শুক্রবার, ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

প্রান্তিক জনতার ঐক্য কাম্য

নূরে আলম সিদ্দিকী

প্রান্তিক জনতার ঐক্য কাম্য

মিয়ানমার থেকে বিভিন্ন পর্যায়ে বিতাড়িত প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা (সম্প্রতি ৪ লাখ ৮০ হাজার) বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছে। আমি এর আগের অনেক নিবন্ধ এবং টকশোতে বলেছি  রোহিঙ্গা বিতাড়ন সুপরিকল্পিত সুদূরপ্রসারী। মিয়ানমার থেকে মুসলমান উত্খাতের সম্ভবত শেষ অঙ্ক। হত্যা, লুণ্ঠন, ব্যভিচার, গৃহদাহ এবার ভয়াবহতা ও পাশবিকতার দিক থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির নািস ও ইতালির ফ্যাসিস্ট বাহিনীকেও হার মানিয়েছে।  অন্যদিকে বাংলাদেশ সরকারের উদারচিত্ত সহিষ্ণু হূদয়ে তাদের শুধু আশ্রয় প্রদানই নয়, বাংলাদেশের প্রান্তিক জনতার সহানুভূতি, সহমর্মিতা ও ঔদার্য বিশ্বমানবতাকে বিস্ময়াভিভূত ও আপ্লুত করেছে। জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরের হাইকমিশনার ফিলিপ্পো গ্র্যান্ডি নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়ানোয় বাংলাদেশ সরকার ও জনগণকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেছেন, ‘বিভিন্ন দেশ শরণার্থীদের আশ্রয় দেয় না। বরং কোনো শরণার্থী যাতে ঢুকতে না পারে, সে জন্য সীমান্ত সিলগালা করে দেয়। সেখানে বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের প্রাণ বাঁচাতে এ পর্যন্ত ছয়-সাতবার সীমান্ত খুলে দিয়েছে। বাংলাদেশের সরকার ও জনগণ তাদের প্রতি যে আতিথেয়তা দেখিয়েছে, তাতে আমি আন্তরিকভাবে শেখ হাসিনা ও বাংলাদেশকে ধন্যবাদ জানাই।’

বিস্ময়কর হলেও সত্য, পাশাপাশি দেশ ভারতবর্ষ পৃথিবীর বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ হলেও কোনোভাবেই রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রবেশের সুযোগ দিচ্ছে না। মাত্র ২৬ জন রোহিঙ্গা মুসলিম পশ্চিমবঙ্গে প্রবেশ করলে পশ্চিমবঙ্গ-রাজ্য সরকারের ওপর নরেন্দ্র মোদির কেন্দ্রীয় সরকারের যে চাপ তা অবলোকন করে মনে এই সংশয়েরও সৃষ্টি হতে পারে চরম মুসলিম-বিদ্বেষী নরেন্দ্র মোদি মিয়ানমারে সফরে গিয়ে সু চিকে কী মন্ত্রণাই না দিয়ে এলেন! হতে পারে মুসলিম রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে মিয়ানমার থেকে এবারই চূড়ান্তভাবে বহিষ্কার করার পরিকল্পনা গৃহীত হয়েছে এবং এতে নরেন্দ্র মোদির প্রত্যক্ষ সম্মতিসূচক ইঙ্গিত রয়েছে। ১৯৬০ সালে যে পরিকল্পনার সূচনা ২০১৭-তে এসে সেটিরই বোধহয় চূড়ান্ত বাস্তবায়ন হতে চলেছে। বাংলাদেশ সরকার ও প্রান্তিক জনতা আকাশের মতো উদারচিত্ত, সাগরের ঊর্মিমালার মতো উদ্বেলিত হূদয় নিয়ে খাদ্যবস্ত্র, চিকিৎসা ও সাময়িক আশ্রয় দিতে পারে কিন্তু তাদের স্থায়ী ঠিকানা তো মিয়ানমারই। মিয়ানমারে সসম্মানে পূর্ণ নাগরিক অধিকারে তাদের প্রতিষ্ঠা করা শুধু বিশ্বের মুসলিম উম্মাহর নয়, সারা বিশ্বেরই নৈতিক দায়িত্ব হচ্ছে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে নিজ ভূমিতে ফিরিয়ে নিতে সে দেশের সামরিক বাহিনী ও তার তল্পিবাহক অং সান সু চিকে বাধ্য করা। এর জন্য অর্থনৈতিক অবরোধ ও কূটনৈতিকভাবে মিয়ানমারকে একঘরে করার মতো কঠোর থেকে কঠোরতম পদক্ষেপ গ্রহণ করার সময় অতিদ্রুত পেরিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা জাতিসংঘে দাঁড়িয়ে যে পাঁচটি দফা তুলে ধরেছেন, নিরাপত্তা পরিষদের মাধ্যমে সেটাকে অবশ্যই বাস্তবায়িত করতে হবে। তা না হলে জাতিসংঘের ওপর পৃথিবীর নিষ্পেষিত জনতার আস্থা সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত হবে। এই ঠুঁটো জগন্নাথ প্রতিষ্ঠানটি রাখার প্রয়োজনীয়তাই পৃথিবীর প্রান্তিক জনতার হৃদয় থেকে মুছে যাবে। যেটি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের চেয়েও ভয়ঙ্কর হবে। এই বিপর্যয়ের হাত থেকে জাতিসংঘকে রক্ষা করার তাগিদ জাতিসংঘের মোড়লরা অবশ্যই অনুভব করছেন এবং ত্বরিত ব্যবস্থা গ্রহণের কথাও ভাবছেন বলেই আমি মনে করি।

জনসংখ্যার দিক থেকে পৃথিবীর সপ্তম দেশ আমাদের প্রাণের বাংলাদেশ আয়তনের দিক থেকে মাত্র ৫৬ হাজার বর্গমাইলের ক্ষুদ্র পরিসর হলেও আমরা সাধ্যমতো সব কিছু করেছি, করবও ইনশাল্লাহ। কিন্তু রোহিঙ্গাদের স্বকীয় স্বাধীনতার সৌকর্যে তাদের মাতৃভূমিতে প্রতিস্থাপিত করা বাংলাদেশের একার পক্ষে সম্ভব নয়। বিশ্বে যারা মোড়লি করেন তাদের সম্মিলিত প্রয়াসে কেবলমাত্র এটি সম্ভব। এ জন্য অর্থনৈতিক অবরোধসহ, রাজনৈতিক সর্বোচ্চ চাপ প্রয়োগের মাধ্যমেই এটি অবশ্যই বাস্তবায়ন করতে হবে এবং এটি অত্যাবশ্যকীয়। জাতিসংঘকে শুধু সহানুভূতির বাণী ও সাহায্য-সহযোগিতা প্রদানের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেই চলবে না। বরং কফি আনান কমিশনের পর্যবেক্ষণের আঙ্গিকে তাদের দেওয়া সুপারিশগুলো বাস্তবায়িত করার জন্য নিরাপত্তা পরিষদকে প্রত্যয়-দৃঢ় সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং আশু পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রসঙ্গটির বিস্তারিত বিশ্লেষণে কলেবর বৃদ্ধি না করে শেখ হাসিনার মানসপটে অন্তর্নিহিত নোবেল প্রাপ্তির যে আকাঙ্ক্ষা (জনশ্রুতি আছে), রোহিঙ্গা প্রসঙ্গে তার সুদৃঢ় ভূমিকা সেই নোবেল প্রাপ্তির পথকে হয়তো কিছুটা প্রশস্ত করলেও করতে পারে। এখানে শেখ হাসিনার স্কন্ধে একটা বিরাট দায়িত্ব, এটা উপলব্ধি করেই হয়তো প্রথমে সব গণমাধ্যম ও গণসংযোগে তিনি বার বার উচ্চারণ করছেন—সব দলের অংশগ্রহণে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটা নির্বাচন, যাতে সব মানুষ নির্ভয়ে ভোটাধিকার প্রয়োগ করে তাদের পছন্দের সরকার গঠন করতে পারে, তার জন্য সব পদক্ষেপ তিনি গ্রহণ করবেন। এটি কথার কথা কি-না বলতে পারব না। তিনি বলেছেন— এর কারণে তিনি যদি সরকার গঠন করতে নাও পারেন, তবুও নিরপেক্ষ এবং সর্বজনগ্রাহ্য নির্বাচন করতে তিনি বদ্ধপরিকর। আমি গণতন্ত্রের একনিষ্ঠ প্রত্যাশী বলেই, শেখ হাসিনার এই উক্তিকে হালকাভাবে নেব না, কটাক্ষ করেও বলব না— ‘একি কথা শুনি আজ মন্থরার মুখে।’

সত্যি কথা বলতে কী, দেশ আজ সর্বস্তরেই মৌলিক অধিকার বিবর্জিত। শুধু ঈশান কোণে নয়, বাংলার দিগন্ত বিস্তৃত্ব আকাশজুড়েই ঘনকালো মেঘের ঘনঘটা। শুধু একদলীয়ই নয়, এক ব্যক্তির শাসনে প্রশাসন, বিচারিক ব্যবস্থা, সংসদ, সংগঠন সবই আজ বিপর্যস্ত। সত্যিকার অর্থে বিরোধী দলের অস্তিত্ব আজ প্রায় নিঃশেষিত। তথাকথিত প্রধান বিরোধী দল বিএনপির কর্মকাণ্ড সংবাদ সম্মেলন ও চেয়ারপারসনের কার্যালয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে এসেছে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বয়কটের অবস্থান জানিয়ে তারা নির্বাচন প্রতিরোধ বা প্রতিহত তো করতে পারেইনি বরং জ্বালাও-পোড়াও, পেট্রলবোমা, বাসে আগুন— ইত্যাদি ভ্রান্ত কর্মসূচির কারণে দলটি অনেকখানি জনসমর্থন হারিয়েছে। ত্যাগী কর্মীর অভাবে অসহযোগ, অহিংস আন্দোলনের প্রত্যয়-দৃঢ় পদচারণায় ব্যর্থ বিএনপি নখদন্তহীন পিঞ্জিরাবদ্ধ বাঘের মতো শুধু ব্যর্থ তর্জন-গর্জনই করেছে। আমি বার বার বলেছি, আজও বলি, প্রশাসনে দলীয়করণ ও দুর্নীতির যে রোবটটি হাওয়া ভবন থেকে বেরিয়ে এসেছিল সেটি আজ ভয়াবহ জীবন্ত দানব। যার ভয়াল ও করালগ্রাসে প্রশাসনের নিরপেক্ষতা সম্পূর্ণ বিলুপ্ত, বিচার ব্যবস্থাও অভিশংসন আইনের জাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে মুমূর্ষু প্রায়; সংসদ তো স্তুতি অর্চনা, বন্দনা, মোসাহেবি ও তোষামোদির পীঠস্থান।

বাংলার প্রান্তিক জনতা আজ হতবাক, নিস্তব্ধ ও নিষ্পৃহ প্রায়। ১৯৫২ থেকে শুরু করে ’৭১ পর্যন্ত এ দেশের সব রাজনৈতিক আন্দোলনের উত্তরাধিকার ছাত্রসমাজের মুখপাত্র ছাত্রলীগ আজ মৃতপ্রায়ই শুধু নয়, মূল্যবোধের অবক্ষয়ের অতলান্তে নিমজ্জিত। সংবাদ মাধ্যম ও সাংবাদিকরাও আজ বিভাজিত। এই বিভাজন ও সুবিধাপ্রাপ্তির মানসিকতা তাদের ক্ষুরধার লেখনীকে দুটি মহিলার অনুকম্পা লাভের আকুতি প্রাপ্তির রম্য ভাবনায় অধিক নেশাগ্রস্ত করে তুলেছে। মরহুম মানিক মিয়া, শহীদ সিরাজুদ্দীন হোসেনের মতো আজকের সাংবাদিকরা প্রান্তিক জনতার মুখপাত্র নন। বরং ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করা ও ক্ষমতা দখল করা যে গতানুগতিক রাজনীতি, সেই স্রোতেই গা ভাসিয়েছেন। সংসদের আইন প্রণয়নের ক্ষমতা কতখানি এবং জনগণের অধিকারের বিরুদ্ধে ’৭২-এর শাসনতন্ত্রে প্রদত্ত মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী কোনো আইন সংসদ করতে পারে না— উল্লেখ করে প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার নেতৃত্বে আপিল বিভাগের সব মহামান্য বিচারপতির সমন্বয়ে সর্বসম্মত রায় এই ঘনঘোর অমানিশার মুহূর্তে যে আশার আলোকবর্তিকা দেখিয়েছিল সেখান থেকে মহামান্য আদালতের কিছুটা পিছটান এ দেশের জনগণকে ব্যাপকভাবে নিরাশ ও নিরুৎসাহিত করেছে, হতাশ ও হতবাক করেছে; তাদের উদ্ভাসিত চেতনাকে ম্রিয়মাণ ও নিষ্প্রভ করেছে।

বিএনপি এমনিতেই লক্ষ্যভ্রষ্ট, ক্ষমতাশ্রিত, সাহসী ও ত্যাগী কর্মী-বিবর্জিত সুবিধাবাদী নেতাসর্বস্ব একটি রাজনৈতিক দল। তারা এই তিন বছরে দৃষ্টিগ্রাহ্য ও ফলপ্রসূ কোনো গণআন্দোলন সৃষ্টি করতে পারেনি। এ ব্যাপারে তাদের সুহূদদের প্রশ্নের উত্তরে তারা সবসময় একই কথা বলেন, সরকার তাদের আন্দোলনের জন্য রাস্তায় নামতেই দিচ্ছে না। তাদের সুহূদরা এই উত্তরে কতখানি তুষ্ট আমি জানি না। কিন্তু গণতন্ত্রের পথপরিক্রমণের একজন সারথী হিসেবে তাদের আমার পাল্টা প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে, ২৩ বছরের পাকিস্তানি শাসনামলে আমাদের সারাটা পথ কি কুসুমাস্তীর্ণ ছিল? নির্যাতন, নিপীড়ন-নিগ্রহের শিকার কি আমাদের হতে হয়নি? দিনের পর দিন, বছরের পর বছর আমাদের জীবন কি কারাগারের অন্ধ প্রকোষ্ঠে কাটেনি? আমাদের নেতা স্বাধীনতার স্থপতিকে কি মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে জীবনের জয়গান গাইতে হয়নি? তার বিশ্বস্ত অনুচর হিসেবে আমার মতো ক্ষুদ্র কর্মীকেও দীর্ঘ কারারুদ্ধ জীবনের একটি পর্যায়ে মৃত্যুপথযাত্রী মায়ের অন্তর্ভেদী আকুতি সত্ত্বেও পেরোল না পেয়ে কারাগারের অন্ধ প্রকোষ্ঠে চোখের জলে বুক ভাসাতে হয়নি? এমনিতেই বিনা ত্যাগ ও তিতিক্ষায় এই বাংলার সমগ্র জনতা একটি মিলনের মোহনায় ঐক্যের মূর্ছনা তুলে ’৭০-এর নির্বাচনে নিরঙ্কুশ ম্যান্ডেট দিয়েছিল? এমনিতেই কি বাংলার প্রান্তিক জনতা ২৫ মার্চের আক্রমণের পর আগ্নেয়গিরির গলিত লাভার মতো প্রজ্বলিত হয়েছিল? তখনকার বাংলার সাড়ে ৭ কোটি মানুষের অনুভূতিকে কতটুকু অনুপ্রাণিত করতে পারলে ২৫ মার্চের পৈশাচিক সামরিক আক্রমণকে প্রতিহত ও প্রতিরোধ করে ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধে বিশাল জনগোষ্ঠীর অংশীদারিত্বে পরাধীনতার বক্ষ বিদীর্ণ করে স্বাধীনতার সূর্যকে ছিনিয়ে আনতে সক্ষম হলো, আজকের বিএনপির ক্ষমতাশ্রয়ী নেতারা সেই রক্তস্নাত ইতিহাস থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখবেন?

এমনিতেই তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি দাঁড় করাতে অক্ষম হয়ে অনেকটা ছাড় দিয়ে এখন সমঝোতার সরকারের দাবি করছেন। পক্ষান্তরে স্তব্ধ হয়ে যাওয়া আন্দোলনের সুযোগ নিয়ে শেখ হাসিনা কঠোর হতে কঠোরতর হচ্ছেন, ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ ও উপহাস করছেন এবং রাজনীতিতে তার নিজের কথাকেই শেষ কথা ভাবতে বদ্ধপরিকর হচ্ছেন। কিন্তু তার অজান্তেই এই চেতনা তাকে কী ভয়াবহ বিপর্যয়ের দিকে টেনে নিচ্ছে তা নিরূপণ তো দূরে থাক, উপলব্ধি করারই যেন তার সময় নেই! স্তুতি, বন্দনা-অর্চনার সুরলহরী তার কর্ণকুহরে অনবরত সুধা ঢালছে। ফলশ্রুতিতে তিনি একটা উন্মাদনার নেশায় বুঁদ হয়ে যাচ্ছেন। ভ্রান্ত বাম ও মোসাহেব চাটুকাররা একদিকে, অন্যদিকে ভয়ঙ্কর দুর্নীতিবাজ সমাজের সমস্ত সম্পদ লুণ্ঠনকারী তস্করেরা আজ এতটাই ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে যে, দেশের অর্থনৈতিক পাদপীঠে তারা উন্মত্ত নৃত্য করছেন। থামাবার কেউ নেই তো বটেই, এতটুকু টুঁ-শব্দটিও কেউ করছেন না। দেশের প্রান্তিক জনতা সবকিছুতেই আজ কেমন যেন নির্জীব। দুর্নীতি, দুুর্বিচার ও সব অন্যায়ে তারা যেন নীরব, নির্বাক, নির্লিপ্ত দর্শক। কিন্তু এই বাংলার প্রান্তিক জনতাই স্বাধীনতার পথপরিক্রমণে বঙ্গবন্ধুর শক্তির উৎস ছিল এবং বাংলার জাগ্রত ছাত্রসমাজের মুখপাত্র ছাত্রলীগ এই জনগণকে জাগ্রত ও একত্রিত করার অগ্রদূত ছিল। তাদের নিরলস, নিষ্কলুষ, নিঃস্বার্থ স্বাধীনতাকামী মানসিকতা এ দেশের সমগ্র জনগোষ্ঠীকে উদ্বেলিত করেছিল, উচ্ছ্বসিত করেছিল, জাগ্রত করেছিল, স্বাধীনতা অর্জনের অগ্নিঝরা শপথে উজ্জীবিত করেছিল। বন্দুকের নল নয়, বিদেশি কোনো পরাশক্তির আশীর্বাদ নয়, এমনকি প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে স্বাধীনতা-পূর্ব সময়ে কোনো যোগসাজশ না রেখে আল্লাহর ওপর বিশ্বাস রেখে প্রান্তিক জনতাকে সেদিন আমরা স্বাধীনতা-সংগ্রামে টেনে আনতে পেরেছিলাম বলেই দেশটি স্বাধীন হয়েছে, পরাধীনতার বক্ষ বিদীর্ণ করা সম্ভব হয়েছে। তবুও আমি আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে বিনম্র চিত্তে জবানবন্দি দিতে চাই— স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে প্রান্তিক জনতার সেই ঐক্যকে আমরা ধরে রাখতে পারিনি, গণতন্ত্রকেও রক্ষা করতে পারিনি। গণবাহিনী ও সিরাজ শিকদার, হক, তোহা, টিপু বিশ্বাসের সশস্ত্র আক্রমণের মুখে দেশের মানুষই কেবল বিপর্যস্ত হয়নি, বঙ্গবন্ধুও বিভ্রান্ত হয়েছেন। সংসদের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে বাকশাল কায়েম করেছেন। একটা কুটিল ষড়যন্ত্রের ফাঁদে পা দিয়ে তার চিরায়ত গণতান্ত্রিক ধারা থেকে সরে এসে যখন তিনি বাকশাল গঠন করলেন, তখনই যেন সব কিছু ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল। তার আওয়ামী লীগ সাংগঠনিক শক্তি হারাল, তার ছাত্রলীগ মূল আদর্শ থেকে ছিটকে পড়ে মুমূর্ষুপ্রায় হয়ে গেল। সমস্ত ক্ষেত্রেই যেন বঙ্গবন্ধুর প্রভাব কমে আসতে লাগল। একটি সামরিক অভ্যুত্থান নয়, ২৬ জন পথভ্রষ্ট সামরিক দুরাচারের নিষ্ঠুর ষড়যন্ত্রের আঘাতে আমরা বঙ্গবন্ধুকে হারালাম। স্বাধীনতা নিষ্প্রভ হলো—গণতন্ত্রও মরীচিকায় রূপ নিল। বুকের রক্তে অর্জিত স্বাধীন দেশে নিজেরাই পরবাসী হয়ে প্রান্তিক জনতা আজ খুঁজছে তাদের হারিয়ে যাওয়া গৌরবকে।

মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনে সফলতার পাশাপাশি বাংলাদেশের নাগরিকদের মৌলিক অধিকারকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে সবার অংশগ্রহণে সর্বজন-স্বীকৃত একটি নির্বাচন অনুষ্ঠান করাই আজ জাতীয় কর্তব্য। এই সাফল্য অর্জন করতে হলে কোনো ষড়যন্ত্র বা কুটিল পথ নয়, প্রান্তিক জনতাকে ঐক্যবদ্ধ করার মাধ্যমেই একটি নিরপেক্ষ নির্বাচনের উদ্যোগ নেওয়া উচিত। সর্বস্তরের রাজনৈতিক ঐক্য, নিষ্কলুষ প্রচেষ্টা ও নির্মোহ মানসিকতা প্রান্তিক জনতাকে আবার সরব করে তুলতে পারে বলেই আমার বিশ্বাস।

বিএনপির ক্ষমতাধর কোনো এক নেতার ব্যক্তিগত উক্তি, শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় রেখে নির্বাচনে বিজয়ী হওয়া আওয়ামী লীগ জোট ছাড়া আর কারও পক্ষেই সম্ভব না। তাই এবারও বিএনপির নির্বাচনে অংশ না নেওয়াই শ্রেয়। অনর্থক নির্বাচন নামক প্রহসনে অংশ নিয়ে শেখ হাসিনাকে বৈধতা প্রদানের প্রয়োজন কি! আমি তাকে সবিনয়ে বোঝানোর চেষ্টা করেছি, নির্বাচন বয়কট বা বর্জন তখনই ফলপ্রসূ হয়, যখন একটি সফল ও সার্থক গণআন্দোলন তৈরি করার শক্তি বিরোধী রাজনৈতিক মহলের থাকে। সেই প্রশ্নে বিএনপি তো দৃশ্যত দেউলিয়া। সে ক্ষেত্রে নির্বাচনে অংশ নিলে গণতান্ত্রিক পরিবেশ যত শ্বাসরুদ্ধকরই হোক না কেন, বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট একটা উল্লেখযোগ্য-সংখ্যক সংসদ সদস্য অবশ্যই পাবে। যার মাধ্যমে সংসদের ভিতরে ও বাইরে যুগপৎ আন্দোলন করা তাদের পক্ষে সম্ভব হবে।  অন্যদিকে, নির্বাচন বর্জন তাদের জন্য আত্মঘাতী এবং দেশের জন্য চরম বিপর্যয় ডেকে আনবে। এ ক্ষেত্রে শেখ হাসিনাকেও ক্ষমতার নেশায় বুঁদ না থেকে একনায়কতান্ত্রিকতার করুণ পরিণতির কথা ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে আগামী নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও অবাধ করার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।  সেটি জাতীয় বিপর্যয় রোধ করবে এবং তার নিজের জন্যও হবে কল্যাণকর।

লেখক : স্বাধীন বাংলা ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের অন্যতম নেতা।

সর্বশেষ খবর