সোমবার, ২৪ জুলাই, ২০১৭ ০০:০০ টা

সংসদ ও বিচার বিভাগ

মীর মোহাম্মদ নাছির উদ্দিন

সংসদ ও বিচার বিভাগ

স্বাধীনতার ৪৬ বছরে সংবিধানে ১৬টি সংশোধনী আনা হয় তন্মধ্যে দ্বিতীয় ও চতুর্থ সংশোধনীর মধ্য দিয়ে ধাপে ধাপে স্বাধীনতার মূলমন্ত্র গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে সংকুচিত করতে করতে শেষ পর্যন্ত ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মধ্য দিয়ে একদলীয় শাসনব্যবস্থা কায়েম করা হয়। এই সংশোধনীগুলো আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালীন আনা হয়।  উল্লেখ্য, ২৮ নভেম্বর ১৯৭৪ সালের সংবিধানের তৃতীয় সংশোধনীর মধ্য দিয়ে ভারত বাংলাদেশ সীমান্ত চুক্তি কার্যকর করতে গিয়ে বাংলাদেশের মানচিত্র পর্যন্ত Truncate করা হয়, আবার আওয়ামী লীগ ৩০ জুন ২০১১ সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান সংবিধান থেকে বিলুপ্ত করে এবং একই দলের উদ্যোগে ২২ সেপ্টেম্বর, ২০১৪ তারিখে ১৬তম সংশোধনীর মাধ্যমে বিচারপতিদের অপসারণ ক্ষমতা সংসদের কাছে নিয়ে যায়, অন্যদিকে আওয়ামী লীগ শাসনামলে চতুর্থ সংশোধনীর মধ্য দিয়ে বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতেই নিয়ে গিয়েছিল। জিয়াউর রহমান পঞ্চম সংশোধনীর মধ্য দিয়ে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিশ্চিত করেন এবং নিজের হাতে বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা কুক্ষিগত করে না রেখে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল করে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা ওই কাউন্সিলের হাতেই ন্যস্ত করেন। ওই যুগান্তকারী সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের ভিত শক্তিশালী করেন। সর্বোচ্চ আদালত যখন সংবিধানের অষ্টম সংশোধনী এবং ১৩তম সংশোধনী বাতিল করল তখন আওয়ামী লীগ নীরবে এই রায়গুলো মেনে নিয়েছে, কোনো টুঁ-শব্দটি করেনি, অন্যদিকে দেশের সর্বোচ্চ আদালত অ্যাপিলেট ডিভিশনের সাত মহামান্য বিচারক সর্বসম্মত হয়ে এক ঐতিহাসিক রায়ের মাধ্যমে ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৪ সালে সংবিধানে আনীত ১৬তম সংশোধনী বাতিল করার পর সংসদে সংসদ সদস্যদের তুলকালাম কাণ্ড এবং বিবেক বিবর্জিত বক্তব্য জাতিকে হতাশ করেছে। স্বাধীনতার পর সংবিধানে ১৬ বার সংশোধনী আনা হয়েছে, তন্মধ্যে আওয়ামী লীগের সময় প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চদশ ও ষোড়শ সংশোধনী এনে ধাপে ধাপে মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে সংকুচিত করা হয়েছে। সংবিধানে যে ১৬টি সংশোধনী আনা হয়েছে তন্মধ্যে ১৪ বার হয়েছে নির্বাচিত সরকারের হাতে আর দুবার হয়েছে ১৯৭৯ সালের ৬ এপ্রিল, ৯ জুলাই ১৯৮৮ (পঞ্চম সংশোধনী, অষ্টম সংশোধনী) জনগণের কোনো মৌলিক অধিকার ক্ষুণ্ন না করলেও যেহেতু সেগুলো সংবিধান পরিপন্থী সে জন্য তা উচ্চ আদালত বাতিল করে দিয়েছে, নির্বাচিত সরকারের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সংশোধনী আনা হয় ২৮ সেপ্টেম্বর ১৯৯১ সংবিধানে ১২তম সংশোধনীর মধ্য দিয়ে এদেশে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার প্রতিষ্ঠিত করা হয় বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে।

১৬তম সংশোধনী বাতিলের রায় নিয়ে আলোচনার এখতিয়ার সংসদের আছে কিনা— যেখানে সংসদে প্রণীত আইন যদি সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয় সেখানে একমাত্র বিচার বিভাগই সেটাকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করতে পারে। সেক্ষেত্রে সাংবিধানিকভাবে বিচার বিভাগই সংবিধান রক্ষার অভিভাবক/সেদিন সংসদে ১৬তম সংশোধনী আলোচনায় সংসদ সদস্যরা যে ভাষা ব্যবহার করেছেন তা সম্পূর্ণ অনাকাঙ্ক্ষিত। কেননা সংবিধানের ৬৫ অনুচ্ছেদে সংসদ প্রতিষ্ঠা এবং অনুচ্ছেদ ৬৫(২) মোতাবেক কারা সংসদ সদস্য হবে তা পরিষ্কারভাবে লেখা আছে। আসলে আজকের সংসদ সংবিধানের ৬৫(২) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী গঠিত না হওয়ায় সংসদে এ ধরনের আত্মঘাতী আলোচনা হয়। অথচ সংসদ কার্যাবলি বিধির ৫৩, ৬৩ ও ১৩৩ বিধি অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিয়ে সংসদে আলোচনা করার কোনো এখতিয়ার নেই। এই বিধি কিন্তু সংসদ সদস্যরাই করেছেন অথচ তারা তাদের প্রণীত আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বিচার বিভাগকে খাটো করার চেষ্টা জাতির জন্য দুঃখজনক ও অনভিপ্রেত। উল্লিখিত বিধি কিন্তু সংসদ আনীত আইন। আমাদের পাশের দেশ পৃথিবীর বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ ভারতের উচ্চ আদালত বলেছেন সংসদ সার্বভৌম নয়। যুক্তরাষ্ট্রেও সংসদ কর্তৃক প্রণীত আইন যদি বিচার বিভাগ দেখতে পায় যে সেটা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক তাহলে একমাত্র বিচার বিভাগই সে আইনকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করতে পারেন।

আমাদের সংবিধানে বিচার বিভাগের বিচারিক ক্ষমতার মধ্যে সংবিধানের ব্যাখ্যা অন্যতম, যেহেতু বিচারিক পর্যালোচনায় ও সংবিধানের ব্যাখ্যার মাধ্যমে উচ্চ আদালত সংসদে পাস করা যে কোনো আইনকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করতেই পারে এতে কোনো ধরনের বাধা নেই। সংবিধান আদালতকে সে ক্ষমতা দিয়েছে। বিচার বিভাগের বিচারিক পর্যালোচনার ক্ষমতা আমাদের সংবিধানে আদালতকে দেওয়া হয়েছে যা সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর অংশ, সংসদ আইন করেও তা রহিত করতে পারে না। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, সম্মান ও মর্যাদা রক্ষা করার সর্বজনীন দায়িত্ব হচ্ছে রাষ্ট্রের। অথচ আমরা দেখলাম যখন সংবিধানের ১৩তম সংশোধনী যেটা কিনা তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের বিধান (১৯৯৬ সালের ২৮ মার্চ) করা হয়েছিল উচ্চ আদালতের বিভক্ত রায়ে সেটাকে বাতিল করা হয় তারা সেটাকে স্বাগত জানাল আর আজ সর্বসম্মতিক্রমে উচ্চ আদালত যখন ১৬তম সংশোধনী বাতিল করে বিচার বিভাগকে স্বাধীনভাবে কাজ করার এক যুগান্তকারী রায় দিলেন তখন গাত্রদাহের কী কারণ তা বুঝতে কারও বাকি নেই। উল্লেখ্য, বর্তমান সংসদে ১৯৬৯ সালের আন্দোলনের মহানায়ক জনাব তোফায়েল দুঃখ করে বলেছিলেন, ‘যে খণ্ডকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে জেল খেটেছিলাম আজ তা বাতিলের জন্য স্বাগত জানাতে হলো’ অথচ এই সংসদে ঝানু পার্লামেন্টারিয়ান তোফায়েল আহমেদের মতো অনেক সংসদ সদস্যের উপস্থিতিতে ১৬তম সংশোধনী বাতিলে সংসদে যে মানের আলোচনা হয়েছে তা জাতি কোনো দিন আশা করেনি। ২০১১ সালের ৩০ জুন সংবিধানে ১৫তম সংশোধনী এনে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান বিলুপ্তকরণ করা হলেও তখন কিন্তু সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল বহাল ছিল। কিন্তু ২০১২ সালে একজন বিচারকের মন্তব্য এবং এ বিষয়ে সংসদের স্পিকারের রুলিংকে কেন্দ্র করে বিচার বিভাগ ও সংসদের মধ্যে চরম বিরোধ সৃষ্টি হয় এবং ২০১৩ সালে সুপ্রিম কোর্ট সংসদের তৈরি আদালত অবমাননার আইন বেআইনি ঘোষণা করে রায় দেন। এ দুটি ঘটনার পর সরকার সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের বিধান বাতিল করে বিচারকদের অপসারণ ক্ষমতা সংসদের কাছে দেওয়ার সিদ্ধান্তেরই ফসল হচ্ছে ষোড়শ সংশোধনী আর দেশের সর্বোচ্চ আদালত এক ঐতিহাসিক সর্বসম্মতিক্রমে রায়ের মাধ্যমে তা বাতিল করে বিচার বিভাগের সেই আদি স্বাধীনতা রক্ষায় যুগান্তকারী ভূমিকা পালন করে বিচার বিভাগকে রক্ষা করেছেন। সংবিধান হচ্ছে জাতির সনদ আর বিচার বিভাগ হচ্ছে তার রক্ষাকারী অভিভাবক।

সংসদে যদি আজ সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের মতো ঝানু পার্লামেন্টারিয়ান থাকতেন তাহলে সংসদে এ ধরনের আলোচনার অবতারণা হতে পারত না। সংবিধানের ৬৫(২) অনুচ্ছেদ যাদের সংসদ সদস্য হিসেবে বিবেচনায় আসত আজকে সে সংসদ ১৫৪ জন সংসদ সদস্যের হাতে জিম্মি যার জন্য ঝানু পার্লামেন্টারিয়ান আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদসহ অনেকে হৃদয়ের সেই অনুভূতি ও ইচ্ছা থাকলেও ব্যক্ত করতে পারছেন না যারা তাদের দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে গণতন্ত্র, আইনের শাসন ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতার সঙ্গে আপসহীন ছিলেন। পথহারা জাতিকে কর্তৃত্ববাদী গণতন্ত্র থেকে প্রকৃত গণতন্ত্রে ফিরিয়ে আনার জন্য আজকে দরকার জনগণের ভোটাধিকার নিশ্চিত করা, আর তজ্জন্য প্রয়োজন জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ পরিবেশ সৃষ্টি করা,  যার অপেক্ষায় তাকিয়ে আছে এদেশের জনগণ।  জাতির প্রতিটি ক্রান্তিকালে বিচার বিভাগ তার বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে পিছপা হবে না এটাই প্রত্যাশা।

     লেখক : সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও সাবেক রাষ্ট্রদূত।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর