মঙ্গলবার, ২৬ ডিসেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

রংপুর সিটি নির্বাচন সত্যিই কি প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক ছিল?

বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম

রংপুর সিটি নির্বাচন সত্যিই কি প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক ছিল?

একদিকে ব্রিগেডিয়ার ক্লের গাড়ি-ঘোড়া ভারী অস্ত্রশস্ত্র কড্ডা নদী পার করতে ব্যস্ত। অন্যদিকে নবীনগর-সাভারের পথে ব্রিগেডিয়ার সানসিং বাবাজি ১৪ তারিখ থেকে মাঝে মাঝে প্রচণ্ড বাধা পাচ্ছিলেন। পাকিস্তানিদের পরিকল্পনা ছিল আরিচা ও টাঙ্গাইলের দিক থেকে পিছিয়ে নবীনগরে একটা শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলা, যা জামালপুর-টাঙ্গাইলের দিক থেকে এবং আরিচা হয়ে যারাই পিছিয়ে আসবে তারা গড়ে তুলবে। কিন্তু বাস্তবে দুই দিক থেকে পিছিয়ে যাওয়া সৈন্যরা তেমন কোনো প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি। আগে যারা ছিল তারাই বাধা দিচ্ছিল। সাভারে বর্তমান ক্যান্টনমেন্ট এরিয়ায় এক ব্যাটালিয়ন নিয়মিত হানাদার ছিল। তারা ১৫ তারিখ রাতে ব্রিগেডিয়ার সানসিং বাবাজিকে প্রচণ্ড বাধা দেয়। বিশদ বলতে গেলে কয়েক পর্ব লেগে যাবে। এক ব্যাটালিয়নের দুই-আড়াই শ সৈন্য আহত-নিহত হওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। পাকিস্তানিদের সেটাই হয়েছিল। ব্রিগেডিয়ার সানসিং বাবাজির ১৪-১৫ জন শহীদ হন। ১৫ তারিখ সারা রাত যুদ্ধ শেষে ৩০০ জন আত্মসমর্পণ করে। বাকি কিছু সৈন্য ঢাকার দিকে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। কড্ডার পাশে ব্রিগেডিয়ার ক্লেরের সঙ্গে সে রাতে কোনো যুদ্ধ হয়নি। ব্রিগেডিয়ার ক্লের যখন কড্ডা থেকে চৌরাস্তার দিকে এগোবার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তখন জেনারেল নাগরার সঙ্গে হেলিকপ্টারে টাঙ্গাইল থেকে মৌচাকে আসি। আগের রাতে জেনারেল নাগরা ফ্রন্ট লাইনের অস্থির অবস্থার কারণে কাদেরিয়া বাহিনীকে সকালের নাশতা সরবরাহের অনুরোধ করেছিলেন। তাই আমরা প্রায় কুড়ি হাজার যোদ্ধার সকালের খাবারের ব্যবস্থা করেছিলাম। এটাও একটা সৌভাগ্য, মিত্রবাহিনী ১৬ ডিসেম্বর আমাদের খাবার খেয়ে ঢাকা জয় করেছে। মৌচাকে হেলিকপ্টার থেকে নামতে নামতেই ব্রিগেডিয়ার ক্লের বলছিলেন এদিকে কোনো যুদ্ধ হয়নি। কিন্তু সানসিংয়ের দিকে সারা রাত যুদ্ধ হয়েছে। ঢাকার কমান্ড নানা জায়গায় ছোটাছুটি করছে, জাতিসংঘের দূতের কাছে যাচ্ছে এগুলো আমাদের ওয়ারলেসে ইন্টারসেপ্ট হচ্ছে। সানসিংয়ের ওখানে রাতভর প্রচন্ড লড়াই হয়েছে শুনে মৌচাকে হেলিকপ্টার থেকে কিছু নাশতা নামিয়ে ক্লেরকে নিয়ে আমরা সাভার আসি। সারা রাত যুদ্ধ করে সানসিং তখন হেমায়েতপুরের কাছে পৌঁছে ছিলেন। আমরা হেমায়েতপুরের দিকে এগিয়ে গিয়ে ব্রিজের পাশে ফাঁকা মাঠে হেলিকপ্টার থেকে নামি। সানসিং তখন আগের রাতের পুরো ঘটনা বর্ণনা করেন। সেখানে বাকি নাশতা নামিয়ে হেলিকপ্টার আবার টাঙ্গাইলের পথে ছোটে অন্যদের জন্য নাশতা নিয়ে আসতে। ২০ হাজার যোদ্ধার নাশতা কম করে হলেও ৭-৮ টন। যদিও বিশাল হেলিকপ্টার একবারই তা বইবার ক্ষমতা রাখে। কারণ ও ধরনের দুটি করে হেলিকপ্টার আগরতলার দিক থেকে আসা মিত্রবাহিনীর ট্যাংক মেঘনা নদী পার করেছিল। আমরা হেমায়েতপুরের পুলের পাড়ে যখন দাঁড়িয়ে ছিলাম তখন সকাল সাড়ে ৮টা। আমাদের সঙ্গে জেনারেল নাগরা পরামর্শ করে নিয়াজিকে একটা চিঠি দিলেন—

‘প্রিয় আবদুল্লাহ!

আমরা এসে গেছি। তোমার সব ভেলকি খতম হয়ে গেছে। আমরা তোমাকে চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলেছি। বুদ্ধিমানের মতো আত্মসমর্পণ কর। না হলে তোমার ধ্বংস অনিবার্য। আমরা কথা দিচ্ছি, আত্মসমর্পণ করলে জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী তোমাদের সঙ্গে আচরণ করা হবে। তোমাকে বিশেষভাবে লিখছি, আত্মসমর্পণ করলে তোমার জীবনের নিরাপত্তা দেওয়া হবে।

তোমারই

মেজর জেনারেল নাগরা

১৬/১২/৭১

০৮-৩০ মিনিট।’

বিদেশি নাগরিকদের সরিয়ে নেওয়ার জন্য ১০টা পর্যন্ত বিমান হামলা বন্ধ রাখা হয়েছিল। ১০টার পর যেমন আকাশপথে আক্রমণ শুরু হবে, ঠিক তেমনি মিত্রবাহিনীর কামানের নল ঢাকার দিকে তাক করা ছিল। ১০টা বাজতেই শুরু হবে। তাই নিয়াজিকে সাবধান করে দিতে কবিগুরুর ‘শেষের কবিতা’র মতো শেষ পত্র বা হুঁশিয়ারি।

১৬ ডিসেম্বর ঢাকা বিজয় পর্বটা এভাবে শেষ করতে পারলেই ভালো হতো। কিন্তু শিক্ষকদের আন্দোলন ও রংপুর সিটি করপোরেশনের নির্বাচন নিয়ে সারা দেশে যে হৈ-হুল্লোড় সে ব্যাপারে পাঠকদের কিছু না বললে তাদের বঞ্চিত করা হবে। তাই ’৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর ঢাকা বিজয় নিয়ে পরের পর্বে আলোচনা করলে তেমন কিছু হবে না।

মানুষ গড়ার কারিগর শিক্ষকসমাজ। তার মধ্যে প্রাথমিক শিক্ষকদের দারুণ বৈষম্যের কারণে কয়েক দিন তারা শহীদ মিনারে অনশন ও অবস্থান করছেন। শিক্ষক হলেও জানেন না এক নাগাড়ে তিন দিন পানি পান না করলে শরীরের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ কিডনি নষ্ট হয়ে যায়। অনেকে না জেনে পানি মুখে তুলছেন না। সেদিন গিয়েছিলাম তাদের কর্মসূচিতে। আমার কাছে অবাক লেগেছে। প্রাথমিক শিক্ষকদের দাবি মানা না হলে ৬৪-৬৫ হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অশান্তির সৃষ্টি হবে, শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট হবে। ’৭৩ সালে বঙ্গবন্ধুর সময় প্রাথমিক শিক্ষা জাতীয়করণ করে প্রধান শিক্ষক আর সহকারী শিক্ষকদের বেতনের পার্থক্য ছিল ১০ টাকা। এখন তা হয়েছে ২৩০০ টাকা। একই যোগ্যতা একই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে কেউ প্রধান শিক্ষক, কেউ আবার সহকারী শিক্ষক হন। তাদের শুরুতেই ২৩০০ টাকার বেতন ব্যবধান! ১৫-১৬ বছর পর ব্যবধান হবে দ্বিগুণ। একই সঙ্গে চাকরিতে যোগদান করা প্রধান ও সহকারী শিক্ষক অবসরে যাবেন। প্রধান শিক্ষকের বেতন হবে ৪৭-৪৮ হাজার, সহকারী শিক্ষকের হবে ২৪ হাজার। এমন বৈষম্য পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানও করেছে বলে মনে হয় না। তাই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে শিক্ষকদের ন্যায়সঙ্গত দাবি ব্যক্তিগত উদ্যোগে দেখতে ও সম্মানজনক সমাধান করতে অনুরোধ জানিয়েছি। আমার বিশ্বাস বঙ্গবন্ধুকন্যা বিষয়টি যথাযথ গুরুত্বের সঙ্গে দেখবেন। যদিও তার মন্ত্রী জনাব ফিজার বলেছেন, কোনোক্রমেই বেতন বৃদ্ধি করা হবে না। তিনি বলতেই পারেন। শিক্ষকরা কোনো বেতন বৃদ্ধি চাইনি, তারা বৈষম্য দূর করতে বলেছেন, গ্রেড বৈষম্য দূর করতে বলেছেন। মানুষ গড়ার কারিগররা পিয়ন-চাপরাশির গ্রেডে থাকলে জাতির সম্মান থাকে না। বিষয়টা নিয়ে পুরো এক পর্ব লিখলেও শেষ হবে না। প্রয়োজন হলে পরে এ প্রসঙ্গে অবশ্যই লিখব।

রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের পর যে আলোচনা ও মূল্যায়ন শুনছি মনে হয় এটা সার্বিক মূল্যায়ন নয়। কেন যেন অনেকেই ঠিক জিনিসটা দেখার চেষ্টা করছেন না। কেউ কেউ হয়তো জেনে-শুনে ব্যাপারটা এড়িয়ে যাওয়ার বা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করছেন। প্রথমেই বলা যায় নির্বাচন কমিশনের দাবি রংপুর সিটি করপোরেশনের নির্বাচন একটি মডেল। ব্যাপারটা সে রকম মনে হয় না। যদিও বিএনপি মহাসচিব বলেছেন, ‘নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে।’ জনাব রিজভী বলেছেন, ‘সূক্ষ্ম কারচুপি হয়েছে।’ এমন বক্তব্য আসতেই পারে। কারণ দেশে এখন কোনো শৃঙ্খলা নেই। সব জায়গায় চেইন অব কমান্ড ভেঙে গেছে। শুধু শৃঙ্খলা বাহিনীতেই চেইন অব কমান্ড বা সিনিয়রিটি থাকে না, রাজনীতিতেও চেইন অব কমান্ড থাকে। এখন সেসব নেই। সেজন্য সবকিছু এতটা লাগামহীন। হ্যাঁ, এটা স্বীকার করতেই হয় রংপুরে একটা ভালো নির্বাচনী মহড়া হয়েছে, ৬০-৬৫ শতাংশ ভোট পড়েছে। দু-চারটি কেন্দ্রে ধস্তাধস্তি হলেও তা উল্লেখ করার মতো কিছু নয়। কিন্তু কীভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচন হলো বুঝতে পারছি না। আগেকার দিনে গ্রামেগঞ্জে কোনো খেলায় কোনো দল অনুপস্থিত হলে কমিটির টিম খেলায় অংশ নিয়ে দর্শকদের সান্ত্বনা দিত। ব্যাপারটা এখনো আছে। এখনো কোনোখানে কোনো খেলায় প্রতিদ্বন্দ্বী দল হঠাৎ অনুপস্থিত থাকলে কমিটির টিম মাঠে নেমে দর্শকদের সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করে। রংপুর সিটি নির্বাচন যে তেমন কিছু নয়, সে কথা বলি কী করে? বরং এখানে কমিটির টিমও খেলেনি, একই টিম দুই ভাগ হয়ে খেলেছে। জাতীয় পার্টি সরকারি জোটের অংশ। জাতীয় পার্টি যেমন সরকারি দল, তেমনি বিরোধী দল। পৃথিবীর কোথাও এ ধরনের হাস্যকর সমীকরণ পাওয়া যাবে না। একই দল সরকারে, আবার বিরোধী দলে। ভোট ছাড়া সংসদ। সেই সংসদের এক অংশ জাতীয় পার্টি। জাতীয় পার্টি ভোট ছাড়া নির্বাচনের পর সরকারে না গিয়ে সংসদে বিরোধী দল থাকলে না হয় কিছুটা সম্মান করা যেত। কিন্তু এভাবে জাতীয় পার্টি-প্রধান মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত, সরকারি দল আবার বিরোধী দল। এ রকম অবস্থায় রংপুরের নির্বাচনের তত গুরুত্ব থাকার কথা নয়। কিন্তু সেটা নিয়েই নাচানাচি। কারণ ‘নাই মামার চাইতে কানা মামা’ অবশ্যই ভালো। হ্যাঁ, এটাকে একটা নির্বাচন হিসেবে মেনে নিতে তেমন কষ্ট হতো না, যদি ছয় মাস আগেও হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূতের পদ থেকে সরে যেতেন, জাতীয় পার্টির মন্ত্রীরা মন্ত্রিসভা থেকে বেরিয়ে আসতেন, তারপর নির্বাচন হতো এবং তাতে এই ফল হলে নিশ্চয়ই ধন্যবাদ পাওয়ার মতো হতো। কিন্তু ব্যাপারটা তেমন হয়নি। লোকজন বলছে, এটা একটা পাতানো কৌশল। হতেই পারে, আবার নাও হতে পারে। কাউন্সিলর নির্বাচন ব্যাপারটাকে আরও ঘোলাটে করে দিয়েছে। কারণ জাতীয় পার্টির মেয়রের তুলনায় আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী তিন ভাগের এক ভাগ ভোট পেয়েছেন। কাউন্সিলর প্রার্থীর তিন ভাগের এক ভাগ ভোট পাওয়া উচিত। সেখানে কিছু রিয়াদ মুরিদ করে তিন ভাগের দুই ভাগ তো জাতীয় পার্টি অবশ্যই পাবে। তা হলেও তো আওয়ামী লীগ ১৪, বিএনপি ৮ আর জাতীয় পার্টি ২ এমন হওয়ার কথা নয়। তাই নিশ্চয়ই ডাল মে কুচ কালা হ্যায়। নির্বাচনী ফলাফলের কিছু আগে মশিউর রহমান রাঙা বলেছিলেন, ‘ভোটের ফলাফল যা দেখছি তাতে আমরা জিতব। আমরা তো সরকারেরই অংশ। সরকারের সঙ্গে আমাদের ভালো সম্পর্ক।’ শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অনেক নেতারই সন্দেহ ছিল, সারা দিন ভোট যাই হোক, গোনাগুনতিতে কী হয়? ব্যাপারটা ভালো নয়। এটা অনাস্থার বহিঃপ্রকাশ। আওয়ামী লীগ এবার নির্বাচনে দ্বিতীয় হয়েছে। ’৯১ সালে জাতীয় নির্বাচনে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ জেলখানা থেকে পাঁচ সিটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পাঁচটাতেই জয়ী হয়েছিলেন। একজন সদস্য একটি আসনের বেশি রাখতে পারেন না। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদও তার চারটি ছেড়ে একটি রেখেছিলেন। তখন বেগম খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী। তিনি বাংলাদেশের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী। সেই উপনির্বাচনে বর্তমান মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে রংপুর গিয়েছিলাম। জাকারিয়া ভূইয়ার উপহার লাল নিশান গাড়িতে তার সঙ্গে পাশাপাশি বসে পাঁচ-ছয় দিন নির্বাচনী প্রচার করেছিলাম। রাত দেড়টা-দুইটা পর্যন্ত প্রচার চলেছে। তখনকার প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াও তিন-চার দিন ছিলেন। তখন প্রধানমন্ত্রীর দলীয় প্রচারে অংশ নিতে বাধা ছিল না। বিরোধী দলের নেত্রী হিসেবে জননেত্রী শেখ হাসিনা এক নাগাড়ে সাত-আট দিন ছিলেন। আমি ছিলাম নির্বাচনী প্রচারের শেষ দিন পর্যন্ত। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া রংপুর সার্কিট হাউসের দোতলায় আর বিরোধী দলের নেত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা ছিলেন নিচতলায়। এক রাতে খাবার জন্য প্রধানমন্ত্রী বিরোধী দলের নেত্রীকে আহ্বান করেছিলেন। মোসাদ্দেক আলী ফালু প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে রাতে খাবারের দাওয়াত নিয়ে বিরোধী দলের নেত্রীর কাছে এসেছিলেন। নেত্রী বলেছিলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী আমাকে কী খাওয়াবে, এটা আমার শ্বশুরবাড়ি। আমারই তো তাকে খাওয়ানোর কথা।’ মোসাদ্দেক আলী ফালু প্রধানমন্ত্রীকে গিয়ে জানালে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘সে নিশ্চয়ই হবে। শ্বশুরবাড়ি হিসেবে তার দাওয়াতেও যাব। কিন্তু আজ আমার দাওয়াতে তাকে আসতে বলো।’ মোসাদ্দেক আলী প্রধানমন্ত্রীর কথা জানালে জননেত্রী বলেছিলেন, ‘বজ নির্বাচনী প্রচারে বাইরে আছে। ওকে ছাড়া খাব না।’ ফালু প্রথম প্রথম বেশ থতমত খেয়ে গিয়েছিলেন। বজ  কে, তার জানার কথা নয়। তেমন বেশি কেউ কাদের সিদ্দিকীর ডাকনাম বজ জানত না। আর জননেত্রী শেখ হাসিনা আমাকে কখনো কাদের বলে ডাকেন না। তার কারণ ড. ওয়াজেদ মিয়ার বাবার নাম আবদুল কাদের মিয়া। ছেলের বউরা শ্বশুরের নাম নেয় না। সে কারণেই তিনি আমার ডাকনামেই ডাকেন। তাতে আমার বেশ ভালোও লাগে। কারণ আমার প্রিয় বজ নামে ডাকার খুব বেশি মানুষ নেই। সেই নির্বাচনী প্রচার ছিল অসাধারণ। আওয়ামী লীগের প্রচারের কাছে বিএনপির প্রচার কোনো ধর্তব্যের মধ্যেই ছিল না। জাতীয় পার্টির প্রচার-প্রপাগান্ডাও আওয়ামী লীগের কাছাকাছি ছিল না। কিন্তু তবু কেন যেন মনে হচ্ছিল ভোটের ফলাফল আমাদের পক্ষে আসবে না। একদিন এক সকালে ১০টা-সাড়ে ১০টার দিকে মিঠাপুকুর স্কুল মাঠে নির্বাচনী সভা ছিল। প্রচুর লোক হয়েছিল। সভানেত্রী এসে গিয়েছিলেন। আমি আরেকটি সভায় অংশ নিয়ে ফিরছিলাম। প্রচণ্ড ভিড় ছিল বলে মূল সড়কে গাড়ি ছেড়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম। কে এক স্থানীয় বক্তা বক্তৃতা করছিল, ‘এরশাদের বাড়িতে টাকা পাওয়া গেছে, এরশাদের চরিত্র খারাপ, দু-তিনটা বউ।’ এক রিকশাওয়ালা সিটে বসে হ্যান্ডেলের ওপর পা রেখে বক্তব্য শুনে বলছিল, ‘রাজার বাড়ি টাকা থাকবে না তো কার বাড়ি থাকবে। এরশাদ হচ্ছে দেশের রাজা। আর দু-তিনটা বিয়ে! আমারও তো দুটা বউ।’ আমার শরীর রি রি করে উঠেছিল। মঞ্চে গিয়ে জননেত্রীকে রিকশাওয়ালার মন্তব্য শুনিয়েছিলাম। সেই নির্বাচনে মিজানুর রহমান চৌধুরী, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের ভাই আরও কে যেন প্রার্থী ছিলেন। তারা চারজনই জিতেছিলেন। সবখানে আওয়ামী লীগ দ্বিতীয়, সরকারি দল বিএনপি তৃতীয় স্থান অধিকার করেছিল। জাতীয় পার্টির সঙ্গে আওয়ামী লীগের ব্যবধান ছিল ৩০-৪০, ৬০-৭০ হাজার আর বিএনপি কোনো আসনেই ৩ হাজারের ওপরে ভোট পায়নি।

হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে নিয়ে হয়তো ভাবা যেত, মানুষ তাকে অনেক দিয়েছে, সে তুলনায় তিনিই বরং মানুষকে তেমন কিছু দেননি বা দিতে পারেননি। এশিয়া মহাদেশে কোনো সামরিক শাসক ক্ষমতা হারিয়ে রাজনীতিতে টেকেননি। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খানের কাছে জেনারেল ইস্কান্দার মির্জা ক্ষমতা হারিয়ে লন্ডনে এক চায়ের দোকানের ম্যানেজার হয়েছিলেন।

গণআন্দোলনে আইয়ুব-মোনায়েমের পতন হলে তাদের আর কোনো খবর পাওয়া যায়নি। এরপর ইয়াহিয়া, তার করুণ পরিণতি সবার জানা। বাংলাদেশের প্রথম সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান বীরউত্তম, তিনি ক্ষমতা হারিয়ে পরীক্ষা দিতে পারেননি। একমাত্র হুসেইন মুহম্মদ এরশাদই এক সেনানায়ক, তার আগে-পিছে শত সহস্র অন্ধকার থাকার পরও তিনি তিনবার ভোটে দাঁড়িয়ে সব কটি আসন জিতেছেন। অথচ লোকজন বলে তার কথার ঠিক নেই। গাধার নাকের ডগায় মুলা ঝোলানোর মতো তার ডগায় সরকার বেশ কিছু মামলা ঝুলিয়ে তাকে পুরুষের বিপরীত করেছে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক যথার্থ বলেছেন, ‘হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সম্পর্কে শেষ কথা বলার সময় আসেনি।’ এই যদি একজন নেতার অবস্থা হয়, তাহলে তার পরিণতি কখনো আলোকময় হয় না। ’৯১-এর উপনির্বাচনে মিজানুর রহমান চৌধুরী ও শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন নির্বাচিত হলে তাদেরই দু-এক বছর দলের নেতৃত্ব-কর্তৃত্ব দিলে জাতীয় পার্টি এবং বাংলাদেশের ইতিহাস হয়তো অন্যরকম হতো। কিন্তু তা না করে তিনি তার বান্ধবীদের কথায় রাজনীতি এবং দল পরিচালনা করে আজকের অবস্থায় এসেছেন। এখন অনেক বয়স হয়েছে, শরীর তাকে তেমন সাহায্য করছে বলে হাঁটা-চলায় মনে হয় না। দেখা যাক, পরের কথা পরে বলা যাবে। এখন অপেক্ষা করাই ভালো।

লেখক : রাজনীতিক।

সর্বশেষ খবর