রবিবার, ১৩ মার্চ, ২০১৬ ০০:০০ টা
পরিবেশ

নদী বাঁচলে ঢাকা বাঁচবে

জামিল হাসান

নদী বাঁচলে ঢাকা বাঁচবে

দখল দূষণের উন্মত্ত শিকারে পরিণত হয়েছে রাজধানীর চারটি নদী। বুড়িগঙ্গা ও শীতলক্ষ্যা নদী এবং বালু ও তুরাগ নদের বেশির ভাগ অংশের পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের মাত্রা শূন্যের কোঠায়। পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) একটি বিশেষজ্ঞ দল রাজধানীর চার নদ-নদী পর্যবেক্ষণ এবং পানি পরীক্ষা করে এ তথ্য দিয়েছে।  গত ২৯ ফেব্রুয়ারি থেকে ৩ মার্চ পর্যন্ত পবার বিশেষজ্ঞ দল চার নদ-নদীর দূষণ পরীক্ষা এবং দখল-ভরাট পর্যবেক্ষণ করে। পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে পবার বিশেষজ্ঞ দল বলেছে, মত্স্য ও জলজ প্রাণীর বিলুপ্তিসহ চার নদ-নদী আজ মৃতপ্রায়। টঙ্গী, গাজীপুর, সাভার, নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জ, কেরানীগঞ্জ এলাকার পয়োবর্জ্য, গৃহস্থালি বর্জ্য, শিল্পকারখানা ও হাসপাতালের কঠিন বর্জ্য, হাজারীবাগের ট্যানারি বর্জ্য, নৌযান নির্মাণ, মেরামত ও রংকরণ, নৌযান থেকে নির্গত তেল এবং নৌযানের বর্জ্য রাজধানীর চার নদী দূষণের অন্যতম কারণ। চার নদ-নদীর দূষিত পানি ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে। রাজধানীবাসীর পানির প্রয়োজন মেটাতে নির্বিচারে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন করা হচ্ছে। ফলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ঢাকার অনেক এলাকায় প্রতিবছর ১০ ফুট করে নেমে যাচ্ছে। অন্যদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে উজানে লবণাক্ত পানি প্রবাহিত হচ্ছে। নদী দূষণমুক্ত ও পানি প্রবাহ বাড়ানো না গেলে এবং বর্তমান অবস্থা চলতে থাকলে আগামী ২০ বছরের মধ্যে পানির অভাবে ঢাকা বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়বে। এ অবস্থার উত্তরণে তারা সমন্বিত কার্যক্রম গ্রহণ ও বাস্তবায়নের তাগিদ দেন। সংবাদ সম্মেলনে রাজধানীর চার নদীকে দখল দূষণমুক্ত করার যে তাগিদ দেওয়া হয়েছে তা তাত্পর্যের দাবিদার। তবে তাদের এ আহ্বান কর্তাব্যক্তিদের কর্ণকুহরে প্রবেশ করবে কিনা সে বিষয়টি স্পষ্ট নয়। সবারই জানা রাজধানীর চার নদীর দখল দূষণ রোধে ইতিপূর্বে উচ্চ আদালতের পক্ষ থেকে নির্দেশনা দেওয়া হলেও তা প্রশাসনের কুম্ভকর্ণের ঘুম ভাঙার ক্ষেত্রে কোনো অবদান রাখতে পারেনি। গণমাধ্যমগুলো নিরলসভাবে এ বিষয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেও তাদের শুভবুদ্ধির উদয় ঘটাতে পারেনি। রাজউক, দুই ঢাকা সিটি করপোরেশন, বিআইডব্লিউটিএ ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে গত পাঁচ বছরে প্রায় অর্ধশতবার অভিযান চালানো হলেও বন্ধ হয়নি নদী দখলের ঘটনা। দখলদারদের আগ্রাসনে বুড়িগঙ্গা ও শীতলক্ষ্যা নদী এবং বালু ও তুরাগ নদের অস্তিত্ব ক্রমান্বয়ে বিপন্ন হয়ে পড়ছে। বুড়িগঙ্গার দক্ষিণ পাড়ের আটি, খোলামোড়া, আগানগর, কালীগঞ্জ হয়ে পারগেণ্ডারিয়া ও হাসনাবাদ এলাকায় দখলদারদের আগ্রাসনে সঙ্কুচিত হয়ে পড়েছে নদী। নদীতীরে প্রভাবশালীদের নেতৃত্বে চলছে বালু ব্যবসা। ঝুঁকিপূর্ণ নৌযানে বালু এনে তা নদীর তীরে খালাস করা হচ্ছে। এর ফলে ভরাট হয়ে যাচ্ছে নদীর তলদেশ। ভরাট হচ্ছে বুড়িগঙ্গার পাড়, চলছে দখলদারদের তত্পরতা। তুরাগ নদীর তীরেও চলছে একইভাবে দখল তত্পরতা। দখলদারদের আগ্রাসী তত্পরতায় শীতলক্ষ্যা এবং বালু নদীও ক্রমেই সংকীর্ণ হয়ে পড়ছে। প্রভাবশালীদের কারণে মানচিত্র থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে এই নদী।

শীতলক্ষ্যা এখন শুধু দখল নয়, দূষণেরও নির্মম শিকার। এক সময় শীতলক্ষ্যার পানি এত স্বচ্ছ ছিল যে, ডিস্টিল ওয়াটারের বোতলে লেখা হতো শীতলক্ষ্যার পানি দিয়ে তৈরি। সে নদীর পানি এখন পরিশোধনের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। রাজধানীর চার নদীর ভয়াবহ দূষণের জন্য দায়ী আমাদের কাণ্ডজ্ঞানহীন আচরণ। ঢাকা মহানগরে পয়োবর্জ্যের পরিমাণ ১৪ লাখ ঘনমিটার। যার মধ্যে মাত্র ৫০ হাজার ঘনমিটার পরিশোধন করা হচ্ছে।

হাজারীবাগের ট্যানারিগুলো থেকে প্রতিদিন ২২ হাজার কিউবিক মিটার অপরিশোধিত বর্জ্য নদীতে পড়ছে। এসব বর্জ্যে রয়েছে ক্রোমিয়াম, সিসা, সালফিউরিক এসিড ইত্যাদি। টেক্সটাইল কারখানার বর্জ্যসহ বিভিন্ন শিল্পকারখানার ১ লাখ ২০ হাজার ঘনমিটার বর্জ্য নদীতে পড়ছে। ঢাকা মহানগর ও আশপাশের এলাকার গৃহস্থালি বর্জ্য, শিল্পকারখানা ও হাসপাতালের কঠিন বর্জ্যের ৪০ শতাংশ যা প্রায় ৩ হাজার টন, এগুলো নালা-নর্দমা, খাল ও জলাভূমি হয়ে নদীতে পড়ছে। ফলে রাজধানীর চার নদ-নদী ও জলাশয়গুলো নির্মম দূষণের শিকারে পরিণত হচ্ছে।

ঢাকার নদ-নদীগুলো ঐতিহ্যের অনুষঙ্গ। বুড়িগঙ্গাকে কেন্দ্র করেই মোগল আমলে ঢাকায় সুবে বাংলার রাজধানী গড়ে উঠেছিল। এখন এ মহানগরী স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী। দেড় কোটি মানুষের এই মহানগরীর পরিবেশ অনেকাংশে চার নদীর অস্তিত্বের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু দখলদার ও দূষণকারীদের দৌরাত্ম্যে ঢাকার নদীগুলো তাদের অস্তিত্ব হারাতে বসেছে।  প্রশাসনের কুম্ভকর্ণের কারণে বিপন্ন হয়ে পড়ছে ঢাকার পরিবেশ। নদী দখল বন্ধে সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব না থাকলেও যথাযথ পদক্ষেপের অভাবে তা সফল হচ্ছে না। প্রশাসনের কৃতসংকল্প ভূমিকাই এ ক্ষেত্রে আশার আলো জাগাতে পারে। নদী বাঁচলে ঢাকা বাঁচবে।

আমাদের বিশ্বাস নিজেদের সুনামের স্বার্থেই সরকার এটিকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নেবে এখনই।

লেখক : প্রাবন্ধিক।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর