মঙ্গলবার, ১৪ নভেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

অবিচল সতর্কতা হলো স্বাধীনতার মূল লক্ষ্য

অধ্যাপক ডা. প্রাণ গোপাল দত্ত

অবিচল সতর্কতা হলো স্বাধীনতার মূল লক্ষ্য

জেনোসাইড খ্রিস্টীয় সভ্যতার আগেও ছিল; এমনকি মানব সভ্যতার ইতিহাসে কত ধরনের জেনোসাইড হয়েছে তা কোনো বিশেষজ্ঞ বর্ণনা করতে পারবেন না। বর্তমান সময়েও তা চলছে। জেনোসাইড এখন একটি বিশেষ আলোচনার বিষয়। ধনী, মধ্যবিত্ত, গরিব প্রায় সব দেশেই বিভিন্ন কারণে জেনোসাইড হচ্ছে। উচ্চমাধ্যমিক পড়ার সময় সমাজ পাঠ বিষয়ের একটি অধ্যায় ছিল নবীজির (সা.) বিদায় হজের ভাষণ। ওই ভাষণে নয়টি দফা ছিল।  আরাফাতের ময়দানে বিদায় হজের ভাষণের আগে তিনি আরও দুটি ভাষণ দিয়েছিলেন। বিদায় হজের ভাষণ ছিল তাঁর সর্বশেষ ভাষণ। তার একটি দফা ছিল শুধু দফা নয় সতর্কবাণী— ‘অতীতে বহু ধর্ম, বহু জাতি, বহু বংশ ধ্বংস হয়ে গেছে ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করে, সুতরাং তোমরা ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করো না।’ এমনকি তিনি এও বলেছিলেন, ‘যারা আমার এই ভাষণ শুনতে পারেনি তাদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব যারা শুনেছে তাদের।’ সর্বশেষ তিনি বলেছিলেন, ‘আমিই শেষ নবী, আমার পরে আর কোনো নবী আসবে না।’ একটি ধর্ম বা গোষ্ঠীর প্রতি অন্য একটি ধর্মের অবিরাম অত্যাচার ছাড়া মানুষ কখনো নিজ ভিটেমাটি, পবিত্র জন্মস্থান ছেড়ে অন্যত্র, অজানা, লক্ষ্যবিহীন পথে গন্তব্য খোঁজে না। এতে শুধু একটু সুবিধাবাদী গোষ্ঠী হঠাৎ করে সম্পদের মালিক হয়ে যায়, যারা চলে যান তারা নিঃস্ব হন। যেমনটি হয়েছিল ১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান স্বাধীনতার সময়। শেকসপিয়রের ‘দ্য টু জেন্টলম্যান অব ভেরোনা’ নাটকে প্রোটিয়ুসের একটি উক্তি ছিল. ‘এই প্রেমের বসন্তের সঙ্গে চৈত্র দিনের অনিশ্চিত মহিমার কি আশ্চর্য মিল।’ বাংলাদেশ গত নয় বছরে যা অর্জন করেছে তাকে অবজ্ঞা করার কোনো উপায় নেই, সমগ্র বিশ্ব এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাও তার স্বীকৃতি দিয়েছে কিন্তু দেশের কিছু লোকের নেতিবাচক বক্তব্য ওপরের উক্তিটির কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। বাংলাদেশ বহু ধর্মাবলম্বী মানুষের দেশ, ব্রিটিশের ধর্মীয় বিভাজনকে কেন্দ্র করে সাম্প্রদায়িক হানাহানি বিপুল আকার ধারণ করেছিল। এ দেশে ’৭১ থেকে ’৭৫ পর্যন্ত স্বাধীনতার অন্যতম মূলমন্ত্র ধর্মনিরপেক্ষতাকে জাতির জনক অন্তরে-মননে লালন করতেন। ’৭৫-এর ইতিহাসের বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডের পরে আবার পাকিস্তানি অবয়বে সংবিধান খণ্ডবিখণ্ড করে মোটামুটি একটা পাকিস্তানি লেবাস দেওয়ার অপচেষ্টা চলে। তা ব্যর্থ করেন আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এত সাফল্যের পরও আজকের বাংলাদেশ ধর্মীয় উন্মাদনা থেকে মুক্ত নয়। বাংলাদেশের আকাশে যেমন উজ্জ্বল রৌদ্র আছে, একই সঙ্গে আছে জমাটবাঁধা মেঘ এবং বৃষ্টি। আজকে মিয়ানমারে যা হচ্ছে তা হলো তথাকথিত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কর্তৃক জেনোসাইড। এর পেছনে হয়তো বা গভীর ষড়যন্ত্র থাকতে পারে, তবে তাও একটা ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি।

পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু তার এক নিবন্ধে লিখেছেন, ‘সাম্প্রদায়িক সমস্যা ঠিক ধর্মীয় সমস্যা নয়, এর মূলে আছে অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতা, বৈষম্য ইত্যাদি। সাম্প্রদায়িকতা উচ্চমধ্যবিত্ত, ভূস্বামী, ব্যবসায়ী ও মহাজনদের স্বার্থপুষ্ট করে যারা কোনোরকম আর্থ-সামাজিক পরিবর্তনের বিরোধী।’ ১৯৫৩ সালের ২০ সেপ্টেম্বর দেশের সব মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠি লিখে তিনি সতর্ক করে দেন সে ধরনের জাতীয়তা সম্পর্কে যেখানে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায় নিজেকে সমগ্র জাতি ভাবতে শুরু করে। কৃষ্ণ মেনন বলেছেন, এমন এক সময় জওহরলাল নেহরু উগ্র জাতীয়তাবাদের বিরোধিতা করেন যখন ভারতের মাটিতে দাঁড়িয়ে তার সমালোচনা করা অসম্ভব ছিল।’জওহরলালই ভারতের একমাত্র প্রধানমন্ত্রী, যিনি পরপর তিনটি সাধারণ নির্বাচনে জয়লাভ করেছিলেন এবং তার পক্ষেই শুধু এসব বলা সম্ভব ছিল।

জ্যোতি বসু এক জায়গায় লিখেছেন, ১৯৩৬ সালে নেহরু যখন লন্ডনে আসেন, তখন তারা তাকে সংবর্ধনা দেন। পণ্ডিত নেহরু শুধু যে স্বাধীনতা সংগ্রামের একজন অধিনায়ক ছিলেন তাই নয়, তিনি ছিলেন ফ্যাসিবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে এক অতন্দ্র সৈনিক। নেহরু ছিলেন সাম্রাজ্যবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে এক আপসহীন সংগ্রামী। যদিও অনেকেই তাকে আখ্যায়িত করেছিলেন এক গণতান্ত্রিক নেতা, সমাজতান্ত্রিক আদর্শে ঘেঁষা।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ১৯৩৯ সালে নেহরু লিখেন, ‘আমাদের যুদ্ধের এলাকা শুধু দেশের সীমান্তে নয়, স্পেন, চীনেও ছড়িয়ে রয়েছে।’ বেইজিংয়ে ভারতীয় দূতাবাসে মাও জে দং জওহরলালকে বলেছিলেন, ‘আমাদের রাজনৈতিক আদর্শ সামাজিক ব্যবস্থা আলাদা হলেও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আমরা ঐক্যবদ্ধ।’ বামপন্থি ইতিহাসবিদ সুশোভন সরকার পণ্ডিত নেহরুর কট্টর সমালোচক হলেও তার ধর্মনিরপেক্ষ ভূমিকার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। শেষের দিকে অবশ্য একসময় নেহরুকে খানিকটা হতাশা গ্রাস করেছিল। তিনি নিজেই গোবিন্দ বল্লভ পান্থকে বলেছেন, ‘যারা একসময় কংগ্রেসের স্তম্ভস্বরূপ ছিলেন তাদের মানসিকতার মধ্যেও সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ঢুকে পড়েছে।’

আমাদের জাতির পিতাও ছিলেন গণতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতার মূর্তপ্রতীক, যাকে উপমহাদেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বের সঙ্গে তুলনা করলে জওহরলাল নেহরুর সঙ্গেই তুলনীয়। নেহরু যেমন সাম্প্রদায়িকতা এবং ফ্যাসিবাদকে ঘৃণা করতেন এবং কিছুটা সমাজতান্ত্রিক আদর্শে গরিব-দুঃখীর ব্যথায় ব্যথিত হতেন, বঙ্গবন্ধু ছিলেন তার চেয়েও একটু বেশি। যেই ধর্মনিরপেক্ষতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ছিলেন বঙ্গবন্ধু, আজ তার কিছু তথাকথিত অনুসারী, হাইব্রিড আওয়ামী লীগার বঙ্গবন্ধুর আদর্শের অপমৃত্যু ঘটাচ্ছেন। ঈশ্বর সম্পর্কে ড. এ পি জে আবদুল কালামের মত হলো, ‘আল্লাহ বনাম ঈশ্বর, খোদা বনাম ভগবান নয়। তাকে মসজিদ বা মন্দিরে খুঁজে পাওয়ার নয়। তাকে যুদ্ধ করে বা আত্মোৎসর্গে খুঁজে পাওয়া যায় না, যেমন আমাদের দেশের বিভিন্ন ধর্মের প্রচারকরা করে থাকেন। তারা একে অন্যের রক্তপাত করার পর বজ্রঘোষণা করে। তখন আলোক থেকে সহসা বজ্রনিনাদ গর্জিত হয়, “শোনো সবাই! আমি তোমাদের কারও নই! প্রেম ছিল আমার ব্রত, আর তোমরা ঘৃণায় তা অপচয় করেছো, আমার হর্ষকে হনন করে, জীবনকে শ্বাসরোধ করে। জেনো খোদা আর রাম উভয়েই এক, ভালোবাসায় তারা প্রস্ফুটিত”।’ কোনো যুক্তিবাদী ঈশ্বরত্ব সম্পর্কে কালামের দৃষ্টিভঙ্গি সমালোচনা করতে পারবেন না। কেউ ঈশ্বরকে দেখেন সত্যরূপে, কেউ প্রেমরূপে। কালামের কাছে ঈশ্বরত্ব হলো সহানুভূতি...।

একটি ঘটনা দিয়ে লেখাটি শেষ করছি। এবারের দুর্গাপূজার নবমী দিনে আমার গ্রামের পুজোয় স্থানীয় নেতার নেতৃত্বে একদল যুবক মিছিল করে আমাদের বাড়িতে আসেন। আমরা সবাই ঘর থেকে বেরিয়ে আসি। কথাবার্তার পর তিনি প্রসাদ না খেয়ে দলবল নিয়ে চলে যান। পরদিন যুবলীগের এক নেতা ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দেন, ‘চান্দিনার জনগণ কাকে বেছে নেবে একজন মসজিদে অন্যজন মন্দিরে।’ পাঠক! আপনাদের সামনে তা তুলে ধরলাম বিবেচনা এবং বিচারের জন্য। দেশ কোথায় যাচ্ছে? আমি আবারও ড. এ পি জে আবদুল কালামের বক্তব্য তুলে ধরতে চাই, ‘অবিচল সতর্কতা হলো স্বাধীনতার মূল লক্ষ্য। এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ যে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া এবং ব্যবহারিক উপযোগিতা উপরিতলে যতই সন্তোষজনক মনে হোক না কেন সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তা এক জায়গায় স্থাণু হয়ে থাকতে পারে না এবং হওয়া উচিতও নয়। আমরা অতীতের সাফল্যে আত্মসন্তুষ্ট হয়ে থেমে থাকতে পারি না এবং যেভাবে সমাজ ও রাষ্ট্রকে চালনা করি সেই পথের পরিবর্তনের জন্য যে সাম্প্রতিক ঘটনাবলি তাকে উপেক্ষা করতে পারি না।’ মনে রাখতে হবে, পড়তে হবে, জানতে হবে, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু, মহাত্মা গান্ধী, জওহরলাল নেহরু কীভাবে রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীদের ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শে দীক্ষিত করেছেন, তাহলে সবার জন্য মঙ্গল হবে। যে কোনো সমাজব্যবস্থায় এবং রাষ্ট্রীয় অঙ্গনে যুবসমাজই সত্যিকার শক্তি। যুবসমাজের প্রজ্বলিত মন পৃথিবীতে, পৃথিবীর ওপরে এবং গভীরে সবচেয়ে শক্তিশালী মূলধন।  রাষ্ট্র পরিচালনায় তাদেরই কাজে লাগাতে হবে।

লেখক : সাবেক উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়।

সর্বশেষ খবর