শনিবার, ৪ নভেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা
ধর্মতত্ত্ব

হূদয়ের চোখে হেমন্ত দর্শন

মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী

হূদয়ের চোখে হেমন্ত দর্শন

বলা হয়, আমাদের আল্লাহ নিরাকার। তাঁকে নাকি দেখা যায় না। আসলে কথাটি সম্পূর্ণ সঠিক নয়। হূদয়ের চোখ থাকলেই আল্লাহকে দেখা যায়। হূদয় মেললেই তাঁকে পাওয়া যায়। আল্লাহ মানুষের এত কাছে যে, তিনি নিজেই বলেছেন, ‘নাহনু আকরাবু ইলাইহি মিন হাবলিল ওয়ারিদ’। ‘আমি তো তোমার ঘাড়ের শাহ রগের চেয়েও বেশি কাছে।’ এত কাছে, তবুও তাঁকে দেখি না। দেখার চেষ্টাও করি না। সূর্য তো সবাই দেখে, কিন্তু যে বাদুড় আলোর ভয়ে কালো গর্তে পালিয়ে থাকে, তার চোখে কি আর সূর্য ধরা পড়ে? চাঁদ তো সবাই দেখে, জোছনার আলোয় মধুর স্নানও করে; কিন্তু যে অন্ধ কোনো ঘরে আবদ্ধ, সে কি আর চাঁদের মায়াবী রূপ দেখতে পারে? তেমনি আমাদের আল্লাহ নিরাকার নন, তিনি সবকিছুর মাঝে বিরাজমান। তাঁর রূপ-রং-মাধুর্য সৃষ্টিব্যাপী ছড়ানো। আলো ঝলমলে দিনে যেমন তাকে দেখা যায় হূদয়ের চোখ মেলে রাতের ঘুটঘুটে আঁধারেও তাঁকে বোঝা যায় স্পষ্টভাবে। প্রয়োজন শুধু হূদয়ের চোখ মেলে তাকানোর। অন্তরের চোখ খুলে দেখা। এই একটি বিষয়েই আমাদের ঘাটতি থেকে যায়।

স্রষ্টাকে দেখতে পাওয়া যায় তাঁর সৃষ্টির মাঝে। সৃষ্টিবৈচিত্র্যের মাঝেই লুকিয়ে আছে স্রষ্টার পরিচয়। তাই তো বার বার আল্লাহতায়ালা বান্দাকে আহ্বান করেছেন, ‘বান্দা! চোখ মেলো। আমার সৃষ্টিরাজির প্রতি তাকাও। দেখো তো আমার সৃষ্টিতে কোনো খুঁত আছে কিনা? আবার তাকাও। বার বার তাকাও। তাকাতে থাকো। প্রাণভরে, মনভরে দেখো। দেখতে দেখতে তোমার দৃষ্টি ক্লান্ত হয়ে যাবে, কিন্তু আমার সৃষ্টির কোনো ত্রুটি তোমার চোখে পড়বে না।’ (সূরা মুলক : ৪-৫)। আল্লাহ আরও বলেন, ‘সিরু ফিল আরদ’। বান্দা! এই পৃথিবীতে, ওই আকাশে সব জায়গায় ভ্রমণ কর। চষে বেড়াও বিশ্বচরাচর। এভাবেই একদিন তুমি অদেখাকে দেখতে পাবে, অধরাকে ধরতে পারবে। না-দেখা প্রভুকে দেখা যায় তাঁর সৃষ্টির রঙে। খোদার সৃষ্টির মনকাড়া রং নিয়ে আমাদের মাঝে এসেছে রঙিন ঋতু হেমন্ত। ষড়ঋতুর চতুর্থ ঋতু এটি। কার্তিক ও অগ্রহায়ণ এ দুই মাস নিয়ে হেমন্তকাল। ‘কৃত্তিকা’ ও ‘আগ্রা’ তারার নামানুসারে কার্তিক ও অগ্রহায়ণ নামকরণ করা হয়েছে। ঋতুচক্রের পালাবদলে হেমন্ত তার আগমনী বার্তা দিতে থাকে শরতের শেষে। এ সময় মেঘ-বৃষ্টিতে ছাওয়া উন্মাতাল দিনগুলোর ভিতর হেমন্ত তার সম্ভাব্য আগামী বার্তা মেলে ধরে। শরতের কাশবনেরা যখন মাথা উঁচু করে অসীম বীরত্ব দেখায়, তখন ধূসর মেঘে ভর করে হিম হিম কুয়াশা কিংবা মিষ্টিমধুর পেলব রোদের ভিতর। হেমন্ত শরৎ থেকে খুব পৃথক নয়, শীত থেকেও তেমন বিচ্ছিন্ন নয়, শীত-শরতের মাখামাখি এক স্নিগ্ধ সুন্দর ঋতু এটি। হেমন্তের পরই আসে শীত, তাই হেমন্তকে বলা হয় শীতের পূর্বাভাস। কবির ভাষায়—

‘হিম কুয়াশার সাদা আবরণ গায়ে

আসে হেমন্ত শিশির সিক্ত পায়ে

সোনালি রোদের ঝিলিক ছড়িয়ে পড়ে

লতাপাতা, ঘাসে নিশির শিশির ঝরে।’

হেমন্ত মানেই শিশিরস্নাত প্রহর। হেমন্তের সকালে আবছা কুয়াশায় ঢাকা থাকে চারদিকের মাঠঘাট। কখন কোথা থেকে শিশির এসে ঘাসের ডগায় গাছের পাতায় মুক্তোর মালা পরিয়ে দিয়ে যায় তা কেউ জানে না। সকালের প্রথম রোদের বর্ণচ্ছটায় গাছের পাতাগুলো যেন চিকচিক করে হেসে ওঠে। দৃষ্টিসীমা যতদূর গিয়ে পৌঁছে দেখা যায়, আলোকোজ্জ্বল অপূর্ব একটি সকাল তার অভাবনীয় সৌন্দর্য নিয়ে যেন অপেক্ষমাণ। আর সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গেই প্রকৃতিকে কাঁদিয়ে কোন সুদূরে মিলিয়ে যায় তাও মানুষের দৃষ্টির বাইরে। এ এক অবাক করা রহস্যও বটে। হেমন্তে দেখা যায় অখণ্ড নীল আকাশ। মিষ্টি সোনারোদ। হেমন্তের মেঘমুক্ত আকাশে রাতের জোছনার আলো অন্য সময়ের তুলনায় একটু বেশিই ফুটে ওঠে। এ সময় রাতের পথে, ঘাটে, বনে, বাদাড়ে জোছনার আলো ঠিকরে পড়ে। দেখে মনে হয় যেন চাঁদের শরীর থেকে মোমের মতো গলে গলে জোছনা পড়ছে। জোছনার এমন মোহনীয় রূপ মন কাড়বে ভাবুক হূদয়ে। অন্যান্য ঋতুর মতো প্রকৃতি রাঙাতে হেমন্তেও নানান রঙের ফুল ফোটে। অনিন্দ্যসুন্দর শিউলি, কামিনী, গন্ধরাজ, মল্লিকা, দেবকাঞ্চন, হিমঝুরি, ধারমার, রাজঅশোক ইত্যাদি হেমন্তের ফুল।

প্রকৃতির এতসব রূপ-মাধুর্য আমাদের হূদয়ের জানালা খুলে দেয়। ভাবতে অবাক লাগে আল্লাহ আপন তুলিতে এত সুন্দর করে আমাদের এই পৃথিবী সাজিয়েছেন। কেন সাজালেন? কী জন্য গড়লেন এই রূপনগরী? তাঁর ভাষায় শুনুন দিলের কান খুলে— ‘নিশ্চয়ই, এসব সৃষ্টিরাজির মধ্যে জ্ঞানীদের জন্য রয়েছে অনুপম নিদর্শন।’ (সূরা নাহল : ১২)। তাই আসুন! আমরা প্রকৃতি নিয়ে ভাবী। প্রকৃতির রং মেখে হূদয়ের চোখ পরিচ্ছন্ন করি। হে আল্লাহ! আমাদের হূদয় দৃষ্টি খুলে দিন।

লেখক : বিশিষ্ট মুফাসসিরে কোরআন ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব।

www.selimazadi.com

 

সর্বশেষ খবর