কয়েক দিন ধরে সারা দুনিয়ার মানুষের মনোযোগ ছিল মার্কিন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের দিকে। দিন যতই ঘনিয়ে আসছিল তাতে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল হিলারি আর ট্রাম্পের মধ্যে লড়াইটা হবে হাড্ডাহাড্ডি। হয়েছেও তাই। সিবিএস নিউজ, সিএনএন-এর মতো নামিদামি বার্তা সংস্থাগুলোর সংবাদকর্মীদের কষ্টকর প্রচেষ্টা এবং ব্যস্ততা দেখে বোঝা গেছে এবার মার্কিন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের চেহারাটা নানাদিক থেকেই ছিল ভিন্নতর এবং অনিশ্চয়তায় ভরপুর। কারণ, মার্কিন মিডিয়ার প্রচার থেকে প্রথমে প্রবল একটা ধারণা জন্মেছিল যে, হিলারি ক্লিনটন ট্রাম্পের থেকে বিরাট ব্যবধানে এগিয়ে থাকবেন। কিন্তু বাস্তবে তা ঘটেনি। ইলেক্টোরাল ভোটের ৫৩৮টির মধ্যে ২৮৯টি পেয়ে জয়ী হয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। হিলারি ক্লিনটনের বাক্সে পড়েছে ২১৮টি। মার্কিন সিনেট এবং কংগ্রেস উভয় কক্ষেও রয়েছে ট্রাম্পের দল রিপাবলিকানদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা।
তবে এ নির্বাচনের ফলাফলের ভিতর দিয়ে মার্কিন দ্বিদলীয় রাজনীতির আসল চেহারাটা আগের চেয়ে অনেক নগ্নভাবেই বের হয়ে এসেছে। এ নির্বাচনে ট্রাম্প কীভাবে জিতল? হিলারি এবং ট্রাম্প ভোটে জেতার জন্য তাদের নির্বাচনী প্রচারাভিযানে কী কী ভাষণ দিয়েছে? কী কী রাজনৈতিক ইস্যুকে সামনে এনেছে? সেটিও এবার মানুষের কাছে অনেক পরিষ্কার হয়েছে। দেখা গেছে, মার্কিন করপোরেট পুঁজি এবার খোলামেলাভাবে এ নির্বাচনে কাঁড়ি কাঁড়ি ডলার ঢেলেছে। করপোরেটের এ ডলার ট্রাম্পের শিবিরে গেছে। গেছে হিলারির তহবিলেও। উভয়েই বিশ্বজুড়ে মার্কিন আধিপত্য আরও প্রবল করার কথা বলেছেন। দুজনেই নিজেদের মার্কিন করপোরেট ও ফিন্যান্স পুঁজির রক্ষক বলে দাবি করেছেন। বিলিয়ন ডলারের নির্বাচনী ব্যয় এবং করপোরেট নিয়ন্ত্রিত মার্কিন মিডিয়ার দাপটের কাছে এ নির্বাচনে মার্কিন সমাজের শ্রমজীবী ও নিম্ন আয়ের মানুষের কথাগুলো শেষ পর্যায়ে এসে হারিয়ে গিয়েছিল। অথচ যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির বর্তমান চিত্র প্রতিনিয়ত জানান দিচ্ছে, সেখানকার সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রমজীবী ও নিম্ন আয়ের মানুষের কথা আড়াল করে রাজনীতিকে বেশি দূর অগ্রসর করা যাবে না। ডোনাল্ড ট্রাম্প এ সত্যটি সব সময়ই আড়াল করতে চেয়েছেন এবং রক্ষণশীল উগ্র জাতীয়তাবাদী ধারাতেই তার রাজনীতি অব্যাহত রেখেছেন। বাস্তবতা হলো, যুক্তরাষ্ট্রের ভোটাররা এ ধারার রাজনীতির পক্ষেই তাদের রায় দিয়েছেন। ফলে ট্রাম্পের শাসন যুক্তরাষ্ট্রকে যে আরও প্রতিক্রিশীলতার দিকে নিয়ে যাবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। অন্যদিকে হিলারিও তার রাজনীতিতে রিপাবলিকান শিবিরের বিপরীতে ডেমোক্রেটদের রাজনীতির পক্ষে তেমন কোনো বিশ্বাসযোগ্য উদাহরণ দেখাতে পারেননি। বরং করপোরেট পুঁজির পক্ষে তার ওকালতির কারণে বিভিন্ন পর্যায়ের যেসব প্রান্তিক মানুষেরা ডেমোক্রেট শিবিরে ভিড়েছিল তারা সন্দেহগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল। তাছাড়া এবারের নির্বাচনে বিভিন্ন নির্বাচনী সমাবেশে মারামারি এবং ডোনাল্ড ট্রাম্প যেভাবে প্রতিপক্ষ হিলারিকে ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ করেছেন তাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক সংস্কৃতির অধঃপতনের ব্যাপারটিও অনেকের নজরে এসেছে।
সবচেয়ে বড় কথা হলো, এ ফলাফলের মধ্য দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রমজীবী, নিম্ন আয়ের মানুষ এবং অভিবাসীদের অধিকারের প্রসঙ্গটি আবারও বিরাট চাপের মধ্যে পড়ে গেল। একটি বিষয় এখন স্পষ্ট যে, ট্রাম্প কিংবা হিলারি যতই চমকপ্রদ ভাষণ দিক না কেন, মার্কিন পুঁজিবাদী অর্থনীতির বর্তমান বেহাল অবস্থা তারা কেউই ঢেকে রাখতে পারছেন না। ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব, শ্রমিক ছাঁটাই, মজুরি কর্তন এখন সেখানে সাধারণ মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে। ৪ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের শ্রম অধিদফতর দেশটির কর্মসংস্থান সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এতে দেশটির অব্যাহত অর্থনৈতিক স্থবিরতার প্রসঙ্গটি স্পষ্টভাবেই উঠে এসেছে। সরকারি হিসাব মতে, এ বছরের অক্টোবর পর্যন্ত নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে ১৮১০০০টি। অথচ গত বছর এর সংখ্যা ছিল ২,২৯০০০টি। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, নতুন কর্মসংস্থান বাড়েনি। বরং কমেছে। এ প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ম্যানুফ্যাকচারিং খাতে তৃতীয়বারের মতো কর্মসংস্থান কমেছে। এ খাতে চাকরি হারিয়েছে ৯ হাজার শ্রমিক। দুই বছর ধরে খনি শিল্প খাতেও শ্রমিকরা চাকরি হারাচ্ছে। পূর্ণকালীন কাজ হারানোর ফলে খণ্ডকালীন এবং অস্থায়ী শ্রমিকের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। ২০০৮ সালে ওয়াল স্ট্রিট বিপর্যয়ের পর মার্কিন অর্থনীতিতে যে মহামন্দা সৃষ্টি হয়েছিল সে ক্ষত এখনো রয়ে গেছে। যার ফলে দেশটির শ্রমজীবী ও নিম্ন আয়ের মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সংকট এখনো কাটেনি। করপোরেট পুঁজির স্বার্থ রক্ষা করে ট্রাম্পের পক্ষে কখনই এ সংকট দূর করা সম্ভব নয়। ফলে মার্কিন সমাজে ‘অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট আন্দোলনের’ মতো বিক্ষোভ আরও তীব্র হয়ে উঠবে। সুতরাং, নীতির পরিবর্তন না করে ক্ষমতার পালাবদল যে কোনো সমাধান দিতে পারে না, যুক্তরাষ্ট্রের এ নির্বাচন তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। যদিও নির্বাচনে জেতার পর প্রথম বক্তৃতায় ডোনাল্ড ট্রাম্প সুর নরম করেছেন। কিন্তু অভিবাসী প্রসঙ্গ, নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং মার্কিন অর্থনীতি চাঙ্গা করার প্রসঙ্গে কোনো বিশ্বাসযোগ্য বক্তব্য তিনি হাজির করতে পারেননি। এসব কারণেই ডেমোক্রেট দলীয় মনোনয়ন প্রার্থী বামপন্থি বার্নি স্যান্ডার্স বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্রে এখন দরকার ‘রাজনৈতিক বিপ্লব’। নিছক ক্ষমতার পালাবদল করে কোনো লাভ হবে না। প্রয়োজন রাষ্ট্রীয় নীতিতে পরিবর্তন। প্রয়োজন গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র। মার্কিনের নয়া রক্ষণশীল শাসকচক্রের ব্যর্থতা সম্ভবত যুক্তরাষ্ট্রে এখন সেই রাজনৈতিক বিপ্লবের পটভূমি রচনা করবে। বার্নি স্যান্ডার্সের নির্বাচনী প্রচারাভিযানে লাখো মানুষের সমাবেশ, ব্যাপক তরুণদের অংশগ্রহণ, গণচাঁদা প্রদান এবং সাধারণ মানুষের মৌলিক অধিকারের ইশতেহার সে নয়া সমাজের পথরেখাই দেখিয়ে দিয়ে গেছে।তারপরও বহুবিধ বিবেচনায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এ রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ফলাফল সারা পৃথিবীর মানুষের জন্য বিরাট এক তাত্পর্যপূর্ণ বিষয়। বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দেশের জন্য তো বটেই। এর কারণ হলো, এসব দেশের শাসকচক্র এবং রাজনৈতিক এস্টাব্লিশমেন্ট সাধারণত মার্কিনের ধামাধরা হয়। তাছাড়া মার্কিনের এ নতুন রাষ্ট্রপতির নেতৃত্বে দেশটি কী ধরনের সামরিক, অর্থনৈতিক ও পররাষ্ট্রনীতি আগামী দিনে চালু করে তার ওপর পৃথিবীর শান্তি ও স্থিতিশীলতা অনেকাংশেই নির্ভর করছে। বাংলাদেশে এরকম একটা কথা রাজনৈতিক মহলে চালু ছিল যে, নির্বাচনে হিলারি জিতলে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার বিপাকে পড়তে পারে। কারণ ড. ইউনূসের সঙ্গে হিলারির সখ্যকে কাজে লাগিয়ে বিএনপি বিশ্বব্যাংক এবং আইএমএফকে তুরুপের তাস হিসেবে ব্যবহার করবে। যার ফলে বাংলাদেশেও ক্ষমতার পালাবদল ঘটা অসম্ভব কিছু নয়। এ নিয়ে আওয়ামী লীগের ভিতরে উদ্বেগ থাকলেও তারা সেটা চেপে রেখে বলেছে, যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতায় যে-ই আসুক সবার সঙ্গেই তাদের সুসম্পর্ক রয়েছে এবং থাকবে। ট্রাম্পের এ বিজয় হয়তো আওয়ামী শিবিরে আনন্দ বয়ে আনবে। কিন্তু এ বিষয়টির ভিতর দিয়ে যা স্পস্ট হয়ে ওঠে তা হলো, দুই দলের মধ্যেই রয়েছে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য নিজ দেশের জনগণের আস্থা অর্জনের চেয়ে বিদেশি শক্তির আনুগত্য লাভের জন্য আত্মমর্যাদাহীন প্রতিযোগিতা। বাস্তবতা হলো, এ প্রতিযোগিতায় দুপক্ষই হারে, জিতে যায় বিদেশি শক্তি। ইতিহাস তার নির্মম সাক্ষী। ইরাকের সাদ্দাম হোসেন থেকে শুরু করে লিবিয়ার গাদ্দাফি কেউই বাঁচতে পারেনি। ফলে ট্রাম্পের এ বিজয় ভারত-মার্কিন সামরিক চুক্তির ক্ষেত্রে কোনো বাধার সৃষ্টি করবে না। বরং রাষ্ট্রপতি ওবামার গৃহীত এশিয়ামুখী সামরিকনীতি আরও জোরদার হবে। চীনের সঙ্গে মার্কিনের দ্বন্দ্ব আরও বাড়বে। অর্থনৈতিক পরাশক্তি চীনকে ঠেকাতে ট্রাম্প তার নির্বাচনী প্রচারাভিযানে তাদের বিরুদ্ধে মুদ্রামান কারসাজির অভিযোগ এনেছিলেন। হুমকি দিয়ে বলেছিলেন, চীনা পণ্যের ওপর ৪৫% পর্যন্ত ট্যারিফ বাড়ানো হতে পারে। তাছাড়া চীনের সমুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধ, সাইবার অপরাধ ইত্যাদি নিয়ে বিরোধ তো রয়েছেই। আবার প্যালেস্টাইন প্রসঙ্গে প্রথমে শান্তি আলোচনার পক্ষে ছিলেন ট্রাম্প। এরপর ধীরে ধীরে প্যালেস্টাইনিদের প্রতি তিনি কঠোর হয়ে ওঠেন। ইরানের বেলায়ও একই রকম কঠোর ট্রাম্প। তবে রাশিয়া প্রসঙ্গে এক রহস্যময় অবস্থান মি. ট্রাম্পের। যা অনেক হিসাব নিকাশকেই গোলমাল করে দিচ্ছে। রাশিয়া ইস্যুতে সিরিয়া প্রসঙ্গেও ট্রাম্পের অবস্থান ভিন্নতর। মার্কিন পত্রিকাগুলোর ভাষ্যমতে, হিলারি সিরিয়ায় নো-ফ্লাই জোনের পক্ষে ছিলেন। অন্যদিকে ট্রাম্প মনে করেন, বাশার আল আসাদকে ক্ষমতা থেকে সরানোর চেয়ে ইসলামী জঙ্গি আইএস দমনই অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত। এরকম বিচিত্র অবস্থান সত্ত্বেও মি. ট্রাম্পের আগামী দিনের আমেরিকা কেমন হবে তার বিস্তারিত অনুধাবন করতে আরও বেশ কিছু দিন অপেক্ষা করতে হবে।
লেখক : সম্পাদক, বিশ্ব গতান্ত্রিক আইনজীবী পরিষদ।
ইমেইল: [email protected]