মঙ্গলবার, ১৪ নভেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

শিশুশ্রম : একটি অভিশাপ

আফতাব চৌধুরী

শৈশবই হচ্ছে মানব জীবনের সিংহদ্বার। জীবনের সুদীর্ঘ পথের শুরু এ শৈশবেই। এ সময়ের শিশুচিত্ত প্রভাতের স্নিগ্ধ রবিকিরণের মতোই স্বচ্ছ, পবিত্র। শৈশবই সেই গঙ্গোত্রী যেখান থেকে পুণ্যসলিলা জীবনজাহ্নবীর যাত্রাপথের শুরু। তাই জীবনের শুরু এই পুণ্য মুহূর্তকে সঠিক দিশা দিতে পারলেই জীবনজাহ্নবীর সঠিক পরিণতি সম্ভব।

আজকের শিশুই ভবিষ্যতের নাগরিক। শিশুর কোমল দুটি কাঁধের ওপরই গোটা জাতির ভবিষ্যতের অট্টালিকা দণ্ডায়মান। মানব জাতির ভবিষ্যৎ অস্তিত্ব রক্ষার দায়ভার শিশুর ওপরই নির্ভরশীল। আর শিশুকে এ দায়ভার বহনের যোগ্য করে তোলার দায়িত্ব সমাজের, বর্তমান প্রজন্মের। জীবনের এই ঊষালগ্নের গুরুত্ব অনুমান করেই প্রাচীন ভারতবর্ষ শৈশবকালে ব্রহ্মচর্য পালনের নির্দেশ দিয়েছিল। সে যুগে রাজকুমার থেকে সাধারণ বালক, সবাই গুরুগৃহে গুরুর তত্ত্বাবধানে শিক্ষালাভ করতেন। একে বলা হতো গুরুকুলপ্রথা। এ গুরুকুলে শিশুর শৈক্ষিক বিকাশের সঙ্গে শারীরিক, মানসিক, নৈতিক, চারিত্রিক ইত্যাদি সর্বাঙ্গীণ বিকাশের প্রতি বিশেষ দৃষ্টিদান করা হতো। তাই শৈশবেই একটি সুন্দর জীবনশৈলীর নির্মাণ সম্ভব হতো।

কিন্তু জীবনের এই অতি মূল্যবান সময়ের গুরুত্ব যা আমাদের পূর্বসূরিরা অনুধাবন করতে পেরেছিলেন এবং যাকে রক্ষা করতে সচেষ্ট ছিলাম আমরা, তাদের উত্তরসূরিরা, সেই দিকটিকে সযত্নে উপেক্ষা করে যাই। তাই তো জীবনের ফুল মুকুলেই ঝরে যায় কারখানার যন্ত্রের বিষবাষ্পে। ছোট্ট, কোমল হাত দুইখানি যন্ত্রের নির্মম আঘাতে জর্জরিত। শিশু বলতেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে সরল নিষ্পাপ একটি মুখ যাতে চাঁদের হাসি ঝরে কিন্তু হূদয়বিহীন সমাজের নিষ্ঠুরতায় সে মুখ আজ পরিশ্রমের কালিমালিপ্ত। চাঁদের হাসিতে গ্রহণ লাগে শিশুশ্রমরূপী রাহুর করাল ছায়ায়। এ কালিমা অকালের এ গ্রহণ, মনুষ্যরূপী জীবকুলের লজ্জা। এ লজ্জা আধুনিক সমাজের মুখে কলঙ্করেখা। এ লজ্জা, এ কলঙ্ক মোছার হাজার চেষ্টা সত্ত্বেও আজও তা সগৌরবে বিরাজমান এবং চক্রবৃদ্ধি হারে বর্ধিষ্ণু। এ বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে গৃহীত পরিসংখ্যান অন্তত তার সপক্ষেই সাক্ষ্য দেয়। বর্তমানে আমাদের দেশে বিভিন্ন কলকারখানায় কর্মরত শিশু শ্রমিকদের সংখ্যা লক্ষাধিক। তারা বিভিন্ন বিপজ্জনক শিল্পে কাজ করছে যা তাদের শারীরিক ক্ষেত্রে প্রচণ্ড হানিকর। এভাবেই দেশলাই শিল্প, আতশবাজি তৈরির কারখানা, বিভিন্ন রত্ন খোদাই এবং পরিষ্কারের কারখানা, কাচশিল্প, কার্পেট শিল্প ইত্যাদি আরও কত শিল্প উদ্যোগ ও কারখানার যূপকাষ্ঠে আমাদের দেশের লাখ লাখ শিশুর ভবিষ্যৎ আমরা বলি দিচ্ছি।

আশ্চর্য হলেও সত্য যে, দেশের শিশু শ্রমিকের ১০ শতাংশই বালিকা তারা প্রাপ্তবয়স্ক শ্রমিকের তুলনায় তিন ভাগের এক ভাগ কম মজুরিতে দিনে ৯ ঘণ্টা পর্যন্ত কাজ করছে। আমাদের দেশে ক্ষতিকারক শিল্প উদ্যোগগুলোয় শিশু শ্রমিকের নিযুক্তি আইনত নিষিদ্ধ। কিন্তু আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে শহরের বিভিন্ন কলকারখানার মালিক কম বেতনে শিশু শ্রমিকদের নিযুক্ত করছেন। এদের সিংহভাগই কাজ করছে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে মারাত্মক শিল্পোদ্যোগে। এবার যদি দেশের শ্রমিক আইনগুলোর দিকে দৃষ্টি দেওয়া যায়, তবে দেখা যাবে যে প্রতিটি আইনই শিশুশ্রমকে নিষিদ্ধ করেছে আর শিশু শ্রমিক নিযুক্তকারীদের কঠোর শাস্তির বিধান দিয়েছে। আমাদের সংবিধানে দেশে ১৪ বছরের কমবয়সী শিশুদের ক্ষতিকারক শিল্পোদ্যোগ, কলকারখানা, খনি ইত্যাদিতে নিযুক্তি নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর