মঙ্গলবার, ২৭ ডিসেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

রাষ্ট্রপতির সংলাপ ও নারায়ণগঞ্জের সিটি নির্বাচন

বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম

রাষ্ট্রপতির সংলাপ ও নারায়ণগঞ্জের সিটি নির্বাচন

নির্বাচন কমিশন গঠনে মহামান্য রাষ্ট্রপতির আমন্ত্রণে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের ১৩ সদস্যের প্রতিনিধি দল ২১ ডিসেম্বর বঙ্গভবনে গিয়েছিলাম। জনাব আবদুল হামিদ ভাটি বাংলার একজন কঠোর পরিশ্রমী মানুষ। ধীরে ধীরে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আসনে আসীন হয়েছেন। ক’দিন আগে সান্ত্বনা পুরস্কারের মতো ময়মনসিংহকে বিভাগে উন্নীত করা হয়েছে। বিভাগ করতে গিয়ে একদিকে কিশোরগঞ্জ, অন্যদিকে টাঙ্গাইল বাদ দেওয়া হয়েছে— যেটা ভাবীকালে এক মারাত্মক ঐতিহাসিক ভুল বলে বিবেচিত হবে। কোনো মানব সন্তানের হাত-পা কেটে তাকে সুস্থ বলা যায় না, ময়মনসিংহ বিভাগের ক্ষেত্রেও তেমনি। হাজার বছর আগে সুলতানি আমলে বৃহত্তর ময়মনসিংহ ছিল পশ্চিমে দিনাজপুর, পূর্বে সিলেটের কানাইঘাট পর্যন্ত বিস্তৃত। অঙ্গ ছেদ করতে করতে বর্তমান অবস্থায় আনা হয়েছে। ময়মনসিংহ যখন বিভাগ করা হয়, তখন টাঙ্গাইলের কিছু উদ্ভট লোক তাতে না থাকার বায়না ধরেছিল। যাদের অতীত তেমন সচ্ছল বা পরিষ্কার নয়। অনেকেই রাজাকার-আলবদর ছিল। কেউ কেউ নিজেরা না থাকলেও তাদের ভাই-বেরাদাররা ছিল। তাই বৃহত্তর ময়মনসিংহের অঙ্গ ছেদ করে বিভাগ হওয়ায় কখনো মনে খুব একটা শান্তি বা স্বস্তি পাইনি। সেই বৃহত্তর ময়মনসিংহের ভাটি বাংলার এক কৃতী সন্তান জনাব আবদুল হামিদ। স্যার আনন্দ মোহন বোস, গুরুদয়াল সরকার, ভূপেশ দাসগুপ্তের যোগ্য উত্তরসূরি মোহাম্মদ আবদুল হামিদ বর্তমান গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের মহামান্য রাষ্ট্রপতি।

সংবিধানের ১১৮তম অনুচ্ছেদের ক্ষমতাবলে নির্বাচন কমিশন নিয়ে তিনি আমাদের আহ্বান জানিয়ে ছিলেন। সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদের ‘(১) প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে লইয়া এবং রাষ্ট্রপতি সময়ে সময়ে যেরূপ নির্দেশ করিবেন, সেইরূপ সংখ্যক অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারকে লইয়া বাংলাদেশের একটি নির্বাচন কমিশন থাকিবে এবং উক্ত বিষয়ে প্রণীত কোন আইনের বিধানাবলি-সাপেক্ষে রাষ্ট্রপতি প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারকে নিয়োগদান করিবেন।’ প্রত্যেকটা শব্দ গভীর মনোযোগের সঙ্গে পড়েছি। সেখানে রাষ্ট্রপতি আর রাষ্ট্রপতি ছাড়া কোনো কিছু খুঁজে পাইনি। নির্বাচন কমিশন গঠনে যতক্ষণ কোনো বিধানাবলি না হচ্ছে, ততক্ষণ শুধুই রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা। তিনি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে এ ব্যাপারে আলোচনা করেছেন এবং করবেন— এটা তার সারা জীবনের গণতান্ত্রিক মনস্কের প্রতিফলন। তিনি সার্চ কমিটি গঠন করে করবেন, নাকি নিজের বিবেচনায় করবেন এটা তার ব্যাপার। রাষ্ট্রপতি ভবনে দরবার হলে তার সঙ্গে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের আলোচনা ছিল খুবই মনোরম সৌহার্দ্যপূর্ণ। একই মতপথের রাজনীতিকরা একত্র হলে যা হয় তাই হয়েছে। আমরা তাকে বলেছি—

কমিশনে অবশ্য অবশ্যই একজন নারী সদস্য অন্তর্ভুক্ত করবেন। নির্বাচন কমিশনকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণ থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত স্বাধীন করতে হবে।

বর্তমান নির্বাচন কমিশন কখনো কোনো রাজনৈতিক দলের মতামতের তোয়াক্কা করেনি। কমিশনের জন্য যখন আগামীতে বিধিবিধান প্রণীত হবে তখন অবশ্যই তাতে বিধান রাখতে হবে নির্বাচন কমিশনকে প্রতি বছর অন্তত চারবার নিবন্ধিত দলের সঙ্গে নিয়মিত আলাপ-আলোচনা করবে। যদি সম্ভব না হয় তিনবার। এ ছাড়া কোনো নতুন রাজনৈতিক পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে সে বিষয় বাধ্যতামূলক আলোচনার বিধান রাখতে হবে।

নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের মতামত না নিয়ে নির্বাচন কমিশন নতুন কোনো নির্বাচনী বিধিবিধান বহাল বা পরিবর্তন করতে পারবে না।

নির্বাচনী প্রচারে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদকের প্রতি কোনো বিধি-নিষেধ রাখা যাবে না।

গণতন্ত্রের প্রধান স্তম্ভ হচ্ছে রাজনৈতিক দল। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যেমন প্রতিবার বিদেশ সফর শেষে মহামান্য রাষ্ট্রপতিকে অবহিত করেন, ঠিক তেমনি নিবন্ধিত দলের সঙ্গে বছরে অন্তত দুইবার দেশের পরিস্থিতি, অগ্রগতি, শান্তিশৃঙ্খলা এবং ভবিষ্যত্ পরিকল্পনা নিয়ে দলগুলোর মতামত নেবেন এবং তিনি তার মতামত ব্যক্ত করবেন।

মহামান্য রাষ্ট্রপতি দেশের প্রধান অভিভাবক। তিনিও একইভাবে বছরে দুইবার, সম্ভব না হলে অন্তত একবার সব রাজনৈতিক দলের মতামত নেবেন এবং তিনি তার অভিমত ব্যক্ত করবেন।

 

 

বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার প্রধান উপাদান পৃথিবীর নির্যাতিত মুক্তিকামী মানুষের পাশে দাঁড়ানো। যেখানেই মানুষ লাঞ্ছিত হবে সেখানেই বাংলাদেশ তার সর্বশক্তি নিয়ে পাশে দাঁড়াবে। মিয়ানমার বর্বরোচিত নির্মম অত্যাচারে রোহিঙ্গা মুসলমানরা দেশ ছাড়া, মানবতা ভূলুণ্ঠিত। বাংলাদেশ এখানে নীরব ভূমিকা পালন করলে স্বাধীনতার ঘোষণাই ব্যর্থ হয়ে যায়। তাই জাতির এই ক্রান্তিকালে বাংলাদেশকে ঐতিহাসিক দায়িত্বশীল পদক্ষেপ নিতে হবে। রোহিঙ্গাদের সাময়িক আশ্রয় এবং তাদের সমস্যা বিশ্ব দরবারে তুলে ধরে বাংলাদেশকে তার স্বাধীনতার ঘোষণার সার্থক প্রতিফলন ঘটাতে হবে। ’৭১-এ যেমন সারা দুনিয়া ঘুরে ভারতের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী মুক্তিযুদ্ধকে তুলে ধরেছিলেন, ঠিক তেমনি বঙ্গবন্ধুর কন্যা আমাদের প্রধানমন্ত্রী দুর্দশাগ্রস্ত রোহিঙ্গাদের দুর্দশা বিশ্ব দরবারে তুলে ধরে মানবতার সিপাহশালার এবং বিশ্ব মানবতার প্রতীক হিসেবে নিজেকে তুলে ধরুন।

আলোচনার এক পর্যায়ে আমার সারা জীবনের রক্ত ঘামে অর্জিত কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের নির্বাচনী প্রতীক গামছা উপহার হিসেবে তার গলায় পরিয়ে দিয়েছিলাম। তিনি পরম মমতায় গামছাটি গলায় নিয়েছিলেন। পেছন থেকে দু’তিনবার এডিসি গামছাটি গলা থেকে সরিয়ে নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মহামান্য রাষ্ট্রপতি তাকে বারণ করেন, ‘না থাক। যতক্ষণ তারা আছেন এবং বিদায় পর্যন্ত তাদের শ্রদ্ধা ভালোবাসা আমার কণ্ঠহার হয়ে থাক।’ আমি অভিভূত হয়েছিলাম আমন্ত্রিতদের প্রতি এমন উদার সহমর্মিতা ও মর্যাদাদানে। তিনি বঙ্গভবনের একেবারে দরজায় এগিয়ে দিয়ে বলছিলেন, ‘এই আমার লক্ষণ রেখা। আপনাদের নিয়ে আমি এ পর্যন্তই আসতে পারি।’ শুরুতে পাশাপাশি বসতেই বলেছিলেন, ‘ক’দিন আগে টাঙ্গাইল গিয়েছিলাম। খাঁচায় থাকি, কিছু করার নেই।’ বলেছিলাম, দাওয়াত পেলে যেতাম। পাইনি। কিন্তু রাস্তাঘাটের সে যে কি দুরবস্থা, পোয়াতিকেও এপার ওপার হতে দেয়নি। হাসতে হাসতে মহামান্য রাষ্ট্রপতি বলেছিলেন, ‘আমার নিজের জেলা কিশোরগঞ্জে গেলে দোকানপাটের ঝাঁপ বন্ধ করে রাখে। লোকজন কি দেখবে? এ এক বিচিত্র ব্যাপার!

রাষ্ট্রপতি ভবনের পথে সিংহদ্বারে নানান এজেন্সি হাঁ করে থাকে। বেগম সাহেবকে নিয়ে আমি ছিলাম প্রথম গাড়িতে। আমার গাড়ির কাচের ফাঁক দিয়ে একে ওকে নাম জিজ্ঞেস করেছিলেন। বিরক্তিতে মন ভরে গিয়েছিল। কতবার জেলে গেছি। আসামিদের তালিকা মিলিয়ে জেলে ঢুকানো হয়। কিন্তু রাষ্ট্রপতি ভবনে এমন হবে কেন? খুব একটা বিনীতভাবে তালিকা মেলাচ্ছিল না। ক্ষমতা দেখানোর মতো চেষ্টা হয়েছিল। দরজা খুলে নেমে বলেছিলাম, আমরা বাড়ি ফিরে গেলে খুশি হবেন? মহামান্য রাষ্ট্রপতির আলোচনায় সিট নির্দিষ্ট আছে। আমরা বেশি হলে বেশি বলতাম। সখিপুরের কৃতী সন্তান আমাদের প্রিয় আবদুল হালিম লাল পেছনে পড়েছিল। তার কথা বলে ভিতরে গিয়েছিলাম। গেটে আর কোনো উচ্চবাচ্য হয়নি। মহামান্য রাষ্ট্রপতি আমাদের সঙ্গে আলোচনায় প্রথমেই বলেছিলেন, ‘আপনাদের যে একজন পেছনে আছেন তাকে ছাড়া আলোচনায় কি অসুবিধা হবে?’ আমি তার এ কথাতেও দারুণ খুশি ও মর্যাদাবোধ করেছিলাম। আলোচনার কয়েক মিনিটের মধ্যেই আবদুল হালিম লাল আসেন। মহামান্য রাষ্ট্রপতি উঠে গিয়ে তাকে স্বাগত জানান। বাধ্য হয়ে আমি এবং আমার স্ত্রীও রাষ্ট্রপতির পাশে দাঁড়াই। আমরা সবাই গিয়েছিলাম রাষ্ট্রপতির সঙ্গে আলোচনায়। কিন্তু আমাদের কোনো কথা নেই, ফেসবুকে কোনো ছবি নেই, আলোচনা নেই, কিন্তু সব কথা, সব আলোচনা লাল মিয়াকে নিয়ে। কোথায় ইংল্যান্ড, কানাডা, সৌদি, আমেরিকা থেকে ফোন আসছে, জাপান, সিঙ্গাপুরের কয়েকজন তো ফোন ছাড়তেই চাচ্ছিল না।

সেই সাহাবুদ্দীন সাহেবের আমল থেকে দেখে আসছি বঙ্গভবনের খাবার তেমন ভালো নয়। বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকতে গণভবনের চা-নাস্তা ছিল অসাধারণ। এখনো তেমন আছে কিনা জানি না। তবে তখনকার খাবারের কথা মনে রাখার মতো। কতবার শফিউল্লাহ, জিয়াউর রহমানকে মজা করে খেতে দেখেছি। মহামান্য রাষ্ট্রপতি নির্বাচন কমিশন গঠনে সফলকাম হলে বাংলাদেশে যে আস্থা ও বিশ্বাসের অভাবের পর্ব চলছে এটা অনেকাংশে কেটে যাবে। শুধু মেরুদণ্ডসম্পন্ন ন্যায়-নীতিপরায়ণ নির্বাচন কমিশন নিয়োগ করতে পারলেই অন্তত ৫০ শতাংশ নির্বাচন সুষ্ঠু হয়ে যাবে। আর ২৫-৩০ শতাংশ চেষ্টা করলেই বিশুদ্ধ করা যাবে। অথর্ব নির্বাচন কমিশন না হলে মানুষ যে ভোট দিতে পারে এটা তো নারায়ণগঞ্জের নির্বাচন থেকেই প্রতীয়মান হয়। নারায়ণগঞ্জের মানুষ সম্পূর্ণ না হলেও অবাধে ভোট দিয়েছে, ভোটের প্রতিফলন ঘটেছে, আইভী বিজয়ী হয়েছেন। আমি তাকে আমার, আমার পরিবার এবং কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের পক্ষ থেকে অভিনন্দন জানাই। সেই সঙ্গে আশা করি যে ভরসা নিয়ে মানুষ তাকে ভোট দিয়েছে, মানুষের সে আস্থা ও ভরসার মূল্য তিনি দিতে পারবেন। নির্বাচনের পুরো সময়টা বিএনপি খুবই আশাবাদী ছিল তারাই জিতবে। কিন্তু বেল পাকলে কাকের কি? বেলের ওপর যে শক্ত খোলস থাকে সেটা ভাঙার ক্ষমতা কাকের থাকে না। জনাব সাখাওয়াত বিএনপির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ছিলেন না। সব বিএনপি কাজ করেননি, আর কাজ করলেও প্রকৃত ভোটে আইভীর হারার সম্ভাবনা ছিল না।

আওয়ামী লীগ, বিএনপি যেদিন মনোনয়ন দেয় মনে হয়েছিল তৈমূর দাঁড়াবে। তৈমূর আলম খন্দকার আমার ছোট ভাইদের মতো। আমি তাকে খুবই ভালোবাসি। তার লেখালেখিরও অভ্যাস আছে। তার চিন্তাচেতনা একেবারে ফেলনা নয়। ২২.১১.২০১৬ তারিখে লিখেছিলাম, ‘সেলিনা হায়াত আইভী আবার নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন পেয়েছেন। বিএনপি জেলা পরিষদে অংশ নেবে না, সিটি করপোরেশনে নেবে। মানে নামাজ পড়বে অজু করবে না। নির্বাচনের একদিন আগে লিখেছিলাম, ‘একদিন পর নারায়ণগঞ্জের করপোরেশনের নির্বাচন। বলেছি আইভী জিতবেন এবং খুব ভালোভাবে জিতবেন। কেন জিতবেন কারণ আইভীর হারার কোনো পথ নেই।’ জয়দেবপুর-গাজীপুরের করপোরেশন নির্বাচনে বলেছিলাম, ‘বিএনপি প্রার্থী এক লাখ ভোটে জিতবে।’ জিতেছিল এক লাখ ছয় হাজার ভোটে। আল্লাহর অশেষ দয়ায় নারায়ণগঞ্জ সম্পর্কে আমার যে মূল্যায়ন ছিল তাই হয়েছে। আমি কোনো অ্যাস্ট্রোলোজার নই, সারা জীবন রাজনীতি নিয়ে পড়ে আছি। ছেলেবেলায় পড়তাম না বলে এখনো লেখাপড়া করব না তা কি করে হয়।

রাষ্ট্রপতি ভবন থেকে বেরিয়ে কুশিমণির জন্য একটা কিছু কিনতে স্বামী-স্ত্রী বায়তুল মোকাররমের নিচতলায় ইলেকট্রনিক মার্কেটে গিয়েছিলাম। গাড়ি থেকে নামতেই তিনজন সুদর্শন ব্যক্তি ছুটে এসে হাত মিলিয়ে উপযাচকের মতো বললেন, ‘রাষ্ট্রপতি ভবনে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে ঘাস খেতে দেওয়া হয়েছে।’ কেন ঘাস খেতে দেবে? ‘না, না। আমি বলছি না, ফেসবুকে দেখেছি।’ বিরক্তিতে মন ভরে গিয়েছিল। তৃণভোজীরা ঘাস খায়। মানুষ তো ঘাস খায় না। তাহলে কি অপরাধে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে ঘাস খেতে হবে। ’৯০-এ পদত্যাগ করে রক্তগঙ্গার হাত থেকে দেশকে বাঁচানোর জন্য কি তাকে ঘাস খেতে হবে। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ অবশ্যই একজন স্বৈরাচার। আইয়ুব, মোনায়েম, ইয়াহিয়া, জিয়াউর রহমানের চেয়েও কি তিনি বড় স্বৈরাচার? তার শাসন আমলে নুর হোসেনকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল। নুর হোসেনের বুকে-পিঠে ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ লেখা ছিল। কিন্তু হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ পদত্যাগ না করলে আন্দোলন আরও দীর্ঘ হলে কত রক্ত ঝরত। আজ আমরা জেনারেল নুরুদ্দিনের কথা প্রায় ভুলে গেছি। কত সামাজিক অনুষ্ঠানে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে খেদ ব্যক্ত করতে দেখেছি। নুরুদ্দিন তাকে বাবা ডাকতেন। কিন্তু পদত্যাগ করার আগে যখন সেনাবাহিনী নামাতে বলেছিলেন, তখন জেনারেল নুরুদ্দিন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে বলেছিলেন, আমি সেনাবাহিনীকে জনগণের মুখোমুখি করতে পারব না। কে এখন জেনারেল নুরুদ্দিনের সেই অবদান মনে রাখে।

হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ঘাস খাবে কেন? ’৯০-এ অমন একটি গণআন্দোলনের পর জেল থেকে পাঁচটি আসনে দাঁড়িয়ে পাঁচটিতেই জিতেছিলেন। এজন্য কি তাকে ঘাস খেতে হবে? ’৯১-এ নির্বাচনে জাতীয় পার্টি ৩৫টি সিটে জয়ী হয়েছিল, তার পাঁচটিতেই হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। তার ছেড়ে দেওয়া চারটি আসনে উপনির্বাচনে জননেত্রী মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে নির্বাচনী প্রচারে রংপুরে গিয়েছিলাম। সাত দিন জননেত্রী ছিলেন। তখনকার প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া সার্কিট হাউসের উপরতলায়, আমরা ছিলাম নিচতলায়। জননেত্রী চলে আসার পরও আট দিন ছিলাম। চারটি আসনের এমন কোনো জায়গা ছিল না যেখানে নির্বাচনী প্রচারে যাইনি। রাত ২টা, ৩টা পর্যন্ত প্রচার করেছি। কত মানুষের কত মন্তব্য শুনেছি। কোনো আসনে সেবার বিএনপি তিন হাজারের বেশি ভোট পায়নি।

আওয়ামী লীগ দ্বিতীয় স্থান পেয়েছিল। চারটিতেই ভোটে ব্যবধান ছিল প্রায় পঞ্চাশ হাজারের উপরে। জনাব মিজানুর রহমান চৌধুরী এবং শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন দুইটিতে জয়ী হয়েছিলেন। পল্লীবন্ধু হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে যেমন বিয়ে করেছেন, তেমনি বিচার-বিবেচনা না করে দলের নেতা বদল করতেন। মিজানুর রহমান চৌধুরী, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেনের মতো প্রবীণ নেতাদের অকারণ অদল-বদল না করে যদি দল গোছানোর দায়িত্ব দিতেন তাহলে জাতীয় পার্টিকে এ দুর্ভোগ পোহাতে হতো না। ইতিহাস হয়তো অন্যরকম হতো। ছোট্ট বাচ্চারা তাদের ইচ্ছামতো হয়তো অনেক কথা বলতে পারে কিন্তু পূর্ণ বয়সী কেউ অমন বললে সেটা মানানসই হয় না।

     লেখক : রাজনীতিক।

সর্বশেষ খবর