মঙ্গলবার, ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা
ধর্মতত্ত্ব

ইসলামে কর্মের গুরুত্ব

যুবায়ের আহমাদ

ইসলামে কর্মের গুরুত্ব

ইসলামের কালজয়ী দর্শন শুধু পারলৌকিক জীবনকেই বিমল করে না, ইহলৌকিক জীবনকেও করে অমলিন। সর্বকালের সেরা অর্থনীতিবিদ হজরত মুহাম্মদ (সা.) ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজের দারিদ্র্য দূরীকরণে নিরলস চেষ্টা করেছেন। ব্যক্তিগত ও সামাজিক উভয় স্তরেই গ্রহণ করেছেন নানা উদ্যোগ। ব্যক্তিগত জীবনে স্বনির্ভরতার জন্য প্রত্যেককে উদ্যোগী হওয়ার নির্দেশও দিয়েছেন। আবার যারা আয়-রোজগারে অক্ষম তাদের দেখভালের দায়িত্বও দিয়েছেন সচ্ছলদের ওপর। স্বাবলম্বনের পথ ছেড়ে পরাশ্রয়ী হওয়া তিনি কখনো পছন্দ করেননি। ‘আমি বোঝা হব না কারও পিঠে’ এই বলিষ্ঠ শপথে উজ্জীবিত করে কর্মের প্রেরণা ছড়িয়ে দিয়েছেন সবার মাঝে। নিজ হাতে উপার্জনই মহানবীর (সা.) পরম শিক্ষা। হজরত রাফে ইবনে খাদিজ (রা.) থেকে বর্ণিত, রসুলুল্লাহকে (সা.)-কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, সর্বোত্তম উপার্জন কোনটি? জবাবে তিনি বলেন, ব্যক্তির নিজস্ব শ্রমলব্ধ উপার্জন ও সততার ভিত্তিতে ক্রয়-বিক্রয়। (মুসনাদে আহমাদ)। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, রসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তোমাদের কারও নিজ পিঠে কাঠের বোঝা বয়ে এনে বিক্রি করা কারও কাছে হাত পাতার চেয়ে উত্তম। তাকে (প্রার্থীকে) সে কিছু দিক বা না দিক।’ (বুখারি, মুসলিম)।

আল্লাহতায়ালা মানুষকে নামাজ আদায়ে মসজিদে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। পাশাপাশি উপার্জনচিন্তা বাদ দিয়ে অলসভাবে মসজিদে বসে না থেকে নামাজ সমাপনান্তেই জীবিকার সন্ধানে বের হতেও নির্দেশ দিয়েছেন। সুরা জুমার ১০ নম্বর আয়াতে ইরশাদ হচ্ছে, ‘সালাত সমাপ্ত হলে তোমরা জমিনে ছড়িয়ে পড়বে এবং আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধান করবে, আর আল্লাহকে অধিক স্মরণ করবে যেন তোমরা সফলকাম হতে পারো।’ এ আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম মুহাম্মাদ ইবনে আহমাদ কুরতুবি (র.) আল জামে লিআহকামিল কোরআনে লিখেছেন, ‘যখন নামাজ শেষ হয়ে যাবে তখন তোমরা ব্যবসায়িক কাজকর্ম ও অন্যান্য পার্থিব প্রয়োজনাদি পূরণে বেরিয়ে পড়।’ তাই রিজিকের সন্ধান করা, স্বাবলম্বী হওয়ার চেষ্টায় ব্রতী হওয়া নিশ্চয়ই দুনিয়াদারি নয়, নয় ঐচ্ছিকও বরং তা ফরজ। যারা এ ফরজ পালনে কর্মের পথ অবলম্বন করে সন্ধ্যায় পরিশ্রান্ত হয়ে বাড়ি ফেরে আল্লাহ তাদের ক্ষমা করে দেন। একটি হাদিসে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি শ্রমের কারণে ক্লান্ত হয়ে সন্ধ্যা যাপন করে সে ক্ষমাপ্রাপ্ত হয়েই তার সন্ধ্যা অতিবাহিত করে।’ (তাবারানি; ইসলামে শ্রমিকের অধিকার, পৃষ্ঠা-২)। হালাল উপার্জনের জন্য বের হওয়ার মাধ্যমে আল্লাহতায়ালার নৈকট্য লাভ করা যায়। তাই তো মহানবী (সা.) হালাল উপার্জনের জন্য বের হওয়া লোকটির জন্য আল্লাহর পথে জিহাদে থাকা লোকের সমান সওয়াবের ঘোষণা করেছেন। হজরত কাব ইবনে আজুরা (রা.) থেকে বর্ণিত, একদা রসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছ দিয়ে এক লোক যাচ্ছিল। সাহাবায়ে কিরাম লোকটির শক্তি, স্বাস্থ্য দেখে বললেন, হে আল্লাহর রসুল! এই লোকটি যদি আল্লাহর রাস্তায় (জিহাদে) থাকত! নবী (সা.) বললেন, লোকটি যদি তার বৃদ্ধ পিতামাতা অথবা ছোট ছোট সন্তানের জন্য উপার্জনের চেষ্টায় বেরিয়ে থাকে তাহলে সে আল্লাহর রাস্তায়ই আছে (অর্থাৎ হাত না পেতে উপার্জন করে জীবিকা নির্বাহ করলে সে জিহাদের সওয়াবই পাবে)। (হাইসামি : ৪/৩২৫)। ব্যবসা, শ্রম বিক্রি কিংবা দাওয়াতি কাজ যাই হোক; হোক ঘরে কি বাইরে, সারা জীবনই মহানবী (সা.) থাকতেন কর্মব্যস্ত। কিশোর বয়সেও তিনি বেকার বসে থেকে চাচার সংসারে বোঝা হননি। কৈশোরে চরিয়েছেন মেষ, যৌবনে দেশ থেকে দেশান্তর সফর করে অর্থনৈতিক মন্দার সময়েও রেখেছেন সফল ব্যবসায়ীর বিরল কৃতিত্বের স্বাক্ষর। মুদারাবা ব্যবসায় একজন সফল উদ্যোক্তা তিনি। কাপড়ের ব্যবসা করে বিত্তশালী হয়েছিলেন হজরত আবুবকর (রা.)। ইসলামপূর্ব সময়ে তিনি ব্যবসার উদ্দেশ্যে রসুলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গে দেশ-দেশান্তরে সফর করেছেন। ইসলাম গ্রহণকালে তিনি ৪০ হাজার দিনারের মালিক ছিলেন। হজরত উমর (রা.)-এর অন্নসংস্থানের প্রধান অবলম্বন ছিল ব্যবসা। খেলাফতের মহান দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি পরিবারের ভরণ-পোষণের জন্য তিনি ব্যবসা করতেন। হজরত ওসমান (রা.) সফল ব্যবসায়ী ছিলেন। যৌবনের শুরুতেই নিজেকে ব্যবসা-বাণিজ্যে নিয়োজিত করেন। তৎকালীন আরবের বড় ধনী ছিলেন বলেই তাকে ‘গনি’ বলা হতো। ইমাম আবু হানিফাও (রহ.) ছিলেন কাপড়ের ব্যবসায়ী। রাষ্ট্রীয় হাদিয়া-তোহফার পরোয়া না করে নিজ উপার্জনে জীবিকা নির্বাহ, জ্ঞানের সেবা এবং গরিব শিক্ষার্থীদের যাবতীয় ব্যয়ভার বহন করতেন। তার পিতার ছিল ইরান, ইরাক, সিরিয়া ও হেজাজজুড়ে বিস্তৃত এলাকায় রেশমি কাপড়ের ব্যবসা। কৈশোরেই তিনি পিতার ব্যবসায়ে যোগ দিয়েছিলেন। ইতিহাসের খ্যাতিমান সাধক শাকিক বলখি (রহ.) একবার ব্যবসায়ের উদ্দেশ্যে সফরে বের হন। তার বাণিজ্যিক সফরের কথা জানান স্বীয় সাধকবন্ধু ইবরাহিম ইবনে আদহাম (রহ.)-কে। একে অন্যকে বিদায় জানান। দেখা হবে অনেক দিন পর। কিন্তু একি! কদিন যেতে না যেতেই ফিরে এলেন শাকিক বলখি। হজরত ইবরাহিম ইবনে আদহাম (রহ.) তাকে মসজিদে দেখতে পেয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, এত তাড়াতাড়ি ফিরে এলেন যে! বলখি বললেন, সফরে এক আজব ঘটনা দেখে ফিরে এলাম। আদহাম বললেন, আল্লাহ আপনার মঙ্গল করুন! কী সে ঘটনা? বলখি বললেন, পথে ক্লান্ত হয়ে বিশ্রামের জন্য বিরান ঘরে আশ্রয় নিই। চোখে পড়ে একটি অন্ধ পাখি। পাখিটির হাত-পা অচল। অবাক হয়ে ভাবলাম, জনমানবহীন স্থানে এই অন্ধ পাখিটি কীভাবে বেঁচে আছে! চোখে দেখে না, নড়াচড়া করতে পারে না। এরই মধ্যে লক্ষ্য করলাম, একটি পাখি এলো কিছু খাবার সঙ্গে নিয়ে। পাখিটি দিনে কয়েকবার খাবার নিয়ে আসে। অন্ধ ও অচল পাখিটির জন্য খানাপিনার এ আয়োজন দেখে ভাবলাম, যিনি এই নির্জনে একটি অচল পাখিকে খাওয়াতে পারেন তিনি তো আমার জীবিকারও ব্যবস্থা করতে সক্ষম। এই ভেবে ফিরে এলাম।

কাহিনী শুনে ইবরাহিম ইবনে আদহাম (রহ.) বললেন, শাকিক! খুবই আশ্চর্য হলাম আপনার কথায়। আপনি কীভাবে একটি অন্ধ পাখির পথ বেছে নিলেন! সে তো বেঁচে আছে অন্যের ওপর ভরসা করে। আপনি কেন ওই পাখিটির পথ অবলম্বন করতে পারলেন না, যে নিজের জীবিকার সংস্থান করার পাশাপাশি আরেকটি অন্ধ ও অক্ষম পাখিটির অন্নসংস্থানও করছে। আপনার কি জানা নেই, মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘দাতার হাত গ্রহীতার হাতের চেয়ে উত্তম।’ এ কথা শুনে শাকিক বলখি (রহ.) ইবরাহিম আদহামের হাতে চুমু খেয়ে বললেন, হে আবু ইসহাক! সত্যিই আপনি আমাদের শিক্ষক! অতঃপর শাকিক বলখি স্বীয় ব্যবসায় ফিরে গেলেন। (মুশকিলাতুল ফাকর ; ড. ইউসুফ আল কারজাবি, পৃষ্ঠা-৪০)।

লেখক : খতিব, বাইতুশ শফিক মসজিদ, বোর্ডবাজার, গাজীপুর।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর