একদিনের পত্রিকায় অনেকগুলো খারাপ খবর। ক্ষমতাসীন লীগ সরকারের জন্য সব খবরই নেতিবাচক। শুরু করি এককালে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড বলে খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগের অনিয়ম নিয়ে। প্রথমেই বলে নেওয়া দরকার, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে সরকার কর্তৃক ‘নিযুক্ত’ ভাইস চ্যান্সেলরদের প্রায় সবাই ইতিমধ্যে আচরণে-উচ্চারণে প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন, তারা যেন আওয়ামী লীগারদের চেয়েও বড় আওয়ামী লীগার। কেউ কেউ আওয়ামী লীগের কোনো কোনো সহযোগী দলের কেন্দ্রীয় নেতাও বটে। দলীয় কর্মসূচিতে কাউকে দলীয় ব্যাজ বুকে ঝুলিয়ে বুক ফুলিয়ে হাঁটতেও দেখা গেছে। এর আগে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলেও দলীয় বিবেচনায় ভিসি নিয়োগ দেওয়া হয়েছে বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে। তারা দলীয় পারপাসও হয়তো সার্ভ করেছেন। কিন্তু একমাত্র জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি মরহুম আফতাব আহমদ ছাড়া আর কারও বিরুদ্ধে ব্যাপক অনিয়মের কোনো অভিযোগ ওঠেনি। অর্থাৎ দল কর্তৃক আয়োজিত কোনো আলোচনা সভা, সেমিনার, সিম্পোজিয়ামে গেলেও সবাই নির্লজ্জভাবে দলবাজি করেননি, দলীয় নেতার ভাষায় ও ঢঙে বক্তৃতা করেননি। আর এখন? সরকারি দলের কোনো অনুষ্ঠানে ভিসি সাহেবরা কেউ গেলে এতে কোনো লীগ নেতার থাকার দরকার হয় না বলে অনেকেই বলে থাকেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার পরিবেশ বজায় রাখা, শিক্ষার মানোন্নয়ন ঘটানো, বহুমতের সহাবস্থান নিশ্চিত করার বিষয়ে ভিসি সাহেবদের ভূমিকা নিয়ে ইদানীং বেশ আলোচনা হচ্ছে। গত আট বছরে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েই প্রচুর শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। নিয়োগকালে দলীয় বিবেচনাই প্রাধান্য পেয়েছে বলে অভিযোগ খুব জোরালো; দুর্নীতির অভিযোগও যে নেই, তাও নয়। গত আট বছরে সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ পাওয়া সব শিক্ষকের তালিকা নিয়ে গুণমান যাচাই করলে বোঝা যাবে, এদের মধ্যে কতজন প্রতিযোগিতা করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেতেন। গত ৪ আগস্ট একটি বহুল প্রচারিত জাতীয় দৈনিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এ সংক্রান্ত একটি ‘পিলে-চমকানো’ খবর বেরিয়েছে। তাতে বলা হয়, ‘দলীয় রাজনীতির কারণে এবং উপাচার্যের পছন্দের ব্যক্তিকে নিয়োগ দিতে শিক্ষাগত যোগ্যতা শিথিল করার পাশাপাশি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির অতিরিক্ত শিক্ষক নিয়োগ করা হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। এমনকি বিজ্ঞপ্তি ছাড়া এবং স্নাতকোত্তর ডিগ্রি না থাকা প্রার্থীরাও নিয়োগ পেয়েছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান প্রশাসনের গত তিন বছরের মধ্যে এবং নতুন বিভাগগুলোয় শিক্ষক নিয়োগে অনিয়ম হয়েছে সবচেয়ে বেশি। বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকারপন্থি নীল দলের শিক্ষকদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কারণে বর্তমান উপাচার্যের নেতৃত্বে প্রশাসনিক ক্ষমতায় থাকা অংশটি নিজেদের পছন্দ ও অনুগত শিক্ষকদের সংখ্যা বাড়াতে অনেক অনিয়ম করেছে। প্রশাসনিক ভবন সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন শিক্ষকের সংখ্যা ১ হাজার ৯৯২। উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকের সাড়ে আট বছরের মেয়াদে মোট ৯০৭ জন শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে শেষ তিন বছরে নিয়োগ পেয়েছেন ৩৫০ জন। শিক্ষাগত যোগ্যতা শিথিল করে এবং যোগ্য প্রার্থীদের বাদ দিয়ে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে অন্তত ৭৮ জন এবং ন্যূনতম যোগ্যতা পূরণ না করেই দুই বিভাগে নিয়োগ পেয়েছেন ১০ জন। আর নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে উল্লিখিত সংখ্যার চেয়ে দুই বা ততোধিক শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে ৪১ জনের ক্ষেত্রে। স্নাতকোত্তর ছাড়াই নিয়োগ পেয়েছেন অন্তত তিনজন। বিশ্লেষণধর্মী খবরটি অনেক বড়। সংশ্লিষ্ট সব অনিয়মের কথা স্বীকার করেননি, আবার সব উড়িয়েও দেননি। যা ঘটেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের খাতা-পত্রে, কাগজে-কলমে তার প্রমাণ রয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের অহংকারের ধন নানা কারণে। সে অহংকার চূর্ণ হোক তা কোনো দেশপ্রেমিক নাগরিক চাইতে পারেন না। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে দেশের মেধাবী ছাত্রছাত্রীরা লেখাপড়া করে। অনেক অদম্য মেধাবী নানা ক্ষেত্রে বিস্ময় সৃষ্টি করছেন। কিন্তু ব্যতিক্রম ব্যতিক্রমই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান নিয়ে অনেক দিন ধরেই সমালোচনা চলছে। বিশ্বমানের ক্ষেত্রে আগের গর্বের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে জাতি এখন লজ্জা পায়। যারা শিক্ষা দেবেন যারা আলো ছড়াবেন, তারাই যদি অনেকে আলোহীন হন তাহলে অন্ধকার থেকে মুক্তির পথ কী? প্রকাশিত খবরের অংশবিশেষ মনোযোগ সহকারে পড়লে স্পষ্ট বোঝা যায়, বর্তমান সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর সাড়ে আট বছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও শিক্ষা ব্যবস্থাপনার ক্রমাবনতিশীল পরিস্থিতির সবচেয়ে বেশি অবনতি হয়েছে। এটা সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা অথবা উদাসীনতার ফল। শিক্ষক রাজনীতির একটা কুফলও এটা। সরকারি নীল দল ও বিএনপি-জামায়াতপন্থি সাদা দলের ক্ষমতার লড়াই, দলবাজি ও দলভারী করার প্রবণতা বাড়িয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি সরকারি দলের নিয়ন্ত্রণে রাখতে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্যানেল, হলের প্রভোস্ট ও হাউস টিউটরের পদসহ অন্যান্য লাভজনক প্রশাসনিক পদ দখলের জন্য সরকারি দল সমর্থকদের মধ্যেই ভেদাভেদ ও লড়াই পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই যদি এ অবস্থা হয়, অন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থা যে কী তা সহজেই অনুমান করা যায়। কোনো অবস্থাতেই এ পরিস্থিতি অভিপ্রেত নয়। যোগ্য ও মেধাবীরাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক হবেন এটাই তো হওয়া উচিত। বর্তমান সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর বিভিন্ন ক্ষেত্রে দৃশ্যমান উন্নয়ন হচ্ছে। অনেক অর্জন হয়েছে বাংলাদেশের। একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার, সন্ত্রাসবাদ-জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই সরকারকে দেশে ও বিদেশে অনেক গৌরবান্বিত করেছে। সরকারের ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্ন রাখতে চাইছে সরকার। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আবারও বিজয়ের গৌরব অর্জন করতে যে কাজগুলো হয়েছে সে পুুঁজিই যথেষ্ট হবে না। গণঅসন্তোষ সৃষ্টিকারী, গণদুর্ভোগ সৃষ্টিকারী কর্মকাণ্ড, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতিসহ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নের প্রতি জোর নজর দিতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খবরটি সরকারের জন্য সুখকর নয়। কোনো কোনো খবর আছে বিদ্যুত্গতিতে ছড়ায়। কোনো কোনো খবর আছে যা মানুষের মন বদলায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে শাসক দলের দলবাজি মানুষ ভালোভাবে নেয়নি। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির বড় একজন লীগ নেতার দায়িত্ব নেওয়ার কী প্রয়োজন? তা ছাড়া দলের অধিকতর যোগ্যদের বাদ দিয়ে যখন অন্য ‘কর্মযোগ্য’ কাউকে বড় পদে বসিয়ে দেওয়া হয় তখন তাতে সরকারের ‘সুইট ডিজায়ার’ নিয়েও প্রশ্ন ওঠে, বিতর্ক সৃষ্টি হয়। এরা বোধহয় নিম্নমানের নেতাই পছন্দ করেন।
আরেকটি খবর ছিল, ‘ঢাকার অর্ধেকের বেশি সড়ক নষ্ট’। ঢাকা শহরের অনেক এলাকার রাস্তাঘাট দীর্ঘদিন ধরে শুধু যানবাহন চলাচলেরই অনুপযোগী নয়, মানুষের হাঁটাচলারও অনুপযোগী। পাঠক, আপনারা কেউ গত তিন মাসের মধ্যে যদি রাজধানীর একটি গুরুত্বপূর্ণ আবাসিক এলাকা বনশ্রী গিয়ে থাকেন তাহলে বুঝতে পেরেছেন কী ঝুঁকিপূর্ণ সেই এলাকার সড়ক পথে চলাচল করা। বহুদিন ধরে ডেমরা থেকে সব ভারী যানবাহন স্টাফ কোয়ার্টার হয়ে এ সড়ক দিয়ে চলাচল করে। সড়কটি হাইওয়ের মতো এতো বিশাল বিশাল ভারী যানবাহনের ভার বইতে অক্ষম। ফলে রাস্তা আর রাস্তা নেই। স্থানে স্থানে বিশাল বিশাল গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। বড় বড় গর্তে চাকাও আটকে যায়, দুর্ঘটনা ঘটে, রাত ২টা-৩টা পর্যন্ত অসহনীয় যানজটে এলাকাবাসীর প্রাণ ওষ্ঠাগত। এর মধ্যে বৃৃষ্টি আরও সর্বনাশ করেছে রাস্তাটির। দেখভাল করার কেউ নেই। মাস দুয়েক আগে উচ্চ আদালতের নির্দেশে কিছুদিন ভারী যান চলাচল বন্ধ ছিল। কিন্তু গেল সপ্তাহ থেকে রাত-বিরাতে ভারী যান চলাচল শুরু হয়েছে উচ্চ আদালতের রায় অগ্রাহ্য করে। পুলিশ দেখেও কিছু দেখে না। দিন পনেরো আগে ঢাকা উত্তরের মেয়র আনিসুল হক সাহেব তসরিফ এনেছিলেন বনশ্রীতে। ভেবেছিলাম এবার কিছু হবে। কিন্তু হলো না কিছুই। আশ্বাসের মুলোই ঝুলছে। একজন এমপি তো আছেন। তার ছবি সংবলিত পোস্টার-ব্যানারে প্রায়ই এলাকা ছেয়ে যায়। তিনিও তো কিছু করতে পারেন— কিন্তু করেন কই? ঢাকা শহরের অর্ধেক সড়কেরই এ করুণ অবস্থা। ঠিকমতো রক্ষণাবেক্ষণের অভাবেই এই দশা। এভাবে যদি আর কিছুদিন চলে তাহলে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে অফিসে আসতে, পার্লামেন্টে যেতে, কোনো সরকারি ও রাষ্ট্রীয় প্রোগ্রামে অ্যাটেন্ড করতে হেলিকপ্টার ব্যবহার করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী না হয় তা করলেন, সাধারণ মানুষের ভোগান্তির কী হবে? এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও সরকারের কি কোনো দায় নেই। এত বিরাট মন্ত্রীর বহর কেন? সব ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর দিকেই যদি তাকিয়ে থাকতে হয়, তাহলে অন্যরা বিদায় হন না কেন? কাজ না করলে স্বীয় দায়িত্ব পালনে যোগ্যতা ও দক্ষতার প্রমাণ দিতে না পারলে ওনাদের বক্তৃতাবাজিরও কোনো দরকার নেই। কয়েকটি খবর উদ্ধৃত করেছি দৈনিক প্রথম আলো থেকে। দৈনিক কালের কণ্ঠ, দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিনসহ আরও অন্যান্য কাগজে একই দিন ধর্ষণ, হত্যাসহ নানা নেতিবাচক খবর রয়েছে। দিন যত যাচ্ছে, নির্বাচনের সময় যত এগিয়ে আসছে এসব ঘটনার প্রকোপ যেন বাড়ছে। মনে হচ্ছে সরকারের সারা অঙ্গেই ঘা ছড়িয়ে পড়ছে। সারা অঙ্গে ঘা হয়ে গেলে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, মলম দেবেন কোথায়? কম থাকতেই ‘কড়া ওষুধ’ দিন। না হয় এ অসুখ হবে সর্বনাশা। ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন ও ‘তুফান সরকারদের’ অপকর্মের বিরুদ্ধে মানুষ যখন ফুঁসছে, তখন অর্থমন্ত্রী অনর্থক আরেক জটিলতা সৃষ্টি করলেন বিচার বিভাগের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক কৌশলে একজনের পরোক্ষ সমালোচনা করলেও অর্থমন্ত্রী গোটা বিচার বিভাগের ওপর হামলে পড়েছেন বলে মনে হয়। ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের বিরোধিতা করে তিনি সর্বোচ্চ আদালতকে চ্যালেঞ্জ করে বলেছেন, উচ্চ আদালত যতবার সংবিধানের এই সংশোধনী বাতিল করবে, তারা ততবার তা পার্লামেন্টে পাস করবেন। তার এ বক্তব্য কি সরকার ও সরকারি দলের বক্তব্য? যদি তাই হয় তো, বিচার বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগের মধ্যে প্রকাশ্য যুদ্ধের ঘোষণা দিলেন অর্থমন্ত্রী। আর যদি তা না হয়, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রীর বেসামাল মুখ সামলান।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট।
ই-মেইল : [email protected]