সোমবার, ২২ মে, ২০১৭ ০০:০০ টা

পরিচয় সংকটে অবসরকাল

উম্মে মুসলিমা

সত্তর-আশির দশকে আমাদের দেশের প্রায় সিনেমাতেই দেখা যেত নায়ক অথবা নায়িকার ধনী বাবা বা বড়ভাই ভিলেনের ষড়যন্ত্রের কারণে রাতারাতি নিঃস্ব কিংবা খবরের কাগজের হকার। প্রথমে তাদের উচ্চপদস্থ চাকুরে বা কোনো বড় প্রতিষ্ঠানের মালিকরূপে দেখানো হতো। এক সিনেমাপাগল মজার মানুষ এসব দেখে বলত ‘এত শিক্ষিত ভদ্রলোক, ওদের কি অন্য কোনো দক্ষতা উন্নয়ন হয় না? চাকরি চলে গেলেই পথের ফকির। ওদের স্বল্পশিক্ষিত স্ত্রীরা সেদিক থেকে অনেক পরিণামদর্শী। এদের সবার সেলাইয়ের প্রশিক্ষণ নেওয়া থাকে, আপদকালীন তারাই সংসার চালান’।

চাকরি থেকে অবসর মৃত্যুর মতোই সত্যি। এটা অনেকেই মানতে পারেন না। চাকরিকে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু ভাবেন। চাকরি শেষ হয়ে যাওয়া মানে বেঁচে থাকাটাই অর্থহীন মনে হয়। এক পরিচিত উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার অবসরগ্রহণের পনের দিনের মাথায় হার্ট অ্যাটাক হলো, তিন মাসের মাথায় ইহলোক ত্যাগ করলেন। তার স্ত্রী বলেছিলেন অর্ধচৈতন্যে থাকা অবস্থায় তার স্বামীর অস্পষ্ট যে কথাগুলো তিনি স্পষ্ট বুঝতে পেরেছিলেন তার মধ্যে ‘আমি এখন কী করব?’ ছিল। নারী চাকরিজীবীরা এরকম সমস্যায় কম পড়েন বলেই মনে হয়। একে নারী উচ্চপদস্থের সংখ্যা কম, তার ওপর নারীর ঘরের কাজের তো ইয়ত্তা নেই। ছুটিছাটার বিষয় নিয়ে এমন অনেক নারী চাকরিজীবীকে বলতে শোনা গেছে যে তারা বাড়ির চেয়ে কর্মস্থলে অবস্থানকেই অগ্রাধিকার দেন। কারণ বাড়ির কাজ বিরামহীন, অফিসের কাজে খানিকটা ফুরসত আছে। তাই অবসরে যাওয়া নারী শ্রমজীবীদের ‘আমি এখন কী করব’ বলার কোনো অবকাশ নেই। আর সিনেমার নারীদের মতো সেলাই জানেন, এমন নারী বাস্তবেও ঘরে ঘরে। শেষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে কেন জানি সরকারি উচ্চপদসমূহে কট্টরপন্থিদের নিযুক্ত করতে দেখা গেল। তেমনি এক কট্টরের অধীনস্থ এক কবি কর্মকর্তার চাকরি যায় যায় অবস্থা। ঊর্ধ্বতন নিজে দীর্ঘ সময় নিয়ে অফিসের নামাজঘরে জোহরের নামাজে ইমামতি করেন। কবিকে খুব একটা দেখেন না নামাজে। তলব পড়ল কবির।

‘আপনি কবিতা লেখেন?’

‘ঐ স্যার টুকটাক’

‘অফিসের কাজে ফাঁকি দিয়ে? অন্য কাজেও তো ফাঁকি দেন দেখি’

‘স্যার আমি তো কাজে ফাঁকি দিই না’

‘তাহলে কবিতা লেখেন কখন?’

‘অবসরে’

‘আপনাকে অখণ্ড অবসরে পাঠানোর ব্যবস্থা হচ্ছে’।

কর্মজীবনে খুব সফল একজন কর্তাব্যক্তি তার ভ্রমণবিলাসী লেখক সহকর্মীকে বলছিলেন ‘ভাই অবসরে তোমরাই বেঁচে থাকবে। আমরা যারা নির্গুণের আধার চাকরি শেষ হওয়ার পর তাদের কেউ মনে রাখবে না’। তবে পেশাজীবীরা এক্ষেত্রে ভাগ্যবান। তারা চাইলে নিজস্ব পেশা দিয়েই অবসরকে অর্থবহ করে তুলতে পারেন।  

মানুষের গড় আয়ু বাড়ছে। অবসরও প্রলম্বিত হচ্ছে। যাদের লেখালেখিতে হাত আছে তাদের অবসরকাল কাটানো কঠিন তো নয়ই বরং আনন্দের। এক সদ্য অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ছায়ানটে গানের ক্লাসে ভর্তি হয়েছেন। একজনকে নাটকের দলে যোগ দিতে দেখেছি। আঁকার হাত ভালো ছিল যার তিনি একক প্রদর্শনীর জন্য ছবি আঁকছেন। তো যাদের এসব গুণ নেই তারা কি ‘কেবলি স্বপনও করেছি বপনও’ বলে আকাশের দিকে চেয়ে সময় পার করবেন? সমাজ বা কমিউনিটির জন্য কিংবা সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য শিক্ষা বা আয় বৃদ্ধিমূলক কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারেন। অবসরে যাওয়া এমন নারীদের কথা জানি যাদের স্বামী গত হয়েছেন, সন্তানরা বিদেশে তারা বিনা পারিশ্রমিকে শুধু সময় কাটানোর জন্য কোনো কাজ চান। একজন পরিচিত অবসরপ্রাপ্ত ব্যক্তি তিনি লেখালেখি পারেন না, বাগান করাও তার হয়ে ওঠে না, কিন্তু তার রয়েছে পৈতৃকভাবে পাওয়া একটা বেশ বড় লাইব্রেরি। তিনি তার আশপাশের সাহিত্যানুরাগীদের লাইব্রেরি থেকে বই নিয়ে বাসায় গিয়ে পড়ার আমন্ত্রণ জানালেন। প্রতি সপ্তাহে পঠিত বই নিয়ে আলোচনায় তার বিকাল ভরে উঠত। সঙ্গতি থাকলে দল বেঁধে দেশ বা দেশের বাইরে বেড়াতে যাওয়াও এক ধরনের বেঁচে থাকার রসদ। আর অবসর ভাতার কিছু অংশ দিয়ে ছোটখাটো উদ্যোক্তা হয়ে উঠলেও উঠা যেতে পারে। কিন্তু ঘরে বসে মাসিক মুনাফার লোভে কাউকে ব্যবসা করার জন্য মোটা অংশটা তুলে দিয়ে ‘মানুষের ওপর বিশ্বাস হারানো পাপ’-এ বিশ্বাস করে না ঠকাই বাঞ্ছনীয়।

এক অবসরপ্রাপ্ত দম্পতির একটিই মাত্র সন্তান। বিদেশে থাকেন। তাদের অবসর জীবন কেমন কাটে জিজ্ঞাসা করলে তারা বলেন যে মাঝে মধ্যে বিদেশে মেয়ের ওখানে যান, নাতির সঙ্গে কিছুদিন সময় কাটিয়ে দেশে ফেরেন। দুজনে মিলে ঘরের কাজ সারেন, টবে ফুল আর সবজির চাষ করেন, সিনেমা দেখতে যান, সপ্তাহে একদিন আবাসন সোসাইটির শিশু শ্রমিকদের লেখাপড়া শেখান।

আমেরিকার শিকাগো এয়ারপোর্টে কয়েক ঘণ্টা বসে থাকতে হয়েছিল পরবর্তী ফ্লাইটের জন্য। দেখলাম প্রায় শতবর্ষী এক নারী জানালার কাচ মুছে বেড়াচ্ছেন। যখন একটু জিরিয়ে নিচ্ছিলেন তখন জিজ্ঞাসা করলে তিনি বললেন ৩০ বছর আগে তিনি অবসরে গেছেন। কিন্তু কাজ করার ক্ষমতা আছে বলে একটা এয়ারলাইন তাকে এ কাজে নিয়োগ দিয়েছে। বেতনও খারাপ না। তাছাড়া সময় তো কাটে।    

উদ্যোক্তাদের জীবনে অবসর আসে না। ষাট বছরে পৌঁছে তাদের ভাবতে হয় না ‘আমি এখন কী করব’? বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অবসর আসে বেশ দেরিতে। খেলোয়াড়রা যখন ইচ্ছা নিজে থেকে অবসর নেন। সবচেয়ে ভালো ব্যবসায় রাজনীতি। রাজনীতিবিদদের অবসরের চিন্তা নেই। নব্বই-এর কাছাকাছি বয়সে এসেও এইচ এম এরশাদ নিয়মিত জিম সেরে জনসভায় গিয়ে নির্বাচনে জয়ী হওয়ার ঘোষণা দেন। নিজ দলে হালে পানি না পেলে দল বদল করেন কিন্তু অবসরে যাওয়ার কথা ভাবেন না রাজনীতিবিদরা। হাতেগোনা অল্পসংখ্যক উচ্চপদস্থ সুবিধাপ্রাপ্ত নারী ব্যতীত চাকরিজীবী, উদ্যোক্তা, শ্রমিক, গৃহবধূ, কৃষক নারীর জীবনে কোনো অবসর নেই। তারা একটু অবসর চান।

বছর চারেক আগে থাইল্যান্ডের যুব কার্যক্রম দেখে এসে প্রথম আলোতে লিখেছিলাম ওখানকার যুব সংগঠন প্রবীণদের জন্য অনন্য সাধারণ উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। প্রতি সপ্তাহান্তে তারা বিভিন্ন কমিউনিটি হলে প্রবীণদের জন্য বিনোদন ও আয় সঞ্চারণমূলক কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা রেখেছে। এসব প্রবীণের অনেকেই হস্তশিল্পে সুনিপুণ। তারা যেমন নবীনদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন, তেমনি নিজেরাও ক্ষুদ্র শিল্পসামগ্রী উত্পাদন করছেন। যুব সংগঠকেরা এগুলো বাজারজাত করার ব্যবস্থা করছেন। সেখানে অনেকে রান্নার প্রশিক্ষণ দেন। সেই প্রশিক্ষণের সুবাদেই দুপুরের খাওয়া ও বিকালে নাচগানের আসর। যুবদের পরিচালনায় প্রবীণেরা গীতিনাট্য উপস্থাপন করলেন। এতে দর্শকেরাও অনন্দিত, আবার উপস্থাপক প্রবীণেরাও অনুপ্রাণিত। তারা সারা সপ্তাহের পাঁচ দিন ঘরে বসে হস্তশিল্প তৈরি করেন। সপ্তাহান্তের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করেন। সেদিন কী গান গাইবেন বা কোন নৃত্য বা নাটক অভিনয় করে দেখাবেন, তার অনুশীলন করতে থাকেন। স্বপ্নে আর শিল্পে তাদের দিন কেটে যায় বাঁচার আনন্দে।

আমাদের দেশে অসংখ্য সামাজিক সংগঠন। যুব সংগঠন প্রায় ২০ হাজার। তারা পরিবেশ সংরক্ষণ, বয়স্কশিক্ষা, শিশুশিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিভিন্ন হস্তশিল্প প্রশিক্ষণ ও সামাজিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। আমাদের যুবরা প্রবীণদের নিয়ে ব্যাংককের মতো উদাহরণ সৃষ্টি করতে পারেন। তাদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্য কার্যক্রমে অবসরপ্রাপ্তদের কাজে লাগাতে পারেন।

আমরা শিশুদের পড়াশোনার পাশাপাশি সুকুমার বৃত্তি পরস্ফুিটনে বহুমুখী প্রশিক্ষণে পাঠাই। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও এসবের ব্যবস্থা থাকে। আগে অনেক বেশি ছিল। ইদানীং গোল্ডেন ফাইভ ব্যতীত অন্য কোনো পুরস্কার শিশুদের ঝুলিতে সংযোজন করতে অভিভাবকরা নারাজ। তাই কোচিং এবং প্রাইভেট টিউশনের চাপে শিশুরা পাঠ্যবই বহির্ভূত সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে ইচ্ছা হলেও জড়িত হতে পারছে না। এখনকার বয়সী প্রজন্মরা তবুও একটা সাংস্কৃতিক পরম্পরা নিয়ে বেড়ে উঠেছেন বলে কম-বেশি তাদের অবসর একঘেয়েমিমুক্ত। কিন্তু আজকের প্রজন্ম যখন অবসরে যাবেন তখন লেমিনেট করা জিপিএ ফাইভ-এর সনদপত্র দেখে কাল কাটানো আর ফেসবুক ঘাঁটা ছাড়া তাদের অন্য কিছু করার থাকবে?

লেখক : কথাসাহিত্যিক।

[email protected]

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর