সোমবার, ১১ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা
বিচিত্রিতা

প্লাস্টিক : আশীর্বাদ না অভিশাপ

আফতাব চৌধুরী

প্লাস্টিক : আশীর্বাদ না অভিশাপ

আমাদের পূর্বপুরুষদের দৈনন্দিন জীবনে প্লাস্টিকের কোনো প্রভাব না থাকলেও বর্তমানে সুউচ্চ পর্বতশিখর থেকে সমুদ্রের তলদেশ সর্বত্রই এর অবাধ বিচরণ, যা মানুষেরই সৌজন্যে। বিজ্ঞানীরা Anthropocene আখ্যা দিয়েছেন বর্তমানকালের এমন একটি যুগকে যেখানে মানুষের ক্রিয়াকর্ম দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে ভৃপৃষ্ঠের গঠন এবং প্রাকৃতিক ইকোসিস্টেম। হয়তো সুদূর ভবিষ্যতে ভূতাত্ত্বিক স্তরে যুগের Anthropocene  স্মারক রূপে স্তরীভূত শিলার স্তরের মাঝে থেকে যাবে জীবাশ্মভূত প্লাস্টিকের স্তর, যাকে বিজ্ঞানীরা Technofossils  বলছেন। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে এ কার্বননির্ভর পলিমারের প্রভাব অস্বীকার করা যায় না। বিভিন্ন ক্ষেত্রে এর ব্যবহার উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাওয়ায় পৃথিবীপৃষ্ঠে জমছে পরিত্যক্ত প্লাস্টিকের জঞ্জাল। শুধু পরিত্যক্ত প্লাস্টিক নয়, দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত প্লাস্টিক সামগ্রী থেকেও দূষণের পরিমাণ যথেষ্ট। পেট্রোলিয়ামজাত এ পলিমারের ভঙ্গুরতা হ্রাস করতে এর সঙ্গে মেশানো হয় Bisphenol A  যা একটি কার্বননির্ভর কৃত্রিম রাসায়নিক পদার্থ। এর উপস্থিতিতে প্লাস্টিকের ভঙ্গুরতা হ্রাস পাওয়ার সঙ্গে বৃদ্ধি পায় এর স্বচ্ছতা। আর তাই মাইক্রোওয়েভ বাসন, টুথব্রাশ, বিভিন্ন কনটেনার, পাইপ, পানির বোতল, ডিভিডি প্রভৃতি প্রস্তুতের ক্ষেত্রে এর ব্যবহার ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। সমস্যা হলো অতি উষ্ণ অথবা অতি শীতল হিমায়িত অবস্থায় কিংবা অ্যাসিডিক পরিবেশে সমৃদ্ধ BPA প্লাস্টিক বস্তুর থেকে Bisphenol A  নিঃসরণ হয় চারপাশের পরিবেশ। সাম্প্রতিককালে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বিজ্ঞানীরা প্রমাণ করেছেন Bisphenol A-র উপস্থিতিতে ক্যান্সার এবং হরমোনঘটিত নানা ব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। অন্যদিকে বিভিন্ন দৈনন্দিন ব্যবহারিক জিনিসপত্রে উপস্থিত Polyvinyl Chloride (PVC) -র মতো রাসায়নিক পদার্থের ক্ষতিকারক প্রভাবও অস্বীকার করা যায় না। কারণ এতে আছে Phathalat’s  এর মতো রাসায়নিক পদার্থ যার উপস্থিতিও স্বাস্থ্যের জন্য যথেষ্ট হানিকারক বলে প্রমাণিত, যদিও এর উপস্থিতিতে প্লাস্টিকের নমনীয়তা বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। ব্যবহারের পরে বিশ্বব্যাপী যে বিপুল পরিমাণের প্লাস্টিকজাত জঞ্জালের সৃষ্টি হয়েছে তা বায়োডিগ্রেডেবল অর্থাৎ জৈব বিয়োজনের অধিকারী না হওয়ার দরুন পৃথিবীপৃষ্ঠে থেকে যায় দীর্ঘদিন এবং বাতাস, বৃষ্টির পানি, নদীনালা দ্বারা বাহিত হয়ে মিশে সমুদ্রের পানিতে। উপকূলবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত প্রায় ১৯২টি দেশ থেকে যে বিপুল পরিমাণে প্লাস্টিক জঞ্জাল সমুদ্রের পানিতে মিশ্রিত হয় তার মধ্যে বেশিরভাগই হলো মধ্যবিত্ত অধ্যুষিত দেশগুলো এবং দ্রুত উন্নয়নশীল দেশগুলোর সৌজন্যে। বিশেষত, দায়ী করা হচ্ছে চীন, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপিনস, থাইল্যান্ড এবং ভিয়েতনামের মতো দেশগুলোকে। জানা গেছে, আগামী ২০২৫ সাল নাগাদ শুধু সমুদ্রে নিমজ্জিত প্লাস্টিক জঞ্জালের পরিমাণই দাঁড়াবে ১৫৫ মিলিয়ন টন। বিশ্বাসযোগ্য না হলেও এটা ঘটনা যে সামুদ্রিক স্রোতের দ্বারা বাহিত হয়ে বিভিন্ন মহাসাগরের মাঝে তৈরি হয় প্লাস্টিকজাত বর্জ্য পদার্থের পাহাড়। উত্তর প্রশান্ত মহাসাগরের হাওয়াই দীপপুঞ্জ এবং জাপানের মাঝে মহাসাগরে তৈরি হয়েছে পরিত্যক্ত প্লাস্টিকের যে পাহাড় তাকে বলা হচ্ছে Great Pacific Garbage Patch,  আর যার আকার নাকি টেক্সাসের মতো বৃহদাকৃতির রাজ্যের তুলনায় আকারে দ্বিগুণ। নিস্তার নেই আটলান্টিক মহাসাগর এবং ভারত মহাসাগরের, সেখানেও মহাসাগরের মাঝে তৈরি হয়েছে প্লাস্টিকের পাহাড়। এ যাবৎ সমুদ্রবক্ষে মোট এরকম পাঁচটি প্লাস্টিক পাহাড়ের সন্ধান পাওয়া গেছে। আর সমুদ্রের পানিস্রোতের প্রভাবে প্লাস্টিক বস্তুগুলো ক্ষুদ্রাকারে ভেঙে গেলে তা সহজেই সামুদ্রিক প্রাণীর খাদ্যবস্তুর সঙ্গে প্রবেশ করে তার পাচনতন্ত্রে। এ প্লাস্টিক পদার্থের মধ্যে উপস্থিত বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ যেমন, অ্যান্টিমনি, লেড, ক্যাডমিয়াম, মারকারি প্রভৃতি পদার্থ সহজেই প্রবেশ করে সামুদ্রিক প্রাণীকুলের দেহে। শুধু এই নয়, পেট্রোলিয়ামজাত এ বস্তুগুলো সমুদ্রে প্রবেশের আগে তার যাত্রাপথেও স্পঞ্জের মতো শোষণ করে বহু রাসায়নিক পদার্থ। সুতরাং এদের উপস্থিতিতে শুধু যে সামুদ্রিক প্রাণীকুলই বিপন্ন তা নয়, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পৃথিবীপৃষ্ঠের ওপরে অবস্থিত সব থেকে বড় সামুদ্রিক ইকোসিস্টেম, বিঘ্নিত হচ্ছে বহু সামুদ্রিক মাছ, সি টারটল, সামুদ্রিক পাখি, ডলফিন, সিল প্রভৃতি প্রাণী। পেট্রোলিয়ামজাত এ প্লাস্টিক প্রস্তুতির জন্য প্রতিবছর যেমন ব্যয় হয় ৩৩১ মিলিয়ন ব্যারেল পেট্রোলিয়াম তেমন প্রচুর পরিমাণে গ্রিনহাউস গ্যাসের উদ্গীরণের দরুণ বায়ুমণ্ডলও দূষিত হচ্ছে। তাই এহেন দূষণ থেকে মুক্তি পেতে রিসাইক্লিংয়ের সঙ্গে ধরা হচ্ছে বায়োপ্লাস্টিক প্রস্তুতিতে প্রয়োজনীয় শক্তির পরিমাণ, পেট্রোলিয়ামজাত প্লাস্টিকের তুলনায় প্রায় অর্ধেক। বায়োপ্লাস্টিকের জৈব বিয়োজনের গুণাগুণ থাকায় কোনো ক্ষতিকারক অবশেষ না রেখেই প্রকৃতিতে মিশে যায় সহজেই। সুতরাং এর ব্যবহারে পরিত্যক্ত প্লাস্টিকের জঞ্জাল থেকে মুক্তি পাওয়ার পথে একধাপ এগোনো যায় আর কী।

আবার কিছু পেট্রোলিয়ামজাত পলিমার এবং বায়োপলিমারের সংমিশ্রণে উৎপন্ন প্লাস্টিকও হতে পারে বায়োডিগ্রেডবল। বর্তমানে সমগ্র বিশ্বে যে পরিমাণ বায়োপ্লাস্টিক উৎপন্ন হয় তা সমগ্র বিশ্বে উৎপন্ন ৩৫০ মিলিয়ন টন পেট্রোলিয়ামজাত প্লাস্টিকের মাত্র ০.২ শতাংশ, কারণ এ মুহূর্তে বায়োপ্লাস্টিক প্রস্তুতি যথেষ্ট খরচাসাপেক্ষ। প্লাস্টিক এমন একটি পদার্থ যার প্রস্তুতি থেকে শুরু করে পরিত্যক্ত অবস্থায় পৌঁছানো পর্যন্ত প্রতিটি ধাপেই দূষণ ছড়ায়। আজকের দিনে প্লাস্টিক আশীর্বাদ, না অভিশাপ তা নির্ণয় করা ভীষণ কঠিন, কারণ এর উপস্থিতি ছাড়া দৈনন্দিন জীবনযাত্রার কথা ভাবাই যায় না। 

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

সর্বশেষ খবর