সোমবার, ৭ আগস্ট, ২০১৭ ০০:০০ টা

৫৫ বছর আগের ও পরের বাংলাদেশ

আবু হেনা

৫৫ বছর আগের ও পরের বাংলাদেশ

রমনা থানা আমার ছাত্রজীবনের স্মৃতিতে ভাস্বর। ১৯৬২-এর হামুদুর রহমান কমিশনবিরোধী আন্দোলনে যখন এদেশের শিক্ষাঙ্গন উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল তখন গণতন্ত্রের বরপুত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর গ্রেফতার আন্দোলনকে তীব্রতর করে তোলে। সম্ভবত ৩১ জানুয়ারি আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহাসিক আমতলা থেকে একটি বিশাল মিছিল নিয়ে সারা শহর প্রদর্শন করে যখন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছাকাছি পৌঁছেছি তখনই পাকিস্তানি সেনাদের গুলির শব্দে আমরা সবাই চারদিকে ছিটকে পড়লাম। সেখান থেকে শত শত ছাত্রকে ট্রাকে করে তুলে অজানা জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়। আমি ফিরে আসি সেগুনবাগিচায় যেখানে আমি এনায়েতুল্লাহ খান মিন্টু ভাইয়ের সঙ্গে একটি ঘরে থাকতাম। গভীর রাতে পুলিশ আমাকে এবং একই বাড়ি থেকে মওলানা ভাসানীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ডা. করিম এবং তাকিউল্লাহকে গ্রেফতার করে। রমনা থানায় ওই রাতযাপন সুখকর ছিল। পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের আতিথেয়তা ছিল মনে রাখার মতো। মনে হয়েছিল স্বাধীকার সংগ্রামে তারাও আমাদের সঙ্গে একাত্ম। সেদিন সমগ্র জাতি ছিল ঐক্যবদ্ধ। তারপর প্রায় ছয় মাস ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে রাষ্ট্রদোহিতার অভিযোগে বিচারাধীন থাকার পর এ সময়ে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে যে বিশাল আন্দোলন গড়ে ওঠে এর তীব্রতার মুখে বিপর্যস্ত হয়ে আইয়ুব শাহী আমাদের মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। আজ এ শোকাবহ আগস্টের দিনগুলোতে কৃতজ্ঞ জাতি বঙ্গবন্ধুর স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছে। একই সঙ্গে তাঁর সঙ্গে যারা প্রাণ দিয়েছেন তাদের বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করছে।

ষাটের দশকের সূচনা হয় বাষট্টির আন্দোলন দিয়ে, তারপর মধ্যপথে ১৯৬৬ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলার স্বাধিকারের সনদ ছয় দফা প্রণয়ন করার পর এদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে এক নতুন মাত্রার যোগ হয় এবং স্বাধীনতা সংগ্রাম দুর্বার হয়ে ওঠে। আসে ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান। ছাত্র-জনতার অপ্রতিরোধ্য সংগ্রাম, ১৯৭০-এর নির্বাচন এবং ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের মধ্যদিয়ে তা ১৯৭১-এর রক্তরঞ্জিত মুক্তিযুদ্ধে রূপ নেয়। এ যুদ্ধে অর্জিত বিজয় আনে স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশ। এদিক থেকে ষাটের দশক ৫২-এর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে স্বাধীনতা আন্দোলনের সূচনা এবং ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে সেতুবন্ধ। আমরা সেই উত্তাল রাজনৈতিক ও সামাজিক ঘটনাবলির সক্রিয় অংশীদার। এ সময় পাকিস্তানি ঔপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে ষাটের দশকের উঠতি বাঙালি মধ্যবিত্তের মনোভাব কঠোর হয়ে ওঠে। ১৯৬৫-এর নির্বাচনে আইয়ুব খানের স্বৈরতান্ত্রিক প্রত্যাবর্তনের পর বলিষ্ঠ কণ্ঠে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের স্লোগান উচ্চারিত হয়। এর পর ১৯৬৫’র সেপ্টেম্বরে কাশ্মীর প্রশ্নে পাক-ভারত যুদ্ধ তৎকালীন পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের যোগাযোগ ব্যবস্থা এমনভাবে বিচ্ছিন্ন করে যে এর ফলে পাকিস্তানিদের সঙ্গে একসঙ্গে থাকার উপযোগিতা সম্পর্কে প্রশ্ন আসে।

এ পটভূমিতেই বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর সহকর্মীরা ‘ছয় দফা’ কর্মসূচি পেশ করেন। পূর্ব বাংলার জন্য রাজনৈতিক, প্রশাসনিক এবং অর্থনৈতিক স্বায়ত্তশাসনের পূর্ণাঙ্গ কাঠামো চিত্রণকারী এ কর্মসূচি বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণিসহ সব শ্রেণির মুক্তি সনদ হিসেবে তাত্ক্ষণিক স্বীকৃতি ও জনপ্রিয়তা লাভ করে। ১৯৬৮ সালের প্রথমদিকে তথাকথিত ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’র মাধ্যমে পাক সরকার জাতির জনকসহ বাঙালির রাজনৈতিক নেতা, বেসামরিক ও সামরিক কর্মকর্তাদের বেশ কয়েজজনকে ভারতের সঙ্গে যোগাসাজশ করে পূর্ব বাংলাকে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টার অভিযোগে হত্যার প্রচেষ্টা চালায়, প্রকৃতপক্ষে এ মামলা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে সরিয়ে দেওয়ার একটি চক্রান্ত ছিল। পরিশেষে এ মামলা স্বাধীনতা আন্দোলনকে আরও জোরদার করে তোলে এবং বাঙালি জাতির মুখপাত্র এবং রণাঙ্গনের প্রধান সেনাপতি বঙ্গবন্ধুর ভূমিকাকে সুসংহত করতে সাহায্য করে।

১৯৭০-৭১ এ পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী নির্বাচনের মাধ্যমে রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের শেষ চেষ্টা চালায়। এ নির্বাচনে অংশ নিয়ে বঙ্গবন্ধু যে দূরদর্শিতা এবং প্রজ্ঞার পরিচয় দেন তা অতুলনীয়। এ সিদ্ধান্তই তাঁকে সাফল্যের শিখরে পৌঁছে দেয়। ১৯৭০-এর নির্বাচনে বাংলাদেশ ঐক্যবদ্ধভাবে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগকে সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে জয়যুক্ত করে। আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করা সত্ত্বেও পাক সামরিক সরকার তাদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে ১৯৭১-এর ২৫ মার্চ বাংলাদেশের নিরস্ত্র জনগণের ওপর চালায় সশস্ত্র সামরিক হামলা। এ বর্বরোচিত হামলার বিরুদ্ধে এ দেশের মানুষ যে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলে সেই মুক্তি সংগ্রামের পরিণতিতেই নয় মাসের যুদ্ধে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব অর্জিত হয়।

সময় এসেছে যখন সব ভেদাভেদ ভুলে জাতি এ মহান নেতার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করবে। এই সেই নেতা যার কৈশোর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সবকিছুকে ঘিরে একটিই স্বপ্ন ছিল আর তা হলো স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। মৃত্যু তাঁকে তার স্থান থেকে সরাতে পারেনি। তিনি আছেন এ দেশের সব মানুষের হৃদয়ে। চীনা লেখকের কথায়— ‘এখন রণাঙ্গন, যেন দণ্ডায়মান লাশের দেশ, যারা মৃত্যুবরণে দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ তাঁরা বেঁচে থাকবে যারা জীবন্ত অবস্থায় পালিয়ে যাবার আশা রাখে তারা মরবে।’

তবু শঙ্কা কাটেনি। আজও বঙ্গবন্ধুর, পরিবারের নিরাপত্তা নির্বিঘ্ন নয়। গত ২২ জুলাই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর পুত্র এবং কন্যার নাম ভাঙিয়ে ন্যক্কারজনকভাবে অবৈধ পথে অর্থ উপার্জনে লিপ্ত বাগমারা উপজেলা আওয়ামী লীগের একজন নেতাকে রমনা পুলিশের হাতে সোপর্দ করা হয়। এ ঘৃণ্য চক্রান্ত চরিতার্থ করতে সে তার নামে নিবন্ধিত তিনটি এবং একটি অনিবন্ধিত মোবাইল ফোন ব্যবহার করেছে যা তথ্যপ্রযুক্তি আইনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। দুঃখ হয় যে, যে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা একদিন বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে বুকের রক্ত দিয়েছিল আজ সেই সংগঠনের একজন উপজেলা পর্যায়ের নেতা চারটি মোবাইল ফোন ব্যবহার করে বঙ্গবন্ধুর পরিবারের মানমর্যাদা ধুলায় লুণ্ঠিত করার ঘৃণ্য চক্রান্তে লিপ্ত হয়েছে এবং এ অঞ্চলের নেতারা তার খবর রাখে না।

গত ২৯ জুলাই শনিবার গোয়েন্দা পুলিশের একটি দল একটি কারসহ তিনজনকে গ্রেফতার করেছে। তাদের কাছ থেকে এসএসএফের ব্যবহৃত জ্যাকেট, তিনটি ওয়ারলেস সেট, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে প্রবেশের অনুমতি স্টিকার ও ড্যাশবোর্ডে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মনোগ্রাম রয়েছে।

এসব ঘটনায় স্পষ্টভাবে বলা যায় যে, যেসব মূল্যবোধ ও নৈতিক আচরণ সমাজকে শক্তি জোগায় তা আজ ভেঙে গুঁড়িয়ে গেছে। সমাজব্যবস্থা আজ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। এখানে গুটিকয়েক ব্যক্তিকে কঠোর শাস্তি দিয়ে সমস্যার সমাধান হবে না। প্রয়োজন ওপরের স্তরে দৃষ্টিভঙ্গির আমূল পরিবর্তন। দেশের জন্য এ এক নাজুক সময়, বিশাল ক্রান্তিকাল। মনোভঙ্গি এবং রাজনৈতিক কাঠামো ও পদ্ধতির সংস্কারমূলক পরিবর্তনের মাধ্যমে সুষ্ঠু রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে না পারলে তা ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি করবে।

     লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য।

সর্বশেষ খবর