রবিবার, ১ মে, ২০১৬ ০০:০০ টা
ধর্মতত্ত্ব

শ্রমিক-মালিক সম্পর্ক

মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী

শ্রমিক-মালিক সম্পর্ক

ইসলাম শ্রমিকের সঙ্গে সদাচরণের শিক্ষা দেয়। নিয়োগ, পদোন্নতি বা অন্যান্য যে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় শ্রমজীবীদের যোগ্যতা মূল্যায়নের ক্ষেত্রে বা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই নিরপেক্ষতা এবং ন্যায়বিচার অনুসরণ করতে হবে। আল্লাহ আমাদের সেরূপ নির্দেশই দিয়েছেন : আল-কোরআনে তিনি বলেছেন, নিশ্চয়ই আল্লাহতায়ালা তোমাদের আদেশ দিচ্ছেন আমানতগুলো তার হকদারদের কাছে পৌঁছে দিতে। আর যখন মানুষের মধ্যে ফয়সালা করবে তখন ন্যায়ভিত্তিক ফয়সালা করবে (সূরা নিসা-৫৮)। ইবনে তাইমিয়াহ রহ. অভিমত ব্যক্ত করেছেন যে, নিয়োগদাতা তার কর্মচারীদের ন্যায্য পারিশ্রমিক প্রদান করতে বাধ্য। যদি মজুরির হার খুব অল্প হয়, তাহলে একজন ব্যক্তি পর্যাপ্ত কাজ করতে উৎসাহী নাও হতে পারে। পক্ষান্তরে, মজুরির হার যদি খুব বেশি হয়, তাহলে নিয়োগকারী মুনাফা অর্জনে সক্ষম নাও হতে পারে এবং সেক্ষেত্রে তার ব্যবসা চালিয়ে যাওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে। ইসলামী অনুশাসন অনুযায়ী পরিচালিত কোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে মজুরির পরিমাণ বা হার কর্মচারী ও নিয়োগদাতা উভয়ের জন্যই ভারসাম্যপূর্ণ হওয়া আবশ্যক। বিচারের দিনে মহানবী সা. তাঁর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবেন, ‘যে ব্যক্তি একজন শ্রমিক নিয়োগ করে তার কাছ থেকে পরিপূর্ণ কাজ আদায় করে কিন্তু তাকে তার মজুরি পরিশোধ করে না। (বুখারি) পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় মুসলমান মালিকদের কর্মচারীদের প্রতি অসঙ্গত আচরণ করা উচিত নয়। যেমন— মুসলমান কর্মচারীদের নামাজের জন্য বিরতি দেওয়া উচিত, ইসলামী অনুশাসনের বিপরীত কোনো কাজে তাদের জোর-জবরদস্তি না করা, অসুস্থতার সময় সাময়িক অবকাশ বা ছুটি দেওয়া এবং হয়রানি না করা ইত্যাদি। সমতা এবং সাম্যাবস্থা লালনের জন্য অমুসলিম কর্মচারীদের ধর্মমতের প্রতিও শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা উচিত। এ ব্যাপারে আল্লাহ বলেন, দীনের ব্যাপারে যারা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেনি এবং তোমাদের বাড়িঘর থেকে বের করে দেয়নি, তাদের প্রতি সদয় ব্যবহার এবং ন্যায়বিচার করতে আল্লাহ তোমাদের নিষেধ করছেন না। নিশ্চয়ই আল্লাহ ন্যায়পরায়ণদের ভালোবাসেন। (সূরা মুমতাহিনা-৮)।

সাম্যের ধর্ম ইসলাম জাতি-ধর্ম-বর্ণ-গোত্র-ধনী-দরিদ্র, ছোট-বড় সব ভেদাভেদ মুছে ফেলার তাগিদ দিয়েছে। কোনো ব্যক্তির মর্যাদা মূল্যায়নের ক্ষেত্রে ধন-সম্পদ, শক্তি-সামর্থ্য কোনো বিবেচ্য বিষয় হতে পারে না। মানুষের মর্যাদার স্বীকৃতি যদি কিছু থেকে থাকে তাহলো ইমান, তাকওয়া ও পারহেজগারি। এ প্রসঙ্গে রসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তোমাদের অধীন দাস-দাসী, শ্রমিক-কর্মচারীরা তোমাদেরই ভাই। সুতরাং আল্লাহ যে ভাইকে অপর ভাইয়ের অধীন করে দিয়েছেন, সে তার (শ্রমিক) ভাইকে যেন তাই খাওয়ান, যা সে নিজে আহার করেন, আর তাই পরিধান করান, যা সে নিজে পরিধান  করেন।’ (আবু দাউদ: ২/৩৩৭)। হজরত মুহাম্মদ (সা.)  সবার সঙ্গে সুন্দর ব্যবহার করতেন। মানুষে মানুষে ভেদাভেদ করতেন না। তিনি গোলাম জায়েদ (রা.) কে সন্তানতুল্য স্নেহ করতেন। রসুল  (সা.)  এর স্নেহ, আদর, ভালোবাসা পেয়ে জায়েদ ইবনে হারেস (রা.)  ধন্য হয়েছেন। বাবা এবং চাচা জায়েদ (রা.)কে নিতে এলে তিনি বলেন, আমি যাব না। জায়েদ (রা.) কে তার বাবা ও চাচা অনেক করে বোঝালেন। তারা বললেন, তুমি এখানে থাকলে গোলাম হিসেবে থাকবে আর আমাদের সঙ্গে থাকলে স্বাধীন হিসেবে থাকবে। আমাদের কত টাকা-পয়সা, বসে বসে খেতে পারবে। কোনো কাজ করার দরকার হবে না। জায়েদ (রা.) উত্তর দিলেন, আমি এ ব্যক্তির কাছে, (রসুল) (সা.) গোলাম হিসেবে থাকা বেশি পছন্দ করি, নিজের মা-বাবার কাছে স্বাধীন হিসেবে থাকার চেয়ে রসুল (সা.)-এর কাছে পরাধীন থাকাটাই তার কাছে প্রিয় মনে হয়েছে। গোলামের প্রতি নবীজী কতই না স্নেহশীল ছিলেন। কত বেশি তাকে আদর করতেন। যার কারণে স্বাধীন থাকার সুযোগও ভালো মনে করেননি জায়েদ (রা.)। রসুল (সা.)-এর এ আচরণ আমাদের জন্য শিক্ষণীয়। কোরআনে বলা হয়েছে, তোমরা ইবাদত কর আল্লাহর, তাঁর সঙ্গে কোনো কিছুকে শরিক কর না। আর সদাচরণ কর মাতা-পিতার সঙ্গে, নিকটাত্মীয়ের সঙ্গে। এতিম, মিসকিন, নিকটাত্মীয় প্রতিবেশী, অনাত্মীয় প্রতিবেশী, পার্শ্ববর্তী সাথী, মুসাফির এবং তোমাদের মালিকানাভুক্ত দাস-দাসীদের সঙ্গে। ‘নিশ্চয় আল্লাহ পছন্দ করেন না তাদের যারা দাম্ভিক, অহংকারী।’ (সূরা নিসা : ৩৬)। ইসলাম সব মানুষের একই উৎসস্থল ও প্রত্যাবর্তনস্থলের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দেয়, ‘তোমরা সবাই আদমের সন্তান এবং আদমকে সৃষ্টি করা হয়েছে মাটি থেকে। (মুসলিম ও আবু দাউদ)। আজ আমরা মানুষকে দাসে পরিণত করতে শুরু করেছি অথচ তাদের মা তাদের স্বাধীনরূপে জন্ম দিয়েছে।

রসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন : অধীনস্থ চাকর-বাকর ও দাস-দাসীদের প্রতি ক্ষমতার বলে খারাপ আচরণকারী জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। লোকেরা জিজ্ঞাসা করলেন, হে আল্লাহর রসুল! আপনি কি এ কথা আমাদের বলেননি, অন্যান্য জাতির তুলনায় এ জাতির মধ্যে গোলাম ও এতিমের সংখ্যা বেশি হবে? তিনি বলেন, হ্যাঁ। অতএব, তোমরা তাদের তোমাদের সন্তানদের মতো আদর-যত্ন করবে এবং তোমরা যা খাবে, তাদের তাই খাওয়াবে। (ইবনে মাযা)।

লেখক : বিশিষ্ট মুফাসসিরে কোরআন ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব।

www.selimazadi.com

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর