মঙ্গলবার, ২৬ ডিসেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

জেরুজালেম ইসরায়েলের রাজধানী : কোন মতলবে?

তুষার কণা খোন্দকার

জেরুজালেম ইসরায়েলের রাজধানী : কোন মতলবে?

বর্তমান সময়ে মুসলমানরা ভয়ানক প্রতিকূল অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। পশ্চিমা দুনিয়ার চোখে মুসলমানদের একমাত্র পরিচয় তারা মৌলবাদী, সন্ত্রাসী। নব্বইয়ের দশকে মধ্যপ্রাচ্যে আল-কায়েদার উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে পশ্চিমা দুনিয়ার কানে মুসলমান পরিচয়ের প্রতিশব্দ মৌলবাদী, সন্ত্রাসী বলে ধ্বনিত হতে শুরু করেছে, যা আর থামছে না। বিন লাদেনের মৃত্যু এবং আল-কায়েদার ঘাঁটিগুলো বিধ্বস্ত হওয়ার পর আমরা ভেবেছিলাম মুসলমানদের গায়ে লেপে দেওয়া সন্ত্রাসী কলঙ্কের কালি হয়তো এবার মুছবে। কিন্তু বাস্তবে তা ঘটেনি। আল-কায়েদা মরে ভূত হওয়ার পরে তাকে কল্পনার রাজ্যে বাঁচিয়ে রাখা যখন কঠিন হয়ে গেল, তখন আইসিস নামের প্রাগৈতিহাসিক জান্তব শক্তির উত্থান। আল-কায়েদা মরার পরে আইসিস নামের দানব কে পয়দা করল আর কে তাকে লালন করল পশ্চিমা দুনিয়া তা জানে। তারা যে তা জানে তার প্রমাণ গত বছর আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় ডোনাল্ড ট্রাম্প তার নির্বাচনী সভায় প্রকাশ্যে অনেকবার বলেছেন, ‘বারাক ওবামা ও মিসেস ক্লিনটন আইসিস পয়দা করেছেন।’ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের অভিযোগ সত্য না মিথ্যা তা আমাদের পক্ষে খতিয়ে দেখা সম্ভব নয়। তবে আমরা জানি, কোনো ভয়ানক শক্তিশালী পৃষ্ঠপোষক না পেলে আইসিসের মতো দানবীয় শক্তির জন্ম হতে পারে না। জন্মের পর থেকে আইসিস মধ্যপ্রাচ্যের দেশে দেশে গণহারে মুসলমান নিধন করার পরও পশ্চিমা দুনিয়ার চোখে ওরা মুসলমানদের শত্রু নয়। বরং তারা দুনিয়ার সব মুসলমানকে আইসিস বলে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার মিশনে ব্যস্ত।

আমেরিকা ও তার মিত্ররা আল-কায়েদাকে শায়েস্তা করার অজুহাতে ইরাক ও আফগানিস্তানে যেভাবে যুদ্ধ করল একে গণহত্যা ছাড়া আর কী বলা যেতে পারে। ইরাক ও আফগানিস্তানে গণহত্যা এবং ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে যখন আল-কায়েদা ভূতকে আর বাঁচিয়ে রাখা গেল না, তখন আইসিস নামের আরেকটি ভূতের জন্ম। আল-কায়েদা নিঃশেষ হওয়ার পর আইসিসকে হাতিয়ার বানিয়ে কয়েক বছর ধরে মধ্যপ্রাচ্যে ধ্বংসের তাণ্ডব চলল। আইসিস নিধনের ভয়ঙ্কর যুদ্ধে আইসিস, ইউরোপিয়ান ও আমেরিকান কয়টা মরেছে জানি না তবে মধ্যপ্রাচ্যের বাসিন্দা নারী-শিশুসহ সাধারণ মানুষের রক্তে মধ্যপ্রাচ্যের মাটি ভিজে গেছে। অনেক রক্ত ঝরার পরে অবশেষে আইসিস নামের ভূত যখন মরল, তখন আমরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ভাবলাম, যাক বাঁচা গেল। দুনিয়ার শান্তিপ্রিয় মানুষকে প্রতিদিন সংবাদমাধ্যমে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ দেখে আর বিষণ্ন হতে হবে না। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের। যেদিন ইরাকের প্রেসিডেন্ট রাষ্ট্রীয় ঘোষণায় ইরাককে আইসিসমুক্ত ঘোষণা করেছেন সেই দিনই আমেরিকার প্রেসিডেন্ট আচমকা জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী ঘোষণা করে মধ্যপ্রাচ্যকে উত্তপ্ত করে তুললেন। ইসরায়েল তার নিজ দেশের রাজধানী তেলআবিব বলে মানলেও আমেরিকার প্রেসিডেন্ট গায়ে পড়ে জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী কেন ঘোষণা করলেন সেটি একটি বিস্ময়কর প্রশ্ন। ইসরায়েলের রাজধানী তেলআবিব নাকি জেরুজালেম, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্ব আমেরিকার প্রেসিডেন্টের ওপর কীভাবে বর্তাল তা দুনিয়াবাসী ভেবে ঠাহর করতে পারে না। আমার মনে হচ্ছে, আল-কায়েদা কিংবা আইসিস জমানা শেষ হওয়ার পরে পাছে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি ফিরে আসে, সেই আতঙ্কে অস্থির হয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী ঘোষণা করতে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। ডোনাল্ড ট্রাম্পের উন্মত্ত আচরণ দেখে প্যালেস্টাইনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস বললেন, ‘ডোনাল্ড ট্রাম্প জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী ঘোষণা করে মধ্যপ্রাচ্যে দোজখের দরজা খুলে দিলেন।’ মাহমুদ আব্বাসের কথা শুনে আমি ভাবলাম, ১৯১৭ সালে ইংল্যান্ড বালফুর ঘোষণার মধ্য দিয়ে ইসরায়েল রাষ্ট্রের জন্ম দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে দোজখের দরজা হাট করে খুলে দিয়েছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প নতুন কিছু করেননি। তিনি বিনা প্রশ্নে তার পূর্বসূরিদের পদাঙ্ক অনুসরণ করেছেন। ইংল্যান্ডের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আর্থার বালফুর ১৯১৭ সালে মধ্যপ্রাচ্যে দোজখের দরজা খুলে দেওয়ার পরে গত ১০০ বছরে কেউ কি সেই দরজা আর বন্ধ করেছে? বরং একটি দরজা বন্ধ হওয়া মাত্র ইসরায়েলের পশ্চিমা মিত্ররা নতুন একটি দরজা খুলতে এক সেকেন্ডও দেরি করে না। নব্বইয়ের দশকে প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন (পিএলও) যখন শান্তির পথে এসে ইসরায়েল রাষ্ট্রের অস্তিত্ব মেনে নিয়েছিল তখনই হামাস সন্ত্রাসী হামলায় সব লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছিল। ইসরায়েল অনুমান করেছিল, পিএলও শান্তির পথে এগিয়ে এলে ইসরায়েলকে তার অনৈতিক ভূমিদস্যুবৃত্তি থেকে সরে আসতে হবে। মধ্যপ্রাচ্যে দোজখের দরজা খোলা রাখার জন্য ইসরায়েল কাঁড়ি কাঁড়ি ডলার ব্যয় করে অনেক আগে থেকেই হাজী ইয়াসিন ও তার হামাস সৃষ্টি করেছিল।

২০১৭ সালে বালফুর ঘোষণার ১০০ বছর পূরণ হলো। ১৯১৭ সালের ২ নভেম্বর ইংল্যান্ডের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আর্থার বালফুর ব্রিটেনের ইহুদি সম্প্রদায়ের নেতা লর্ড রথশিল্ডকে কয়েক লাইনের একটি চিঠি লিখে মধ্যপ্রাচ্যে দোজখ নামিয়ে আনার ব্যবস্থা করেছিলেন। কয়েক লাইনের সেই চিঠিতে বালফুর সে সময়ে অটোমান সাম্রাজ্যের শাসনাধীন প্যালেস্টাইনকে ইংল্যান্ড ও আয়ারল্যান্ডের ইহুদি ফেডারেশনকে উপহার দিয়ে দিলেন। তিনি বললেন, ইহুদিরা দীর্ঘদিন তাদের নিজস্ব একটি আবাসভূমি পাওয়ার স্বপ্ন লালন করে আসছে। ইহুদিদের দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্নকে গুরুত্ব দিয়ে তার দেশের সরকার প্যালেস্টাইনে ইহুদিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অনুমতি দিচ্ছে। ভেবে দেখুন, প্যালেস্টাইন কোনো জনমানবহীন নির্জন দ্বীপ নয়। সে সময় অটোমান শাসনের অধীনে প্যালেস্টাইনে তিন সম্প্রদায়ের মানুষ— মুসলমান, খ্রিস্টান ও ইহুদিরা মিলেমিশে বাস করছিল। প্যালেস্টাইনের আদি বাসিন্দা মুসলমান, খ্রিস্টান ও ইহুদিরা যদি অটোমান শাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে প্যালেস্টাইনকে অটোমান শাসন থেকে মুক্ত করে ফেলত, তাতে কারও কিছু বলার থাকত না। কিন্তু ইংল্যান্ড কোন অধিকারে প্যালেস্টাইনকে ইংল্যান্ডের ইহুদি ফেডারেশনকে উপহার দিয়ে দিল, সে প্রশ্ন কে তুলবে?

ইসরায়েল রাষ্ট্রের জন্মের আগে প্যালেস্টাইনবাসী ইহুদিরা সেখানে কষ্টে ছিল তেমন নয়। প্যালেস্টাইন ভূখণ্ডে ইসরায়েল রাষ্ট্রের জন্ম দেওয়ার জন্য তাওরাতকে ধর্মীয় ছুতা হিসেবে কাজে লাগানো হয়েছে। সাড়ে চার হাজার বছর আগে চালু হওয়া তাওরাতে বলা হয়েছে, ঈশ্বর যিহুবা ইহুদিদের নবী মোজেসকে জেরুজালেম উপহার দেবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। সেই প্রতিশ্রুতির কারণে জেরুজালেম ইহুদিদের জন্য ‘প্রতিশ্রুত ভূমি’। খ্রিস্টজন্মের আগে প্যালেস্টাইন দখলকারী গ্রিকবীর আলেকজান্ডার থেকে শুরু করে প্যালেস্টাইনের সর্বশেষ শাসক অটোমান সম্রাটদের আমল পর্যন্ত ইহুদিদের ঈশ্বর যিহুবা তার প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করার শক্তি অর্জন করতে পারলেন না। অবশেষে ১৯১৭ সালে অটোমান শাসন দুর্বল হয়ে পড়ার পর ইংল্যান্ডের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বালফুর যিহুবার পক্ষে ইহুদিদের প্যালেস্টাইন রাষ্ট্র উপহার দিলেন। আসলে ইউরোপবাসী খ্রিস্টানরা তাদের জন্মশত্রু ইহুদিদের হাত থেকে মুক্তি চাচ্ছিল। খ্রিস্টানরা বিশ্বাস করে ইহুদিরা তাদের প্রভু যিশুকে শূলে চড়ানোর নাটের গুরু। সেই অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে বহু শতাব্দী ধরে খ্রিস্টানরা ইহুদিদের ঘৃণা করে আসছে। ইউরোপে তারা ইহুদিদের নিজেদের বসবাসের জায়গায় প্রতিবেশী হিসেবে গ্রহণ করেনি। গরুর খোঁয়াড়ের মতো ঘেটো বানিয়ে তারা ইহুদিদের বন্দী করে রেখে তাদের প্রভু যিশু হত্যার প্রতিশোধ নিয়েছে। ইউরোপের রাজরাজড়াদের সিংহাসন আরোহণকে মহিমান্বিত করার জন্য খ্রিস্টান প্রজারা রাজা-রানীর অভিষেক অনুষ্ঠানে একেকজন ইহুদিকে ঘেটো থেকে বের করে এনে তাকে লাথি-ঘুষি মেরে ফূর্তি করত। এসব তথ্য সত্য নাকি মিথ্যা তা ইউরোপিয়ানদের লেখা ইতিহাস থেকে পাঠককে পড়ে নিতে বলব। এ কথা সত্য যে, ইউরোপের খ্রিস্টানরা তাদের জানি দুশমন ইহুদিদের হাত থেকে রেহাই পাওয়ার উপায় খুঁজছিল। ইসরায়েল রাষ্ট্রের জন্ম দিয়ে ইউরোপের খ্রিস্টানরা এক ঢিলে অনেক পাখি মেরেছে। ইসরায়েলের জন্ম দিয়ে তারা নিজেদের সমাজ থেকে ইহুদিদের নির্বাসিত করেছে। সেই সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যে চিরঅশান্তির বীজ বুনে পেট্রোলিয়ামের ওপর তাদের আধিপত্য কায়েম করে নিয়েছে।

আইসিস কিংবা আল-কায়েদা জন্ম থেকে ধ্বংস হওয়া পর্যন্ত এক নাগাড়ে মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোয় ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে গেছে। মুসলমানদের তারা নির্বিচারে হত্যা করেছে। কিন্তু আইসিস-আল কায়েদা কখনো ইসরায়েলের দিকে একটি ঢিলও ছুড়ে মারেনি। মধ্যপ্রাচ্যে আল-কায়েদা কিংবা আইসিসের জন্মের আগে ইসরায়েল যুদ্ধের হুমকির মধ্যে থাকত। প্রতিবাদীরা হারুক কিংবা জিতুক সেটি বড় কথা নয়, প্রতিবার ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদ করে তাদের ভিটেমাটি দখল করার সময় ইসরায়েলকে অনেক ঝামেলা পোহাতে হয়েছে। কিন্তু এখন তারা গাজা কিংবা পশ্চিমতীরে ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদ করে অবাধে ইহুদি জনপদ গড়ে তুলছে। ইসরায়েলি বুলডোজার ফিলিস্তিনিদের বসতবাড়ি, ফসলি খেত সব লণ্ডভণ্ড করে দিচ্ছে কিন্তু ভিটেমাটি ছেড়ে উচ্ছেদ হওয়া ফিলিস্তিনিদের পক্ষে কথা বলার মতো সুহৃদ মধ্যপ্রাচ্যে অবশিষ্ট নেই।

আল-কায়েদা ও আইসিস নিঃশেষ হয়ে যাওয়ায় আমেরিকা মহাবিপাকে পড়েছে। এখন তারা কী ছুতায় মধ্যপ্রাচ্যে তাদের আধিপত্য ধরে রাখবে? বালফুর ঘোষণার ১০০ বছর পূর্তির বছর ২০১৭ সালে প্রমাণ হলো দুর্জনের ছলের অভাব হয় না। আইসিস-আল-কায়েদা মরে গেলেও মধ্যপ্রাচ্যে অশান্তির হোতা ইসরায়েল কিংবা আমেরিকা তো এখনো মরেনি। কাজেই মধ্যপ্রাচ্যে অশান্তির আগুন জ্বালিয়ে রাখার তাগিদে ডোনাল্ড ট্রাম্প তড়িঘড়ি জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী বলে ঘোষণা করেন। ইসরায়েলের জন্মদাতা ইউরোপ এবার আমেরিকার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছে। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের ১৫টি সদস্য রাষ্ট্রের মধ্যে ১৪টি আমেরিকার বিরুদ্ধে নিন্দা প্রস্তাব উত্থাপন করলে আমেরিকা তাতে ভেটো প্রয়োগ করে। সেই সঙ্গে আমেরিকা গলা উঁচিয়ে বলছে, যারা আমেরিকার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছে আমেরিকা তাদের এক হাত নেবে। আমেরিকার ধমক শুনে ইউরোপ ভয়ে কুঁকড়ে গেছে নাকি তারা এখন বিদ্রূপের হাসি হাসছে, তা দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। আমার মনে হয়, ইউরোপের সাহায্য বিনা আমেরিকা দুনিয়ার মোড়লগিরি বেশি দিন কব্জায় রাখতে পারবে না। চীন কিংবা রাশিয়া ওটি আমেরিকার হাত থেকে খপ করে কেড়ে নেবে। দুনিয়ার মোড়লগিরি আমেরিকার হাতছাড়া হয়ে গেলে দুনিয়ার লাভ হবে না ক্ষতি হবে— তা সময়ই বলে দেবে।

লেখক : কথাসাহিত্যিক।

সর্বশেষ খবর