রবিবার, ১৩ মার্চ, ২০১৬ ০০:০০ টা

প্রাথমিক শিক্ষার মেয়াদ বৃদ্ধি এবং পথভ্রষ্টতা

অধ্যাপক ছিদ্দিকুর রহমান

প্রথম পর্ব

দেশে দেশে বিভিন্ন সময়ে রাষ্ট্রনায়কের আবির্ভাব ঘটে, কিন্তু মানবকল্যাণে যুগান্তকারী অবদান রেখে মাইলফলক স্থাপনকারী রাষ্ট্রনায়কের সংখ্যা নিতান্তই সীমিত। বাংলাদেশে এমন মাইলফলক স্থাপনকারী এখন পর্যন্ত একজনই।  ক্ষণজন্মা আমাদের জাতির পিতা বাংলার সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দুটি মাইলফলকের একটি হচ্ছে, দীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রামের মাধ্যমে বিশ্বদরবারে বাংলাদেশ নামে একটি নতুন স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা, অন্যটি হচ্ছে স্বাধীনতার অব্যবহিত পরের জীর্ণ অর্থনীতির ওপর দাঁড়িয়ে প্রাথমিক শিক্ষার জাতীয়করণ। যার মাধ্যমে ৩৭ হাজার বিদ্যালয়ে কর্মরত লাখ লাখ শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীর চাকরি একসঙ্গে সরকারিকরণ করা হয়। বলাবাহুল্য, প্রাথমিক শিক্ষায় আজকের অর্জিত উন্নয়নের গোড়াপত্তন সেখান থেকেই। প্রসঙ্গত, অবিভক্ত ভারতের শিক্ষা ক্ষেত্রের আরেকটি মাইলফলকের কথা উল্লেখ না করলেই নয়; তা হচ্ছে ১৮৫৪ সালের উডের এডুকেশন ডিসপ্যাচ যা থেকে বর্তমানে প্রচলিত সাধারণ শিক্ষার সূচনা।

বর্তমান সরকার দেশের বিপুল জনসংখ্যাকে জনসম্পদে রূপান্তরের মাধ্যমে দেশের মানুষের ভাগ্য উন্নয়নের লক্ষ্যে জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ গ্রহণ করে। নীতি যতই ভালো হোক তাতে কোনো লাভ নেই যদি তা বাস্তবায়নের মাধ্যমে মানুষের জীবনমানের কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন না ঘটে। জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এ অন্তর্ভুক্ত নীতিগুলোর মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষার প্রবর্তন। যে দর্শনের ওপর ভিত্তি করে তা গ্রহণ করা হয়েছে তার সঠিক বাস্তবায়ন করা গেলে তা এ দেশের শিক্ষার ইতিহাসে আরেকটি মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হবে। কারণ এতে শিক্ষার মৌলিক ভিত তৈরি হবে যা মানবসম্পদ উন্নয়নের অন্যতম পূর্বশর্ত।

গত ২৬ ফেব্রুয়ারি পত্রপত্রিকায় দেখলাম সরকার চলতি বছরের মে মাস থেকে প্রাথমিক শিক্ষার মেয়াদ বৃদ্ধির কাজ শুরু করবে। খবরটা পড়ে প্রথমে যতটা উল্লসিত হয়েছি, এর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া পড়ে মর্মাহত হয়েছি ঢের বেশি। পত্রপত্রিকায় বলা হয়েছে, প্রথম পর্যায়ে একাডেমিক স্বীকৃতিপ্রাপ্ত ও শিক্ষাদানের অনুমতিপ্রাপ্ত ৪,৩৬৫টি নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয়কে প্রাথমিকের নিয়ন্ত্রণে নেওয়া হবে। পরবর্তীতে নতুন শ্রেণিকক্ষ তৈরি এবং নতুন শিক্ষক নিয়োগ করে প্রয়োজনীয় সংখ্যক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পর্যায়ক্রমে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা চালু করা হবে। উল্লেখ্য, ২০১৩ সালে একবার এ ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল। তখন ৫৯৬টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণি এবং পরবর্তী দুই বছরে ওই বিদ্যালয়সমূহে সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণি চালু করা হয়। ওইসব বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ২০১৫ সালে অষ্টম শ্রেণি শেষ করে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে একই প্রশ্নে জুনিয়র সার্টিফিকেট পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে। যারা ড. কুদরত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন প্রণয়ন এবং আমরা যারা জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ প্রণয়নের সঙ্গে জড়িত, অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়নের বর্তমান অনুসৃত পদ্ধতি দেখে সবারই হতভম্ব ও বিস্মিত হওয়ার কথা। ড. কুদরত-এ-খুদা এবং জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরী বেঁচে থাকলে অবশ্যই মারাত্মক মানসিক যন্ত্রণায় ভুগতেন। মাধ্যমিক শিক্ষার দর্শনের ওপর ভিত্তি করে প্রণীত মাধ্যমিক শিক্ষার শিক্ষাক্রম এবং পাঠ্যপুস্তকসমূহ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়ালে হয় মাধ্যমিক শিক্ষা এবং একই শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তকসমূহ প্রাথমিক বিদ্যালয়গৃহে পড়ালে হয় প্রাথমিক শিক্ষা! এ যেন গির্জায় বসে বাইবেল পড়লে হয় ‘বাইবেল পাঠ’ এবং মন্দিরে বসে একই বাইবেল পড়লে হয় ‘গীতা পাঠ’। স্থানভেদে পড়ার কারণে কি বাইবেল পরিবর্তন হয়ে গীতা বা গীতা পরিবর্তন হয়ে বাইবেল হয়ে যায়? মুখ্য কোনটি? কোথায় পড়ানো হলো তা মুখ্য, নাকি কী পড়ানো হলো এবং কীভাবে পড়ানো হলো তা মুখ্য? অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা চালু করার আগে মেয়াদ বৃদ্ধির দর্শন সম্পর্কে আমাদের ধারণা স্পষ্ট করা প্রয়োজন।

স্বাভাবিক, সাবলীল, সুন্দর জীবনযাপনের যোগ্যতা অর্জন ও সাধারণ জীবন সমস্যা সমাধানের যোগ্যতা অর্জন এবং পরবর্তী শিক্ষা অর্জনের জন্য শক্ত ভিত তৈরি করাই হচ্ছে মৌলিক শিক্ষার লক্ষ্য। আমাদের দেশে প্রাথমিক শিক্ষার মাধ্যমে মৌলিক শিক্ষা অর্জন করার কথা। মৌলিক শিক্ষা শেষে কেউ কেউ পরবর্তী সাধারণ শিক্ষায় না গিয়ে বৃত্তিমূলক শিক্ষা নিয়ে কর্মজীবনে প্রবেশ করবে, অন্যরা পরবর্তী শিক্ষায় প্রবেশ করবে। তাই মৌলিক শিক্ষা সমাপ্তিকে সাধারণ শিক্ষার প্রান্তিক স্তর বলা হয়। দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থা ভেদে মৌলিক শিক্ষার মেয়াদ নির্ধারণ করা হয়। আমাদের দেশে বর্তমানে এর মেয়াদ আট বছর, ভবিষ্যতে বাড়তে পারে। দেশভেদে ৯ থেকে ১২ বছরও আছে। মৌলিক শিক্ষা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব। এ শিক্ষা নির্ধারিত বয়সের সবার জন্য বাধ্যতামূলক ও অবৈতনিক। মৌলিক শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য টেকসই সাক্ষরতা, মৌলিক জ্ঞান, জীবন দক্ষতা ও মানবিক গুণাবলিসম্পন্ন যুক্তিবাদী ও দেশপ্রেমিক নাগরিক তৈরি। আমাদের দেশে বর্তমানে প্রচলিত প্রাথমিক শিক্ষা এ লক্ষ্য অর্জনের জন্য অনুপযোগী এবং মেয়াদও অপর্যাপ্ত। তাই জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এ প্রাথমিক শিক্ষার শিক্ষাক্রম উন্নয়ন করে লক্ষ্যমুখী করা এবং মেয়াদ বৃদ্ধি করে আট বছর করার নীতি গ্রহণ করা হয়েছে। মাধ্যমিক স্তরের জন্য প্রণীত ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণির শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক ভিত্তিক পাঠদান কার্যক্রম প্রাথমিক স্কুলে পরিচালিত করে উল্লিখিত লক্ষ্য অর্জন কোনো অবস্থাতেই সম্ভব নয়। এমনকি প্রাথমিক স্তরে বর্তমানে প্রচলিত পাঁচ বছর মেয়াদি শিক্ষার শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক অপরিবর্তিত রেখে এর সঙ্গে ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণির নতুন শিক্ষাক্রম জোড়াতালি দিয়েও সম্ভব নয়। প্রাথমিক শিক্ষার দর্শনভিত্তিক প্রথম থেকে অষ্টম শ্রেণিকে একই অবকাঠামোর আওতায় এনে নতুন করে শিক্ষাক্রম প্রণয়ন ও শিখনসামগ্রী তৈরি করতে হবে। এ ধরনের শিক্ষাক্রম প্রণয়নের কাজটি টেকনিক্যাল এবং অপেক্ষাকৃত জটিল। এ কাজ করার জন্য শিক্ষাক্রম উন্নয়ন বিষয়ে উচ্চতর একাডেমিক ডিগ্রিধারী যার দেশ-বিদেশের শিক্ষাক্রম সম্পর্কে প্রগাঢ় জ্ঞান আছে এবং যিনি শিক্ষাক্রম প্রণয়নে দীর্ঘ অভিজ্ঞতাসম্পন্ন এমন একজন শিক্ষাবিদের নেতৃত্বে আরও দু-চারজন শিক্ষাক্রম বিশেষজ্ঞ, শিশু মনোবিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানী, শিক্ষক-প্রশিক্ষক ও দক্ষ শ্রেণি শিক্ষকের সমন্বয়ে একটি কমিটি দ্বারা এ কাজটি করা যেতে পারে। কমিটিতে শিক্ষা নিয়ে চিন্তাভাবনা করেন এমন দু-একজন জনপ্রতিনিধি ও অভিভাবক রাখা যেতে পারে। কমিটির কাজে সমন্বয় করা ও সার্বিক সহযোগিতা প্রদানের দায়িত্ব জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডকে দেওয়া যেতে পারে। পদাধিকার বলে বলীয়ানদের যত কম রাখা যায় ততই মঙ্গল।

প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নতুন শ্রেণিকক্ষ তৈরি এবং বিষয়ভিত্তিক নতুন শিক্ষক নিয়োগ করে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা চালু করার জন্য বর্তমানে যে পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে তা মারাত্মক ভুল পদক্ষেপ। এতে একদিকে সরকারের প্রচুর অর্থের প্রয়োজন হবে, অন্যদিকে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে বর্তমানে কর্মরত অনেক শিক্ষক চাকরি হারাবেন। সার্বিকভাবে এই পদক্ষেপ সরকারের জন্য সমস্যার নতুন দ্বার তৈরি করে সরকারকে বিব্রত করবে। নতুন শিক্ষক নিয়োগ করে এবং নতুন শ্রেণিকক্ষ তৈরি ও আসবাবপত্রের ব্যবস্থা করে অতি অল্প সময়ে এবং অতি অল্প খরচে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা চালু করা ও এর মাধ্যমে মৌলিক শিক্ষার লক্ষ্য অর্জন এককথায় অসম্ভব।  পরবর্তী পর্ব ‘প্রাথমিক শিক্ষার মেয়াদ বৃদ্ধি : সঠিক পথের সন্ধানে’ শীর্ষক প্রবন্ধে এসব বিষয়ে আলোকপাতের চেষ্টা করা হয়েছে।

লেখক : অধ্যাপক ও প্রাক্তন পরিচালক, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

e-mail: [email protected]

সর্বশেষ খবর