সোমবার, ২৪ জুলাই, ২০১৭ ০০:০০ টা

গুডবাই প্রণব মুখার্জি

সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত

গুডবাই প্রণব মুখার্জি

আগামীকাল ২৫ জুলাই শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়, বাংলাদেশ এবং গোটা বিশ্বে বসবাসকারী বাঙালিদের কাছে একটি বেদনার দিন হিসেবে দেখা দিতে চলেছে। ঠিক পাঁচ বছর আগে এই জুলাই মাসের ২৫ তারিখে বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র ভারতের রাষ্ট্রপতি হিসেবে তিনি দায়িত্বভার নিয়েছিলেন। প্রণব মুখার্জি এই দায়িত্ব নেওয়ায় গোটা বিশ্বের বাঙালি সেদিন গর্বিত হয়েছিল। ‘বাঙালি গর্বিত’ বলে স্লোগানও দিয়েছিলেন তারা। কিন্তু আমাদের যতদূর মনে আছে, সেদিন প্রণব বাবুর মনোনয়ন ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে কংগ্রেস দল থেকে বামপন্থিসহ সব বিরোধী দল তার প্রার্থী পদকে সমর্থন করেছিল। কিন্তু মমতা ব্যানার্জির দল সেদিন দিল্লির রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ প্রদর্শন পর্যন্ত করেছিল।

এসব তো ইতিহাস। পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার কীর্মাহার গ্রামে তার জন্ম। তার পিতা ছিলেন ১৬ আনা কংগ্রেসি এবং তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গ বিধান পরিষদের সদস্য কামদাকিঙ্কর মুখোপাধ্যায়। প্রণব বাবুর প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে হাতেখড়ি ১৯৬৭ সালে কংগ্রেস ভেঙে বাংলা কংগ্রেস গঠিত হওয়ার সময়। তিনি ওই দলের সচিব ছিলেন। তারপর তিনি আর থেমে থাকেননি। ১৯৬৯ সালে যুক্তফ্রন্টের শরিক বাংলা কংগ্রেস থেকেই তিনি প্রথম রাজ্যসভায় যান। সেই দলের প্রধান অজয় মুখোপাধ্যায় ছিলেন যুক্তফ্রন্টের মুখ্যমন্ত্রী। ইতিহাস ও আইনের ছাত্র রাজনীতিতে আসার আগে একাধিক কলেজে অধ্যাপনা করেছেন। ১৯৭০ সালের লোকসভা নির্বাচনের পর ইন্দিরা গান্ধী যখন বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ফিরে এলেন, তার এক বছরের মধ্যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়। অজয় বাবু তখন বামপন্থিদের ছেড়ে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট সরকার গঠন করেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের জন্য যে সর্বদলীয় কমিটি করা হয়েছিল, প্রণব বাবু সেখানে বাংলা কংগ্রেসের প্রতিনিধিত্ব করতেন। ১৯৭২ সালের শেষ দিকে রাজ্যসভায় প্রণব বাবুর একটা বক্তৃতা শুনে ইন্দিরা গান্ধী এতই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে, তাকে ডেকে অসামরিক সরবরাহ দফতরের উপমন্ত্রী করেছিলেন। প্রণব বাবু নিজের ভাষায় তিনি যেদিন তার মন্ত্রণালয়ে যান, তখন দক্ষিণ ভারতের একজন অফিসার সচিব ছিলেন। তিনি মন্ত্রীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে এসে উভয় উভয়ের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকেন। ওই সচিব মন্ত্রীকে প্রশ্ন করেন, আপনি কী বীরভূম জেলা থেকে এসেছেন? প্রণব বাবু তাকে বলেন, আপনি কী করে জানলেন?

স্যার আপনি ম্যাট্রিক পরীক্ষায় জেলায় প্রথম হয়েছিলেন। আর আমি আপনাকে পুরস্কার তুলে দিয়েছিলাম। প্রণব বাবু বলেছেন, যতদিন আমি ওই মন্ত্রণালয়ে ছিলাম আমার কাজ বুঝতে এবং করতে কোনো অসুবিধে হয়নি। ওই সচিব আমাকে সব রকম সাহায্য করেছেন। প্রণব বাবুর দক্ষতা দেখে ইন্দিরা গান্ধী এতই মুগ্ধ হন যে, জরুরি অবস্থার সময় ভারত সরকারের অর্থ দফতর ভেঙে প্রণব বাবুকে রাজস্ব দফতরের রাষ্ট্রমন্ত্রী করে দেন। জরুরি অবস্থার সময় প্রণব বাবু ইন্দিরা গান্ধী ও তার পুত্র সঞ্চয় গান্ধীর ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন। সেই সময় কেন্দ্রে আর একজন বাঙালি দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় (বরিশালের) রাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন। দেবীবাবু এবং সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় মিলে প্রণব বাবুর বিরুদ্ধে নানা ষড়যন্ত্র করতে থাকেন। এ খবর দিল্লির রাজনৈতিক মহলে চাউর হয়ে গিয়েছিল। প্রণব বাবু যে মন্ত্রণালয়ে গিয়েছেন সেখানেই দক্ষতার সঙ্গে কাজ করে সবারই নজরে পড়েছেন। ’৭৮ সালে কংগ্রেস যখন ভেঙে যায়, তখন ইন্দিরা গান্ধী পশ্চিমবঙ্গ থেকে দুজনকে বেছে নেন। এরা হলেন প্রণব মুখার্জি এবং মালদহের বরকত গনিমান চৌধুরী। প্রণব বাবুকে করা হয় কংগ্রেসের নীতিনির্ধারক ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য, আর বরকতকে করা হয় প্রদেশ কংগ্রেসের সভাপতি এবং ওয়ার্কিং কমিটির আমন্ত্রিত সদস্য। জরুরি অবস্থার পর ১৯৮০ সালে প্রণব বাবু বীরভূম থেকে ভোটে দাঁড়িয়ে হেরে যান। মালদহ থেকে নির্বাচিত হন গনিখান চৌধুরী। দুজনের মধ্যে সমতা রাখার জন্য বরকতকে মন্ত্রী করা হয়। একই সঙ্গে প্রণব বাবুকেও মন্ত্রী করা হয়। এর কয়েক মাস পর তাকে গুজরাট থেকে রাজ্যসভার সদস্য করে আনা হয়।

ইন্দিরা গান্ধীর দুর্দিনে কংগ্রেসের সর্বভারতীয় বাঘা বাঘা নেতারা তাকে ছেড়ে চলে যান। তাদের মধ্যে এই দুই বাঙালিই ইন্দিরার সঙ্গে শেষ পর্যন্ত ছিলেন। কিন্তু ’৮০ সালে ইন্দিরা গান্ধী যে নতুন মন্ত্রিসভা গঠন করেছিলেন, সেই মন্ত্রিসভার কার্যত প্রণব বাবুই ছিল দুই নম্বর। অনেক সময় প্রণব মুখার্জির সুপারিশই মেনে নিতেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি প্রধানমন্ত্রী এবং রেলমন্ত্রীর পদ পাননি। এ ছাড়া প্রায় সব বড় দফতরই তিনি সামলেছেন। কখনো অর্থ, কখনো প্রতিরক্ষা, কখনো ইস্পাত, কখনো বিদেশ বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেছেন। বিরোধী দলের নেতারাও তাকে সম্মান করতেন এবং তার দক্ষতা নিয়ে কখনো কোনো প্রশ্ন তোলেননি।

কিন্তু বিরোধ দেখা দিল ইন্দিরা গান্ধীর মৃত্যুর পর। ইন্দিরাপুত্র রাজীব গান্ধী প্রণব মুখার্জি এবং বরকত গনি খান চৌধুরী এই দুই বঙ্গসন্তানকেই মন্ত্রিসভা থেকে বের করে দেন। কিছুদিন পরে বরকতকে মন্ত্রিসভায় ফিরিয়ে আনলেও প্রণব মুখার্জিকে তিনি দল থেকেই বহিষ্কার করেন। পশ্চিমবঙ্গের কংগ্রেসের কিছু নেতার ষড়যন্ত্রও এই ঘটনাক্রমের পেছনে কাজ করেছে। অপমানিত প্রণব বাবু পশ্চিমবঙ্গে একটি নতুন দল গঠন করেন রাষ্ট্রীয় কংগ্রেস নামে। কিন্তু বিধানসভা নির্বাচনে তার দল সব আসনে প্রার্থী দিলেও  একটিতেও জেতেনি তার প্রার্থীরা। কয়েকজনের জামানত জব্দ হয়। ১৯৮৯ সালের নির্বাচনের আগে রাজীব গান্ধী তার ভুল বুঝতে পেরে প্রণব বাবুকে আবার দলে ফিরিয়ে আনেন। যথাযোগ্য মর্যাদায় তাকে ওয়ার্কিং কমিটির সদস্যও করেন।

প্রায় চার দশক ভারতের উপমন্ত্রী থেকে শুরু করে পূর্ণমন্ত্রী থাকার সময় সংসদের কোনো কক্ষেই কোনো অভিযোগ ওঠেনি। তার প্রখর বাগ্মিতা এবং আইনের জ্ঞান দেখে তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষও তার প্রশংসা করতেন। ইন্দিরা গান্ধীকে একবার প্রশ্ন করেছিলাম, পশ্চিমবঙ্গের এই দুই মন্ত্রীকে আপনি কীভাবে দেখেন। ইন্দিরা গান্ধী আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললেন, তোমার কী দরকার? তারপর হেসে বললেন, বরকত কাজ-পাগল। ওকে কোনো কাজ ১০০ দিনে করতে বললে তা ৭০ দিনে শেষ করে আমাকে দিয়ে উদ্বোধন করাত। প্রণব শুধু দক্ষই নয়, দেশ, মন্ত্রিসভা, কংগ্রেসের স্বার্থে কোথাও প্রশ্ন করা হলে, প্রণব বাবু ঠিক সেটিকে এড়িয়ে যেতে পারতেন। বলেছিলাম, আপনার উত্তরটা বুঝতে পারলাম না। ইন্দিরা বলেছিলেন, যা উত্তর দিয়েছি, তাই।

বাংলাদেশের রাষ্ট্রনায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সঙ্গে প্রণব মুখোপাধ্যায়ের ব্যক্তিগত পরিচয় ছিল না। কিন্তু ’৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যার দিন কাকভোরে ইন্দিরা গান্ধী তাকে ডেকে নিয়ে গিয়ে বলেন, তুমি তো শুনেছ বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হয়েছেন। ওর মেয়েরা এখন জার্মানিতে আছে। আমি রাষ্ট্রদূতকে ডেকে বলে দিয়েছি। তুমি বিমান বাহিনীর বিশেষ প্লেন নিয়ে গিয়ে ওদের নিয়ে এসো। যে ৬-৭ বছর শেখ হাসিনা দিল্লির পান্ডারা রোডে ছিলেন, ইন্দিরা গান্ধীর নির্দেশে প্রণব মুখার্জি হয়ে ওঠেন তাদের অভিভাবক। তাদের দেখভাল করা থেকে তাদের ছেলেমেয়েদের স্কুলে ভর্তি করা সবই দেখতেন প্রণব বাবু। বাংলাদেশের শিল্পপতি থেকে সাংবাদিক, গায়ক থেকে রাজনীতিবিদ, এমন কাউকে পাওয়া যাবে না, যারা দিল্লিতে এসে প্রণব বাবুর সঙ্গে দেখা না করে ফিরে গেছেন। তাদের অনেকের মুখেই শুনেছি তার আতিথেয়তার কথা। তিনি দরাজহস্তে বিরোধী পার্টিগুলোকেও সব রকম সাহায্য করতেন। তার অসাধারণ মেধা এবং পাণ্ডিত্য ছিল চোখে পড়ার মতো। তিনি দুবার ভারতের অর্থমন্ত্রী হয়েছিলেন।

প্রণব বাবু সম্পর্কে লিখতে গেলে একটা গোটা মহাভারত হয়ে যায়। ১৩০ বছরের কংগ্রেস দলের ইতিহাস বইটিও তিনিই লিখেছেন, যা একেবারে নিখুঁত, নির্ভুল এবং তথ্যভিত্তিক। একবার তাকে প্রশ্ন করেছিলাম। আপনি কংগ্রেস সভাপতি বা প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন। স্মিত হেসে তিনি বলেছিলেন, আমি জানি না, তাই এই দুটি পদে হয়তো যেতেও পারব না। কিন্তু তিনি ভারতের রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন। রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন প্রথম দুই বছর ইউপিএ সরকার এবং তিন বছর মোদি সরকারের সঙ্গে তার কোনো রকম গোলমাল হয়নি। ৩০ জুন মধ্যরাতে প্রণব বাবুকে পাশে বসিয়ে মোদি যখন জিএসটির কৃতিত্ব দাবি করছিলেন, তখন প্রণব বাবু একটু খোঁচা দিয়ে যান। ১০ মিনিটের বক্তৃতায় তিনি বলেন, জিএসটি নিয়ে আমি একাধিকবার গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কাছে গিয়েছিলাম। কিন্তু সে সময় তিনি জিএসটির বিরোধিতা করেছিলেন। আজ জিএসটি চালু করাতে আমি অভিনন্দন জানাচ্ছি। তবে এ ব্যাপারে আমার কিছু বক্তব্য ছিল, কিন্তু এই অনুষ্ঠানে তা বলব না।

সেদিনই সকালে খবরের কাগজ মুদ্রণের ২০০ বছর পূর্তি উপলক্ষে কলকাতার এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছিলেন, গণতন্ত্রে সংবাদপত্রের ওপর কিছু চাপিয়ে দেওয়া উচিত নয়। সংবাদপত্রের সমালোচনা করার অধিকার আছে। কিন্তু বিজ্ঞাপন বন্ধ করে তাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করা যায় না। তাতে গণতন্ত্র সফল হয় না। বরং গণতন্ত্রের বিপদ ডেকে আনে। অনুষ্ঠান শেষে বেরিয়ে আসছি, একজন নিরাপত্তারক্ষী এসে বললেন, চলুন আপনাকে রাষ্ট্রপতি ডাকছেন। আমাকে বললেন, কী ব্যাপার আপনার তো দেখাই নেই। আমি বললাম রাষ্ট্রপতি ভবনে যেতে আমার ভয় করে। আমি উল্টো প্রশ্ন করলাম, আপনি কি কলকাতায় আসবেন? প্রণব বাবু বললেন, মাঝে মাঝেই আসব। এসে পুরনো আড্ডাটা আবার শুরু করতে হবে।

এরপরে রাষ্ট্রপতি পদে আবার কবে একজন বাঙালি আসবেন তা সময়ই বলতে পারবে। তেমনই প্রণব বাবু কি এবার অবসর জীবনযাপন করবেন। নাকি রাজনীতিতেই সক্রিয় থাকবেন, তা জানার জন্যও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। তবে ১০০ শতাংশ খাঁটি এই বাঙালি ভদ্রলোককে সর্বভারতীয় রাজনীতি মিস করবে তা বলাই বাহুল্য।

লেখক : ভারতীয় প্রবীণ সাংবাদিক।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর