সোমবার, ৩ জুলাই, ২০১৭ ০০:০০ টা

প্রবীণদের প্রতি শ্রদ্ধা

অধ্যাপক ডা. প্রাণ গোপাল দত্ত

প্রবীণদের প্রতি শ্রদ্ধা

কেমন আছেন দেশের প্রবীণরা? গত ১৫ জুন ছিল বিশ্ব  প্রবীণ দিবস। বিশ্ব ডঊঅঅউ (World Elders Abuse Awareness Day) অর্থাৎ বিশ্ব প্রবীণ নির্যাতন প্রতিরোধ সচেতনতা দিবস। বিশ্ব প্রবীণ নির্যাতন প্রতিরোধ সচেতনতা দিবসটি জাতিসংঘের আওতায় বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এবং আন্তর্জাতিক প্রবীণ নির্যাতন প্রতিরোধ নেটওয়ার্কের উদ্যোগে ২০০৬ সাল থেকে বিশ্বব্যাপী পালিত হচ্ছে। এই দিবসের উদ্দেশ্য নবীনদের, সমাজকে সচেতন করা। আজকে যারা প্রবীণ তারাই তাদের শ্রম এবং মেধা দিয়ে আমাদের এখানে এনে দাঁড় করিয়েছেন। সুতরাং তাদের প্রাপ্য সম্মান দিতে নবীন, তথা সমাজ ও সরকার দায়বদ্ধ। ২০১৭ সালের বিশ্ব প্রবীণ নির্যাতন প্রতিরোধ সচেতনতা দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল—‘Understand and End Financial Abuse of Older People : A Human Right Issue.’ এই প্রতিপাদ্য বিষয় বেছে নিয়ে জাতিসংঘ বৃদ্ধ বয়সে আর্থিক সংকটকে বা আর্থিক প্রতারণাকে প্রচণ্ড গুরুত্ব দিয়েছে। বাস্তবতার নিরিখে পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে ২০৩০ সাল যখন পুরো বিশ্ব SDG বা টেকসই অর্জনে উন্নতির শীর্ষে উঠার স্বপ্ন বা বাস্তবে প্রচণ্ডভাবে ব্যস্ত তখন আমাদের মনে রাখতে হবে ২০৩০ সাল নাগাদ পুরো বিশ্বে উন্নত বা উন্নয়নশীল দেশ সর্বত্রই প্রবীণ জনগণের সংখ্যা বেড়ে কত দাঁড়াবে। শুধু বাংলাদেশেই এর সংখ্যা হবে আনুমানিক ৩ থেকে ৪ কোটি।

যেহেতু প্রবীণ নাগরিকের সংখ্যা বাড়বে তেমনি বাড়বে আনুপাতিক হারে অত্যাচার এবং নির্যাতন। মনে রাখতে হবে অমর্যাদা বা অত্যাচার বা অপব্যবহার বা অবহেলা যাই হোক না কেন, শিশু নারী বা প্রবীণ বৃদ্ধ-বৃদ্ধা সবাই তার ভুক্তভোগী। গভীরভাবে চিন্তা করলে বা সামাজিকভাবে বিশ্লেষণ করলে প্রবীণ নির্যাতন কত মর্মান্তিক তা শুধু ভুক্তভোগীরাই জানেন। সামাজিক বা ব্যক্তি সম্মানের কারণে কিংবা ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার কথা চিন্তা করে ভুক্তভোগী তা প্রকাশ করতে চান না। আমাদের দেশে ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস সেন্টার অথবা ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার প্রমাণ করে আমরা শিশু নির্যাতন বা নারী নির্যাতন সম্পর্কে খুবই সচেতন। যদিও বয়োবৃদ্ধের জন্য এ সংক্রান্ত কোনো কেন্দ্র গড়ে ওঠেনি। অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী দেশ জাপান, শিক্ষিত ও সভ্য এবং আত্মত্যাগী হওয়ার পরেও নিজ দেশে Elder Abuse Prevention Centre তৈরি করেছেন। কানাডিয়ান সরকার সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে তাদের নিজের দেশে স্কুল কারিকুলামের মাধ্যমে Elder Abuse প্রতিরোধে তাদের দেশের ছেলেমেয়েদের বয়স্কদের প্রতি সচেতন এবং সংবেদনশীল করার জন্য শিক্ষা দিচ্ছেন। পারিবারিকভাবে এই শিক্ষা কিন্তু বাংলাদেশে বিদ্যমান ছিল। উদাহরণ স্বরূপ বলা যেতে পারে আমরা ছোটবেলায় যখন মা-বাবা, দাদু-দিদা বা পুজনীয় ব্যক্তিদের জুতো পায়ে লাগালে তা যথাযোগ্য মর্যাদায় যথাস্থানে সম্মানের সঙ্গে সাজিয়ে রাখতে হতো।

একজন প্রবীণ লোকের জন্য পাঁচটি মৌলিক চাহিদা মেটানোর প্রয়োজন পড়ে না। তাদের দরকার সামান্য খাবার, ন্যূনতম আশ্রয়, স্বাস্থ্য খাতে প্রবেশাধিকার, সর্বোপরি তাদের শারীরিক এবং মানসিক নিরাপত্তা। আমাদের মনে রাখতে হবে বয়োবৃদ্ধ নিগৃহীত শুধু অর্থনৈতিকভাবেই হয় না, Verbal Abuse (মৌখিক), Psychological Abuse (মানসিক নির্যাতন), Physical (শারীরিক নির্যাতন), Sexual (যৌন নির্যাতন), Caregiver Neglecঃ (পরিচর্যাকারীর অবহেলা), Self neglecঃ (স্ব অবহেলা), সর্বোপরি Financial Abuse (আর্থিক অবহেলা) সুতরাং প্রত্যেকটাই। বয়োবৃদ্ধের জন্য যা দরকার তা হলো স্বাস্থ্য খাতে তাদের মুক্ত প্রবেশ। আমার এই দেশ যখন Immunization ev Vaccination দিয়ে শিশুমৃত্যু কমিয়ে এনেছে, স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে মাতৃমৃত্যু কমিয়েছে, এখন অপরিহার্য হয়ে গেছে বৃদ্ধদের চিকিৎসাসেবা প্রদান। চিকিৎসক হিসেবে আমি জানি একজন বৃদ্ধকে ৬০ বছরের ঊর্ধ্বে গেলেই ন্যূনতম ৬-৭টা ওষুধ খেতে হয়। যদি ডায়াবেটিস থাকে তাহলে ইনস্যুলিন নিতে হলে, মাসিক খরচের পরিমাণ ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা। তা হলে যেই চাকরিজীবী সন্তান তাদের বাবা-মার দেখাশোনা কীভাবে করেন? তাই রাষ্ট্রকে সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ের অধীনে বৃদ্ধাদের নিয়ে আসতে হবে। 

বিশ্বজুড়ে প্রতিদিন অসংখ্য প্রবীণ নানাভাবে নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। বিশ্ব প্রবীণ নির্যাতন প্রতিরোধ সচেতনতা দিবসটি জাতিসংঘের আওতায় বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এবং আন্তর্জাতিক প্রবীণ নির্যাতন প্রতিরোধ নেটওয়ার্ক উদ্যোগে সর্বপ্রথম ২০০৬ সালের থেকে ১৫ জুন বিশ্বব্যাপী পালিত হয়ে আসছে। বিশ্বব্যাপী প্রবীণ নির্যাতন ও অবহেলা সম্পর্কে সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, জনসংখ্যা তাত্ত্বিকভাবে জনগণকে সচেতন করাই এই দিবসের উদ্দেশ্য। বাংলাদেশের প্রবীণরা নানাভাবে প্রবীণ নির্যাতনের শিকার হন। বাংলাদেশের প্রবীণরা সাধারণত শারীরিক নির্যাতন, মানসিক নির্যাতন, অবহেলাজনিত নির্যাতন, অর্থনৈতিক নির্যাতনের শিকার হন। হেল্পএইজ ইন্টারন্যাশনাল এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সাইন্স বিভাগের এক জরিপে দেখা গেছে, ৮৮% প্রবীণ মানসিকভাবে নির্যাতনের শিকার হন। জরিপের উত্তরদাতা তাদের ৮৩.৩% মনে করেন, তারা কোনো না কোনোভাবে অবহেলার শিকার, ৫৪.৪% অর্থনৈতিক নির্যাতন, ৩৯.৬% হচ্ছেন শারীরিক নির্যাতনের শিকার, যার মধ্যে ৫৪.৫% নারী প্রবীণ। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অধিকাংশ প্রবীণ একসঙ্গে একাধিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। বাংলাদেশে পুরুষ প্রবীণদের চেয়ে নারী প্রবীণ অধিক মাত্রায় নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন।

বাংলাদেশে যদিও কিছু এনজিও প্রবীণদের কল্যাণে কাজ করে যাচ্ছে, যার মধ্যে রিসোর্স ইন্টিগেশন সেন্টার (রিক), স্যার উইলিয়াম বেভারেজ ফাউন্ডেশন, হেলদি হোম ইত্যাদি। বাংলাদেশ সরকার পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ আইন, ২০১৩ অক্টোবর ২৭, ২০১৩ অনুমোদন করেছে। আজকের স্কুল ছাত্রছাত্রী, যুবক-যুবতী সবার জ্ঞাতার্থে পুনরায় উপস্থাপন করলাম। আইন হিসেবে এত চমৎকার, সময়োপযোগী আইন প্রণয়নের জন্য অবশ্যই সরকার ধন্যবাদ পাওয়ার অধিকার রাখে এবং প্রবীণ জনগোষ্ঠী ও কৃতজ্ঞতাবদ্ধ। প্রয়োজন আইনের প্রয়োগ। পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ আইন, ২০১৩ এখানে উল্লেখ করছি যাতে বলা আছে—

ধারা-৩ : পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ। প্রত্যেক সন্তানকে তাহার পিতামাতার ভরণপোষণ নিশ্চিত করিতে হইবে।

কোন পিতামাতার একাধিক সন্তান থাকিলে সেইক্ষেত্রে সন্তানগণ নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করিয়া তাহাদের পিতামাতার ভরণপোষণ নিশ্চিত করিবে। এই ধারার অধীনে পিতামাতার ভরণপোষণ নিশ্চিত করিবার ক্ষেত্রে প্রত্যেক সন্তানকে পিতামাতার একই সঙ্গে একই স্থানে বসবাস নিশ্চিত করিতে হইবে।

কোনো সন্তান তাহার পিতা বা মাতাকে বা উভয়কে তাহার, বা ক্ষেত্রেমত, তাহাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে, কোনো বৃদ্ধ নিবাস কিংবা অন্য কোথাও একত্রে কিংবা আলাদা আলাদাভাবে বসবাস করিতে বাধ্য করিবে না।  প্রত্যেক সন্তান তাহার পিতা এবং মাতার স্বাস্থ্য সম্পর্কে নিয়মিত খোঁজখবর রাখিবে, প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবা ও পরিচর্যা করিবে। পিতা বা মাতা কিংবা উভয়, সন্তান হইতে পৃথকভাবে বসবাস করিলে, সেইক্ষেত্রে প্রত্যেক সন্তানকে নিয়মিতভাবে তাহার বা ক্ষেত্রেমত, তাহাদের সহিত সাক্ষাৎ করিতে হইবে।

কোনো পিতা বা মাতা কিংবা উভয়ে, সন্তানদের সহিত বসবাস না করিয়া পৃথকভাবে বসবাস করিলে, সেইক্ষেত্রে উক্ত পিতা বা মাতার প্রত্যেক সন্তান তাহার দৈনন্দিন আয়-রোজগার বা ক্ষেত্রমত, মাসিক আয় বা বাৎসরিক আয় হইতে যুক্তিসঙ্গত পরিমাণ অর্থ পিতা বা মাতা বা ক্ষেত্রেমত, উভয়কে নিয়মিত প্রদান করিবে। 

ধারা-৪ : পিতামাতার অবর্তমানে দাদা-দাদি, নানা-নানির ভরণপোষণ। প্রত্যেক সন্তান তাহার—  (ক) পিতার অবর্তমানে দাদা-দাদিকে; এবং (খ) মাতার অবর্তমানে নানা-নানিকে। ধারা ৩-এ বর্ণিত ভরণপোষণ প্রদানে বাধ্য থাকিবে এবং এ ভরণপোষণ পিতামাতার ভরণপোষণ হিসেবে গণ্য হইবে।

ধারা-৫ : পিতামাতার ভরণপোষণ না করিবার দণ্ড—

কোনো সন্তান কর্তৃক ধারা ৩-এর যে কোনো উপধারার বিধান কিংবা ধারা ৪-এর বিধান লঙ্ঘন অপরাধ বলিয়া গণ্য হইবে এবং উক্ত অপরাধের জন্য অনূর্ধ্ব ১ (এক) লাখ টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হইবে; বা উক্ত অর্থদণ্ড অনাদায়ের ক্ষেত্রে অনূর্ধ্ব ৩ (তিন) মাস কারাদণ্ডে দণ্ডিত হইবে।

কোনো সন্তানের স্ত্রী বা ক্ষেত্রমত, স্বামী কিংবা পুত্র-কন্যা বা অন্য কোনো নিকট আত্মীয় ব্যক্তি—

(ক) পিতামাতার বা দাদা-দাদির বা নানা-নানির ভরণপোষণ প্রদানে বাধা প্রদান করিলে বা (খ) পিতামাতার বা দাদা-দাদির বা নানা-নানির ভরণপোষণ প্রদানে অসহযোগিতা করিলে তিনি উক্তরূপ অপরাধ সংঘটনে সহায়তা করিয়াছে গণ্যে উপধারা (১)-এ উল্লিখিত দণ্ডে দণ্ডিত হইবে।

ধারা-৬ : অপরাধের আমলযোগ্যতা, জামিনযোগ্যতা ও আপসযোগ্যতা। এই আইনের অধীন অপরাধ আমলযোগ্য (Cognizable), জামিনযোগ্য (bailable) ও আপসযোগ্য (Compoundable) হইবে।

ধারা-৭ :  অপরাধ বিচারার্থ ও বিচার।

Code of Criminal Procedure, ১৮৯৮ (Act V of ১৮৯৮)-এ যাহা কিছুই থাকুক না কেন, এই আইনের অধীন সংঘটিত অপরাধ প্রথম শ্রেণির জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে বিচারযোগ্য হইবে।

কোনো আদালত এ আইনের অধীন সংঘটিত অপরাধ সংশ্লিষ্ট সন্তানের পিতা বা মাতার লিখিত অভিযোগ ব্যতীত আমলে গ্রহণ করিবে না।

ধারা-৮ : আপস-নিষ্পত্তি।

আদালত এই আইনের অধীন প্রাপ্ত অভিযোগ আপস-নিষ্পত্তির জন্য সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বা মেম্বার কিংবা ক্ষেত্রমত, সিটি করপোরেশন বা পৌরসভার মেয়র বা কাউন্সিলর, কিংবা অন্য যে কোনো উপযুক্ত ব্যক্তির নিকট প্রেরণ করিতে পারিবেন।

উপধারা (১)-এর অধীন কোনো অভিযোগ আপস-নিষ্পত্তির জন্য প্রেরিত হইলে, সংশ্লিষ্ট চেয়ারম্যান, মেয়র, মেম্বার বা কাউন্সিলর উভয়পক্ষকে শুনানির সুযোগ প্রদান করিয়া, উহা নিষ্পত্তি করিবে এবং এইরূপে নিষ্পত্তিকৃত অভিযোগ উপযুক্ত আদালত কর্তৃক নিষ্পত্তিকৃত বলিয়া গণ্য হইবে।

অবাক হলেও সত্য সরকার বিশ্ব নারী দিবস, বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, ধরিত্রী দিবস, বিশ্ব শ্রমিক দিবস, বিশ্ব রেডক্রস দিবস, বিশ্ব পরিবেশ দিবস, শিশুশ্রম প্রতিরোধ দিবস, মাদকবিরোধী দিবস, জনসংখ্যা দিবস, বিশ্ব মাতৃমুগ্ধ দিবস, নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস, বিশ্ব এইডস দিবস, বিশ্ব মানবাধিকার দিবসসহ জাতিসংঘ ঘোষিত অন্য দিবসগুলো যেভাবে যথাযোগ্য মর্যাদার সঙ্গে পালন করেন, সেক্ষেত্রে ১৫ জুন, বিশ্ব প্রবীণ নির্যাতন প্রতিরোধ সচেতনতা দিবস-২০১৭, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বা সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের কেউই পালন তো দূরের কথা স্মরণও করেননি। এ ব্যাপারটা প্রবীণদের প্রতি কিছুটা হলেও বেদনাদায়ক। আশা করব ভবিষ্যতে আমরা আরও সচেতন হব।

 

লেখক : সাবেক উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর