বৃহস্পতিবার, ১৩ জুলাই, ২০১৭ ০০:০০ টা
পাঠক কলাম

বিপদের নাম বজ্র্রপাত

আবদুল বাকী চৌধুরী

বিপদের নাম বজ্র্রপাত

বাংলাদেশে বজ্রপাতে প্রতি বছর শত শত লোক মারা যাচ্ছে। ইদানীং এই মৃত্যুর হার বেড়ে চলেছে। বিষয়টি সবাইকে ভাবিয়ে তুলেছে।  কেউ কেউ বলছেন,  এর জন্য দায়ী উষ্ণতা বৃদ্ধিসহ গ্রিন হাউস গ্যাস। আবার কোনো কোনো সুধীজন বলছেন মোবাইল টাওয়ারের কারণে এই নেতিবাচক ঘটনা অধিক ঘটছে। সত্যি কথা বলতে কী এ দুটোই দায়ী। উল্লেখ্য, আগে মে-জুন মাসে কালবৈশাখীর মৌসুমে কেবল বজ্রপাত পরিলক্ষিত হতো। কিন্তু এখন কালবৈশাখী ছাড়াই কোনো বড় ধরনের ঝড় বৃষ্টি এবং সামান্য ঝড়ো বাতাসের সঙ্গেই ঘটছে ঘন ঘন বজ্রপাতের ঘটনা। আর এর ফলশ্রুতিতে মারা যাচ্ছে অগণিত মানুষ। এই লাগাতার বজ্রপাতের জন্য কালো মেঘকে প্রায় বিশেষজ্ঞরা দায়ী করে থাকেন। অবশ্য কালো মেঘ সৃষ্টির ক্ষেত্রে বাতাসে অতিরিক্ত নাইট্রোজেন ও সালফার গোত্রের গ্যাস প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ক্রিয়া-প্রক্রিয়া করে থাকে। মূলত ঝড়ো বাতাসের প্রভাবে দ্রুতগতি সংবলিত কালো মেঘের মধ্যে ঘর্ষণ এবং একই সঙ্গে সংঘর্ষের ফলে সৃষ্টি হওয়া ইলেকট্রনের প্রবাহে বজ্রপাতের সূচনা হয়। সাধারণত সাদা মেঘের  উপাদানের অধিকাংশ জলীয়বাষ্প বা পানির কণায় ভরপুর থাকে বিধায় এ ধরনের মেঘে ঘর্ষণের বা সংঘর্ষের ফলে তেমন ইলেকট্রন সৃষ্টি হওয়ার অবকাশ নেই। অথচ কালো মেঘে নাইট্রোজেন ও সালফার গোত্রের গ্যাসের পরিমাণ অধিক থাকায় এবং একই সঙ্গে দ্রুত গতির কারণে এসব যৌগিক গ্যাসের মধ্যে সংঘর্ষে প্রচুর পরিমাণ ইলেকট্রনের প্রবাহ সৃষ্টি হয়। আর সেই সময়ে একঝাঁক ইলেকট্রন বাতাসের জলীয়বাষ্পের মাধ্যমে ভূমিতে চলে আসে, যাকে আমরা বজ্রপাত বলে থাকি। সাধারণত তিনভাবে বজ্রপাত হয়ে থাকে। প্রথমত, একই মেঘের মধ্যে সৃষ্টি হয় এবং মেঘের মধ্যে শেষ হয়ে যায়। দ্বিতীয়ত, দুটি ভিন্নধর্মী মেঘের মধ্যে ঘর্ষণজনিত কারণে সৃষ্টি হয় এবং উক্ত স্থানে এর কার্যকারিতা রহিত হয়ে যায়। শেষতক, যে বজ্রপাতটি প্রাথমিকভাবে মেঘে উৎপন্ন হয়ে পৃথিবীর উপরিভাগে চলে এসে জনপদে আঘাত হানে, আমরা সেটিকেই বজ্রপাত বলে বুঝে থাকি। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য, ‘এটি প্রাকৃতিক ঘটনা হলেও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে বজ্রপাতের পরিমাণ অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে। এক্ষেত্রে কার্বন, নাইট্রোজেন ও সালফার গ্যাসের পরিমাণ আনুপাতিক হারে যত বাড়বে বজ্রপাতের পরিমাণও তত বৃদ্ধি পেতে থাকবে। তা ছাড়া ভূমিতে বজ্রপাত ঘটার পেছনে যত্রতত্র অপরিকল্পিত মোবাইল নেটওয়ার্কের টাওয়ারও কম দায়ী নয়?’ কেননা উচ্চতার কারণে মোবাইল টাওয়ারগুলো বজ্রপাতের প্রথম শিকার হওয়ার কথা। কিন্তু উন্নত আর্থ-কানেকশন এবং বজ্রপাতের বিদ্যুতের প্রবাহকে অন্যদিকে সরিয়ে দেওয়ার প্রযুক্তি এসব টাওয়ারে রয়েছে। একই সঙ্গে এসব টাওয়ার অত্যধিক ইলেকট্রো-ম্যাগনেটিক ফিল্ড সৃষ্টি করায় বজ্রপাতে সৃষ্ট ইলেকট্রনও ওই টাওয়ারগুলোর দিকে স্বাভাবিকভাবে আকৃষ্ট হয়। কিন্তু টাওয়ারগুলোতে উচ্চ প্রযুক্তির কারণে বজ্রপাতের বিদ্যুৎ কিছুটা ভূ-সংযোগের মাধ্যমে কমিয়ে ফেলে অবশিষ্ট সব বিদ্যুৎ অন্যদিকে সরিয়ে দেয় এবং ফলশ্রুতিতে টাওয়ারের আশপাশে বজ্রপাতজনিত বিপর্যয় অধিক ঘটে থাকে। এদিকে একেকটি বজ্রপাতের প্রাক্কালে প্রায় ৬০০ মেগা ভোল্ট বিদ্যুৎ প্রবাহিত হয়। আর ১ মেগা ভোল্ট সমান ১০ লাখ ভোল্ট, এই হিসাবে একেকটি বজ্রপাতের সময় প্রায় ৬০ কোটি ভোল্ট বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয়। তাহলে বুঝুন, বজ্রপাতের সময় কত বিদ্যুৎ বিদ্যমান থাকে। এদিকে আকাশে যে মেঘ সৃষ্টি হয়, তার ২৫ থেকে ৭৫ হাজার ফুটের মধ্যে বজ্রপাতের ঘটনা আনুপাতিক হারে অধিক ঘটে। এ এলাকায় তড়িৎ প্রবাহের আওতায় খাড়াভাবে যে বজ্রপাতের সৃষ্টি হয়, তার তাপমাত্রা ৩০ হাজার থেকে ৫০ হাজার ডিগ্রি ফারেনহাইট এবং বজ্রপাতের গতিও প্রতি সেকেন্ডে ৬০ হাজার মিটার বেগে নিচে বা এদিক-সেদিক ছুটে চলে যায়। তা ছাড়া তীব্র তাপসহ বজ্রপাত মানুষের দেহের ওপর পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই মৃত্যু হওয়া স্বাভাবিক। কেননা একজন মানুষের মৃত্যুর জন্য মাত্র ১১০ ভোল্টই যথেষ্ট। বজ্রবিদ্যুতের বৈশিষ্ট্য হলো উঁচু স্থানে আঘাত হানে। তাই খোলামেলা জায়গা ও নদীতে অবস্থিত নৌকায় বাজ পড়ার আশঙ্কা থাকে। এদিকে একটি কুসংস্কার আছে, বজ্রপাতে মৃত ব্যক্তির দেহে নাকি দামি পাথর থাকে। তাই বোধ হয় এই লাশ চুরি হওয়ার ভয় থাকে। যা হোক, প্রতি বছর বাংলাদেশে শত শত মানুষ মৃত্যুর কবলে পড়ছে এই বজ্রপাতের কারণে। গত বছর মারা গেছে দুই শতাধিক। আর এদের অধিকাংশেরই বসবাস গ্রাম এলাকায়। বেশির ভাগ পেশায় কৃষক। বিষয়টি নিয়ে উদগ্রীব হয়ে পড়ছে সরকার এবং বজ্রপাতকে দুর্যোগ হিসেবে গণ্য করছে। শুধু তাই নয়, বজ্রপাতে নিহত ও আহতের জন্য ক্ষতিপূরণ বাবদ যথাক্রমে ২৫ হাজার এবং ১৫ হাজার টাকা দেওয়ার ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছে সরকার। ইতিমধ্যে বজ্রপাতে মৃত্যুঘটিত সংখ্যা কমানোর লক্ষ্যে দশ লাখ তালগাছ লাগানোর কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়েছে।

সাধারণত আকাশের চার মাইল সীমার মধ্যে কালো মেঘসহ বিভিন্ন ধরনের মেঘের সৃষ্টি হয় এবং এ সীমার উপরে পানি ও বাতাস থাকলেও তা ঠাণ্ডা এবং হালকা অবস্থায় থাকে। আর সৃষ্ট কালো অথবা ঘন কালো মেঘ থেকে বেশি বজ্রপাতের ঘটনা ঘটে। মজার ব্যাপার হলো বিকালের দিকেই এ ধরনের মেঘ বেশি সৃষ্টি হতে দেখা যায়। সাধারণত বিকাল ছাড়া অন্য সময়ে সংঘটিত মেঘে বজ্র আওয়াজ থাকলেও বজ্রপাতের ঘটনা কম হয়ে থাকে। এদিকে রাতের বেলায় সূর্যতাপ না থাকায় এবং ঠাণ্ডা আবহাওয়ার কারণে বজ্রপাতের  ঘটনা খুব কম হয়ে থাকে।

ই-মেইল: [email protected]

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর