শনিবার, ২৩ ডিসেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

বিজয়ের বিপত্তি এবং বিজয়ীর সংগীত

গোলাম মাওলা রনি

বিজয়ের বিপত্তি এবং বিজয়ীর সংগীত

বিজয় লাভের পর কতিপয় সাধারণ বিপত্তি মানুষের জীবনকে নানাভাবে তছনছ করে দিতে পারে। প্রথমত, বিজয় মানুষকে নিদারুণ দাম্ভিক, অকৃতজ্ঞ এবং অত্যাচারী বানিয়ে ফেলতে পারে। পৃথিবীর স্মরণকালের তাবৎ হত্যাযজ্ঞ, ধ্বংসযজ্ঞ এবং অনাচারসমূহ সর্বদা বিজয়ীর দ্বারাই সংঘটিত হয়েছে। সম্রাট আলেকজান্ডার কর্তৃক তৎকালীন দুনিয়ার সবচেয়ে বৃহৎ ও সমৃদ্ধ নগরী  পার্সিপোলিশ জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে  ছারখার করে দেওয়ার ইতিহাস ছাড়াও পৃথিবীতে বহু শত প্রলয় সংঘটিত হয়েছিল ইতিহাসের মহানায়কদের দ্বারা।  মহাবীর হানিবল কর্তৃক রোম আক্রমণ এবং একদিনের যুদ্ধে আশি হাজার রোমান সৈন্যের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছিল বিজয় উল্লাসকে স্মরণীয়-বরণীয় করে তোলার জন্য। পরবর্তীতে রোমান জেনারেল স্কিপিও হানিবলের দেশ কার্থেজ আক্রমণ করে নগর রাষ্ট্রটিকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে দেন। ১৪৬ খ্রি. পূর্বাব্দের সেই নৃশংস ঘটনায় পাঁচ লাখ কার্থেজবাসী নিহত হয়েছিলেন এবং একটি সভ্যতায় আগুন লাগিয়ে সম্পূর্ণ ছাই বানিয়ে ফেলা হয়েছিল।

হানিবল, আলেকজান্ডার এবং স্কিপিওর মতো জুলিয়াস সিজার, নেপোলিয়ন বোনাপাট প্রমুখ মহানায়কের বিজয়ের বিপত্তিতে তৎকালীন দুনিয়া বহুবার কম্পিত হয়েছিল। নায়কদের বাদ দিয়ে আমরা যদি খলনায়কদের বিজয়ের বিপত্তি নিয়ে আলোচনা করি তবে ধ্বংসযজ্ঞের ইতিহাস দিয়ে মস্তবড় পিরামিড অথবা চীনের মহাপ্রাচীর নির্মাণ করা যাবে। মধ্যযুগের অসভ্য বারবার যোদ্ধাদের ধ্বংসযজ্ঞ, চেঙ্গিস খান, হালাকু খান, তুলি খান, বাতু খান, নাদের শাহ, তৈমুর লং, আইভান দ্য টেরিবল প্রমুখ কুখ্যাত বিজয়ী তাদের বিজয়কে চিরস্মরণীয় করে রাখার জন্য হত্যা, ধর্ষণ এবং অগ্নিসংযোগের যে নমুনা স্থাপন করেছিলেন তা দেখে ভুক্তভোগীরা নিশ্চয়ই ভেবেছিলেন যে কিয়ামত শুরু হয়ে গেছে।

বিজয়ের দ্বিতীয় বিপত্তি হলো এটি মানুষকে অসভ্য, বেয়াদপ এবং অকৃতজ্ঞ বানিয়ে ফেলতে পারে। এ ব্যাপারে বড় বড় উদাহরণ না দিয়ে এবার আমরা আমাদের সমাজ-সংসারের চারপাশে ঘটে যাওয়া নিত্যনৈমিত্তিক কিছু ঘটনাকে সামনে এনে আজকের শিরোনামের যথার্থতা প্রমাণের চেষ্টা করব। আবহমান বাংলার দরিদ্র ফজু মিয়া ও ছমিরন বেওয়ার বুকের ধন কাঞ্চন মিয়া বাবা-মায়ের রক্ত পানি করা অর্থে বিএ-এমএ পাস দিয়ে মস্তবড় এক চাকরি জুটিয়ে ফেললেন। এরপর শহরের সবচেয়ে ধনী ব্যবসায়ী চৌধুরী সাহেবের কন্যাকে বিয়ে করে গর্বে ফুলেফেঁপে বেলুন হয়ে আকাশে উড়তে লাগলেন। কাঞ্চন মিয়ার নতুন নাম হলো কামবার চৌধুরী। কাঞ্চন থেকে কামবার হয়ে প্রথমেই সে পিতা-মাতার অবাধ্য হয়ে উঠলেন এবং সর্বনিকৃষ্ট অকৃতজ্ঞতা দ্বারা কীভাবে সে তার দরিদ্র পিতা-মাতার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করলেন তার ভূরি ভূরি উদাহরণ এদেশের নাটক, সিনেমা, গীতিকাব্য এবং সাহিত্যে বর্ণিত হয়েছে।

আলোচনার এ পর্যায়ে আরও একটি ঘটনার বর্ণনা দিয়ে মূল প্রসঙ্গের দিকে অগ্রসর হব। গ্রামের হতভাগ্য দরিদ্র জুলহাস পরিণত বয়সে ব্যবসা-বাণিজ্য করে অঢেল অর্থকড়ির মালিক বনে গেলেন। নিজের অর্থবিত্তের দাপট দেখানোর জন্য সে নানা রকম ফন্দিফিকির শুরু করলেন। মস্তবড় বাড়ি, গাড়ি, গহনা ইত্যাদি ক্রয় করার পর নানান অমিতচার, অবিচার-ব্যভিচারে লিপ্ত হয়ে পড়লেন। আল্লাহ-খোদা, নীতিবোধ, সংসার ও সমাজের নিয়মকানুনের তোয়াক্কা না করে সে দিনকে দিন বেপরোয়া হয়ে এক সময় জমিনের জন্য হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়ালেন। আপনজনের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হলো— সমাজের ঘৃণার পাত্রে পরিণত হলো এবং এক সময় নানা রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে বহুদিন মানবেতর জীবনযাপন করে একা ও নিঃসঙ্গ অবস্থায় মৃত্যুবরণ করলেন।

আমরা যদি উল্লিখিত ঘটনাগুলো পর্যালোচনা করি তবে লক্ষ্য করব যে, বিজয় সাধারণত দুই প্রকারের হয়ে থাকে। যথা রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক। রাজনৈতিক বিজয় যেমন জাতীয়ভাবে হতে পারে; আবার ব্যক্তিগত পর্যায়েও তা হয়ে থাকে। অন্যদিকে অর্থনৈতিক বিজয় বলতে আমরা ব্যক্তিশ্রেণির উন্নয়ন বা সফলতাকেই বুঝে থাকি। ইতিহাসের দিক লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, সেই অনাদিকাল থেকেই বিজয়ীরা নিজেদের বিজয়কে সুনিশ্চিত করার জন্য কখনো ধর্মাশ্রয়ী হয়েছেন আবার প্রয়োজন মনে করলে ধর্মকে বিসর্জন দিয়েছেন। তবে যেসব নায়ক-মহানায়ক তাদের বিজয়কে সুসংবদ্ধ করতে চেয়েছেন এবং একটি স্থায়ী সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করার জন্য বদ্ধপরিকর ছিলেন তারা সবাই ধর্মকে পুঁজি করে কর্মযজ্ঞ চালিয়েছেন। রোমান সম্রাট কনস্টান্টাইন কিংবা মিসরের ফেরাউন সম্রাটরা ধর্মকে পুঁজি করে রাজনীতি করেছেন। অন্যদিকে আলেকজান্ডার, নেপোলিয়ন কিংবা জুলিয়াস সিজার প্রমুখ মহাবীর সেনানায়ক যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যাপক সফলতা দেখাতে পারলেও সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি কেবল বিশ্বাসের সংকটের কারণে।

পৃথিবীর ইতিহাসের দুটো নির্মম সত্য এবং সেই সত্যের অন্তর্নিহিত কারণ আলোচনাই আজকের নিবন্ধের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। প্রথম সত্যটি হলো ইসলাম পূর্ব সময়ে এবং ইসলাম পরবর্তী সময়ে অমুসলিম, অধার্মিক, নামধারী কপট মুসলিম, কাফের, মুশরিক প্রভৃতি শ্রেণির মানুষ যখনই যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যাপক কোনো বিজয় অর্জন করেছেন তখনই বিজয় উল্লাসে রক্তগঙ্গা বইয়ে দিয়েছেন। অন্যদিকে এই শ্রেণির লোক যখন ব্যক্তিগত পর্যায়ে সফলতা লাভ করেছেন তখনো দেখা দিয়েছে নানা অসঙ্গতি, বিপর্যয় এবং দুর্ভোগ-দুর্গতি। প্রাচীন দুনিয়ার মহাভারত, ট্রয়, পিউনিখ, গাওগেমেলা, কেন্নাই প্রভৃতি যুদ্ধক্ষেত্রে যেভাবে মানবতা লাঞ্ছিত হয়েছে তা বর্ণনা করার ভাষা আমার জানা নেই। মধ্যযুগ থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক দুনিয়ার নানান যুদ্ধক্ষেত্রের নৃশংসতার কথা স্মরণ করলে আজও ভয়ে আমাদের শরীরের পশম খাড়া হয়ে যায়। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ, মিয়ানমারের রোহিঙ্গা নির্যাতন, ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়ার যুদ্ধ, বসনিয়া, হার্জেগোভিনার যুদ্ধ, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকালীন নািস বাহিনী কর্তৃক ইহুদি নিধন এবং জাপানি সেনাবাহিনী কর্তৃক কোরীয় উপদ্বীপে হত্যাকাণ্ড ও গণধর্ষণের নৃশংসতার সঙ্গে তুলনীয় কোনো নির্মমতা মানব ইতিহাসে পাওয়া যায় না।

উল্লিখিত ইতিহাসের বিপরীতে মুসলিম স্বর্ণযুগের শত সহস্র যুদ্ধজয় কিংবা ব্যক্তি পর্যায়ে ব্যাপক সফলতার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে আমরা সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি দৃশ্য দেখতে পাই। খোলাফায়ে রাশেদীন, উমাইয়া, মধ্য এশিয়ার খাওয়েরেজম, আব্বাসীয়, ফাতেমীয়, স্পেনের মুর, তুরস্কের অটোম্যান, ভারতের মুঘল এবং পারস্যের সাভাভিদ শাসনামলের কোনো যুদ্ধক্ষেত্রে মুসলিম বাহিনী ধর্ষণ, জুলুম, অত্যাচার কিংবা নির্যাতন করেছেন এমন বদনাম কোনো কট্টরপন্থি ইসলাম বিরোধী ইতিহাসবিদও দিতে পারেননি। অন্যদিকে, ব্যক্তি পর্যায়ে বিজয়ী হওয়া সফল মুসলমানবৃন্দ জমিনের জন্য কি করতে পারেন তা জানার জন্য হাজী মুহম্মদ মুহসীন, পারস্যের নিজামুল মূলক, আলরাজি, আল ফারাবী, ইবনে সিনা, জাবির আল হাইয়ান, জালালুদ্দিন রুমী, ইমাম গাজ্জালী, ইমাম মালেক প্রমুখ মনীষীর জীবনাল্লেখ্য অধ্যয়ন করা যেতে পারে।

মুসলমানদের বিজয়ে কোনো বিপত্তি ঘটেনি এ কারণে যে, বিজয়ীরা বিজয়ের আগে অথবা যুদ্ধক্ষেত্রে অবতীর্ণ হওয়ার আগেই খুব ভালো করে বিজয়ের গানগুলো আত্মস্থ করে নিয়েছিলেন। পবিত্র কোরআনে দুটি সূরায় বর্ণিত কয়েকটি আয়াতের মাধ্যমে স্বয়ং আল্লাহ তার মুমিন ও মুত্তাকি বান্দাদের দুটো বিজয়ের গান শিক্ষা দিয়েছেন। একটি গান ব্যক্তিগত বিজয়ের জন্য এবং অপরটি জাতিগত বিজয়ের ক্ষেত্রে রাজা-বাদশাহ বা শাসক শ্রেণির জন্য। প্রথম গানটি বর্ণিত হয়েছে সূরা নাছরের মাধ্যমে। আর অন্যটি বর্ণিত হয়েছে সূরা হাজ্জের ৪১ নং আয়াতের মাধ্যমে। আমরা প্রথমে ব্যক্তিগত বিজয়ের গানের মর্মবাণী নিয়ে আলোচনা করব এবং পরবর্তীতে জাতীয় বিজয় সংগীত নিয়ে পর্যালোচনা করে আজকের নিবন্ধের ইতি টানব।

সূরা নাছরের বাংলা প্রতিশব্দ হলো বিজয়ের সূরা। এখানে আল্লাহ তার হাবীব প্রিয় নবী মুহাম্মাদুর রসুলুল্লাহ (সা.)-কে উদ্দেশ করে বলেন, ‘যখন আল্লাহর সাহায্য ও বিজয় এসে পৌঁছবে, আর আপনি মানুষকে দলে দলে আল্লাহর দীনে প্রবেশ করতে দেখবেন, তখন আপনার রবের প্রশংসাসহ মহিমা বর্ণনা করুন। ক্ষমা চান, তিনিই তওবা কবুলকারী।’ আলোচ্য এ সূরাটির বাংলা তরজমা পড়লে আপনি কতগুলো বিষয় যেমন বুঝতে পারবেন তদ্রূপ কতগুলো নিতান্ত যৌক্তিক প্রশ্ন আপনার মনে উদয় হবে। প্রথমত, বিজয়কে বলা হয়েছে আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি সাহায্য যা কোনো বান্দার ওপর এহসান করা হলে পৃথিবীর সব কাজ তার জন্য সহজ হয়ে যায়। মুমিন ও মুত্তাকি সর্বদা বিশ্বাস করেন যে, তার জীবনের তাবৎ সফলতার মূলে রয়েছে আল্লাহর দয়া, করুণা এবং সাহায্য। আল্লাহই তাকে বিজয়ের জন্য লক্ষ কোটি বান্দা-বান্দীর মধ্য থেকে বিশেষভাবে মনোনীত করেছেন এবং বিজয়ের পথের দৃশ্যমান এবং অদৃশ্য বাধাসমূহ দূর করে পুরো পরিস্থিতি তার অনুকূলে এনে দিয়েছেন।

মুমিন বান্দা আরও বিশ্বাস করেন যে, আল্লাহ তার মন-মস্তিষ্ক ও শরীরকে বিজয়ের জন্য উপযুক্ত করে রাখেন যার ওপর বান্দার সাধারণত কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না। যুদ্ধের ময়দানে আল্লাহ তার সাহায্যকারী শক্তি ও ইশারা দ্বারা বিজয়ীর বিজয় নিশ্চিত করেন। অর্থাৎ বিজয়ীর প্রতিপক্ষের মনে বিজয়ী সম্পর্কে ভয় ধরিয়ে দেন এবং নিজপক্ষের লোকদের অন্তরে শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও আন্তরিকতাসহ আনুগত্য পয়দা করে দেন। এগুলোর বাইরে আলো, বাতাস, পানি এবং ক্ষেত্রবিশেষে বন্যপশুদেরও বিজয়ীর অনুকূলে কাজ করার নির্দেশ প্রদান করা হয়। সূরার দ্বিতীয় আয়াতে মানুষের সমর্থন ও আনুগত্যের কথা বলা হয়েছে। বিজয় নিশ্চিত হওয়ার পর দলে দলে লোক বিজয়ীর কাছে আসতে থাকে। লোকজনের বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস, সমর্থন এবং নানামুখী প্রশংসা বাক্যে মুমিন-মুত্তাকী কখনো বিভ্রান্ত হন না। তিনি বিশ্বাস করেন, বিজয় না দিলে লোকজন তার কাছে আনুগত্য শ্রদ্ধা ও প্রশংসার ডালা সাজিয়ে আসত না। কাজেই তার দিল কোনো দিন তাকে এ কথা বোঝাতে সাহস পায় না যে এ বিজয় এ সাফল্য তোমার মেধা-শ্রম-কূটনীতির কারণে এসেছে।

তৃতীয় আয়াতে আল্লাহ তার বিজয়ী বান্দাকে হুকুম করেছেন তার প্রশংসাসহ মহিমা বর্ণনা করার জন্য, যাতে বান্দা নিজেকে দাম্ভিকতা ও অহঙ্কার থেকে মুক্ত রাখতে পারেন। বান্দা যদি তার সব সফলতা, সুখ-শান্তি ও বিজয়ের জন্য আল্লাহর করুণাকে চিরন্তন সত্য বলে বিশ্বাস করেন এবং তার প্রতি বিজয়ের মতো একটি উত্তম নেয়ামত নাজিল করার কারণে আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন তবে আপনাআপনি বান্দার চরিত্রে এমন বিনয়, ভদ্রতা, নম্রতা এবং ঐশী সৌন্দর্য সন্নিবেশিত হয়ে যায় যা কিনা বিজয়ের আনন্দ, গৌরব ও মহত্ত্বকে বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়— বিজয়কে রওনকবকশ শানদার করে তোলে এবং বিজয়ের সুফল বান্দার জীবনের স্থায়ী সম্পদে পরিণত হয়ে যায়। তৃতীয় আয়াতের দ্বিতীয় অংশে আল্লাহ তার বিজয়ী বান্দাকে ক্ষমা চাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন এ কারণে যে, প্রতিটি মানুষই তার মানবিক দুর্বলতা দ্বারা আক্রান্ত এবং সহজাত ভুলভ্রান্তি দোষে দুষ্ট। কাজেই বিজয়ী বান্দা তার বিজয়ের পথে যুদ্ধসংগ্রাম করতে গিয়ে নিশ্চয়ই অনাহূত বিপত্তি ঘটিয়ে থাকবেন— ভুল করে বা বাধ্য হয়ে খুন জখমের মতো অন্যায়-অপরাধ করে থাকবেন অথবা অন্য কোনো খোদায়ী হুকুম-আহকাম অমান্য করে থাকবেন। কাজেই আল্লাহ চান যে তার বিজয়ী মুমিন বান্দা তওবার মাধ্যমে নিষ্কলুষ ও গুনামুক্ত হয়ে জান্নাতের মেহমানরূপে দুনিয়াতে বসে বিজয়ের সুফল ভোগ করুক।

আল্লাহর মুমিন-মুত্তাকী বিজয়ী বান্দারা বিজয়ের শুকরিয়া জানাতে গিয়ে তাই সর্বদা বিজয়ের গানরূপে গাইতে থাকে— সুবাহান আল্লাহি, আল হামদুলিল্লাহি, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু, আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, ওয়ালিল্লাহিল হামদ। ব্যক্তিগত বিজয় সংগীতের পর এবার আমরা আলোচনা করব জাতীয় বিজয় সংগীত নিয়ে। সূরা হাজ্জের ৪১ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন— ‘আমি তাদের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করলে তারা নামাজ কায়েম করবে। জাকাত আদায় করবে। সৎ কর্মের নির্দেশ ও অসৎ কর্মে বাধা প্রদান করবে। তাদের কর্মের পরিণাম আল্লাহরই হাতে।’ আলোচ্য আয়াতে বিজয়ী মুমিন ও মুত্তাকিদের যদি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র ক্ষমতা প্রদান করা হয় তখন তাদের জাতীয় সংগীত কেবল মুখে আওড়ানো আল্লাহর প্রশংসা সূচক মহিমা এবং অন্তরের বিশ্বাসের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। রাষ্ট্রক্ষমতাপ্রাপ্ত বিজয়ী মুমিন মুত্তাকিকে চারটি সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব পালন করার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়। মূলত এই নির্দেশগুলো সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হলেই বিজয়ীর বিজয় দীর্ঘস্থায়ী, শান্তিপূর্ণ এবং আনন্দদায়ক হয়।

রাষ্ট্রক্ষমতাপ্রাপ্ত মুমিন মুত্তাকিদের প্রথম দায়িত্ব নামাজ প্রতিষ্ঠা করা। রাষ্ট্রের সব মুসলমান সঠিকভাবে যাতে নামাজ আদায় করেন বা করতে পারেন তা বিজয়ী রাষ্ট্রনায়ককে নিশ্চিত করতে হবে। নামাজ নাগরিকদের নিয়মানুবর্তিতা শেখায়। তাদের রাষ্ট্র, সরকার-প্রধান, পরিবার এবং আত্মীয়স্বজনের প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে উদ্বুদ্ধ করে তোলে। নামাজের মাধ্যমে পারস্পরিক সম্প্রীতি এবং ঐক্য বৃদ্ধি পায়। শরীর মন সুস্থ হয়ে ওঠে এবং হৃদয়কে প্রসারিত এবং অহংমুক্ত বানিয়ে ফেলে। কাজেই নামাজি নাগরিকবৃন্দকে নিয়ে একজন মুমিন রাষ্ট্রপ্রধান অতি সহজে এবং অত্যন্ত সম্মানজনকভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা করতে পারেন। দ্বিতীয় দায়িত্ব হলো জাকাত আদায় করা যা কিনা একটি সুখী, সমৃদ্ধশালী এবং সুষম অর্থনৈতিক ভিত্তির মূল চাবিকাঠি হিসেবে রাষ্ট্রকে সুসংহত রাখে। জাকাত আদায় ও বিতরণের মধ্যে যে রহমত ও বরকত রয়েছে তা নাগরিকবৃন্দ এবং বিজয়ী শাসকদের মধ্যে মায়া-মমতা, স্নেহ-ভালোবাসা-শ্রদ্ধা এবং প্রীতির বন্ধন সৃষ্টি করে দেয় যা কিনা শেষ অবধি বিজয়ের আনন্দকে বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়।

তৃতীয় নির্দেশনা হলো সৎকর্মের নির্দেশ। বিজয়ী মুত্তাকি বাদশাহ যদি সৎকর্মের নির্দেশদাতা হন তবে তার রাজ্যের সৎ লোকেরা স্বয়ংক্রিয়ভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়ে বিরাট এক শক্তিতে পরিণত হয়ে যান। পরিবার-সমাজ ও রাষ্ট্রের সর্বত্র সৎ লোকের জয়জয়কার শুরু হয়ে যায় এবং সৎ লোকের সুবাসিত ঘ্রাণে প্রকৃতি ও পরিবেশ পবিত্র হয়ে পড়ে।  অসত্জন তখন নির্বাসনে চলে যেতে বাধ্য হন। চতুর্থ নির্দেশ হিসেবে বিজয়ী বাদশাহ যদি অসৎ কর্মে বাধা প্রদান আরম্ভ করেন তবে তার রাজ্য একটি জান্নাতের টুকরায় পরিণত হয়ে যাবে। বিজয়ী মুমিন মুত্তাকি বাদশার প্রধান পরিচ্ছদ ও পরিষদবর্গ হবে সততা এবং সৎ মানুষ। অন্যদিকে তার প্রধান পরিচয় হবে, কোনো অসৎ মানুষ তার দরবারের ত্রিসীমানায় প্রবেশ করা তো দূরের কথা তার রাজ্যে বসবাস করতে সাহস পাবে না।  অসৎ ও অন্যায়কারীরা সর্বদা মাথা নিচু করে নির্বাসিত মানুষের ন্যায় জীবনযাপন করবে এবং সৎ মানুষকে ভয় করবে।

লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য ও কলামিস্ট।

সর্বশেষ খবর