শুক্রবার, ১১ মার্চ, ২০১৬ ০০:০০ টা

সৎকাজ করাই মানবতার দাবি

মুফতি আমজাদ হোসাইন

সৎকাজ করাই মানবতার দাবি

সৎ ও নেক কাজ করা মানবতা— ইনসানিয়াতের মূল দাবি। পবিত্র কোরআন-হাদিসে এ সম্পর্কে অসংখ্য-অগণিত আয়াত ও হাদিস বর্ণিত রয়েছে। যেমন- এক আয়াতে  ইরশাদ হচ্ছে, ‘তারা আপনার কাছে জিজ্ঞেস করে, কি তারা ব্যয় করবে! আপনি বলে দিন যে বস্তুই তোমরা ব্যয় কর, তা হবে পিতা-মাতার জন্য, আত্মীয়- আপনজনের জন্য, এতিম-অনাথদের জন্য, অসহায়দের জন্য এবং মুসাফিরদের জন্য। আর তোমরা যে কোনো সৎকাজ কর, আল্লাহ সে সম্পর্কে পূর্ণভাবে অবগত।’ (সূরা বাকারা : ২১৫) অপর আয়াতে ইরশাদ হচ্ছে, ‘তোমরা যে কোনো সৎকাজ কর তা আল্লাহ জানেন।’ (সূরা বাকারা : ১৯৭)  অপর আয়াতে ইরশাদ হচ্ছে, ‘কোনো ব্যক্তি অণু পরিমাণ সৎকাজ করলেও তা সে দেখতে পাবে।’ (সূরা যিলযাল : ৭) অপর আয়াতে ইরশাদ হচ্ছে, ‘যে ব্যক্তি সৎকাজ করে তা তার নিজের জন্যই করে। আর যে অসৎ কাজ করছে তা তার ওপরই বর্তাবে। অতঃপর তোমরা তোমাদের পালনকর্তার দিকে প্রত্যাবর্তিত হবে।’ (সূরা জাসিয়া : ১৫) হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসুল (সা.) বলেছেন, সূর্য উদয় হয় এমন প্রত্যেক দিন মানুষের মধ্যে তুমি যে ইনসাফ কর তা সাদাকা। তুমি মানুষকে তার জানোয়ারের উপর উঠিয়ে দিয়ে অথবা মাথার উপর তার আসবাবপত্র উঠিয়ে দিয়ে যে সাহায্য কর তাও সাদাকা। ভালো কথা বলাও সাদাকা। নামাজের দিকে যাওয়ার সময় তোমার প্রতিটি পদক্ষেপ সাদাকা। রাস্তা থেকে তুমি যে কষ্টদায়ক বস্তু সরিয়ে ফেল তাও সাদাকা। (বুখারি ও মুসলিম)  ইমাম মুসলিম (রা.) এই একই হাদিস হজরত আয়েশা (রা.) সূত্রে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, রসুল (সা.) বলেছেন, প্রতিটি আদম সন্তানকে ৩৬০টি গ্রন্থির সমন্বয়ে সৃষ্টি করা হয়েছে। অতএব যে ব্যক্তি আল্লাহর মহত্ত্ব বর্ণনা করে, তাঁর প্রশংসা করে, লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলে, সুবহানাল্লাহ বলে, তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে, লোকদের যাতায়াতের পথ থেকে পাথর অথবা কাঁটা অথবা হাড় সরিয়ে দেয়, অথবা সৎকাজের আদেশ করে, অথবা খারাপ কাজ করতে নিষেধ করে এসব কিছু সংখ্যায় ৩৬০ হয়ে যায়। আর এ লোকটির সারাটা দিন এভাবে কাটে যে, সে নিজকে দোজখের আগুন থেকে দূরে রাখল। উল্লিখিত আয়াতসমূহে সৎকাজ সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে।

বর্ণিত হাদিসে সৎকাজসমূহের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দেওয়া হয়েছে। ইমান আনার পর ‘মানব সেবা’ একটি অন্যতম ইবাদত ও নেক কাজের অন্তর্ভুক্ত। ‘মানুষের জন্য মানুষ’-এ স্লোগানে নিজের জীবনকে তৈরি করে অপরের কল্যাণে দৌড়িয়ে যাওয়া, আত্মনিয়োগ করা, তাদের ইমান-আমানের ফিকির করা, অপরের দুঃখে দুঃখিত হওয়া, নিজের স্বার্থের ওপর অন্যের স্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়া মানবতা-ইনসানিয়াতের মূল দাবি। রসুল (সা.) সারাটি জীবন মানুষের উপকারে ব্যয় করেছেন। মানবতাকে দুনিয়া ও আখিরাতে মুক্তির পথ বাতলিয়ে দিয়েছেন। মানবতাকে শিখিয়ে গেছেন মানব সেবার পদ্ধতিগুলো। মানবতার আরাম-আয়েশের ফিকির করেছেন। দুনিয়াবি কারণে জীবনে কাউকে কখনো কষ্ট দেননি। মুশরিক কর্তৃক হাজারো কষ্ট পাওয়ার পরও তাদের জন্য বদদোয়া করেননি। দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করে দিয়েছেন আমাকে আল্লাহপাক মানুষের জন্য রহমত বানিয়ে প্রেরণ করেছেন, মানুষের ওপর লা’নত করার জন্য প্রেরণ করেননি। তিনি আরও ঘোষণা করেছেন, ‘যারা জমিনবাসীর ওপর দয়া করবে তাদের ওপর আল্লাহপাক দয়া করবেন।’ প্রিয় পাঠক! মানবতা ও মানব সেবা আজ নীরবে-নির্জনে কান্না করছে। মানব সেবা তো দূরের কথা প্রতিদিন পত্রিকার পাতা উল্টালে দেখা যায় মানুষ কর্তৃক মানুষ কীভাবে নির্যাতিত হচ্ছে। পুরুষ কর্তৃক নারী নির্যাতিত হচ্ছে, নিষ্পাপ শিশুরাও নির্যাতন থেকে রেহাই পাচ্ছে না। এমনিভাবে এমন নিকৃষ্ট স্বভাব মানুষ গ্রহণ করছে যা দেখে অন্য প্রাণীরাও নীরবে-নির্জনে অশ্রু ঝরাচ্ছে। মা কর্তৃক আপন সন্তানকে জীবন্ত হত্যা করছে। এই স্বভাব অন্য কোনো প্রাণীর মধ্যে আছে বলে অন্তত আমার জানা নেই। একজন শিশুর কি অপরাধ! সে কি মানুষের ঔরসজাতে জন্ম নিয়ে অপরাধ করেছে? কেন তার ওপর এমন বর্বর নির্যাতন করা হচ্ছে? সুন্দর দুনিয়ার আলো-বাতাস থেকে তাকে মাহরুম করা হচ্ছে? এ ধরনের মানুষ আজ সমাজের কোন স্তরে বাস করছে? তাদের সমাজের কোনো স্তরেই রাখা যায় না। তারা দেশ, জাতি ও সমাজের শত্রু। সম্মিলিতভাবে এদের প্রতিহত করতে হবে। সামাজিকভাবে এদের সঙ্গ বয়কট করতে হবে। প্রয়োজনে এদের কাছে দীনি শিক্ষার আলো পৌঁছে দিতে হবে। আল্লাহতায়ালা নবী করিম (সা.)-কে দুনিয়ার বুকে পাঠিয়ে মানুষকে মানবতা-ইনসানিয়াত শিক্ষা দিয়েছেন। দীনি শিক্ষার বরকতে জাহেলি যুগের তামাম কু-প্রথা দূর হয়ে গেছে। নববী শিক্ষা পেয়ে তারা মানবতা-ইনসানিয়াতের সর্বোচ্চ স্তরে উন্নীত হতে পেরেছেন। তাদের আরও বলতে হবে দেখ আল্লাহর সৃষ্টির মধ্যে অতি ক্ষুদ্র একটি প্রাণী পিপীলিকা। সে প্রভাতে বাসা থেকে বের হয় রিজিকের তালাশে। কোথাও যদি একটি খাদ্যের দানা পেয়ে যায় তা সঙ্গে সঙ্গে মুখে নিয়ে নিজের বাসার কাছে নিয়ে এসে অপরের হাওলা করে। জাতি ভাইদের খবর দেয় চলো চলো অমুক এলাকায় খাবার আছে সবাই মিলে ওই খাবার গ্রহণ করি। তাদের চলার পথে দেখা যায় এমনভাবে চলে যাতে অপর ভাইয়ের কষ্ট না হয়। একের দুঃখে অন্যরা সবাই তার দুঃখ দূর করার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে। অনুরূপভাবে একটি জোনাকি পোকা তার আলো দিয়ে প্রতিনিয়ত অপরের উপকার করে যাচ্ছে। কখনো কারও কাছে বিনিময় পর্যন্ত যাচ্ছে না। আমরা মানুষ হয়ে কেন মানুষের উপকার করতে পারব না? কেন নিকৃষ্ট স্বভাবগুলো নিজেদের থেকে দূর করতে পারব না?  অবশ্যই পারব যদি আমাদের মাঝে দীনি শিক্ষা ও আল্লাহ-রসুল (সা.)-এর ভয় থাকে। আল্লাহপাক আমাদের সবাইকে মানব সেবার কাজে নিয়োজিত হওয়ার তাওফিক দান করুন।  আমিন।

লেখক : মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও খতিব বারিধারা, ঢাকা।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর