সোমবার, ২২ মে, ২০১৭ ০০:০০ টা
ধর্মতত্ত্ব

কোরআন শিক্ষার এক ব্যতিক্রমী প্রতিষ্ঠান

মুফতি মাওলানা মুহাম্মদ মানজুর হোসাইন

কোরআন শিক্ষার এক ব্যতিক্রমী প্রতিষ্ঠান

মহাগ্রন্থ আল কোরআন মানবজাতির জন্য সর্বশেষ পথনির্দেশিকা। আল্লাহর পক্ষ থেকে কেয়ামত পর্যন্ত এ কোরআনই মানুষের জাগতিক ও ইহলৌকিক জীবনের পাথেয় হিসেবে ভূমিকা পালন করবে। তাই এ কোরআন শেখা ও বোঝার কোনো বিকল্প নেই। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমরা অনেকেই কোরআন পড়তে পারি না। এটা সত্যিই অনেক বেদনার। এ বেদনার ঢেউ হৃদয়ে লালন করতেন শামসুল ওলামা মাওলানা ফুলতলী (রহ.)। তাইতো তিনি তার পুরো জীবন কোরআনের শেখা ও শেখানোর কাজে ব্যয় করে গেছেন। তিনি যেন বুখারি শরিফের সেই হাদিসের বাস্তব প্রতিচ্ছবি, যেখানে রসুল (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে উত্তম মানুষ সে, যে নিজে কোরআন শেখে এবং অন্যকে শেখায়।’ (বুখারি)। আল্লামা ফুলতলি (রহ.) প্রথমে নিজে দেশ-বিদেশের সেরা সেরা কারি ও হাফেজদের থেকে কোরআন শেখেন। তারপর নিজেকে কোরআন শেখানোর মহৎ কাজে উত্সর্গ করেন। তিনি কোরআন শেখানোর জন্য দারুল কিরাত মজিদিয়া ফুলতলী ট্রাস্ট নামে কোরআন শিক্ষার একটি স্বতন্ত্র বোর্ড গঠন করেন। বর্তমানে এ বোর্ড বাংলাদেশসহ বহির্বিশ্বে কোরআন শিক্ষার এক পথিকৃৎ হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে। আল্লামা ফুলতলী (রহ.) কোরআন শেখানোর দায়িত্ব পেয়েছেন স্বয়ং রসুল (সা.)-এর থেকে। তিনি যখন মক্কা থেকে দেশে ফিরে আসেন, তখন আল্লামা আবদুন নূর গড়কাপনি (রহ.) তার কাছে এসে সপ্তাহে একদিন কিরাত শিক্ষার ক্লাস নেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। ফুলতলী (রহ.) সময়ের অভাবের কারণে অপারগতা প্রকাশ করেন। এভাবে একাধিকবার অনুরোধের

পর আরেক দিন আবদুন নূর (রহ.) বলেন, ‘আজ আপনি আর না করতে পারবেন না। আমি বড় জায়গা থেকে অনুমতি নিয়ে এসেছি।’ ফুলতলী ছাহেব তার ও মুরশিদ বদরপুরী (রহ.) এর ইশারা নাকি জানতে চাইলে তিনি বললেন, ‘আমি স্বপ্নে হুজুরে পাক (সা.)-এর দিদার লাভ করি। তখন নবীজীর কণ্ঠে কোরআন পাকের তেলাওয়াত শুনতে পাই। আরজ করলাম, ইয়া রসুলুল্লাহ! এই কিরাত কীভাবে শিখব? তখন নবী পাক (সা.) ডানদিকে যাকে দেখিয়ে ইশারা করলেন, চেয়ে দেখি সেই সৌভাগ্যবান ব্যক্তি আপনি।’ এ কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে তিনি (রহ.) কেঁদে ফেললেন। তাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘আমি সপ্তাহের প্রতি বৃহস্পতিবার ১২টার পর নিকটবর্তী হজরত আদমখাকি (রহ.) এর মাজার সংলগ্ন মসজিদে কিরাত মশক্ব দেওয়ার ওয়াদা করলাম।’ 

বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ছাত্র ও শিক্ষকদের সুবিধার্থে ছুটির অবসরকালীন ও কোরআন নাজিলের মাস পবিত্র রামাদানকে কিরাত শিক্ষাদানের জন্য বেছে নেন আল্লামা ফুলতলী (রহ.)। ক্রমান্বয়ে এর শিক্ষার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। বিশাল খিদমত পরিচালনার জন্য একটি ট্রাস্ট গঠনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিলে ট্রাস্ট গঠন করে তার ভূসম্পত্তির বিশাল অংশ থেকে প্রায় ৩৩ একর জমি ট্রাস্টের নামে ওয়াকফ করে দিয়ে আল-কোরআনের খিদমতে এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়। তার ওয়ালিদ মাওলানা আবদুল মজিদ চৌধুরীর নামানুসারে এ প্রতিষ্ঠানের নাম রাখা হয় ‘দারুল কিরাত মজিদিয়া ফুলতলী ট্রাস্ট’। ২০১৫ সালের হিসাব অনুযায়ী এ বোর্ডের অধীনে বাংলাদেশে- ১৬৭০টি মাদ্রাসা আছে। লন্ডনে ৪২টি, ভারতে ৩৮টি, আমেরিকায় ৪টি, ইতালিতে ১টি ও স্পেনে ১টি অনুমোদিত শাখাসহ অসংখ্য শাখা দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে রয়েছে এবং প্রতিবছর এর সংখ্যা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে।

২০১৫ সালে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল প্রায় তিন লক্ষাধিক। ২০১৬ সালে তা বেড়ে প্রায় চার লক্ষাধিকে দাঁড়িয়েছে। ট্রাস্টের অধীনে বিভিন্ন স্থানে শাখা পরিচালিত হলেও সর্বশেষ জামাত ‘ছাদিছ’ বাংলাদেশের সিলেটের ফুলতলী ছাহেব বাড়িতে পরিচালিত হয়। প্রতিবছর এ জামাতে প্রায় পাঁচ-ছয় হাজারের মতো ছাত্রছাত্রীর মধ্যে তিন হাজারের অধিক ছাত্রের থাকা-খাওয়ার ব্যয়ভার সম্পূর্ণভাবে বহন করে এ ট্রাস্ট। মূলত শামসুল উলামা ফুলতলী (রহ.) তার বিশুদ্ধ কোরআনের সুরের মূর্ছনায় গোটা সমাজব্যবস্থাকে আলোড়িত করতে পেরেছিলেন। তার এ অনন্য খেদমতের ধারা অব্যাহত রাখতে পারলেই গোটা সমাজব্যবস্থা আল-কোরআনের আলোয় আলোকিত হয়ে উঠবে।

লেখক : টিভি, বেতার ভাষ্যকার খতিব, বাইতুদ দাউদ জামে মসজিদ, মিরপুর, ঢাকা।

সর্বশেষ খবর