’৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাস। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রথম তিনি কলকাতায় এলেন। এক দিন আগেই ইন্দিরা গান্ধী কলকাতায় পৌঁছে যান দমদম বিমানবন্দরে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বাগত জানাতে। বিমানবন্দরে বঙ্গবন্ধুকে স্বাগত জানানোর পর প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী প্রথমে সদ্য নিযুক্ত মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায় (বাবু) এবং পরে পাশে দাঁড়ানো বিরোধী দলের নেতা জ্যোতি বসুর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার পর বঙ্গবন্ধু একটু রসিকতার ছলে বললেন, ‘সেকি জ্যোতি বাবু, ১৯৫৪ সালে যখন পূর্ব পাকিস্তানের জুনিয়র মন্ত্রী হিসেবে কলকাতায় এসে বিধানসভা ভবনে বিধান চন্দ্র রায়ের সঙ্গে দেখা করেছিলাম, বিধান বাবু বলেছিলেন, আপনারা বিরোধী দলের ঘরে গিয়ে বিরোধী দলনেতা জ্যোতি বসুর সঙ্গে দেখা করুন। আপনার ঘরে গিয়ে দেখা করেছিলাম, মনে আছে? এখনো সেই বিরোধী দলের নেতা?’ জ্যোতি বাবু একটু গম্ভীর হয়ে বললেন, ওই মামু ভোটে রিগিং করে ‘তাই আমাদের একটু অসুবিধে হচ্ছে। তবে বেশি দিন হবে না।’ হ্যাঁ, বেশি দিন হয়নি। তার পাঁচ বছরের মাথায় যে নির্বাচন হলো ’৭৭ সালে, সেই নির্বাচনে বামপন্থিরা বিপুল ভোটে জয়ী হলেন এবং জ্যোতি বাবু হলেন মুখ্যমন্ত্রী। পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক মহল মনে করে, বঙ্গবন্ধুর সেই খোঁচাতেই সেদিন জ্যোতিবাবু আরও রেগে গিয়েছিলেন।
ঢাকার নারায়ণগঞ্জের ওপারে বারদি গ্রামে তার জন্ম। গ্রামের লোকেরা ডাক্তার নিশিকান্ত বসুর এই ছেলেকে ‘ঘনা’ বলেই ডাকতেন। বিলেতে ব্যারিস্টারি পাস করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাহাজে দেশে ফিরে আসেন জ্যোতিবাবু। সেই থেকে তিনি টানা ৫১ বছর ধরে রাজনীতি করে বাম রাজনীতিকে শক্তিশালী করে তুলেছিলেন। এ কথা এখন তার শত্রুরাও স্বীকার করছে। জ্যোতিবাবুর অনুপস্থিতি এখন হাড়ে হাড়ে বাম নেতারা টের পাচ্ছেন। জ্যোতি বসু বিভিন্ন সময় যেসব উক্তি করেছেন, তা এখন অক্ষরে অক্ষরে ফলে যাচ্ছে। যেমন তিনি বলেছিলেন (১) কংগ্রেস দল আমাদের স্বাভাবিক বন্ধু। কংগ্রেসের বিরোধিতা আমরা করব, কিন্তু দেশের স্বার্থে ওদের হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করব। শারীরিক কারণে ২৪ বছর মুখ্যমন্ত্রিত্বের পর পদত্যাগ করলেও সিপিআই (এম) নেতারা কোনো সংকটে পড়লেই তার কাছে ছুটে যেতেন। (২) ২০০৮ সালে ইউপিএ সরকারের ওপর থেকে সিপিএমের সাবেক সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ কারাত সমর্থন তুলে নেওয়ার প্রস্তাব নিয়ে জ্যোতিবাবুর কাছে গেলে তিনি তাকে বলেছিলেন— দেখ, তোমাদের যদি অসামরিক পরমাণু চুক্তি নিয়ে আপত্তি থাকে, তাহলে তোমরা সংসদের বাইরে ও ভিতরে আন্দোলন কর, দরকার হলে বন্ধ ডাক। কিন্তু সমর্থন প্রত্যাহার করলে বামপন্থা বলে ভারতে আর কিছু থাকবে না। চরম দক্ষিণপন্থিরা ক্ষমতা দখল করবে। সেদিন জ্যোতিবাবুর এই উপদেশ প্রকাশ কারাত মেনে নেননি। ফলটা কী দাঁড়াল? বামপন্থিরা এখন অবলুপ্তির পথে। তার আরেকটি মন্তব্য ছিল, ১৯৯৬ সালে কংগ্রেস তাকে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল। জ্যোতিবাবু রাজিও হয়েছিলেন। কিন্তু সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে ভোটাভুটিতে জ্যোতিবাবু হেরে যান। হারের মূলে ছিলেন প্রকাশ কারাতপন্থি পশ্চিমবঙ্গের ৮ জন বাঙালি। জ্যোতিবাবু সেদিন বলেছিলেন— এটা একটা হিমালয়ান ব্লান্ডার। তার পরের উক্তি ছিল মমতার হাত ধরে বিজেপিকে এই রাজ্যে আনা এক ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি সৃষ্টি করবে। তিনি ছিলেন দূরদ্রষ্টা। তার সব কথাই অক্ষরে অক্ষরে মিলে গেছে। মমতা শুধু বিজেপিকে নিয়েই আসেনি, বিজেপির মন্ত্রিসভায় যোগও দিয়েছিলেন।
জ্যোতিবাবু কীভাবে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে শ্রদ্ধা করতেন, তার একটা উদাহরণ দিচ্ছি। যেদিন প্রধানমন্ত্রী নরসিমা রাওয়ের অর্থমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং বাজার অর্থনীতির প্রস্তাব পেশ করেন। সেদিন জ্যোতিবাবু বলেছিলেন, আগে ব্যাপারটা বুঝি, তারপরে বলব। অথচ তার দল বলেছিল, মনমোহন সিং ভারতকে আমেরিকার হাতে বিক্রি করে দিয়েছেন। দেড় বছরের মাথায় জ্যোতিবাবু যখন মনমোহনের অর্থনীতি পশ্চিমবঙ্গে চালু করলেন, তখন তার বক্তব্য ছিল— আমি ফেডারেল রিপাবলিক অব বেঙ্গলের প্রাইম মিনিস্টার নই। আমি একটা অঙ্গরাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। দেশ এবং রাজ্যের জন্য আমাকে দিল্লির সিদ্ধান্ত মানতেই হবে। মেনেও ছিলেন। আর মমতা একদিকে প্রকাশ্যে বিজেপিকে গালমন্দ করছেন, আবার দিল্লিতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, লালকৃষ্ণ আদভানিদের সঙ্গে গোপন বৈঠক করে আসছেন।
আর মানুষ দেখছে, জ্যোতিবাবুর ভবিষ্যদ্বাণী এক এক করে মিলে যাচ্ছে। অন্য বাম দলগুলোতেও বর্ষীয়ান নেতারা হয় প্রয়াত হয়েছেন বা রাজনীতি থেকে অবসর নিয়েছেন। সিপিএমেও বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের মতো নেতাও প্রায় অবসর নিয়েছেন। নতুন প্রজন্মের নেতাদের তুলে আনার চেষ্টাও এই বামপন্থি দলগুলো সেভাবে করেনি।
ফলে নেতার অভাব, উপযুক্ত অভিভাবকের অভাবে পশ্চিমবঙ্গের বামপন্থি দলগুলো এখন ভুগছে। এদিকে সিপিএমের সাবেক সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ কারাত বছরে দুবার করে সস্ত্রীক আমেরিকা যান। তিনি কেন বারবার আমেরিকা যান, তা নিয়েও পশ্চিমবঙ্গের কমিউনিস্ট নেতাদের মনে প্রশ্ন রয়েছে। সব মিলিয়ে জ্যোতি বসুর জন্মদিনের ঠিক আগেই আবারও একবার প্রশ্ন উঠেছে বামপন্থিদের ভবিষ্যৎ নিয়ে। ধুতি-পাঞ্জাবি পরা আপাদমস্তক এই ভদ্রলোকের অভাব পদে পদে বুঝতে পারছেন এ রাজ্যের কমিউনিস্টরা।
লেখক : ভারতীয় প্রবীণ সাংবাদিক।