শিরোনাম
মঙ্গলবার, ৩১ জানুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

বিয়েবাড়ির বিভীষিকা

সাইফুর রহমান

বিয়েবাড়ির বিভীষিকা

সবে ইস্কুলের পাঠ শেষ করে কলেজে ভর্তি হয়েছি। পুরনো হাঁপানির মতো বই পড়া রোগটি জীবনের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে থাকার ফলে কলেজ লাইব্রেরি কিংবা বন্ধু-বান্ধবদের বইয়ের সংগ্রহও যথেষ্ট ছিল না আমার অদম্য ও বুভুক্ষু এই গ্রন্থ ক্ষুধা মেটাতে। সে জন্য আমি প্রায়ই বের হতাম গ্রন্থ শিকারে। আমার এক দূরসম্পর্কীয় চাচা আমাকে একদিন জানাল তার কাছে বেশ কয়েকটি বই আছে। চাইলে নির্দ্বিধায় সেগুলো পেতে পারি আমি। আমার সেই চাচা আমার চেয়ে বছর পাঁচ সাতেকের বড় বলে তার সঙ্গে আমার সম্পর্কটাও ছিল অনেকটা বন্ধুর মতো। বই পড়ায় অবশ্য তেমন কোনো মোহ ছিল না তার। নেহাত উপহার হিসেবে বইগুলো সে পেয়েছিল তার কোনো সুহৃদের কাছ থেকে। বইগুলোর মধ্যে আমার যতদূর মনে পড়ে একটি ছিল শরত্চন্দ্রের ‘পথের দাবী’, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘দিবা রাত্রির কাব্য’ ও সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘শবনম’। কোনো এক শুক্রবার সকালে উঠে সোজা চলে গেলাম চাচার বাসায়। তিনি ঢাকা শহরের শাহজাদপুর এলাকায় ধনাঢ্য এক বাড়িতে থাকতেন গৃহশিক্ষক হিসেবে। দুই-চারটি ছাত্রছাত্রী পড়িয়ে বেশ ভালোভাবেই দিন গুজরান করছিলেন। তার ওখানে পৌঁছতেই দেখলাম কোথাও যাওয়ার জন্য সেজেগুজে তৈরি হচ্ছেন তিনি। আমাকে দেখেই বললেন— ও তুই এসেছিস ভালোই হলো। আজ আমার এক ছাত্রীর বিয়ে। সেখানে আমার নেমন্তন্ন। তুইও চল আমার সঙ্গে। আমি ঈষৎ দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে বললাম, বিনা দাওয়াতে আমি যাই কী করে। আপনাকে দাওয়াত করেছে আপনিই যান। তিনি যা বললেন সহজ কথায় বললে বলতে হয়— যেহেতু বিয়েটা হচ্ছে তার ছাত্রীর, সেহেতু আমাকে দেখলে ছাত্রীর পরিবার বরং খুশিই হবে। কিছুটা অনিচ্ছা সত্ত্বেও যেতে হলো অনুষ্ঠানে। স্থানটি শাহজাদপুর থেকে বেশ খানিকটা পূর্ব দিকে, নাম বেরাইদ। কিছুদূর এগোতেই বোঝা গেল অত্র অঞ্চলটিতে রয়েছে স্পষ্ট গ্রামের আভাস। বেশ খানিকটা মেঠো হাঁটা পথ। কিছুটা দূর থেকেই বাতাসে পাওয়া যাচ্ছিল সুরেশ অন্ন ও সুগন্ধি মসলাযুক্ত রোস্ট-রেজালার ঘ্রাণ। আর সেই ঘ্রাণের আভাসে উদরের ক্ষুধা নামক দৈত্যটি দ্বিগুণ, ত্রিগুণ বেগে লাফিয়ে লাফিয়ে আমাকে অতিষ্ঠ করে তুলছিল। বিয়েবাড়িতে পৌঁছে চোখে পড়ল অভ্যাগত অতিথিদের খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে রঙিন কাপড়ের শামিয়ানা টাঙিয়ে। বেশি দেরি না করে সরাসরি গিয়ে বসলাম খাবার টেবিলে। গরম গরম খাবারও পরিবেশিত হলো নির্দিষ্ট সময়ে। বৃহৎ জায়গাজুড়ে টানানো হয়েছে শামিয়ানা। একেক ধাপে প্রায় শ’খানেকের মতো লোকের খাবারের ব্যবস্থা। আমি বরাবরই খাবার গ্রহণ করি একটু ধীরে সুস্থে। দু’চারবার হয়তো পাত থেকে খাবার মুখে তুলেছি মাত্র। অমনি আমার সামনে এসে দাঁড়াল গামছা কাঁধে লম্বা কালো মতো একটি লোক। লোকটি হয়তো খাবার ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যুক্ত। অনেকটা আমার চোখে চোখ রেখে বলল, ‘ওরে বাবুইল্লা জলদি এদিক আয়। বাইরের অনেক লোক কিন্তু খাইয়া যাইতাছে। মুখ চিনিছ... মুখ চিনিছ...’। লোকটি এমন ভাবে আমার দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বলছিল, যেন মনে হচ্ছিল লোকটি হয়তো আমাকে উদ্দেশ্য করেই কথাগুলো বলছে। সঙ্গে সঙ্গে আমার শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল একটি স্রোত নেমে গেল নিচের দিকে। শীতল সেই স্রোত অবশ্য ভয়ের নয়। অপমানের। যদিও আমি জানতাম আমার অপমানিত হওয়ার কিছু নেই, কারণ বিয়ে হচ্ছে স্বয়ং আমার চাচার ছাত্রীর। কিন্তু ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলেও একটি ব্যাপার থাকে। ভয়টা হচ্ছিল মনে হয় সে কারণেই। সত্যি বলতে কী লোকটার মুখ থেকে ওই কথাগুলো শোনার পর একটি অন্নও আর আমার খাদ্যনালি বেয়ে নিচে নামল না। আর কিছু না হোক ছোটবেলা থেকেই আমার আত্মসম্মান বোধটি বেশ টনটনে। আমি না খেয়েই উঠে এলাম টেবিল থেকে। বিকালে চাচার নিবাসে ফিরে এসে তার কলেজপড়ুয়া ছাত্রটিকে যখন এসব বলছিলাম, আমার মুখে এগুলো শুনে সে তো ভারি অবাক। চাচার সেই ছাত্রটি বস্ফািরিত নেত্রে বলল, স্যার আবার ছাত্রী কোথায় পেলেন। স্যার পড়াবে সেই বেরাইদ গিয়ে। তুমি এসব কী আবোল তাবোল বকছ। স্যারের সে সময় কোথায়। চাচাকে আমি শক্ত করে ধরতেই তিনি স্বীকার করলেন যে, তিনি আমাকে মিথ্যা বলেছেন। আসলে সে ছিল একজন ‘অলিক’, অর্থাৎ বিনা দাওয়াতে মিথ্যা পরিচয়ে বিয়েবাড়ি থেকে খেয়ে এলেন তিনি। আমার চাচার ওপর সেদিন ভীষণ রাগ হয়েছিল এবং দীর্ঘদিন পর্যন্ত সে রাগ আমি পুষে রেখেছিলাম। ভাবলেও গা শিউড়ে ওঠে, সত্যিই যদি ধরা পড়ে যেতাম সেদিন। কী ভয়ানক অবস্থাই না হতো। যদিও সুবোধ ঘোষের অলিক গল্পটি তখন পর্যন্তও পড়া হয়ে ওঠেনি আমার। গল্পটি পড়া থাকলে জানা থাকত বিনা দাওয়াতে খেতে গিয়ে ধরা পড়লে অলিকদের কী অবস্থা হয়। আমার সেই দূরসম্পর্কের চাচা যে গরিব তা কিন্তু নয়। গ্রামে তাদের যথেষ্ট জমি-জিরাত ও প্রভাব-প্রতিপত্তি আছে। কিন্তু তারপরও...। আমার মতে, এগুলো হচ্ছে এক ধরনের রোগ। আমি যে গল্পটি এখানে করলাম সেটা ১৯৯২-৯৩ সালের কথা। কিন্তু দিন এখন অনেক পাল্টেছে। অর্থনৈতিক কারণেই হয়তো ‘মুখ চিনিস’ বলা তো দূরে থাক এখন বিয়ে-শাদিতে জৌলুস এমন বেড়েছে যে, কোনো অনুষ্ঠানে মানুষ কম হলে কর্তার মুখ শুকিয়ে যায়। যত বেশি মানুষের সমাগম, ততই আয়োজকের মনে ফূর্তি। যত বেশি মানুষের সমাগম হবে ততই সমাজে কর্তার মুখ উজ্জ্বল হবে, সম্মান বাড়বে। বেশ কয়েক বছর আগে গিয়েছিলাম আমার এক অনুজ বন্ধুর বিয়ের অনুষ্ঠানে। আমার সেই বন্ধুটির বাবা রাজনীতিতে একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিত্ব। একটি রাজনৈতিক দলের নীতি-নির্ধারকদের একজন। বিয়ের মহাযজ্ঞতুল্য এই অনুষ্ঠানটি আয়োজন করা হয়েছিল বসুন্ধরা কনভেনশন সেন্টারে। অনুষ্ঠানে গিয়ে দেখি হাজার হাজার মানুষের সমাগম সেখানে। দাওয়াতে আমার সঙ্গী হয়েছিল আমার দীর্ঘদিনের সুহৃদ এসময়ের রাজনীতিতে অন্যতম সফল তরুণ রাজনীতিবিদ ব্যারিস্টার মীর হেলাল উদ্দিন ও ব্যারিস্টার তাসমিয়া প্রধান। তাসমিয়া প্রধান বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ শফিউল আলম প্রধানের সুযোগ্য পুত্রী। আমাকে দেখে আমার সেই অনুজ বর আমার কাছে এগিয়ে এসে উল্লসিত বদনে বলল, ‘দেখেছেন ভাই হাজার হাজার মানুষ এসেছে আমার বিয়ে খেতে। আমি বললাম, সে তো ভালো কথা, অনেক মানুষ খাওয়াচ্ছ, কিন্তু খাবার নাকি সব শেষ হয়ে গেছে। আমার অনুজটি বলল, ভাই কী যে বলেন, আরও দশ হাঁড়ি খাবার উনুনে চাপানো হয়েছে।

 

 

খিদেয় আমার আত্মারাম বের হয়ে যাওয়ার উপক্রম আর আমাকে বলা হচ্ছে অপেক্ষা করতে। আমি হেলালকে বললাম, চলো কোনো রেস্তোরাঁ থেকে খেয়ে বাড়ি যাই। খাবার রান্না হতে কম করে হলেও ঘণ্টাখানেক সময় লাগবে। যদিও হেলালের ইচ্ছা ছিল খাওয়া-দাওয়াটা ওখানেই সারবে, কিন্তু আমার কারণে তার সে ইচ্ছা ত্যাগ করতে হলো। পরে হেলাল, তাসমিয়া আর আমি গুলশানের ভালো একটি রেস্টুরেন্ট থেকে ভর পেট খেয়ে বাড়ি ফিরেছিলাম। বিলটি অবশ্য চুকিয়েছিল হেলালই। এখানে প্রসঙ্গক্রমে একটি বিষয় বলি, হেলালকে দেখেছি ওর কোনো অপছন্দের লোকদের বিয়ের অনুষ্ঠানে হাজির থাকলেও কোনো প্রকার অন্নগ্রহণ থেকে বিরত থাকে। ওর স্বভাবের এই দিকটা দেখে আমি বেশ আশ্চর্যান্বিত হয়েছি এ কারণে যে, প্রাচীনকালে আমাদের সমাজেও এক প্রকার এ ধরনের সংস্কৃতি চালু ছিল। বিষয়টি খুলে বলি— সেকালে কোনো নিম্নবর্গের লোকজন যখন উচ্চবর্গের লোকদের কিংবা অন্যান্য জমিদার, রাজা ও রাজ আমাত্যদের দাওয়াত করত তখন উচ্চবর্গের লোকদের সামনে যে সব খাবার পরিবেশন করা হতো সেগুলো সবই হতো লবণবিহীন। অর্থাৎ সব খাদ্যদ্রব্যই হতো আলুনি। জাতপাতের বিষয়টি ছাড়াও উচ্চবর্গের লোকজনের ধারণা ছিল নুন না খেলে তো আর গুণ গাইতে হবে না এবং এ কারণে লবণ বস্তুটি সব সময় দাওয়াতে সঙ্গে করে নিয়ে যেতেন তারা। পাঠক জেনে অবাক হবেন যে, ফার্সি নিমক হারাম শব্দটি কয়েক হাজার বছরের পুরনো। লবণ নামক এই বস্তুটি কিন্তু দেশে দেশে কালে কালে সব সময়ই একটি বিশেষ অর্থ বহন করে আসছে। এই যে ইংরেজি শব্দ স্যালারি এটি কিন্তু এসেছে রোমান শব্দ স্যালারিয়াম থেকে। যার অর্থ হচ্ছে, লবণ ভাতা। চতুর রোমান সম্রাটরা বুঝেশুনেই তাদের সৈন্য বাহিনীতে লবণ ভাতা অর্থাৎ সল্ট অ্যালাউন্স চালু করেছিলেন। যাতে করে কেউ সম্রাটের সঙ্গে নিমক হারামি করতে না পারে।       

অন্যদিকে কয়েকদিন আগে আমার প্রিয় এক অগ্রজ, আন্দালিব রহমান পার্থ তার ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন— ‘আজকাল ঢাকা শহরের প্রায় প্রতিটি বিয়েই যেন হয়ে ওঠে বলিউডের তারকাদের পুরস্কার দেওয়ার অনুষ্ঠান।’ কথা মিথ্যা বলেননি পার্থ। মানুষের দেখানোপনাগুলো আজ এতটাই বেড়েছে যে, পাত্র-পাত্রীদের ভবিষ্যৎ আলোকময় নাকি অন্ধকারাচ্ছন্ন সেদিকে খেয়াল না থাকলেও কে কত জমকালো অনুষ্ঠান করবে সর্বক্ষণ চলে সেই প্রতিযোগিতা। আমাদের দেশে শীত ঋতুটাই যেন বিয়ের যথার্থ মৌসুম। ফলে এখন চারদিকে বিয়ের রমরমা উৎসব। কয়েকদিন আগে একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম বরযাত্রী হয়ে। কন্যাপক্ষের অনুষ্ঠানে পৌঁছোতেই চোখ ধাঁধানো নানা রঙের আলোয় সজ্জিত তোরণটি দিয়ে ঢুকতেই দুই পাশে সারিবদ্ধ লাইন থেকে অল্প বয়সী সব তরুণ-তরুণীরা হাতে তুলে দিচ্ছিল নানা রকম তুচ্ছ সব জিনিসপত্র। সস্তা আতরের শিশি, প্লাস্টিকের চিরুনি, কাগজের ফুল, কম দামি বলপেন। ঠুনকো এসব জিনিসপত্রে হাতের মুঠো দুটি ভরে গেল। ভেবে পেলাম না এসব জিনিসপত্র দিয়ে কী করব আমি। কিংবা এগুলো দেওয়ার কি বা মানে। এগুলো তো কোনো কাজে আসবে না। আমার মতে এভাবে অপচয় না করে সে অর্থ দিয়ে বর-কনের কাজে আসে এমন কিছু একটা করলেই বোধ করি ভালো হয়। এখনকার বিয়েগুলোতে লৌকিকতা, লোক দেখানোপনার মতো বিষয়গুলো বেড়ে গেছে বহু গুণ। কিন্তু দু-তিন দশক আগেও প্রায় প্রতিটি বিয়ের অনুষ্ঠানের মধ্যেই থাকত শিল্পের ছোঁয়া ও অফুরান সৃজনশীলতা। সেটা বিয়ের তোরণ সাজানো থেকে শুরু করে, ফুলশয্যা, খাবারদাবার পরিবেশন কিংবা বর-কনের ঘর সাজানো সবকিছুতেই থাকত বিয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত প্রতিটি মানুষের হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসাসিক্ত হাতের ছোঁয়া। এখন টাকার বিনিময়ে বিয়ের সবকিছু করে দেয় ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট নামক একদল লোক। আগেকার দিনের বিয়ের শিল্পময় রূপের একটি দৃষ্টান্ত দিচ্ছি। সেকালে বিয়ের আমন্ত্রণপত্র ছাপানোর সঙ্গে সঙ্গে আলাদা করে সাড়ম্বরে বিয়ের পদ্যও ছাপানো হতো। এ ধরনের পদ্য ছাপানো হতো প্রায় সব ছাপাখানাতেই। এ ধরনের পদ্য যে কাগজে ছাপা হতো, সেই ছাপার বিশেষত্ব হলো, মালা হাতে পরী, লতাপাতার নানান শয্যায় সেটি সজ্জিত হতো। যতীন্দ্রমোহন দত্ত তার স্মৃতিকথায় জানিয়েছেন— ‘তখনকার দিনে বিবাহে পদ্য প্রায় বড় প্রেসে কম্পোজ করা বা বর্ডারসহ ফর্মা বাঁধাই থাকিত। ফলে, সময় সময়ে শ্রাবণ মাসে কোকিল ডাকিত ও ঘোর অন্ধকারে অমাবস্যার রাত্রিতে চাঁদের আলো ফুটিয়া উঠিত।’ বিয়ের অনুষ্ঠানকে উপলক্ষ করে বাংলা সাহিত্যের অন্যতম দিকপাল বুদ্ধদেব বসু তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন— ‘দূরস্থ আত্মীয়দের কাছেও প্রশংসা পাই বিশেষত কোনো বিয়ের সময়, যখন আমি তাদের ফরমাশমাফিক পরিণয়-পদ্য বানিয়ে ফেলি বিদ্যুেবগে রঙিনফুলের পাড় বসানো পাতলা ফুরফুরে জাপানি কাগজে লাল অথবা সোনালি অথবা বেগুনি রঙে ছাপা হয়ে বিয়ের আসরে বিলানো হয় সেগুলো। আত্মীয়েরা, বিশিষ্ট নাগরিকেরা, সকলেই একটু বিশেষ চোখে দেখেন আমাকে, যেসব বই উপহার দেন তার মধ্যে থাকে এক-ভল্যুমে সমগ্র শেকসপীয়র, এমনকি বাল্মীকি-রামায়ণ পর্যন্ত। এমন নয় আমার জীবনের কাছে খুশি হবার মত আমি কিছুই পাচ্ছি না।’ এখানে দেখা যাচ্ছে কবি বুদ্ধদেব বসু বিয়ে বাসরের জন্য কবিতা লিখেও তার কবি প্রতিভাকে তিনি শানিত করেছিলেন। প্রসঙ্গক্রমে বিয়ে সাদিকে উপলক্ষ করে প্রথম কবে থেকে এ জাতীয় পদ্য লেখার সংস্কৃতি চালু হয় সে সম্পর্কে বলতে গিয়ে লেখক যতীন্দ্রমোহন দত্ত তার ‘যম দত্তের ডায়ারী’তে তিনি লিখেছেন— ‘কেহ কেহ বলেন, রাজা সুবোধ মল্লিকের বিবাহে এইরূপ পদ্য প্রথম লিখা হয়। অনুসন্ধান করিয়া জানিলাম যে, রাজা সুবোধ মল্লিকের বিবাহে ১৩০৪ সালে হইয়াছিল, আর তাঁহার পিতা ব্যারিষ্টার মন্মথচন্দ্র মল্লিক এই প্রথার প্রবর্তক।’ তবে এটা বলা প্রয়োজন যে, পদ্য বা কবিতা যে শুধু কাগজ কলমেই লেখা হতো তাই নয়। বিক্রমপুর ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলোতে একসময় বরযাত্রীকে কন্যাপক্ষ নির্মিত বিয়ের সুসজ্জিত তোরণটি অতিক্রম করার জন্য কবির লড়াইয়ে জিততে হতো। হয়তো দেখা যেত কন্যাপক্ষ একটি কবিতা আবৃত্তি করল। ঠিক সে কবিতার প্রতিউত্তরে বরযাত্রীদের মধ্য থেকে কাউকে আরেকটি কবিতা বলে কন্যাপক্ষের কবিতার সমুচিত জবাব দিতে হতো। আমার বন্ধুপ্রতিম যুগান্তরের সাহিত্য সম্পাদক প্রতিভাবান কবি জুন্নু রাইনের মুখ থেকে শুনেছি- তার গ্রামের বাড়ি ভোলায় নাকি লাঠিবাড়ি খেলার সঙ্গে সঙ্গে কবিতা আবৃত্তির চল ছিল। হারিয়ে যাওয়া এ বিরল সংস্কৃতিটি জুন্নু রাইনের নানা তার ছেলের অর্থাৎ জুন্নু রাইনের মামার বিয়েতে আয়োজন করেছিলেন। গ্রাম ভেঙে অজস্র মানুষ এসেছিল মনোজ্ঞ সেই অনুষ্ঠানটি স্বচক্ষে উপভোগ করতে। এককালে কন্যাপক্ষকে জব্দ করাই ছিল বরযাত্রীদের কৌতুক। বিশ-তিরিশ বছর আগেও বরযাত্রীর লোকজন এসে গোপনে খবর নিতেন কোন আইটেমটি শর্ট পড়ার সম্ভাবনা আছে। অনুষ্ঠানে গিয়ে সেই খাবারটি বেশি করে অর্ডার দিতেন। তবে এর ব্যতিক্রমও হতো অনেক সময় কন্যা পক্ষও বরযাত্রীদের হেনস্তা করতে ছাড়ত না। এ প্রসঙ্গে বাংলা ভাষায় প্রথম প্রকাশিত পত্রিকা সমাচার দর্পণে ১৮২৫ সালের ২১ মে একটি খবর প্রকাশিত হয়। সংবাদটির শিরোনাম ছিল- ‘বরযাত্রীকের অবস্থা’। প্রকাশিত সংবাদটি ছিল এরকম— ‘সম্প্রতি বর্ধমান জেলার অন্তঃপাতি হরিপুর গ্রাম নিবাসী রামমোহন বসু নামক এক কায়স্থের পুত্রের বিবাহ আতড়িখড়শী গ্রামের মিত্রের কন্যার সহিত হইয়াছিল। তাহাতে যে সকল বিশিষ্ট সন্তান বরযাত্রায় গিয়াছিলেন তাহারদিগের সহিত পরিহাসের কারণ কন্যা যাত্রীকেরা কয়েকটি হাঁড়ির মধ্যে হেলে, ঢোঁড়া ও ঢেম্না এই তিন প্রকার সর্প পরিপূর্ণ করিয়া এক গৃহমধ্যে রাখিয়া সেই গৃহে বরযাত্রীদিগকে বাসা দিয়া দ্বার রুদ্ধপূর্বক কৌশলক্রমে ঐ সকল হাঁড়ি ভাঙ্গিয়া দিলে তাহার মধ্যে থাকা সর্প বাহির হইয়া হিলিবিলি করিয়া ইতস্ততঃ পলায়নের পথ না পাইয়া ফোঁস ফোঁস করিয়া বরযাত্রীকের গায়ে উঠিতে লাগিল। তাহাতে বরযাত্রীকেরা ঐ সকল বীভৎসাকার সর্প ভয়ে ভীত হইয়া উচ্চৈঃস্বরে— বাপরে মলেমরে, ওরে সাপে খেলরে, তোমরা এগোওরে বলিয়া মহা ব্যস্ত সমস্ত হওয়াতে গ্রামের চৌকিদার ডাকাইত পড়িয়াছে বলিয়া ধাবমানে আসিয়া পরিহাস শুনিয়া হাসিয়া দ্বার খুলিয়া দেওয়াতে সকলে বাহির হইয়া এক প্রকার রক্ষা পাইল এবং দ্রুত প্রস্থান করিল।’ সংবাদটির মাধ্যমে সহজেই অনুমান করা যায় এককালে কী করুণ রসিকতা করা হতো বিয়ের অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে। পরিশেষে সেকাল ও একালের বিয়েসাদির মধ্যে একটি মৌলিক সাযুজ্যের দৃষ্টান্ত দিয়ে লিখাটি শেষ করছি। সেকালে বিয়েসাদি হতো কুল অর্থাৎ বংশ পরিচয় দেখে। তার একটি প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় নাট্যকার দীনবন্ধু মিত্রের (১৮৩০-১৮৭৩) ‘লীলাবতী’ নাটকে— সেখানে নাট্যকার দীনবন্ধু মিত্র (১৮৩০-১৮৭৩) মহাশয় ‘লীলাবতী’ নাটকে নদেরচাঁদের বিবাহ বন্ধন সম্পর্কে বর্ণনা করেছেন। ‘নদেরচাঁদ মূর্খ, অসভ্য, অশিক্ষিত, সকল প্রকার মাদকদ্রব্য সেবনে অভ্যস্ত, হীনচরিত্র এবং অতি কদাকার, তথাপি একজন ধনবান জমিদার তাহার একমাত্র কন্যা রূপে গুণে অতুলনীয় লীলাবতিকে সেই নদেরচাঁদের হস্তে সমর্পণ করিবার জন্য একান্ত আগ্রহান্বিত, কারণ নদেরচাঁদ তাহার অপেক্ষা কুলে শ্রেষ্ঠ।’ আর বর্তমানে বিয়েসাদির ব্যাপারে বর কিংবা কন্যার সবচেয়ে বড় যোগ্যতা হচ্ছে অর্থ। বর-কনে নির্বিশেষে সবার অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে কে কতটা অর্থশালী। বিদ্যা বুদ্ধি, শিক্ষা, মেধা, মনন, তখনো উপেক্ষিত ছিল এখনো  উপেক্ষিত, যা অনভিপ্রেত ও অনাকাঙ্ক্ষিত।

     লেখক : গল্পকার ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী।

ই-মেইল : [email protected]

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর