আমার বাবা স্বর্গীয় কালা চান দত্ত ছিলেন অত্যন্ত সরল, স্বল্পশিক্ষিত, কিন্তু সমাজসচেতন। পাড়া-প্রতিবেশীর ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়ার প্রতি ছিল তার আগ্রহ। প্রতিবেশী কারও ছেলে-মেয়ে লেখাপড়ায় ভালো হলে, তাদের প্রতি থাকত গভীর স্নেহ ও ভালোবাসা। গ্রামে আমাদের সিনিয়রদের মধ্যে নৃপেন্দ্র দত্ত, মতিলাল ভদ্র, নিরঞ্জন কর, নন্দলাল দত্ত, ইব্রাহীম মজুমদার, মান্নান মজুমদার, মোক্তাদির মজুমদার, গোপাল সেন, আতাউর রহমান মজুমদার, মিজানুর রহমান মজুমদার, মিলন ভাইসহ অন্যদের সবাইকে তিনি একটা বিশেষ দৃষ্টিতে দেখতেন। প্রায়ই অনিয়ম করলে, তাদের উদাহরণ আমাদের সামনে তুলে ধরতেন। তারা যে শুধু ভালো ছাত্র ছিলেন তাই নয়, সবাইর ভদ্রতা ও সভ্যতা জ্ঞানের ভূয়সী প্রশংসা করে বুঝাতেন, আমরা অপদার্থ। বরাবরই বলতেন তাদের অনুসরণ করার জন্য।
আমার অন্য একটি লেখায়, আমি বলেছিলাম, অন্যসব লোকের মতো আমার বাবা কুষ্টি-ঠিকুজী খুব বিশ্বাস করতেন। বছরের প্রথম দিন, পহেলা বৈশাখ, এসব জন্ম দলিলপত্র বিশ্লেষণের জন্য লেখক (ঠাকুর বা পণ্ডিতমশাই) অন্যসব জ্ঞানী লোকদের মতো আমাদের বাড়িতেও আসতেন। বিশ্লেষণে আমার বেলায়, জন্মক্ষণে বিদ্যাদেবী নিদ্রিত। বৃহস্পতির সামান্য দৃষ্টি ছিল। শনি ও খড়্গহস্তে দাঁড়িয়ে অর্থাৎ শনির দশা ঘুরেফিরে আছেই, মঙ্গল নিষ্প্রভ। আমার প্রশ্ন ছিল আরও অনেক গ্রহ-নক্ষত্র ছিল, তারা কি অবস্থানে ছিল যেমন শুক্র, ইউরেনাস, প্লুুটো ইত্যাদি। ছোটবেলা থেকে আগ্রহ ছিল খেলাধুলায়। হাতও ভেঙেছি কয়েকবার, নাক থেকে রক্ত ঝরেছে অনেক সময়। এসব কারণে শাসিত হয়েছি, তবে খুব বেশি নির্যাতিত হইনি। কারণ আমার সার্বক্ষণিক দেখার দায়িত্ব এবং জীবনের সবচেয়ে বেশি আদর যার কাছ থেকে পেয়েছি, তিনি হলেন আমার ক্লাস ওয়ান পাস ঠাকুর মা এবং আমার বাবার মা। ক্লাস ওয়ান পাস, স্কুল ইন্সপেক্টরের প্রশ্নের জবাব দিতে পেরে স্লেট ও পেনসিল পুরস্কার গ্রহণ। সর্বোপরি নামি-দামি উকিল, রমণীমোহন পালের সুন্দরী বোন, সবই ছিল তার অহংকারের ঝুলিতে। আমি তাকে ভয় না পেলেও তার সন্তানরা অর্থাৎ বাবা-কাকারা তাকে খুব ভয় পেতেন, এমনকি দাদুও।
যদিও বাড়িতে, পূজা-পার্বণ, সকাল-সন্ধ্যা ঠাকুর পূজা, দুপুরে ঠাকুরের আসন এবং সেবা দেওয়া অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করা হতো, তারপরেও আমার এর প্রতি বিশেষ টান ছিল না। যতই বড় হয়েছি, জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিদের জীবন-চরিত্র পড়ার সুযোগ হয়েছে। ততই ধর্মের প্রতি আমার বিশ্বাস বেড়েছে। ঠিক ধর্ম বললে ভুল হবে অর্থাৎ স্রষ্টার প্রতি। আমি স্রষ্টায় বিশ্বাসী কিন্তু অজ্ঞেয় নই। অনেক বিশ্বাসী মহৎ ব্যক্তির জীবনী যেমন পড়েছি। ঠিক তেমনি অসংখ্য অজ্ঞেয় ব্যক্তির জীবনী পড়েছি ও সান্নিধ্য পেয়েছি, কিন্তু তারা কেউ আমাকে অবিশ্বাসী হতে শিক্ষা দেয়নি, বাধ্যও করেনি। সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের অদেসাতে যখন আমি পিএইচডি করি, তখনো ট্রামে বা বাস বা ট্রলি বাসে করে কর্মস্থলে যাওয়ার পথে বা ফেরার পথে, পুরনো গির্জার সামনে দিয়ে চলার পথে অনেক কমিউনিস্ট নাগরিককে গির্জাকে গাড়িতে বসেই প্রণাম জানাতে দেখেছি। ধর্মটা একটা গভীর শ্রদ্ধার বিষয়, সম্পূর্ণ শিক্ষার বিষয়, পালনের দায়িত্ব, ধর্মীয় অনুশাসন মানুষের জীবনকে সুন্দর করে, গৌরবান্নিত করে। তাই বলা হয় ধর্ম শিক্ষা বা ধর্ম পালন। কখনো বলা হয় না, তোমরা সবাই ধর্ম প্রচার কর। ধর্ম হলো ব্যক্তিগত ব্যাপার, পারিবারিক ও সামাজিক হতে পারে কিন্তু ধর্ম কখনো রাষ্ট্রীয় বা গ্লোবার নয়। শুধু ধর্ম প্রচারের জন্য কত যুদ্ধ হয়েছে, কত প্রাণ বলি হয়েছে, কত জাতি এবং সভ্যতা ধ্বংস হয়েছে— তার ইয়ত্তা নেই। আমি ব্যক্তিগতভাবে শুধু ধর্ম বিশ্বাসী নই, ভাগ্যেও বিশ্বাসী। আমি যেমন বিজ্ঞানে বিশ্বাসী, তেমনি ঐশ্বরিক বা আধ্যাত্মিক শক্তিতেও বিশ্বাসী। যদিও বিজ্ঞান আর ধর্ম বিশ্বাস একসঙ্গে চলতে পারে না। চেয়েছিলাম রসায়নবিদ হতে, হয়েছি জৈব রসায়ন অর্থাৎ মানবদেহের রসায়নের ছাত্র। পর্যায়ক্রমে মানবদেহের আংশিক বিশেষজ্ঞ। কিন্তু ঘুরেফিরে স্রষ্টার প্রতি শুধু বিশ্বাস বেড়েই চলেছে।আমাদের গ্রামে জমিদারবাড়ীর এক সন্তান ছিলেন, অন্ধ। আমরা ছোটবেলায় তাকে কানা নামে ডাকতাম এবং সে যদি বাবাকে নালিশ করত তখন যে কথাটা বাবা আমাদের শাসনের স্বরে বলতেন তা হলো, প্রতিবন্ধীদের নিয়ে কোনো ঠাট্টা-তামাশা করা খুবই অপরাধ এবং ভগবান তা সহ্য করেন না। তোমার ছেলে-মেয়েও কেউ এরকম হতে পারে, তোমার ভাই-বোনরাও কেউ এরকম হতে পারত। তার পরে দেখ সে অন্ধ হয়েও গ্রামের এ প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে চলে যায়। কখনো কোনো দুর্ঘটনায় পড়েনি। তোমাদের চোখ থাকা সত্ত্বেও তোমরা হোঁচট খেয়ে পড়ে গিয়ে কত ধরনের আঘাত পাও। তাহলে বুঝতে পেরেছ। তার দৃষ্টি নেই, কিন্তু অনুভূতি শক্তি তোমাদের চেয়ে হাজার গুণ বেশি। তিনি প্রায়ই বলতেন, ‘তুমি দুস্থ-পীড়িত ও দরিদ্রদের সেবা দাও, তাদের মধ্যে স্রষ্টাকে খুঁজে পাবে এবং প্রকৃতির সবকিছুর মধ্যে স্রষ্টা বিরাজমান।’ যদিও তার নাম ছিল হরিভূষণ সিংহ, কিন্তু সবাই চিনত কানাহরি হিসেবে। দুর্ভাগ্য এই কানাহরিও পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে ১৯৭১ সালে শহীদ হন। আরেকজন এখনো বেঁচে আছেন, জন্মগত অন্ধ সুভাষ কর, সেও কিন্তু স্বনির্ভর।
আমাদের স্কুলের মৌলভী স্যার যিনি ছিলেন আমার প্রিয় প্রধান শিক্ষক আবদুল কাদির মজুমদার স্যারের বড় ভাই রহিম বক্স মজুমদার, যিনি ১১৬ বছর বয়সে পরলোকগমন করেন, তার সঙ্গে আমাদের বাবার প্রচণ্ড মিল ছিল। আমার তিন বন্ধু ও সহপাঠী নুরু, মতি এবং খালেক, তাদের প্রতি আমার বাবার ভালোবাসা ছিল অনেকাংশে আমার চেয়ে বেশি। আমাদের ঘরে তাদের অবাধ বিচরণ ছিল। মৌলভী স্যারের মতো ধর্ম নিয়ে বাবার একটাই ব্যাখ্যা ছিল, হিন্দু, বৌদ্ধ, মুসলিম, খ্রিস্টান, জৈন, শিখ, পার্সিয়ান সবাই এক স্রষ্টার সৃষ্টি। প্রকৃতির দান। সবাই একইভাবে পৃথিবীতে আসে, মৃত্যুকে অনিবার্য সাথী করে। অনেকেই জানেন প্রতিবন্ধী নিয়ে আমি সামান্য কাজ করি, প্রখ্যাত শিশু মনোবিজ্ঞানী সায়মা ওয়াজেদ হোসেন পুতুলের নেতৃত্বে। তার কাজও আমার নিষ্প্রভ চোখকে আলোতে উদ্ভাসিত করেছে। তখন বারবারই বাবার সেই কোমল চেহারাটা আমার সামনে ভেসে ওঠে। আমি এই বিশেষ শিশুদের সঙ্গে কাজ করার দ্বিগুণ প্রেরণা পাই। যাদের আমি Gifted Child (দেব শিশু) Differently abled (বিশেষভাবে পারদর্শী) শিশু হিসেবে আখ্যায়িত করি। দুর্ভাগ্য ১৯৭১-এর ১৩ নভেম্বর যখন তিনি মৃত্যুবরণ করেন, বাড়িঘর ধ্বংস হয়ে যায়। তার কোনো একটা ছবিও আমরা পাইনি। দেশে এমন কোনো সহৃদয় ব্যক্তিও ছিলেন না, যিনি একটা ছবির স্কেচ করে দিতে পারেন। তবুও মনের মন্দিরে সেই ছবিটা সবসময়ই আলোকিত হয়ে থাকে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও আমার এই জেদী একরোখা বাবার জন্যই আমাকে ডাক্তার হতে হয়েছিল। আগেও লিখেছিলাম, ‘বাবা, তুমিই সঠিক’। কারণ ডাক্তার হওয়ার সুবাধেই আজ আমি মানুষের কাছে ন্যূনতম পরিচিতি পেয়েছি। দরিদ্র-অসহায় এমনকি এলাকাবাসীকে বিনামূল্যে সেবা দিতে পারছি। ডাক্তার হয়েছি বলেই আজ আমি ‘অটিজমসহ বিভিন্ন স্নায়ু বিকাশজনিত বা গঠন বিকাশজনিত’ অনেক রোগীর সেবার পথ খুঁজে পেয়েছি। তাদের পাশে দাঁড়ানোর পথ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার কন্যা সায়মা ওয়াজেদ হোসেন পুতুল বিশিষ্ট মনোরোগ বিশেষজ্ঞ এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক মার্গারেট চেনের উপদেষ্টা আমাকে সুযোগ করে দিয়েছেন।
জমিদারবাড়ীর অন্ধ সেই কানা ছেলেটা, হরিভূষণ সিংহ। সেই ছেলেটাকে নিয়ে ঠাট্টা-তামাশার জন্য আজ নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে। কারণ সুযোগ পেলে সে হয়তোবা হয়ে উঠত একজন মেধাবী গুণী ব্যক্তি। কিন্তু তখনকার সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের ওই জ্ঞান ছিল না, শিক্ষাদানের সুযোগ ছিল না, পুনর্বাসন তথা মূল্যায়নও হতো না। তারা ছিলেন অন্যদের গলগ্রহ। বাবার কিছু ঘটনা আমার মন-বিবেক এবং স্বল্পবুদ্ধিকে আলোকিত করেছিল, আমাকে চিন্তা করার ক্ষমতা দিয়েছিল, এখনো অনেক চিন্তার খোড়াক সেখান থেকেই অহরহ পেয়ে যাচ্ছি, আমাকে শিক্ষাদান করেছিল এবং দেশের মানুষকে ভালোবাসা ও চিকিৎসাদানে প্রেরণা জুগিয়ে যাচ্ছে আজও। পবিত্র ইসলাম ধর্মের নির্দেশনায় আমাদের প্রতিবেশীদের আমার সেবাদানের বাধ্যবাধকতা যেমন আছে, তেমনি তাদেরও আমার প্রতি হক আছে। এই মন্ত্র আমি অন্তরে লালন করি বলেই সমগ্র কুমিল্লা জেলা অথবা বাংলাদেশের অনেক জায়গা থেকে কোনো কোনো রোগী এসেই বলে, আমি চান্দিনা থেকে এসেছি। আমি তাদের মিথ্যা বলার জন্য বিরক্ত কখনো হইনি বরং অপার আনন্দ পাই। রাতের অন্ধকার এবং সাপকে আমি খুবই ভয় পেতাম। এ ব্যাপারে বাবা প্রায়ই বলতেন, কাপুরুষরাই ভীতু হয়। আমি জবাবে বলতাম আমি তো এখনো পুরুষ হইনি, আমি শিশু, ভয় পাওয়াটাই স্বাভাবিক। তোমাদের সমান বয়স হলে আমি তোমার চেয়েও বেশি সাহসী হব। তিনি সবসময় বলতেন ‘নির্ভীকতা’ একটি সাহসী মন্ত্র। যুবকদের থাকা উচিত চিন্তা করার নির্ভীকতা। কণ্টকাকীর্ণ পথে চলার নির্ভীকতা, জয়ের জন্য নির্ভীক হওয়া। বাবা, ভয়কে জয় করতে পেরেছিলাম বলেই আমি স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে, মাতৃভূমিকে হায়েনামুক্ত করতে কিছুটা হলেও অংশ নিতে পেরেছিলাম।
বাবা, তুমি প্রায়ই গর্ব করে বলতে ‘আমি কোনো সমস্যা সৃষ্টির অংশ হতে পারি না, বরং আমি সমস্যা সমাধানের কাণ্ডারি হতে পারি’। তুমি আশীর্বাদ কর, যেন আমিও সমস্যা সমাধানে জীবন উৎসর্গ করতে পারি। আমি যেন মানুষের রোগমুক্তি এবং স্বপ্ন পূরণে সহায়তা করতে পারি।
লেখক : সাবেক উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।