শনিবার, ১ জুলাই, ২০১৭ ০০:০০ টা

আওয়ামী লীগ পেছনে হাঁটছে কেন?

রণেশ মৈত্র

আওয়ামী লীগ পেছনে হাঁটছে কেন?

বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু এখন ৭০-এর ওপরে। দেশের দুই প্রধান দলের একটি আওয়ামী লীগের বয়সও তার কাছাকাছি। গত মাসের ২৩ জুন ৬৯ বছরে পদার্পণ করেছে দলটি। ৬৯ বছরে পদার্পণ করা দলটির প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে অনেকেই আজ জীবিত নেই— মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, শামসুল হক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী, কামারুজ্জামানসহ আরও অনেকে। দেশের মুক্তিযুদ্ধেরও নেতৃত্ব দিয়েছিল আওয়ামী লীগ। মুক্তিযুদ্ধের মূল নেতৃত্বের কেউই আজ বেঁচে নেই।

কিন্তু আওয়ামী লীগ আছে এবং শুধু তাই নয়, ক্ষমতায় আছে। ৪৬ বছরের বাংলাদেশে এ যাবৎ ১৭ বছর আওয়ামী লীগ শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত।

এক কথায় যদি বলা যায় তবে বলতে হবে, দলটির বিশাল এক ঐতিহ্য রয়েছে গণআন্দোলন করার এবং তাতে নেতৃত্ব দিয়ে সফলতা অর্জনের। সর্বাধিক সাফল্য এসেছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে যার অসাধারণ যোগ্যতা এবং অসম সাহসিকতা সমগ্র বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছিল। জাতিকে ঐক্যবদ্ধভাবেই সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে অনুপ্রাণিত করেছিল।

প্রতিষ্ঠার পর আওয়ামী মুসলিম লীগ তাবৎ গণআন্দোলন গড়ে তুলেছে ১৯৪৯ থেকে ’৫৪ পর্যন্ত। তখন মুসলিম লীগ ছাড়া কার্যত আর কোনো দলের অস্তিত্বই ছিল না। প্রবল সাম্প্রদায়িক সহিংসতার কবলে পড়ে হিন্দুদের ব্যাপক দেশত্যাগের পরিণতিতে অসাম্প্রদায়িক দলগুলোর ভয়াবহ শূন্যতার পরিপ্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগকে এ দায়িত্ব পালন করতে হয়। যদিও যথেষ্ট পরিমাণে সেই সাংগঠনিক শক্তি তখন পর্যন্ত আওয়ামী মুসলিম লীগের গড়ে ওঠেনি। পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ ছিল আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠন। তাদের নিয়েই আন্দোলনে যেতে হতো।

কিন্তু বায়ান্ন সালে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন নামে বাম প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠন গড়ে ওঠার পর একদিকে যেমন মুসলিম ছাত্রলীগের আবেদন ছাত্রসমাজের কাছে হ্রাস পেয়েছিল, তেমনি ভাষা আন্দোলনের প্রধান নেতারাই ছাত্র ইউনিয়ন গড়ে তোলায় তার আবেদন দ্রুতই ছাত্রসমাজের মধ্যে বিস্তৃতি লাভ করতে থাকে। তদুপরি বামধারার চেতনায় নতুন নেতা-কর্মীও ঝাঁকে ঝাঁকে ছাত্র ইউনিয়নে যোগ দেওয়ায় প্রচণ্ড গতিবেগ সৃষ্টি হয় তৎকালীন ছাত্র আন্দোলনে।

কিন্তু প্রকাশ্যে ছাত্র ইউনিয়নের অভিভাবক বা তার প্রতি বন্ধুসুলভ কোনো রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব ছিল না। এহেন পরিস্থিতিতে ছাত্র ও গণআন্দোলনের অধিকতর বিস্তৃতি ঘটানোর লক্ষ্যে ছাত্র ইউনিয়নও হয়ে পড়ে ছাত্রলীগের সঙ্গে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা আন্দোলনের বিশ্বস্ত সহযাত্রী। এভাবে তখন থেকেই আওয়ামী মুসলিম লীগে যে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার নবউন্মেষ ঘটাতে সচেষ্ট ছিল, তা সহজতর হয় ছাত্র ইউনিয়নের ওই ভূমিকার ফলে। ফলে ঘটতে থাকে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সঙ্গে বাম উপাদানের অবিস্মরণীয় সম্মিলন। এটি আমাদের দেশের ক্রমবিকাশমান গণআন্দোলনের এক অসাধারণ বৈশিষ্ট্য; যার অস্তিত্ব বজায় ছিল নব্বইয়ের দশক অবধি। এবং ওই পর্যন্ত সব বাধা-বিপত্তি পেছনে ঠেলে গণঐক্যের ভিত্তিতে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। অবশ্য বঙ্গবন্ধু হত্যার পরবর্তীতে ওই গতি স্বভাবতই মন্থর হয়ে এসেছিল। সে সংকট নব্বই-পরবর্তীতে দিনে দিনে আরও তীব্র হয়ে উঠছে।

যা হোক, আওয়ামী লীগের সর্বাধিক বড় অবদান গণতন্ত্রের সংগ্রামে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করা এবং সেই সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় ১৯৫৪-এর নির্বাচনের ঐতিহাসিক বিজয়। ’৬৬-তে ছয় দফা আন্দোলন এবং সবশেষে ’৭১-এ মহান মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব প্রদান। আবার লক্ষণীয় যে, এ পর্যন্ত তাবৎ আন্দোলনে এক অসাধারণ সংশ্লেষ ঘটেছিল জাতীয়তাবাদী আওয়ামী লীগের সঙ্গে বাম শক্তির। ফলে উভয়েই লাভবান হচ্ছিল, দেশ এগিয়ে যাচ্ছিল। প্রতিক্রিয়ার শক্তিগুলো পিছু হটছিল।

আওয়ামী মুসলিম লীগকে আওয়ামী লীগে রূপান্তরিত করা বা দলটির অসাম্প্রদায়িকীকরণের ক্ষেত্রে যেমন অবদান ছিল শেখ মুজিবুর রহমানের, তেমনই গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন মওলানা ভাসানী ও দেশের বামপন্থিরা। সবার মিলিত প্রচেষ্টায় ’৫৬ সালে আওয়ামী লীগ থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি তুলে দিয়ে আওয়ামী লীগ নামকরণ করা হয়।

ওই একই বছরে পূর্ব বাংলায় আতাউর রহমান খানের আওয়ামী লীগ কোয়ালিশন সরকার এবং কেন্দ্রে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে মাত্র ১২ জন দলীয় সাংসদ নিয়ে প্রতিক্রিয়াশীল রিপাবলিকান দলের সঙ্গে কোয়ালিশন সরকার গঠিত হয়। পূর্ব বাংলায় গণতন্ত্রী দলের মাধ্যমে বাম-প্রগতিশীল শক্তির সক্রিয় সমর্থন পেয়েছিল আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার। ফলে বাংলাদেশ ওই দলগুলোর নিরন্তর প্রচেষ্টায় অত্যন্ত প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক চেতনায় সমৃদ্ধ হয়ে গন্তব্যপথ নির্ধারণ করে নিতে পেরেছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতা-উত্তর চার রাষ্ট্রীয় মৌলনীতিও সেভাবেই চূড়ান্তরূপে নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল যার দালিলিক প্রমাণ দলগুলোর মেনিফেস্টোতে, একাত্তরে মুজিবনগর সরকারের ঘোষিত দিকনির্দেশনায় এবং বাহাত্তরের সংবিধানে বিধৃত হয়। গৌরবের চূড়ান্ত শিখরে আরোহণ করল বাংলাদেশ ও তার নেতৃত্ব।

নেতৃত্বের ব্যাপারটা বাস্তবতার নিরিখে আমাদের চিন্তা-চেতনায় থাকা দরকার। শৈশবে আওয়ামী মুসলিম লীগের যে বিকাশ ঘটেছিল তাতে বিশাল অবদান ছিল দলটির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর। তার অসাম্প্রদায়িক চেতনার। দরিদ্র-শোষিত মানুষের বিশেষত কৃষকের স্বার্থের অনুকূলে দৃঢ় ভূমিকা এবং সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ও সমাজতন্ত্রের প্রতি আকর্ষণ নিঃসন্দেহে আওয়ামী লীগ জনমনে ব্যাপক প্রভাব বিস্তারে সক্ষম হয়েছিল।

কিন্তু ’৫৭ সালে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী কেন্দ্রের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসন ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী পররাষ্ট্রনীতির বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করেন। মওলানা ভাসানী ও আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরস্থ প্রগতিশীল অংশ ও বাইরে অবস্থানকারী বন্ধুসুলভ বামপন্থি শক্তিসমূহ ওই নীতির তীব্র বিরোধিতা করতে থাকে এবং এরই এক পর্যায়ে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে বহু আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী দল থেকে পদত্যাগ করেন এবং ’৫৭ সালের জুলাইয়ে ঢাকার রূপমহল সিনেমা হলে দুই দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত ‘নিখিল পাকিস্তান গণতান্ত্রিক কর্মী’ সম্মেলনে গৃহীত সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ‘পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ)’ নামে পাকিস্তানব্যাপী বামধারার একটি প্রগতিশীল উদার গণতান্ত্রিক দলের জন্ম হয়। মুসলিম লীগ বাদে একমাত্র এই দলটিরই পাকিস্তানের পাঁচটি প্রদেশে শাখা বিস্তার ঘটেছিল। আওয়ামী লীগ অত্যন্ত শক্তিশালী দল হলেও তার বিস্তৃতি প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত পূর্ব বাংলার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। এ কথার সত্যতা ’৭০ সালের ঐতিহাসিক সাধারণ নির্বাচনে যথার্থভাবে প্রমাণিত হয়েছিল।

’৭০-এর নির্বাচনে পূর্ব বাংলার প্রায় সব কটি আসনে জয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ সমগ্র পাকিস্তানে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও পশ্চিম পাকিস্তানের চারটি প্রদেশের কোনোটিতে একটি আসনও পায়নি।

অথচ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি খান আবদুল ওয়ালী খানের নেতৃত্বে বেলুচিস্তান ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে যথাক্রমে গাউস বখশ বেজেঞ্জোর নেতৃত্বে বেলুচিস্তানে এবং খান আবদুল ওয়ালী খানের নেতৃত্বে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে ন্যাপের সরকারও গঠন করেছিল। ওয়ালী ন্যাপ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধেও সমর্থন দিয়েছিল এবং সে কারণে সেখানকার অনেক নেতাকে ইয়াহিয়া সরকার কারারুদ্ধও করেছিল।

এভাবে নানা চড়াই-উতরাইয়ের মধ্য দিয়ে চললেও, আগেই বলেছি, নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত আওয়ামী লীগ আদর্শিক চেতনায় দৃঢ় ছিল, জনতার ঐক্যও অটুট ছিল। বামপন্থিদের নীতিনিষ্ঠ অবস্থান এ কাজে আওয়ামী লীগের সহায়ক শক্তি হিসেবেও বিরাজ করছিল। কিন্তু ষাটের দশকের গোড়ার দিকে বিশ্বের সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের ও রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে আদর্শগত ভয়ানক মতানৈক্য সৃষ্টি হওয়ায় তার অভিঘাতে বিশ্বব্যাপী সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের মতো বাংলাদেশের সদ্য বিকাশমান বামপন্থি আন্দোলনেও মারাত্মক বিভক্তি ঘটে। ফলে দ্বিখণ্ডিত হয় ন্যাপ, ছাত্র ইউনিয়ন, কৃষক সমিতি প্রভৃতি। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান ও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বামপন্থি শক্তিগুলো ওই বিভক্তিজনিত দুর্বলতা বহুলাংশে কাটিয়ে তুলতে সক্ষম হলেও তা প্রয়োজনমতো শক্তি সংগ্রহ করে আর দাঁড়াতে পারেনি।

এর বিপরীতে আওয়ামী লীগ প্রধানতম ধর্মনিরপেক্ষ শক্তি হলেও পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টে সপরিবারে বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যালীলার পর একদিকে যেমন দলটি আদর্শিক বিপর্যয়ের মুখে পড়ে যায়, তেমনি তারা একটানা ২১ বছর ক্ষমতার বাইরে থেকে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে লিপ্ত থাকলেও তার আদর্শিক অবস্থান ক্রমাগতই দুর্বল হতে থাকে।

’৯৬ সালে আওয়ামী লীগ দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতাসীন হয় বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে। ওই সময় দলটিকে নানা বিপর্যয় সাধ্যমতো প্রতিরোধের কাজে নিয়োজিত থাকতে এবং বিএনপি-জামায়াতের মতো শক্তিকে প্রতিরোধের কাজেই বেশি লিপ্ত থাকতে হয়েছে।

২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পুনরায় বিরোধীদলীয় অবস্থানে গেলে ক্ষমতাসীন বিএনপিকে ক্ষমতাচ্যুত করার আন্দোলনে নেমে পড়ে। সেই আন্দোলন দীর্ঘমেয়াদি হরতাল, সংসদ বর্জনেও রূপ নেয়। এরপর জরুরি অবস্থায় বা সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার কর্তৃক সৃষ্ট পরিস্থিতির নানাবিধ ধকল কাটিয়ে ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ আশাতীত বিজয় অর্জন করে। দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি আসনে জিতে আসার কারণে প্রচণ্ড আশাবাদ সৃষ্টি হয় দেশের সর্বস্তরের মানুষের মনে। ধারণা করা হলো আওয়ামী লীগ এখন নিজ শক্তিবলে বলীয়ান হওয়ায় বঙ্গবন্ধু প্রবর্তিত রাষ্ট্রীয় চার মৌলনীতি যা ১৯৭২ সালে প্রণীত ও গৃহীত হয়েছিল তা সংবিধান সংশোধনী এনে অবিকল পুনঃস্থাপন করা হবে। কারণ মাঝখানে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর প্রথমে জিয়াউর রহমান পঞ্চম সংশোধনী এনে ‘বিসমিল্লাহ’ সংযোজন করেন, জামায়াতে ইসলামীসহ সব ধর্মাশ্রয়ী দলকে বৈধতা প্রদান করেন, অবৈধভাবে পাকিস্তানি নাগরিক গোলাম আযমকে বাংলাদেশে থাকার সুযোগ প্রদান করেন এবং অতঃপর হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ অষ্টম সংশোধনী এনে ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’ সংযোজিত করে বাহাত্তরের সংবিধানকে কলঙ্কিত, কলুষিত ও তার পাকিস্তানিকরণ করেছিলেন, ২০০৮-এর সংসদে তা সহজেই বাতিল করে বাহাত্তরের মূল সংবিধানে ফিরে আসার পথটা সহজ হলো। কিন্তু আওয়ামী লীগ সে পথে হাঁটল না।

অতঃপর ভিন্ন এক মোকদ্দমার রায়ে হাই কোর্ট জিয়ার পঞ্চম ও এরশাদের অষ্টম সংশোধনী বাতিল ও বেআইনি ঘোষণা করলে এবং এর বিরুদ্ধে দায়েরকৃত আপিলে সুপ্রিম কোর্টও ওই রায় বহাল রেখে রায় দিলে সে রায় মোতাবেক জিয়া-এরশাদের আবর্জনা বাতিল হয়ে গেলে আওয়ামী লীগ ছাড়া বাদবাকি সবাই তাকে অভিনন্দন জানাল।

কিন্তু আওয়ামী লীগ? তারা ওই রায়ের ভিত্তিতে কোনো গেজেট প্রকাশ না করে উল্টো পঞ্চদশ সংশোধনী এনে দিব্যি জিয়া-এরশাদের সংশোধনীগুলো সংবিধানে পুনর্বহাল করে বাহাত্তরের চার রাষ্ট্রীয় মূলনীতি থেকে কার্যত পিছটান দিল।

সন্দেহ নেই আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দু-চারটি দুঃসাহসী কাজ করে নিঃসন্দেহে প্রশংসার পাত্রী হয়েছেন। যেমন বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার ও তার রায় বাস্তবায়ন, যুদ্ধাপরাধী জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ নেতাদের বিচার ও তাদের বিরুদ্ধে প্রদত্ত রায় বাস্তবায়ন, বিশ্বব্যাংকের প্রতিশ্রুত পদ্মা সেতু প্রকল্পের টাকা দিতে অস্বীকার করলে নিজস্ব অর্থে তা নির্মাণের প্রত্যয় ঘোষণা এবং ইতিমধ্যে সেতুটির নির্মাণকাজের প্রায় ৪০ ভাগ সম্পাদন উল্লেখযোগ্য।

কিন্তু এতে যা অর্জিত হবে গোলার সেই ধান পোকায় খেয়ে যাওয়ার ব্যবস্থাও তো পাকাপাকি করা হচ্ছে। উগ্র ধর্মান্ধ হেফাজতে ইসলামের দাবি মোতাবেক পাঠ্যপুস্তক সাম্প্রদায়িকীকরণের লক্ষ্যে তাদের নির্দেশিত পাঠ্যক্রম চালু করা, কওমি মাদ্রাসার সর্বোচ্চ ডিগ্রিকে সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ মাস্টার্স ডিগ্রির মর্যাদা প্রদান প্রভৃতির মাধ্যমে বিজ্ঞানসম্মত একমুখী শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তনের দাবি ও সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসে মাদ্রাসা শিক্ষাকে মহিমান্বিত করা হয়েছে তাদের সিলেবাস প্রণয়নে সরকার আদৌ হাত খেলাবে না হেফাজতের এই দাবির কাছেও নীতি স্বীকার করে।

সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণ থেকে ভাস্কর্য অপসারণসংক্রান্ত হেফাজতের দাবি অযৌক্তিক জেনেও তাতে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে তা সরানোর উদ্যোগ গ্রহণ করাও দুর্ভাগ্যজনক। মনে হচ্ছে তাদের কমিটমেন্ট মুক্তিযুদ্ধের প্রতি নয়, তা বরং জামায়াত-হেফাজত জিয়া-এরশাদের প্রতি।

তাই ৬৯ বছরে এসে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ নামক ঐতিহ্যবাহী বৃহৎ দলটি আজ দ্রুত পেছন দিকে ধাবমান। বাঙালির, মুক্তিযুুদ্ধের, বঙ্গবন্ধুর, চার জাতীয় নেতার লালিত সত্তাকে আজ এক মারাত্মক বিপর্যয়ের মুখে পরিকল্পিতভাবেই ঠেলে দেওয়া হচ্ছে প্রতিদিন।

আওয়ামী লীগকে গ্রহণযোগ্য করে রাখতে হলে আপসকামিতা ছেড়ে বঙ্গবন্ধুর পথে প্রগতির শক্তিগুলোর সঙ্গে একত্রে লড়াইয়ে নামতে হবে সাম্প্রদায়িকীকরণ পাকিস্তানিকরণ প্রতিরোধে। এ এক ধর্মযুদ্ধতুল্য, যাতে আপসের বিন্দুমাত্র অবকাশ নেই। আশা করি, শিগগিরই দলটির নেতা-কর্মীদের বোধোদয় হবে। আত্মহননের পথ থেকে আওয়ামী লীগ হয়তো সরে আসবে। বাংলাদেশ অত্যাসন্ন ভয়াবহ বিপর্যয় থেকেও হয়তো রক্ষা পাবে।

লেখক :  সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য— ঐক্য ন্যাপ।

E-mail : [email protected]

সর্বশেষ খবর