সোমবার, ৩ জুলাই, ২০১৭ ০০:০০ টা

চিকুনগুনিয়া

ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ

চিকুনগুনিয়া

সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে মূল্য সংযোজন কর (মূসক) ওরফে ভ্যাট নিয়ে যত আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে (যার আপাত পরিসমাপ্তি ঘটেছে বাজেট অধিবেশনের শেষ বাজেট ভাষণে) তাকে ছাপিয়ে সিরিজ জয়ের মতো মুখরোচক বিষয় হিসেবে উঠে এসেছে চিকুনগুনিয়া। আদি নিবাস আফ্রিকার দেশ তাঞ্জানিয়ায়। ১৯৫২ সালে এডিস মশার মাধ্যমে ধরাধামে তার আত্মপ্রকাশ। সেই থেকে বিগত পঁয়ষট্টি বছরের ব্রাজক জীবন, সাত সাগর তেরো নদী পার হয়ে বাংলাদেশে তশরিফ তার এ দেশের প্রাক-বাজেট আলোচনার মৌসুমে। আফ্রিকার অনেক কিছুই এখন এ দেশে স্বনামে-বেনামে বহাল তবিয়তে। কই, মাগুর, তেলাপিয়া, সাগরকলা, মসুর ডাল আরও কত কিছু। তাদের দাপটে দেশীয় প্রজাতিরা মান-সম্মান নিয়ে, শেষ মোগল সম্রাট শাহ আলমের মতো কোনো রকমে আছে। সর্বশেষ মেহমান চিকুনগুনিয়া তো আজ ঘরে ঘরে বেশ জানান দিচ্ছে তার সহিংস ও অপ্রীতিকর উপস্থিতির। দেশীয় কেন আন্তঃদেশীয় কোনো সুচিকিৎসা কিংবা প্রতিরোধ প্রতিষেধকের অবর্তমানে এটি এখন ঘরে ঘরে মূর্তিমান মহামারী আতঙ্ক। সব সময় সেন্ট্রালাইজড-রাজধানীতে যাত্রা তার শুরু (যেমন গত বছর ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লিতে দেখা গিয়েছিল প্রথম তাকে), গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে ছোট-বড় সবাইকে, জেন্ডার সেনসেটিভ—নারী-পুরুষ-নির্বিশেষে, অসাম্প্রদায়িক—দল, মত, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র ভেদে চিকুনগুনিয়া সবাইকে আক্রমণ করে চলেছে। ছাড় দেয়নি কেবিনেট মিনিস্টার ও তার পরিবারকেও। ঘরে ঘরে আজ তার সরব উপস্থিতি। মৃত্যুপটীয়সী ম্যালেরিয়ার মতো মশহুর ও মারাত্মক সে নয় এভাবে তাকে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হচ্ছে। সঙ্গোপনে এসআরও জারি করে বলা না হলেও তার গোত্রীয় ও ক্যাডারীয় আচরণ বড্ড তিক্ত, বেদনাদায়ক, দুর্বল সাধন ও বল ক্ষয়কারক। ম্যালেরিয়ার প্রতিষেধক ‘কুইনাইন’ আবিষ্কার হলে তা ব্যবহারের হিড়িক পড়ে যায় ভূ-ভারতে, এই বাংলায়ও। কুইনাইন খেলে ম্যালেরিয়া জ্বরের উপশম হতো বটে; তবে কুইনাইন ওষুধ হিসেবে অতিশয় তিক্ত। সহজে কেউ তা গলাধঃকরণ করতে চাইত না। সৈয়দ মুজতবা আলী সে সময় লিখেছিলেন, ‘কুইনাইন জ্বর সারাবে বটে কিন্তু কুইনাইন সারাবে কে’?

এডিসবাহী চিকুনগুনিয়া, জিকা ভাইরাস ও ডেঙ্গুর ফার্স্ব কাজিন এবং এনিফিলিসবাহী ম্যালেরিয়াদের নিকটাত্মীয়। চিকুনগুনিয়া কিছুটা আধুনিক, কেতাদুরস্ত এবং নব্য স্বৈরাচারী। প্রচণ্ড জ্বর এবং ১৫৪ ধারার মতো ব্যাখ্যাবিহীন ব্যথা সারা শরীরে। রক্তপ্রবাহে ট্রাফিক জ্যাম সৃষ্টির জন্য বিভিন্ন মোড়ে (গ্রন্থি) বিচিত্র বিদঘুটে জটলা পাকানো তার বিশেষ কর্মসূচি। এরপর আছে মেগা প্রকল্পের মতো দীর্ঘমেয়াদি বেশ কিছু ব্যয়বহুল উপসর্গ। অন্নপ্রাসনের অবর্তমানে জন্মিয়াও জন্মগ্রহণের অপেক্ষায় থাকা নতুন ভ্যাট আইনের মতো চিকুনগুনিয়া সবার মনে ভয় ঢুকাচ্ছে তার রেশ থাকবে অনেকদিন। কেউ কেউ তাকে বাংলায় ‘ল্যাংড়া জ্বর’ হিসেবে ভাবতে শুরু করেছে। আফ্রিকা, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ এবং এশিয়ার ১২৯ দেশ ঘুরে এসেছে চিকুনগুনিয়া অথচ এতদিনে এর একটা উপযুক্ত ব্যবস্থাপনার বা প্রতিষেধক আবিষ্কৃত হয়নি। ঢাকার পৌরপিতাদের বিবেচনায় ‘চিকুনগুনিয়া’ তাই তেমন পাত্তা পাচ্ছে না। সরকারের স্বাস্থ্য দফতর নিজেদের প্রচারসর্বস্ব কিছু বিবৃতি ও বিজ্ঞপ্তি দিয়ে ঘরে ফিরেছেন। খোদ চিকুনগুনিয়ার সঙ্গে সরকারের কোনো সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে কিনা জানার উপায় নেই। নগর পিতৃদেবদের প্রতি বিশেষ অনুকম্পা/সম্মান প্রদর্শন করছে কিনা কে জানে? রাজধানী ঢাকা এবং ঢাকা থেকে প্রচারসর্বস্ব উন্নয়নের মতো চিকুনগুনিয়া আজ অগ্রযাত্রায়। বাজেট বানিয়েরা কাজে মন দিতে পারছে না, সড়ক বিভাগের ছুটিবিহীন প্রকৌশলীরা কর্মতৎপরতা দেখাতে পারছেন না, অসময়ে অতিরিক্ত সালাম দিয়ে সালামি প্রত্যাশী প্রহরী পরিচারক সুযোগ পাচ্ছে না। সঞ্চয়পত্রের কী হবে এমন দুশ্চিন্তাগ্রস্ত অবসরপ্রাপ্ত আমলা, কামলা, মামলা ও চাঁদাবাজ নেতা, সিন্ডিকেট ব্যবসায়ী, ভ্যাট জমাদানে অনিচ্ছুক ব্যবসায়ী, গায়ক, নায়ক, সেলিব্রেটি সবারই অতিথি হচ্ছে চিকুনগুনিয়া। পেছনে ফেলে যাচ্ছে ধুক ধুক করা ব্যথা কাতর কর্মজীবী মানুষ। দিনে ও রাতে মশারি ব্যবহারের পরামর্শ দিয়ে স্বাস্থ্যসেবা অধিদফতরের বিজ্ঞাপনকে পানসে মনে হচ্ছে আক্রান্ত সবার। চিকুনগুনিয়ার একটা ‘মহত্গুণ’ একবার হলে দ্বিতীয়বার হয় না। কিন্তু বাঘে কিংবা কোনো কোনো সেবা সংস্থা একবার ছুলে যেমন হয়, যাকে একবার সে ছোঁয় তার স্পর্শের ছোঁয়ার রেশ নাকি থেকে যাবে মাসের পর মাস বছরের পর বছর। এক সময় চিকেনপক্স যেমন চিহ্ন রেখে যেত মুখমণ্ডলে। তবুও এডিস মশাবাহিত সংক্রামক রোগ চিকুনগুনিয়ার প্রতিরোধ-প্রতিষেধক গড়ে তোলা কি অসম্ভব? কেন নেওয়া হবে না বিশেষ প্রকৃতির এই মশককুলের বিরুদ্ধে, তাদের বংশবিস্তার ও অবাধ চলাচলের বিষয়ে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা? তাকে এভাবে যুগ যুগ ধরে চার্জশিট না দিয়ে বিচারাধীন অবস্থায় কেন রেখে দেওয়া হবে? সমাজ সংসারের সব চিকুনগুনিয়া ভুক্তভোগীরা যখন একজোট হয়ে মানববন্ধনে নামবে, যখন ব্যক্তি, পরিবার ও দেশের স্বাস্থ্য বাজেটের ওপর টান পড়বে, যখন মানব কর্মঘণ্টায় ঘাটতি হয়ে উৎপাদন ব্যাহত হবে, যখন সৃজনশীল মানুষ ব্যথায় কুঁকড়ে কষ্ট পেতে থাকবে তখন তো অনেক দেরি হয়ে যাবে। চিকুনগুনিয়া অতি ক্ষুদ্র এডিস মশাবাহিত হতে পারে কিন্তু মানবদেহে তার ক্ষতি সাধনের ক্ষমতা কিন্তু বেশ ব্যাপক। মানবসম্পদ উন্নয়নের ও ব্যবহারের পথে প্রচণ্ড প্রতিবন্ধকতা। পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে, আল্লাহ ক্ষুদ্র প্রাণী ‘মশা’র উপমা উদাহরণ দিতে কুণ্ঠাবোধ করেন না অর্থাৎ ক্ষুদ্র প্রাণী ‘মশা’র গুরুত্ব কম নয়। একটি ক্ষুদ্র মশা অতি ক্ষমতাধর নমরুদের নাসিকায় প্রবেশ করে যে সিভিল ক্যু দ্যোতা ঘটিয়েছিল তা তো প্রাচীন ইতিহাসের পাতাতেই আছে। ম্যালেরিয়া, জিকা, ডেঙ্গু এসব রোগের জীবাণু বহনকারী মশাকে নিয়ে পিএইচডি হতে পারে। নোবেল পুরস্কার পাওয়ার সম্ভাবনাও সামান্য নয়। তাই মশক সম্প্রদায়ের বিশেষ ক্যাডার সদস্য, চিকুনগুনিয়ার উৎপাদক ও প্ররোচক সেই সনাতন সক্ষম এডিস মশকদের অবিলম্বে ১৫৪ ধারায় আনতে আর বিলম্ব নয়। মশারি, মলম, স্প্রে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আঁতাতে না গিয়ে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ট পাওয়ার আশায় উন্মুখ একটি অর্থনীতির অশনি সংকেত যথা—উপলব্ধির আওতায় আসুক।

লেখক : সরকারের সাবেক সচিব ও এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর