সোমবার, ৭ আগস্ট, ২০১৭ ০০:০০ টা
ধর্মতত্ত্ব

তিন প্রকারের হজ

আহমদুল ইসলাম চৌধুরী

হজ তিন প্রকার। কেরান, তামত্তো, এফরাদ। তার মধ্যে উত্তম হলো কেরান হজ। তারপরের স্থানে তামত্তো হজ। এরপর এফরাদ হজ। তবে বাংলাদেশি সামান্য সংখ্যক হজযাত্রী বাদে বাকি সরকারি-বেসরকারি সব হজযাত্রী তামত্তো হজই করে থাকে। কারণ তামত্তো হজ অন্য দুই প্রকারের হজ থেকে সহজতর। যারা কারও বদলি হজ করতে যায় তারা সাধারণত এফরাদ হজই করে। আর যারা আগে হজ করেছে বা বেশি নেক আমল প্রত্যাশী এমন মুষ্টিমেয় লোক কেরান হজ করে থাকে। কেরান হজের বেলায় মিকাতের বাহির হতে একসঙ্গে হজ ও ওমরার এহরাম করে পবিত্র মক্কা পৌঁছে ওমরা করে বা ওমরার আহকাম শেষ করে এহরাম অবস্থায় হজের জন্য অপেক্ষা করতে থাকবে। এরই মধ্যে সুন্নত তাওয়াফ তাওয়াফে কুদুম করে সঙ্গে সা’য়ী করে নিলে ১০ তারিখ ফরজ তাওয়াফের পর আর সা’য়ী করতে হবে না। হজের আহকামে একবার সা’য়ী করা ওয়াজিব। তেমনি ওমরার বেলায়ও তাওয়াফের পর একবার সা’য়ী করা ওয়াজিব। কেরান হজযাত্রীরা ৮ তারিখ মিনা, ৯ তারিখ আরাফাত, ৯ তারিখ দিবাগত রাত মোজদালেফায় হজের আহকাম শেষ করে ১০ তারিখ মিনায় বড় শয়তানের প্রতি সাতটি কঙ্কর নিক্ষেপ করে হজের কোরবানি তথা দমে শুকরিয়ার পর মাথা মুণ্ডিয়ে এহরাম খুলবে। মহিলারা চুলের অগ্রভাগ সামান্য কাটবে। তারপর পবিত্র মক্কা গিয়ে ফরজ তাওয়াফ সেরে আবার মিনায় ফিরে আসবে। ১১ তারিখ সূর্য পশ্চিম আকাশে প্রবেশের পর তিন শয়তানের প্রতি ২১টি এবং অনুরূপ ১২ তারিখ তিন শয়তানের প্রতি ২১টি কঙ্কর নিক্ষেপ করে মিনা থেকে পবিত্র মক্কা চলে আসবে। কেরান হজে ওমরা ও হজ একই এহরামে করতে হবে এবং সেই মতে ওমরার সা’য়ী ও হজের সা’য়ী দুটি সা’য়ী করতে হয়।

এফরাদ হজ : এফরাদ হজযাত্রী মিকাতের বাহির হতে শুধু হজের নিয়তে এহরাম করবে। তারপর এহরাম অবস্থায় পবিত্র মক্কা পৌঁছে হজের জন্য অপেক্ষা করতে থাকবে এবং এরইমধ্যে একবার সুন্নত তাওয়াফ তাওয়াফে কুদুম করে সা’য়ী করে নিলে ১০ তারিখ ফরজ তাওয়াফের পর আর সা’য়ী করতে হবে না। তাওয়াফে কুদুমের পর সা’য়ী না করলে ফরজ তাওয়াফের পর পর সা’য়ী করতে হবে। এফরাদ হজযাত্রীরা ৮ থেকে ১২ তারিখ কেরান হজযাত্রীর অনুরূপ হজের আহকাম শেষ করবে। শুধু ১০ তারিখ রমির পর এফরাদকারীর জন্য হজের কোরবানি ওয়াজিব নয় মোস্তাহাব। এফরাদ হজে ওমরা নেই শুধু হজ।

তামত্তো হজ : তামত্তো হজযাত্রীরা মিকাতের বাহির হতে শুধু ওমরার নিয়তে এহরাম করবে। এরপর পবিত্র মক্কা পৌঁছে ওমরা সেরে মাথা মুণ্ডিয়ে এহরাম খুলে স্বাভাবিক অবস্থায় পবিত্র মক্কায় হজের জন্য অপেক্ষা করতে থাকবে। তারপর হজের সময় হজ উপলক্ষে ৮ তারিখ সকালে মিনা রওনা হওয়ার আগে পবিত্র মক্কা থেকে হজের নিয়তে এহরাম করে নেবে। তামত্তো হজযাত্রীরা ৮ থেকে ১২ তারিখ পর্যন্ত কেরান ও এফরাদ হাজির মতো হজের আহকাম সারবে। শুধু পার্থক্য হলো ১০ তারিখ রমির পর তামত্তো হজযাত্রীকে কেরানের মতো হজের ওয়াজিব অঙ্গ দমে শুকরিয়া দিতে হবে। আর কেরান ও এফরাদ হজের সুন্নত তাওয়াফে কুদুম করতে হয়, যা তামত্তো হজে নেই। পুরুষ হজযাত্রী এহরাম খুলতে মাথা মুণ্ডানো উত্তম। তবে চুলের অগ্রভাগ সামান্য পরিমাণ কাটাও জায়েজ আছে। মহিলাদের ক্ষেত্রে এহরাম খুলতে কোনো এহরাম মুক্ত মোহরম দ্বারা এক ইঞ্চি পরিমাণ চুলের অগ্রভাগ কেটে নেবে। বাংলাদেশিদের মিকাত আগে সাগরপথে ইয়ালমলম পাহাড় এলাকা যা জেদ্দার আগে পড়ে। কিন্তু বর্তমান আকাশপথে কারনুল মানাজিল হবে। আর পবিত্র মদিনা হয়ে এলে মিকাত পবিত্র মদিনার কাছে যুলহোলায়ফা নামক স্থানে বর্তমান নাম বীরে আলী। কাজেই যারা চট্টগ্রাম-ঢাকা থেকে জেদ্দা হয়ে প্রথমে মক্কা যাবে তারা দেশে এহরাম করে নেবে। যেহেতু এয়ারক্রাফটের (বিমানের) ভিতর এহরাম করা ঝামেলা হতে পারে। আর যারা দেশ থেকে জেদ্দা হয়ে আগে পবিত্র মদিনা যাবে তারা পবিত্র মদিনা থেকে পবিত্র মক্কার উদ্দেশে রওনা হয়ে যুলহোলায়ফা মিকাত মসজিদে এহরাম করে নেবে। যারা কেরান বা এফরাদ হজ করে তারা অনেকটা হজ সম্বন্ধে অভিজ্ঞ বলা চলে। কিন্তু যারা তামত্তো হজ করে তাদের অধিকাংশই হজ সম্বন্ধে অনভিজ্ঞ অর্থাৎ প্রায়ই প্রথম হজযাত্রী। সাধারণত সরকারি-বেসরকারি অধিকাংশ তামত্তো হজযাত্রী আগে পবিত্র মক্কা যায়। তারপর সময় থাকলে পবিত্র মদিনা জেয়ারতে যায়। নতুবা হজের পরে। যদি আপনি সরকারি হজযাত্রী হন তবে ঢাকা হাজী ক্যাম্প থেকে বিমানবন্দরের উদ্দেশে রওনা হওয়ার আগ মুহূর্তে আর বেসরকারি হলে চট্টগ্রাম-ঢাকা বিমান বন্দরের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে বিমানে আরোহণের আগ মুহূর্তে ওমরার উদ্দেশে এহরাম পরবেন। সেজন্য পুরুষদের এহরামের কাপড় বড় লাগেজে না রেখে সঙ্গে থাকা ছোট ব্যাগে রাখা দরকার যাতে এহরাম পরিধানে এহরামের কাপড়ের সমস্যা না হয়। আপনি এহরামের কাপড় পরে শরীর থেকে ব্যবহারের সব কাপড় খুলে ফেলে মাথায় টুপি রেখে দুই রাকাত সুন্নতুল এহরাম নামাজ পড়ে মাথা থেকে টুপি নামিয়ে ফেলে ওমরার নিয়ত করে তিনবার লাব্বায়েক দোয়া পড়লে এহরাম হয়ে যায়।  আগেই উল্লেখ করেছি ৮ থেকে ১২ তারিখ হজ কার্যক্রমে কেরান, তামত্তো, এফরাদ কোনো ব্যবধান নেই। শুধু ১০ তারিখ কেরান ও তামত্তো হাজীদের ক্ষেত্রে হজের কোরবানি তথা দমে শুকরিয়া ওয়াজিব যা এফরাদের ক্ষেত্রে মোস্তাহাব। আর কেরান ও এফরাদ হজে সুন্নত তাওয়াফ তাওয়াফে কুদুম করতে হয়। যা তামত্তো হজে করতে হয় না। এহরাম অবস্থায় মাথা উন্মুক্ত থাকবে। এমনকি যে কোনো নামাজে এবং রাতে নিদ্রায়ও। মহিলা হজযাত্রীকে পুরুষের মতো এহরামের পৃথক সেলাইবিহীন কাপড় পরতে হয় না। তারা স্বাভাবিক কাপড়ের ওপর বোরকা পরবে এবং মুখমণ্ডল বোরকার পর্দা দ্বারা এমনভাবে আবরণ করবে যাতে ওই পর্দার কাপড় মুখমণ্ডলে না লাগে। নতুবা ওজর হিসেবে মুখমণ্ডল উন্মুক্ত রাখতে হয়। একালে যেহেতু মহিলাদের প্রায়ই হজে ইসলাম ধর্মের কঠোর নির্দেশ পর্দা করার ব্যাপারে শৈথিল্য পরিলক্ষিত হচ্ছে সেখানে এহরামের সময় বিশেষ ব্যবস্থায় মুখমণ্ডলে আবরণ রাখতে হয়তোবা কদাচিৎ পরিলক্ষিত হবে। এহরাম পরার নিয়ম, এহরামের দুই রাকাত নামাজ, নিয়ত, লাব্বায়েক দোয়া, এহরাম অবস্থায় করণীয়-বর্জনীয় দীর্ঘ বর্ণনা, তাওয়াফের নিয়ম, সা’য়ীর নিয়ম ও পাঁচ দিনব্যাপী হজ কার্যক্রমের নিয়ম ইত্যাদি বিবরণ ও দোয়া পত্র-পত্রিকায় অল্প পরিসরে দেওয়া সম্ভব নয়। বাজারে বিভিন্ন লেখকের হজের বই ও কিতাব পাওয়া যায়। কাজেই এক বা একাধিক হজের বই ক্রয় করে অনায়াসে হজ, ওমরা, জেয়ারতের বিস্তারিত বিবরণ ও দোয়া দরুদ জেনে ও শিখে নেওয়া যায়।

     লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক ও কলাম লেখক।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর