সোমবার, ৬ নভেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা
ধর্মতত্ত্ব

সচ্চরিত্র গ্রহণ করা ইমানদারের দায়িত্ব

মুফতি আমজাদ হোসাইন হেলালী

সচ্চরিত্র গ্রহণ করা ইমানদারের দায়িত্ব

মহান রব্বুল আলামিন মানুষকে ইচ্ছাশক্তি, বিবেক-বিবেচনা, জ্ঞান বা বুদ্ধিশক্তি দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। মানবজাতি আল্লাহর দেওয়া ইচ্ছাশক্তি ও বিবেক-বুদ্ধিকে সঠিকভাবে ব্যয় করলে তাকে সচ্চরিত্রবান বলা হয়ে থাকে। আর বিবেক-বুদ্ধিকে অন্যায় রাস্তায় ব্যয় করলে তাকে অসচ্চরিত্রবান বলা হয়ে থাকে। প্রবৃত্তির দাসত্ব হচ্ছে স্বেচ্ছাচারিতা। আর আল্লাহ ও তাঁর রসুলের নির্দেশিত পথে জীবন গঠন করে উত্তম গুণাবলি নিজের জীবনে বাস্তবায়ন করা ও ইমানের রঙে আপন জীবনকে রাঙায়িত করার নামই হলো সচ্চরিত্র। হজরত রসুলে করিম (সা.) বলেন, যার চরিত্র যত উন্নত তার ইমান তত পূর্ণ। অন্য হাদিসে বর্ণিত আছে, রসুল (সা.) বলেন, ‘কিয়ামতের দিন সচ্চরিত্রবানদের ওজন হবে ভারী।’ বস্তুত সচ্চরিত্র মানুষের জন্য অমূল্য সম্পদ। চরিত্রহীন মানুষ ইহ ও পরকালে সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়। মহানবী (সা.) সম্পর্কে কাফের মুশরিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে স্বয়ং আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেন, ‘আপনার জন্য রয়েছে অশেষ পুরস্কার। আপনি অবশ্যই মহান চরিত্রের অধিকারী।’ (সূরা ক্বলাম-৩-৪) আলোচ্য আয়াতদ্বয়ে রসুলে করিম (সা.)-এর উত্তম চরিত্র সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করার নির্দেশ দেওয়া প্রদান করা হয়েছে। মুহাম্মদ (সা.)-এর চরিত্র মাধুরী অধ্যয়ন করে নিজের জীবনে বাস্তবায়ন করতে হবে তাহলেই সচ্চরিত্রবান হওয়া যাবে ইনশাআল্লাহ। রসুল (সা.)-এর চরিত্র সম্পর্কে হজরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) বলেন, স্বয়ং কোরআন হলো রসুলে করিম (সা.)-এর মহান চরিত্র। অর্থাৎ পবিত্র কোরআন যেসব উত্তম চরিত্র ও মহৎ চরিত্রের শিক্ষা দিয়েছে মহানবী (সা.) হলেন সেসবের বাস্তব নমুনা। হজরত আলী (রা.) বলেন, মহান চরিত্র বলে পবিত্র কোরআনের শিষ্টাচার বোঝানো হয়েছে। এক কথায় সেসব চরিত্র পবিত্র কোরআন শিক্ষা দিয়েছে, মহান রব্বুল আলামিন তাঁর কুদরতি বলে সেসব পূর্ণ গুণাবলি রসুলে করিম (সা.)-এর চরিত্রের মধ্যে পরিপূর্ণভাবে সন্নিবেশিত করে দিয়েছেন। রসুল (সা.) নিজেই বলেন, “আমি উত্তম চরিত্রকে পূর্ণতা দান করার জন্যই প্রেরিত হয়েছি (আবু হাইয়্যান)। প্রিয় পাঠক! আমরা মানুষ। মানুষ হিসেবে মানুষের অনেক দায়িত্ব রয়েছে। সচ্চরিত্র অর্জন করা মানুষের নিজেরই দায়িত্ব। মানুষ যতদিন নাবালগ থাকে, ততদিন তার দায়িত্বের বোঝা থাকে পিতা-মাতার ওপর। সে যখন বালেগ হয়, তখন থেকে তার সব দায়িত্ব তার নিজের জিম্মায় চলে আসে। যেমন ধরুন, পানাহারের দায়িত্ব, উপার্জনের দায়িত্ব, রোজা-নামাজের দায়িত্ব, চরিত্র গঠনের ও চরিত্র সংশোধনের দায়িত্ব, দুনিয়ার দায়িত্ব, দীনের দায়িত্ব, সব দায়িত্ব এসে তার ঘাড়ে বর্তায়। সেই মানুষটি অতি সৌভাগ্যবান হয়, যে আপন দায়িত্বের ব্যাপারে সচেতন। নিজের দায়িত্ব যথাযথভাবে আদায় করে। আর ব্যর্থ মানুষ তারা যারা দায়িত্বের জ্ঞান রাখে না, দায়িত্ব পালনও করে না। আপন দায়িত্ব সম্পর্কে সম্পূর্ণরূপে গাফেল বা একেবারেই উদাসীন। তাই সত্চরিত্রের তালিম ছোটবেলা থেকেই দিতে হয়। বালেগ হওয়ার আগেই বাবা-মার ওপর ফরজ হয় ছেলেমেয়েকে ইমান, ইসলাম, নামাজ-রোজা, আদব-কায়দা, হালাল-হারাম, পাক-নাপাক শিক্ষা দেওয়া এবং হালাল উপায়ে রুজি উপার্জনেরও পন্থা শিক্ষা দেওয়া। অর্থাৎ যাবতীয় দীনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদি আপন সন্তানকে শিক্ষা দেওয়ার মাধ্যমে তাকে আদর্শ ও সচ্চরিত্রবান হিসেবে গড়ে তোলা। সন্তানকে বোঝাতে হবে। একজন মৃতব্যক্তি যেভাবে তাকে যিনি গোসল দিচ্ছেন তার কাছে অর্পণ করে দেয়। ঠিক তেমনিভাবে সন্তানও যেন নিজেকে শরিয়তের বিধি-বিধানের কাছে অর্পণ করে দিয়ে সচ্চরিত্র গঠন করে। মৃতব্যক্তি যেভাবে গোসলকারীর কোনো কাজে প্রতিবাদ করে না। ঠিক তেমনিভাবে নিজেকে শরিয়তের বিধি-বিধানের কাছে অর্পণ করতে গিয়ে শরিয়তের কোনো বিধানের ওপর আপত্তি করা যাবে না। শরিয়তের সব বিধানাবলি অত্যন্ত সুন্দর। প্রিয় পাঠক! আমাদের বুঝতে হবে, চরিত্র গঠনের প্রধান কেন্দ্র হচ্ছে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় যথাযথ সময়ে আদায় করা। নামাজের দ্বারা বড় বড় গুণাহগুলো দূরীভূত হয়। অন্যান্য অসৎ ও অন্যায় কাজগুলোও ধীরে ধীরে দূরীভূত হয়ে যায়। আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেন, ‘আপনি আপনার প্রতি প্রত্যাদিষ্ট কিতাব পাঠ করুন এবং নামাজ আদায় করুন। নিশ্চয়ই নামাজ সকল অশ্লীল ও গর্হিত কার্য থেকে বিরত রাখে। আল্লাহর স্মরণ সর্বশ্রেষ্ঠ। আল্লাহ জানেন তোমরা যা কর। (সূরা আনকাবুত : ৪৫) ইমানের পরই যেহেতু নামাজের স্থান। তাই নামাজ পড়ার আগে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন এবং পাক-পবিত্র থাকার অভ্যাস করতে হবে। দেহকে পাক-পবিত্র রাখতে হবে, জামা-কাপড় পাক-পবিত্র রাখতে হবে, স্থানকে পাক-পবিত্র রাখতে হবে, পানি বা মাটি দ্বারা পূর্ণ পবিত্রতা অর্জন করতে হবে। অজু ভালোভাবে করতে হবে। দাঁত, মুখ, নাক পরিষ্কার ও পবিত্র রাখতে হবে। দেহ, কাপড় ও স্থানকে পবিত্র রাখার পর ক্রমান্বয়ে মনকে পবিত্র রাখা শিখতে হবে। নামাজের মধ্যে দৈনিক পাঁচ ওয়াক্তের ১৭ রাকাত ফরজ, তিন রাকাত ওয়াজিব (বিতর) এবং ১২ রাকাত সুন্নাতে মোয়াক্কাদা। এই মোট ৩২ রাকাত নামাজে সূরা ফাতেহার মধ্যে আল্লাহর কাছে আমরা দৈনিক অন্তত ৩২ বার অঙ্গীকার দিয়ে থাকি যে, আমরা আল্লাহর অনুগত হয়ে চলব, শয়তান বা অন্য কারও অনুগত হয়ে চলব না এবং আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে থাকি যে, হে আল্লাহ! তুমি আমাদের সরল সঠিক-সৎপথে রাখ। সচ্চরিত্রবান হতে হলে, সরল-সঠিক পথের প্রার্থনা করার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের এমন চেষ্টাও করতে হবে যে, আমরা বা আমাদের সন্তানাদি কখনো যাতে মিথ্যা কথা না বলি, পরের জিনিস না বলে ব্যবহার করি, বড়কে ভক্তি করি, ছোটকে স্নেহ করি, সমবয়সীদের ভালোবাসার অভ্যাস গড়ি। মা-বাবাকে, বড় ভাইবোনকে এবং অন্য মুরব্বিদের সম্মান করি, ওস্তাদ ও মুরব্বিদের ইজ্জত করি এবং অন্যকে নম্রস্বরে আসসালামু আলাইকুম বলে সালাম করি। এসব শিক্ষা আমাদের মধ্যে অবশ্যই থাকতে হবে। তাহলেই আমরা সচ্চরিত্রবান হতে পারব এবং আমাদের ইহ ও পরকালীন সুখ-শান্তিতে ভরে যাবে ইনশাআল্লাহ। মহান রব্বুল আলামিন আমাদের সচ্চরিত্রবান হওয়ার তৌফিক দান করুন। আমিন।

লেখক : মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও খতিব বারিধারা, ঢাকা।

 

সর্বশেষ খবর