সোমবার, ২৭ মার্চ, ২০১৭ ০০:০০ টা
ধর্মতত্ত্ব

আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন (রহ.)

মুফতি আমজাদ হোসাইন হেলালী

আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন (রহ.)

নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘কিয়ামত পর্যন্ত আমার উম্মতের একদল লোক সর্বদাই দীনের ওপর অটল থাকবে, তিরস্কারকারীদের তিরস্কার তাদের কোনো ক্ষতি করতে পারবে না।’ তাঁর এই অমিয় বাণী অক্ষরে অক্ষরে প্রতিফলিত হয়েছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত হতে থাকবে আল্লাহর কিছু নেক্কার বান্দার মাধ্যমে।  তারাই হবে হক ও হক্কানিয়াতের সুমহান জামাত। তারা ও তাদের অনুসারীরা নাজাতপ্রাপ্তদের কাতারে থাকবে। কালের বাঁকে বাঁকে দাঁড়িয়ে তারাই দিয়েছে জাতিকে সঠিক পথের দিশা। পার্থিব লোভ-লালসা ও কোনো ধরনের ভয়ভীতি ক্ষণিকের জন্যও তাদের দীনি পথ থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। সাহাবা, তাবেইন, তাবেতাবেইন, আইম্মায়ে মুজতাহিদিন, মুহাদ্দিসিন ও উলামায়ে উম্মতদের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে আমরা পেয়েছি দীন-ইসলাম। পৃথিবীর ইতিহাসে সোনালি অক্ষরে তাদের নাম আজও লেখা আছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত লেখা থাকবে। ক্ষণজন্মা মনীষীদের মধ্যে আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন (রহ.) (ফেনুয়ার হুজুর) ছিলেন অন্যতম। তিনি শায়খুল ইসলাম হোসাইন আহমদ মাদানি (রহ.)-এর সুযোগ্য খলিফা ও যুগশ্রেষ্ঠ ওলিয়ে কামিল। শায়খুল ইসলামের পরশে তিনি একদিকে ছিলেন হাদিসবিশারদ, বিদগ্ধ আলিম। অন্যদিকে অন্যায় ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে ইস্পাতকঠিন এক শক্তিমান পুরুষ। এই মানুষটি ১৯০৫ সালে কুমিল্লার লাকসাম উপজেলার ফেনুয়া গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম মৌলভি ইমাম উদ্দিন মোল্লা। দাদার নাম ফযল উদ্দিন মোল্লা। পরদাদা কোরেশ উদ্দিন মোল্লা। এই হিসাবে তার বংশ ‘মোল্লা বংশ’ নামেই খ্যাত। মাতা ‘আমেনা’ ছিলেন একজন দীনদার মহীয়সী। এই মানুষটি পিতা-মাতা হারানোর পর আপন চাচা মৌলভি মেহেরুল্লাহর তত্ত্বাবধানে থাকেন। চাচাজান তার মধ্যে সোনালি ভবিষ্যতের ইঙ্গিত লক্ষ্য করেন। তাই চাচা তাকে খুব আদর-যত্ন করতেন। তার প্রতি সদা সজাগ দৃষ্টি রাখতেন। সংসারে আর্থিক অসচ্ছলতা ও অভাব-অনটন ছিল প্রকট। দেশের বাইরে গিয়ে লেখাপড়ার কোনো সুযোগ ছিল না। অবশেষে চাচার তত্ত্বাবধানে কুমিল্লার বটগ্রাম মাদ্রাসায় ভর্তি হন। সেখানে তিনি মাওলানা কাসেমের অধীন লেখাপড়া করেন। তিনি শিক্ষকের খুব আদরের ছিলেন। একদিন শিক্ষক বললেন, বাবা দেলাওয়ার! চল উজানীর কারি ইবরাহিম (রহ.)-এর কাছে যাই। মাসটি ছিল চৈত্র। রোদের প্রচণ্ড তাপ, তদুপরি মাথার ওপর ওস্তাদের বিরাট কাপড়ের গাঁঠরি। এ অবস্থায় ১০-১২ মাইল পথ অতিকষ্টে পাড়ি দিয়ে দ্বিপ্রহরের পর উজানী পৌঁছেন। তখন কারি সাহেব পুকুরের ঘাটলায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে কারি সাহেব বলে উঠলেন দেলু তুমি এসেছ! কারি সাহেব তাকে আদর করে ‘দেলু’ বলে ডাকতেন। তোমার কোরআন তিলাওয়াত বড় মধুর। আমাকে একটু তিলাওয়াত করে শোনাও। তখন তিনি ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত এবং ঘর্মাক্ত অবস্থায় ছিলেন। বিশ্রাম নেওয়ারও সুযোগ পাননি। সঙ্গে সঙ্গে কারি সাহেব হুজুরকে সুমধুর কণ্ঠে তিলাওয়াত করে শুনিয়ে দিলেন। তিলাওয়াত শুনে কারি সাহেব হুজুর উনাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘দেলু! তুমি তো আমার কলিজা শীতল করে দিলে।’ হজরত বলেন, ‘এরপর আমার সব ক্লান্তি দূর হয়ে গেল এবং আমি এক অজানা শান্তি অনুভব করলাম।’ এভাবে তিনি স্বদেশের শায়েখ ও উলামাদের থেকে ইসলামী ও আধ্যাত্মিক শিক্ষা শেষ করার পর চৌমুহনী ইসলামিয়া মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করেন। এরই মধ্যে বিয়ে করেন। বিয়ের পর কালবিলম্ব না করে দারুল উলুম দেওবন্দের উদ্দেশে রওনা হলেন। সেখানে পৌঁছে ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে কৃতিত্বের সঙ্গে পাস করলেন। দারুল উলুম থেকে ফারাগাতের পর চিন্তা করলেন জাহেরি ইলম তো অর্জিত হলো, কিন্তু বাতেনি ইলম কীভাবে হাসিল করা যায়। তাই ভারতের থানাবনে হজরত আশরাফ আলী থানভি (রহ.)-এর দরবারে যান। তার কাছে নিজের মনের বাসনা পেশ করলেন। হজরত থানভি বললেন, ‘ভাই! মেরে পাছ কিঁউ আয়েহো? জবকে দারুল উলুম মেঁ শায়েখ মাদানি মৌজুদ হায়।’ (আমার কাছে কেন এসেছ? দারুল উলুমে শায়খ মাদানি উপস্থিত থাকা অবস্থায়)। শায়খ মাদানির প্রতি হজরত থানভি (রহ.)-এর গভীর ভক্তি-শ্রদ্ধা দেখে শায়খ মাদানির প্রতি হজরতের ভক্তি-শ্রদ্ধা আরও বেড়ে গেল। কালবিলম্ব না করে দারুল উলুমে শায়খ মাদানি (রহ.)-এর দরবারে এসে তার হাতে বাইয়াত গ্রহণ করলেন। শায়খ মাদানি হজরতের সুলুকের লাইনে এত উন্নতি দেখে বাইয়াত গ্রহণের মাত্র ১৩ দিনের মাথায় খিলাফত দান করেন। দারুল উলুম দেওবন্দ থেকে দেশে এসে আনাচে-কানাচে বিভিন্ন মাদ্রাসা, মসজিদ ও খানকা কায়েম করেন। মানুষ যাতে সঠিক পদ্ধতিতে ইবাদত করতে পারে এবং ওয়াজ-নসিহতের মাধ্যমে দেশ থেকে শিরক-বিদাত ও কুসংস্কার প্রতিরোধের আপ্রাণ চেষ্টা করেন। তার খোলাফাদের মধ্যে অন্যতম আল্লামা সিরাজুল ইসলাম (রহ.) (বি বাড়িয়ার বড় হুজুর), আল্লামা আলী আকবর (রহ.) (তাবলিগ জামাতের বিশিষ্ট মুরব্বি), আল্লামা আবদুল মান্নান (রহ.) (ফেনীর পীর সাহেব) প্রমুখ। দীন-ইসলামের খেদমত করতে করতে জীবনের পড়ন্ত বেলায় পবিত্র হজ পালন করে আসার পর বাড়ি ফেরেন।

দিনটি ছিল রবিবার। রাতে ঘুমাতে যান। অন্যরাও ঘুমিয়ে পড়েন। রাত ৯টা বা সোয়া ৯টার দিকে হজরতের স্ত্রী এসে তার বড় ছেলে মাওলানা আছেম বিল্লাহকে ডেকে পাঠালেন। ছেলে এসে দেখেন পিতাজান চেয়ারে বসে জোরে জোরে শ্বাস গ্রহণ করছেন। ছেলেকে বললেন, ‘আমার সময় আর বেশি বাকি নেই।’ একসময় বলে উঠলেন, ‘দূর হও দূর জালিম কোথাকার, তুমি আমার ইমান নষ্ট করতে এসেছ?’ ঘরের সবাই বুঝে নিলেন হজরতের সময় আর বেশি বাকি নেই। তিনি শয়তানকে তাড়াচ্ছেন। কিছুক্ষণ পর জোরে জোরে আল্লাহু আকবার কয়েকবার বলে, কালিমা পড়ে মাওলার সান্নিধ্য গ্রহণ করলেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। সময়টি ছিল ১৯৭৭ সাল। আল্লাহ হজরতকে জান্নাতুল ফিরদাউসের ঠিকানা দান করুন। আমিন।

লেখক : মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও খতিব, বারিধারা, ঢাকা।

সর্বশেষ খবর