সোমবার, ৬ নভেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

নীল তিমি রহস্য!

সাইফুর রহমান

নীল তিমি রহস্য!

এক. ইংরেজি সাহিত্যে যদি শ্রেষ্ঠ ২০টি উপন্যাসের একটি তালিকা প্রস্তুত করা হয় তবে হারমান মেলভিল রচিত ‘মবিডিক’ উপন্যাসটি নিঃসন্দেহে স্থান করে নেবে সে তালিকায়। উপন্যাসটির উপজীব্য হচ্ছে- ভয়ঙ্কর ও দম বন্ধ করা রোমাঞ্চকর সমুদ্রগামী তিমি শিকারিদের বিচিত্র জীবন। সেই সঙ্গে লেখক এখানে ঘটিয়েছেন মবিডিক নামক বিশালাকার তিমির অপরাজেয় মনস্তাত্ত্বিক আচরণ ও মনোভঙ্গির শৈল্পিক চিত্রায়ন। মবিডিক উপন্যাসটি ছাপা হয় ১৮৫১ সালে। ছাপা হওয়ার আগে মেলভিল তিন তিনটি উপন্যাস লিখলেও মবিডিকই তাকে কালজয়ী লেখকদের আসনে বসিয়ে দেয়। মবিডিক উপন্যাসটি শুরু হয়েছে এভাবে- ‘আমাকে তোমরা ইসমাইল বলে ডেকো’। কালজয়ী একটি উপন্যাসের কি সাবলীল ও স্বাচ্ছন্দ্যময় শুরু। কে এই ইসমাইল। আমরা হারমান মেলভিলের জীবনী পড়ে থাকলে কিন্তু অনায়াসে বলে দিতে পারি। এই ইসমাইল হচ্ছেন স্বয়ং লেখক। যিনি কথক সেজে সমস্ত সময় জুড়ে আমাদের কাহিনীটি শুনাবেন। কারণ তিমি শিকারের অভিযান শেষে তিনি ছাড়া জাহাজের আর কেউ বেঁচে ছিলেন না যে কিনা কাহিনীটা শুনাতে পারে আমাদের।

হারমান মেলভিলের জন্ম ১৮১৯ সালে আমেরিকার নিউইয়র্ক শহরে। ১৮৩২ সালে দেউলিয়া পিতার মৃত্যুর পর মেলভিলকে বেঁচে থাকার তাগিদে জড়িয়ে পড়তে হয় বিচিত্র সব পেশায়। তারই ধারাবাহিকতায় ১৮৩৯ সাল থেকে টানা তিন-চার বছর তিনি তিমি শিকারি জাহাজে ঘুরে বেড়ান এক মহাসাগর থেকে অন্য মহাসাগরে। তাঁর এই বিচিত্র অভিজ্ঞতার ফসলই হচ্ছে প্রবাদপ্রতিম মবিডিক উপন্যাস।

তরুণ ইসমাইল আজব ও মজার সব জায়গা দেখার অভিলাসে চাকরি জুটিয়ে নিলেন পিকোড নামের একটি তিমি শিকারি জাহাজে। জাহাজের ক্যাপ্টেনের নাম আহাব। ক্যাপ্টেন আহাবের একজন সহকারীও আছেন যার নাম ফেদাল্লাহ। যিনি আহাবের প্রধান পরামর্শদাতা। এক কুয়াশাচ্ছন্ন ভোরে আমেরিকার ম্যাসাচুসেটস থেকে পিকোড জাহাজটি রওনা হলো তিমি শিকারের উদ্দেশে। কৌতূহলী পাঠক-পাঠিকাদের মনে হয়তো প্রশ্ন জাগতে পারে, তিমি শিকারের উদ্দেশ্য কী? তিমির শরীর থেকে তেল আহরণের জন্যই তিমি শিকার করা হতো। তিমির দেহের ‘ব্লাবার’ নামের চর্বির স্তর কেটে বড় বড় পাত্রে এসব চর্বি সিদ্ধ করে গলানো হতো। এক একটা তিমি থেকে কম করে হলেও ৫০ টন তেল হয়। তিমির তেল অনেক কাজে লাগে। তবে বাড়িতে আলো জ্বালাতেই এ তেল বেশি ব্যবহৃত হয়। একটি জিনিস বুঝতে হবে যে, কেরোসিন আবিষ্কার করেন কানাডিয়ান আবিষ্কারক আব্রাহাম গ্যাসনার ১৮৫৪ সালে। এর আগ পর্যন্ত ঘরদোরের আলো জ্বালাতে ইউরোপ কিংবা আমেরিকায় তিমির তেলই ছিল সম্বল। আমাদের দেশে তখন অবশ্য ব্যবহৃত হতো রেড়ির তেল। ভেনলা নামক এক প্রকার ফল থেকে তৈরি হয় এই তেল। রবীন্দ্রনাথ অবশ্য রেড়ির তেল দিয়ে পরাটাও ভেজে খেতেন। মধ্য প্রাচ্যে ও চিনে তেলের ব্যবহার শুরু হয়েছিল এখন থেকে দু-তিন হাজার বছর আগ থেকেই। পায়ের গোড়ালি দিয়ে মাটিতে আঘাত করলে যেখানে তেল পাওয়া যায়, সেখানে তেলের ব্যবহার শুরু হবে হাজার বছর আগে। সেটাই তো স্বাভাবিক। সে যা হোক জাহাজটি বন্দর ছাড়ার দু-এক দিনের মধ্যেই ইসমাইলের ভুল ভাঙল। বিশেষ করে তিনি যেদিন স্বচক্ষে ক্যাপ্টেন আহাবকে দেখলেন। একটি পা-বিহীন আহাব দাঁড়িয়ে আছেন জাহাজের ডেকে। নকল পা-টা দেখে শরীরের রোম দাঁড়িয়ে গিয়েছিল ইসমাইলের। নকল পা-টা তৈরি করা হয়েছে স্পার্ম নামক তিমির শক্ত চোয়াল নিখুঁতভাবে কেটে। সেদিনই ইসমাইল জানতে পারলেন তিমি শিকারের ছদ্মবেশে আহাব আসলে খুঁজে বেড়াচ্ছেন মবিডিক নামক দুর্ধর্ষ সেই তিমি মাছকে। সে মাছটি নাকি কিছুকাল আগে কেড়ে নিয়েছে আহাবের একটি পা। আহাবের চোখে মুখে প্রতিশোধের আগুন। কোথায় পাওয়া যাবে মবিডিককে জানা নেই। কিন্তু প্রত্যেকটি সাগর-মহাসাগর তিনি চষে বেড়াবেন এই মাছটিকে খুঁজতে। এভাবে দিনের পর দিন তিমিটিকে অনুসরণ করে সব মহাদেশ চক্কর দিতে লাগল পিকোড। শেষে চীন সাগরের সন্দা প্রণালী দিয়ে ঢুকে জাহাজটি জাভা ও সুমাত্রা দ্বীপের মাঝখান দিয়ে এগিয়ে যায় সামনের দিকে। অবশেষে মবিডিককে খুঁজে পাওয়া গেল জাপান সাগরে। কিন্তু ভাগ্যের এমনই পরিহাস, জাহাজের সমস্ত মাঝিমাল্লা, দাপুটে ও দক্ষ হারপুনাররাও কেউ মবিডিককে মারতে সক্ষম হলো না। উল্টো মবিডিক- তার সমস্ত শক্তি দিয়ে আঘাত করে সমস্ত জাহাজটিকে ভেঙেচুরে লণ্ডভণ্ড করে দিল। ক্যাপ্টেন আহাব ও মাঝিমাল্লা সমেত জাহাজটি তলিয়ে গেল অতল সাগরে। শুধু জাহাজে রক্ষিত একটি কফিনের ওপর ভেসে, বেঁচে রইলেন ইসমাইল। পিকোড এবং আহাবের কাহিনী বলার জন্য এই পৃথিবীতে শুধুমাত্র ইসমাইল-ই বেঁচে রইলেন। এটা এক নাবিকের এমন এক করুণ কাহিনী, যিনি একটি অতিকায় নিরীহ প্রাণীকে হত্যা করার জন্য পৃথিবীর সব সাগর মহাসাগর চষে বেড়িয়েছিলেন। শেষমেশ নিজেই মারা পড়েন প্রাণীটার আঘাতে। সম্ভবত মবিডিক-ই পরিবেশ-প্রকৃতির ওপর মানুষের হস্তক্ষেপের প্রথম প্রতিবাদ।

দুই. ১১ই সেপ্টেম্বর ১৯১৬ সাল। আমেরিকার টেনেসি প্রদেশের সালিভান নামক অঞ্চলটিতে স্পার্কস ওয়ার্ল্ড নামে একটি দল সার্কাস দেখাচ্ছিল। সেই সার্কাস দলে একটি হাতিও খেলা দেখাত। হাতিটির নাম ‘মেরি’। ওটিকে নিয়ে আসা হয়েছিল এশিয়ার কোনো দেশ থেকে। যে মাহুতটি সাধারণত দীর্ঘদিন ধরে মেরিকে দিয়ে সার্কাস দেখাত হঠাৎ তার চাকরিচ্যুত হওয়ায় সার্কাস কোম্পানি মেরিকে পরিচালিত করার জন্য রেড এন্ডরিজ নামক এক ভবঘুরে ও অদক্ষ লোককে মাহুত হিসেবে নিয়োগ দেন। সে দিনই বিকালে নানা রকম হৃদয়গ্রাহী করসত প্রদর্শনকালে এন্ডরিজ হাতিটিকে নানাভাবে উত্ত্যক্ত করতে থাকে। লাঠির তীক্ষ ডগা দিয়ে মেরির অসুস্থ দাঁতে বারবার আঘাত করার এক পর্যায়ে হাতিটি এন্ডরিজকে লম্বা শুঁড় দিয়ে দশ ফুট ওপরে ছুড়ে দেয়। এন্ডরিজ মাটিতে ভূপাতিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পা দিয়ে তাকে পিষ্ট করে দেয় হাতিটি। গ্যালারিতে উপবিষ্ট হাজার হাজার মানুষের সামনে এমন একটি নির্মম ঘটনার মধ্য দিয়ে এন্ডরিজের মৃত্যুতে উত্তেজিত হয়ে ওঠে জনতা। অথচ তারা বুঝে উঠতেই পারেনি কী কারণে হাতিটি মেরে ফেলল এন্ডরিজকে। তারা মুহুর্মুহু ধ্বনি দিতে থাকে। আমরা হাতির মৃত্যু চাই— মৃত্যু চাই বলে। সঙ্গে সঙ্গে একজন কামার তার বন্দুক থেকে বেশ কয়েক দফা গুলিবর্ষণ করল মেরির ওপর। কিন্তু এতেও মৃত্যু হলো না মেরির।

এদিকে সমস্ত টেনেসিজুড়ে হৈহৈ রব উঠল। নিষিদ্ধ করা হোক এই সার্কাস দলকে। সার্কাস দলের অধিকারী চতুর চার্লি স্পার্কসও দেখলেন কোনোভাবেই জনরোষ থামানো যাবে না। সঙ্গে সঙ্গে তিনি বললেন- উন্মুক্ত স্থানে ফাঁসি দেওয়া হবে মেরিকে। অবশেষে ১৩ সেপ্টেম্বর ১৯১৬ সালে কুয়াশাচ্ছন্ন বৃষ্টিমুখর বিকালে জনসাধারণের সম্মুখে শিল্পাঞ্চলে ব্যবহৃত বিশাল এক ক্রেন দিয়ে ফাঁসিতে ঝুলানো হলো ৪,৫০০ কেজি ওজনের মেরিকে। প্রথম দফায় শেকল ছিঁড়ে মাটিতে আছড়ে পড়ল মেরি। প্রচণ্ড ব্যথায় গগনবিদীর্ণ করে আর্তনাদ করে উঠল হাতিটি। ওর পেছন দিককার হাড়গুলো ভেঙে গুঁড়িয়ে গেল মড়মড় শব্দে। এরকম ভয়ার্ত পরিবেশ দেখে কিছু ছেলে পুলে পালিয়ে গেল ওখান থেকে। অবশেষে দ্বিতীয় দফায় তোলা হলো ক্রেনে। এবার কিন্তু ঠিকই কৃতিত্বের সঙ্গে হত্যা করা গেল নিরীহ অতিবিশালাকার এই প্রাণীটিকে! তিন. উপরোক্ত কাহিনী দুটি এ লেখার সঙ্গে কীভাবে প্রাসঙ্গিক সে বিচারে যাওয়ার আগে কিছু কথা বলে নেওয়া প্রয়োজন। বিগত দু-এক মাস ধরে বাংলাদেশের কিছু মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন ব্লু হোয়েলস নামে নতুন একটি সিনড্রোমে। এটা প্রায় সবারই জানা যে ব্লু হোয়েলস একটি ভার্চুয়াল খেলা এবং এই খেলায় অংশগ্রহণকারীকে পঞ্চাশতম পর্বে যে কোনো একটি পদ্ধতিতে বেছে নিতে হয় আত্মহননের পথ। এই খেলা খেলে বাংলাদেশে এ পর্যন্ত প্রায় অর্ধডজনের মতো মানুষ নাকি মারা গেছে। এ বিপদ উত্তোরণে হিমশৈলের উপরিভাগে ঘোরাফেরা করে কোনো লাভ নেই। ঢুকতে হবে সমস্যার অন্দরমহলে। উঠতি বয়সী তরুণ-তরুণী এই খেলার নাম করে আত্মঘাতী হচ্ছে। সর্বশেষ আত্মহত্যা করল হলিক্রস কলেজের সম্ভাবনাময়ী ও কৃতী ছাত্রী স্বর্ণা নামের মেয়েটি।

এবার উপরোক্ত কাহিনী দুটির প্রাসঙ্গিকতা সম্পর্কে একটু আলোচনা করি। এই যে ক্যাপ্টেন আহাব নিরীহ একটি তিমি মাছকে হত্যার উদ্দেশ্যে এক মহাসাগর থেকে আরেক মহাসাগরে ছুটে বেরিয়ে তাকে হত্যা করতে চাইলেন। এর পেছনে কি কোনো যুক্তি দাঁড় করানো যায়। তিমি মাছটি সত্যি সত্যি কি শত্রুতা করে আহাবের পা খোঁড়া করে দিয়েছিল। সেটা কি আদৌ সম্ভব। আমরা কেউই আহাব কিংবা তিমি মাছটির মনস্তত্ত্ব বুঝতে চাইনি। কিংবা মেরি নামের যে হাতিটি, সেটি কি শুধু শুধুই এন্ডরিজকে পা দিয়ে পিষে মারল। এন্ডরিজ হাতিটিকে ক্রমশ উত্ত্যক্ত করে চূড়ান্ত সীমা অতিক্রম করে যাচ্ছিলেন। হাজার হাজার দর্শকের মধ্য থেকে কেউই কিন্তু সেটা উপলব্ধি করতে সক্ষম হননি। কিংবা হলিক্রস কলেজের সেই মেয়েটি। তার মনোজগতে কি পরিবর্তনের কারণে আচানক তাকে বেছে নিতে হলো আত্মহত্যার মতো এমন কঠিন একটি পথ। আমরা কি কেউ একটি বার ভেবে দেখেছি। না দেখিনি। কারণ, কারও মনোজগৎ নিয়ে ভাববার সময় আমাদের নেই। অথচ পৃথিবীর প্রত্যেকটি প্রাণীই পরিচালিত হয় তার নিজস্ব মনোজগত দ্বারা তাড়িত হয়ে।

এটা হয়তো অনেকেরই জানা যে ব্লু হোয়েলস খেলাটির জন্ম রাশিয়ায়। ফিলিপ বুদেকিন নামক একুশ বছরের এক যুবক এই খেলাটির উদ্ভাবক। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার হওয়া মনোবিজ্ঞানের এই ছাত্র এই গেইমটি উদ্ভাবন করেছেন এ কারণে যে, তার এই খেলাটি খেলে দুর্বল, হতাশাগ্রস্ত, অপ্রয়োজনীয় ও আবর্জনা তুল্য মানুষগুলো যেন অপসৃত হয়ে যায় সমাজ থেকে। কী নির্মম ও নিষ্ঠুর চিন্তাভাবনা একজন মানুষের। আর ব্লু হোয়েলস নামটিও সে কারণেই দেওয়া। কারণ প্রকৃতির এক রহস্যজনক কারণে অনেক সময় দেখা যায় নীল তিমিরা তীরে এসে আর ফিরতে চায় না সাগরে। তীরের বালুকাবেলায় ধীরে ধীরে তারা মৃত্যুকে বরণ করে নেয় স্ব-ইচ্ছায়। তাদের ধরে সাগরে নিয়ে ফেলে এলেও তারা আবার ফিরে আসে তীরে। এ যেন স্বেচ্ছায় মৃত্যুবরণ। প্রকৃতিতে এ ঘটনা যে শুধু নীল তিমিদের ক্ষেত্রে ঘটে তা কিন্তু নয়। আমার জানা মতে, আসামের জাটিঙ্গা নামক একটি স্থানে প্রতি বছর সেপ্টেম্বর অথবা অক্টোবর মাসের কোনো এক অমাবস্যা রাতে, রাত ৭টা থেকে ১০টা পর্যন্ত প্রায় ৪৪ প্রজাতির হাজার হাজার পাখি এসে আত্মাহুতি দেয় আলোকবাতি কিংবা গ্রামের মানুষের প্রজ্বলিত মশালের ওপর। এ ঘটনা চলছে বিগত একশ বছর ধরে। সঠিক করে এ রহস্যের কারণ আজ পর্যন্ত কেউ উদঘাটন করতে পারেনি। যা হোক যা বলছিলাম। ফিলিপ বুদেকিন যা চেয়েছিলেন সেটাই হচ্ছে। মানসিকভাবে অসুস্থ, হতাশাগ্রস্ত ও দুর্বল চিত্তের মানুষগুলো মরছে, মরণখেলার ফাঁদে পা দিয়ে।

বর্তমান জমানায় ছেলেপুলে মানুষ করা খুবই শক্ত একটি কাজ। ছেলেমেয়েদের সার্থক করে গড়ে তুলতে সর্বপ্রথম আমাদের প্রবেশ করতে হবে তাদের মনোজগতে। নানা কারণে বর্তমান সময়ের তরুণ-তরুণীরা সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে অলীক এক ভার্চুয়াল জগতে। এ ক্ষেত্রে বাবা-মায়েরাও উদাসীন। তাদের ছেলেমেয়ের কাছে এখন তাদের একটাই প্রত্যাশা- ভালো মার্কস। সন্তানদের কাছে পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট ছাড়া আর কিছু চাওয়ার নেই আমাদের। তুমি যত নম্বর এনে দেবে, তুমি তত ভালো, আর পিতা-মাতাও ততটাই খুশি। প্রকৃতপক্ষে অভিভাবক হিসেবে আমাদের সার্থকতা এখন এই ছেলেমেয়েদের পরীক্ষার ফলাফলের ওপরই দাঁড়িয়ে আছে। প্রকৃত মানুষ হওয়ার আশীর্বাদটুকু এখানে একেবারেই অন্তর্হিত। আমরা আমাদের ছেলেমেয়েদের যাতে সুন্দর দেখায় সে জন্য সুন্দর সুন্দর জামাকাপড় কিনে দিই। শিক্ষার জন্য ভালো স্কুল। যাতায়াতের জন্য দামি গাড়ি। ভালো রেজাল্টের জন্য দক্ষ ও অভিজ্ঞ গৃহশিক্ষক, কোচিং প্রভৃতি উপকরণ। কিন্তু কোনোকালেও আমরা খবর নেই না আমাদের সন্তানদের ভিতরের দিকটা কতটুকু পরিবর্তিত হয়েছে।

ছোটবেলায় ছেলেমেয়েদের কাছে বাবা-মা-ই সর্বপ্রথম উপাস্য ব্যক্তি। তাদের কাছে পিতা-মাতা হচ্ছে ভালোবাসা, পরমভক্তি ও শ্রদ্ধার প্রতীক। আজকাল স্কুল, কোচিং, গৃহশিক্ষক এসবের বদৌলতে ছেলেমেয়েরা বাবা-মাকে কাছে পায় যৎসামান্যই আর এ জন্যই তাদের কাছে এখন হিরো হচ্ছে কার্টুনের সুপারম্যান, স্পাইডারম্যান, ব্যাটম্যান প্রভৃতি শক্তিমানেরা। সন্তানদের মানুষ করতে হলে বাবা-মা’দেরও মিথ্যাচার, শঠতা, প্রতারণা প্রভৃতি নিকৃষ্ট দিকগুলো পরিহার করা উচিত। কারণ পিতা-মাতার চরিত্রের এ দিকগুলো সন্তানদের ওপর দারুণভাবে প্রভাব ফেলে। এ জন্যই বোধকরি বাংলা সাহিত্যের প্রথম উপন্যাস প্যারীচাঁদ মিত্র রচিত ‘আলালের ঘরে দুলাল’-এ লেখক লিখেছেন- “ছেলেকে সৎ করিতে হইলে, আগে বাপের সৎ হওয়া উচিত।” তরুণ-তরুণীদের মনোবিকাশের সবচেয়ে সহজ মাধ্যম হচ্ছে বই। পর্যাপ্ত পাঠ্যাভ্যাস-ই পারে মানুষের মনের জানালাগুলো খুলে দিতে। ভিন্নদৃষ্টি দিয়ে সব কিছু দেখতে শেখায় ভালো ভালো বই। আমরা যখন ছোট ছিলাম তখন পাড়ায় পাড়ায় গ্রন্থাগার ছিল। বিদ্যালয়গুলোতে তো ছিলই। এখন পাড়া-মহল্লা তো দূরের কথা স্কুলগুলোতেও পাঠাগারের কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ।

বাবা-মায়ের সামর্থ্য থাকলেই ছেলেমেয়েরা চাওয়া মাত্র সবকিছু হাজির করা মোটেও উচিত নয়। অনেক সময় দেখা যায় ছেলেমেয়েরা বাবা-মায়ের কাছে যা চাইছে তারা সবই কিনে দিচ্ছেন। এতে করে ছেলেমেয়েদের এই উপলব্ধি কখনই হয় না যে, জীবনে বেশির ভাগ জিনিসই এভাবে অর্জিত হয় না। যা কিছু ভালো ও শ্রেষ্ঠ সবই অর্জন করতে হয় শ্রম, মেধা ও দক্ষতা দিয়ে। এ বিষয়ে একটি দৃষ্টান্ত দিই- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরিবার ছিল সে সময় কলকাতার অন্যতম শ্রেষ্ঠ ধনী পরিবার। আমরা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনস্মৃতি থেকে জানতে পারি, তিনি জমিদার ঘরে জন্মালেও ছোটবেলায় তার গায়ে থাকত- সুতির একটি জামা আর একটি পাজামা। প্রচণ্ড শীতে হয়তো যোগ হয়েছে আরেকটি সুতির জামা। এর চেয়ে বেশি কিছু নয়। বুড়ো নেয়ামত দর্জি, চোখে গোল গোল চশমা, জামা গড়িয়ে দিত। রবীন্দ্রনাথের মনে ক্ষোভ ও কষ্ট যে, সে জামায় একটি পকেট পর্যন্ত থাকত না!

আরেকটি মজার বিষয় উল্লেখ করে আজকের লিখাটি শেষ করছি। ঘটনাটি লিখে গেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাইপো অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, তাঁর স্মৃতি কথায়। রবীন্দ্রনাথের বাবা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর রোজ বড় জাম বাটির এক বাটি করে গরুর দুধ খেতেন। গরুর দুধ যাতে করে মিষ্টি হয় সে জন্য গরুকে রোজ খাওয়ানো হতো পর্যাপ্ত পরিমাণ গুড়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বড় বোন সৌদামিনীর ওপর ছিল গরুকে গুড় খাওয়ানোর ভার। আর এসব দেখে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সবচেয়ে বড় ভাই দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছেলে দ্বিপেন্দ্রনাথ ঠাকুর লেখক অবনীন্দ্রনাথকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন- “দেখেছিস অবন! কী কাণ্ড, আমরা গুড় খেতে পাইনে একটু লুচির সঙ্গে। আর কর্তাদাদামশায়ের গরু দিব্যি কেমন রোজ গাদা গাদা গুড় খাচ্ছে। আমি নাতি হয়ে জন্মেও কিছু করতে পারলুম না।”

লেখক : গল্পকার ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী।

ই-মেইল :  [email protected]

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর