মহররম মাসের ১০ তারিখে সৃষ্টির আদিকাল থেকে অনেক আলোচিত ও বিস্ময়কর ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। কিন্তু এটি আমাদের সমাজে সবচেয়ে বেশি আলোচিত এ জন্য যে, এ মাসে প্রিয় নবী (সা.)-এর দৌহিত্র সাইয়্যেদিনা ইমাম হোসাইন (রা.)-সহ নবী পরিবারের বহু সদস্য ও সাথীবর্গ মোট ৭২ জন শাহাদাতবরণ করেন, ইতিহাসের সবচেয়ে মর্মান্তিক এ ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল ৬১ হিজরির ১০ মহররম শুক্রবার। প্রিয় নবীর নাতি হিসেবে এমনিতেই ইমাম হোসাইন (রা.)-এর প্রতি সব মুমিনের অফুরন্তর ভালোবাসা থাকাটাই স্বাভাবিক তদুপরি কোরআন হাদিসে আহলে বায়েত ও ইমাম হোসাইনের (রা.) প্রতি বেশি মর্যাদা বর্ণিত হয়েছে যে, তাদের প্রতি ভালোবাসা পোষণ ইমানের পরিচায়ক হিসেবেও নির্ধারিত হয়েছে। আহলে বায়েতের ফজিলত সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেছেন— ‘হে নবী পরিবারের সদস্যবর্গ আল্লাহ কেবল চান তোমাদের থেকে অপবিত্রতা দূর করতে এবং তোমাদেরকে পূর্ণরূপে পূত পবিত্র রাখতে।’ (সূরা আহযাব : ৩৩)
প্রিয় নবী রসুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘হোসাইন আমার থেকে আর আমি হোসাইন থেকে।’ (ইবনে মাজাহ)।
ইয়াজিদ ক্ষমতাসীন হওয়ার পর ইমাম হোসাইন (রা.) তাকে অযোগ্য হিসেবে মনে করতেন বিধায় তার হাতে বায়াত গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানান। কেননা ইয়াজিদ ছিল দুশ্চরিত্র, বে-নামাজি ও মদ্যপায়ী। হজরত হাসান ও হজরত মুয়াবিয়া (রা.)-এর ইন্তেকালের পর খিলাফতের ন্যায়সংগত দাবিদার হোসাইন (রা.) ইন্দ্রিয়পরায়ণ, নীতিজ্ঞানহীন ইয়াজিদের কাছে তিনি জীবনের বিনিময়েও মস্তক অবনত করতে রাজি ছিলেন না। কারণ ইমাম হোসাইন (রা.) বিশ্বাস করেন যে, তার বায়াত গ্রহণের মাধ্যমে ইসলামের আইন ও কানুন ছত্রভঙ্গ হয়ে যাবে। ফলে ইসলামের গুরুত্ব ভূলুণ্ঠিত হতে পারে। তার দেখাদেখি অন্যান্য অনুসারীও বায়াত নিয়ে নেবেন। মোট কথা ইমাম হোসাইন (রা.) বায়াত না নিয়ে বাতিলের সামনে মাথানত না করার প্রবণতা প্রমাণ করেছেন। অন্যদিকে কুফাবাসী ইমাম হোসাইন (রা.)-কে চিঠির মাধ্যমে সেখানে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানায়। ইয়াজিদ শাসনের মোকাবিলায় তার হাতে বায়াতের অঙ্গীকার করে ১৫০ খানা মতান্তরে ১২শ’ চিঠি ইমাম হোসাইন (রা.)-এর কাছে প্রেরণ করে। তারা ইমাম হোসাইন (রা.)-কে খিলাফতের অধিক যোগ্য, তার জন্য জানমাল কোরবানির জন্য প্রস্তুত, তারা আহলে বায়াতের অনুরক্ত ও সমর্থনকারী ইত্যাদি পয়গাম পাঠাতে থাকে। তাদের চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য তার আপন চাচাতো ভাই মুসলিম বিন আকিলকে কুফায় প্রেরণ করেন। কুফার গভর্নর নুমান বিন বশিরসহ ৪০ হাজার মানুষ মুসলিমের হাতে হোসাইন (রা.) নামে বায়াত নেন। এ অনুকূলীয় অবস্থার বর্ণনা দিয়ে একজন পত্রবাহককে চিঠি দিয়ে ইমাম হোসাইন (রা.)-কে কুফায় আসতে অনুরোধ করেন। ইমাম হোসাইন (রা.) ইবনে আব্বাস (রা.)-সহ অনেকের বাধা সত্ত্বেও ৬০ হিজরির ৮ জিলহজ পরিবার-পরিজন, বন্ধুবান্ধব ও প্রিয়জন সঙ্গে নিয়ে মক্কা থেকে কুফার উদ্দেশে রওনা দেন। পথিমধ্যে তার চাচাতো ভাই আবদুল্লাহ জাফর সাক্ষাৎ করে মদিনার গভর্নর কর্তৃক প্রদত্ত নিরাপত্তা সনদের ভিত্তিতে মদিনায় ফিরে যাওয়ার অনুরোধ করলে তিনি বলেন, ‘আমি স্বপ্নে নানাজির সাক্ষাৎ পেয়েছি। তিনি আমাকে একটি কাজ করার নির্দেশ দিয়েছেন। ফলাফল যা হোক না কেন, আমি অবশ্যই তা করব আর কাজটি কি, সে সম্পর্কে মৃত্যুর আগে আমি কাউকে কিছু বলতে পারি না।’ পথিমধ্যে ‘যি জাশাম’ নামক স্থানে উবায়দুল্লাহ ইবনে যিয়াদের পক্ষ থেকে হুর ইবনে ইয়াজিদ তাকে খুঁজতে খুঁজতে সেখানে পৌঁছে এবং ইমাম কাফেলার সামনে ছাউনি ফেলে। হুর তাকে বলল— ‘আমাদের এই মর্মে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যে, যতক্ষণ না আমরা আপনাকে উবায়দুল্লাহ ইবনে যিয়াদের হাতে তুলে দেব ততক্ষণ আমরা নিজেরাও ফিরে যাব না এবং আপনাকেও ফিরে যেতে দেওয়া হবে না।’ বাধ্য হয়ে ইমাম হোসাইন (রা.) তাদের সঙ্গে চললেন, ৬১ হিজরির ৯ মহররম বৃহস্পতিবার দিন মহান ইমাম হোসাইন (রা.) তার সঙ্গী-সাথীসহ এক স্থানে থামানো হয় যা কারবালা নামে খ্যাত। কারবালায় অবস্থানরত দ্বিতীয় দিনে আমর ইবনে সা’দ চার হাজার সৈন্য নিয়ে ইবনে যিয়াদের পক্ষ থেকে কারবালায় এসে পৌঁছে ৯ মহররম ইবনে যিয়াদের পক্ষ থেকে কঠোর ভাষায় লিখিত একটি পত্রসহ আমর ইবনে সাদের সঙ্গে ‘শিমারযিল জাওশান’ যোগ দিলে যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে পড়ে। ইমাম তাদের থেকে এক রাতের সময় চেয়ে নেন এবং সারা রাত ইবাদত বন্দেগি ও আল্লাহর দরবারে কান্নাকাটি করে কাটান। ১০ মহররম ইমাম হোসাইন (রা.) পরিবার-পরিজন ও সাথীবর্গ নিয়ে জালিমদের বিরুদ্ধে জিহাদে অবতীর্ণ হন এবং একে একে হোসাইন (রা.)সহ ৭২ জনের সবাই শাহাদাতবরণ করেন। পরিবারের নারী ও শিশুসহ বাকি ১২৮ জন সদস্য বন্দী হন। প্রকৃত পক্ষে আহলে বায়াতের ভালোবাসা ইমানের দাবি, আহলে বায়াতের আদর্শ আমাদের আঁকড়ে ধরতে হবে। হজরত যাবের (রা.) থেকে বর্ণিত : তিনি বলেন, আমি আরাফার দিবসে রসুলুল্লাহ (সা.)-কে তার কাছওয়া নামক উটের উপর বসে খুতবা দিতে শুনেছি। তিনি বলেন, ‘হে মানব সকল আমি তোমাদের নিকট যা রেখে যাচ্ছি, যদি তোমরা এগুলো আঁকড়ে ধরো বা প্রতিপালন করো তাহলে কখনো পথভ্রষ্ট হবে না। তার মধ্যে এক হলো আল্লাহর কিতাব (কোরআন) এবং অপরটি হলো আমার আহলে বায়েত।’ ১০ মহররম কারবালার ময়দানে ইমাম হোসাইন (রা.) অন্যায়ের বিরুদ্ধে মাথানত না করে যে অনুপম দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তা আমাদের আজও অনুসরণ করতে হবে। সত্য ও ন্যায়ের ঝাণ্ডা সমুন্নত রাখতে সর্বদা সচেষ্ট থাকতে হবে। শুধু বেদনা ও সুখ প্রকাশের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে মাতম মর্সিয়ার ক্রন্দনে ব্যস্ত হলে চলবে না।