ বিষয়টি সম্পর্কে জানলেও বিস্তারিত ব্যাখ্যা অনেকেই জানেন না। আদালতগুলোতে যারা বিচারপ্রার্থী হয়ে কোর্ট-কাছারিতে যাতায়াত করেন তারাও এ বিষয়ে ন্যূনতম একটি ধারণা রাখেন যে, কোনো বিজ্ঞ আইনজীবী মৃত্যুবরণ করলে ‘ফুল কোর্ট রেফারেন্স’ হয় যার অর্থ সেদিন আদালতের সব কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। আদালতের কার্যক্রম বন্ধ রেখে সেদিন মৃত আইনজীবীর কর্মজীবন নিয়ে আলোচনা করা হয় এবং তার বিদেহী আত্মার মাগফিরাত প্রত্যাশা করে মৃত আইনজীবীর পরিবারকে সমবেদনা জ্ঞাপন করা হয়। রেওয়াজ মোতাবেক যুগ যুগ ধরে এ ঘটনাটি পালিত হয়ে আসছে আদালতে।

বাংলাদেশে সব আইনজীবী সমিতিতে এ রকমের রেওয়াজ থাকলেও এর আনুষ্ঠানিকতায় রয়েছে কিছুটা ভিন্নতা। বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের বিজ্ঞ আইনজীবীর মৃত্যুজনিত শোকসভা প্রত্যেক মৃত আইনজীবীর জন্য  পৃথকভাবে করা হয় না। বরং এ ধরনের মৃত্যুজনিত শোকসভা বছরে একবার নির্দিষ্ট দিনে অনুষ্ঠিত হয়। যেদিন এ অনুষ্ঠান হয় সেদিন সে শোকসভায় প্রধান বিচারপতিসহ বিচারপতিরা এবং বিজ্ঞ আইনজীবীদের সমন্বয়ে শোকসভা অনুষ্ঠিত হয়। এ রকম শোকসভার দিন সুপ্রিম কোর্ট মুলতবি থাকে। সুপ্রিম কোর্টের শোকসভাজনিত রেওয়াজ বেশ কিছু জেলা আইনজীবী সমিতি অনুসরণ করলেও বেশির ভাগ জেলা আইনজীবী সমিতি এটাকে নিজেদের মতো করে শোকসভা পালন করে। এ বিষয়টি যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। ফলে এড়িয়ে যাওয়া ঠিক হবে না। আদালতের বিজ্ঞ আইনজীবীদের মৃত্যুজনিত শোকসভার রেওয়াজ বাংলাদেশের প্রতিটি জেলায় অভিন্ন হওয়া উচিত। এসব বিষয়ে সুপ্রিম কোর্ট বাংলাদেশের সব নিম্ন আদালতের নিয়ন্ত্রক হিসেবে একটি বিধি বা সার্কুলার জারি করতে পারেন। বাংলাদেশ বার কাউন্সিল প্রণীত The Bangladesh Legal Practitioners and Bar Council Order 1972 সংশোধন করে সেখানে আইনজীবীদের মৃত্যুজনিত শোকসভা বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের শোকসভাজনিত রেওয়াজটি সর্বজনীন হিসেবে চালু করা যেতে পারে। এ ছাড়াও সরকার ইচ্ছা করলে আইন মন্ত্রণালয় থেকেও প্রাসঙ্গিক বিধি, বিধান ও প্রজ্ঞাপন প্রকাশ করার মাধ্যমে এ সমস্যার সমাধান করে একটি সর্বজনীন নিয়ম চালু করা যেতে পারে।

দুঃখের সঙ্গে বলতে হয় বিজ্ঞ আইনজীবীদের মৃত্যুজনিত শোকসভাটি সুপ্রিম কোর্টের আদলে না হওয়ায় একটি অরাজকতার সৃষ্টি হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে ঢাকা আইনজীবী সমিতিতে প্রতিজনের মৃত্যুতে প্রতিটি শোকসভা অনুষ্ঠিত হয় না বরং এ ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টের আদলে বছরে একবার অনুষ্ঠিত হয়। এ নিয়মের প্রচলন রয়েছে চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতিতেও।  অন্যদিকে দেশের বিভিন্ন জেলা আইনজীবী সমিতিতে প্রতিজনের মৃত্যুতে পৃথকভাবে শোকসভা অন্তে আদালত মুলতবি রাখা হয়। কোনো কোনো জেলা আইনজীবী সমিতিতে প্রতি মাসের শেষে সমন্বিত শোকসভাসহ একদিনের জন্য আদালত মুলতবি রাখা হয়। এ ধরনের বহুমাত্রিক রেওয়াজ দূর করে একই রেওয়াজ চালু করলে বোধ করি মন্দ হয় না। কেননা প্রতিজনের মৃত্যুজনিত শোকসভাসহ আদালত মুলতবি থাকায় ওই দিনের হাজার হাজার বিচারপ্রার্থীর ভোগান্তির আর্তনাদ মৃত আইনজীবীর বিদেহী আত্মার ওপর বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি করে কিনা সেটাও একবার ভেবে দেখা দরকার, যদিও এটা ধর্মীয় বিষয়। আর ধর্মের বিষয়টি যদি বিবেচনা নাও করি সেক্ষেত্রেও একজন বিচারপ্রার্থীর অধিকার লংঘনের বিষয়টি নিয়ে ভাবা দরকার। এমনিতেই বর্তমানে প্রচুর মামলা বিচারাধীন থাকায় মামলা নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে বহুমাত্রিক প্রতিবন্ধকতায় বিচারপ্রার্থীরা নতজানু। নানা রকম দীর্ঘসূত্রতার পাশাপাশি যদি প্রতিজন আইনজীবীর মৃত্যুতে আদালতের কার্যক্রম বন্ধ রেখে আদালত মুলতবি রাখা হয় তাহলে বছরে প্রচুরসংখ্যক বিচারপ্রার্থী ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হবে।

ফুল কোর্ট রেফারেন্সের প্রাচীন ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখার পাশাপাশি এর অসঙ্গতিগুলো দূর করে সুপ্রিম কোর্টের আদলে আইনজীবীদের মৃত্যুজনিত শোকসভা সব জেলা আইনজীবী সমিতিতে চালু করা দরকার। এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্ট, আইন মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ বার কাউন্সিল নিয়ম করে বছরে একবার শোকসভা অনুষ্ঠান করা দরকার।  যদি এ বিষয়ে একটি সর্বজনীন নিয়ম চালু করা যায় তবেই বিচারপ্রার্থীর ভোগান্তি লাঘব হতে পারে এবং ফুল কোর্ট রেফারেন্সের বিষয়টি সর্বজনীন নিয়মের আওতায় আসে।

লেখক : আইনজীবী এবং আইনবিষয়ক ছোট কাগজ ‘পঞ্চায়েত’ এর সম্পাদক।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর