মঙ্গলবার, ২৬ ডিসেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

প্রতিবন্ধীরাও পরিবার, সমাজ ও দেশের অংশ

শেখ সালাহ্উদ্দিন আহমেদ

অটিজম কোনো মানসিক রোগ বা মানসিক প্রতিবন্ধিতা নয়। তবে সমাজে এর ব্যাপকতা দিন দিন বেড়েই চলেছে। এটি মূলত শিশুদের মস্তিষ্কের স্বাভাবিক বিকাশজনিত একটি সমস্যা, যা তার সামাজিক সম্পর্ক স্থাপনে বাধা সৃষ্টি করে। এর অন্য নাম অটিজম স্পেকট্রাম সিনড্রোম (এএসডি)। বিজ্ঞানীরা স্নায়ুতন্ত্রের বিকাশজনিত সমস্যা হিসেবে উল্লেখ করেছেন। অটিজমে মস্তিষ্কের গঠনতন্ত্রে বিশেষ কোনো পার্থক্য থাকে না, কিন্তু এর চিন্তাধারা ও কার্যাবলি ভিন্নধারায় ও ভিন্ন খাতে পরিচালিত হয়।

প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার প্রতিষ্ঠা ও সুরক্ষা নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে বাংলাদেশের প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইনে তাদের শারীরিক, মানসিক, বুদ্ধিগত, বিকাশগত, ইন্দ্রিয়গত ক্ষতিগ্রস্ততা ও প্রতিকূলতার ভিন্নতা বিবেচনায়, প্রতিবন্ধিতার বেশ কয়েকটি ধরন রয়েছে। অটিজম বা অটিজম স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডারস, শারীরিক প্রতিবন্ধিতা, মানসিক অসুস্থতাজনিত প্রতিবন্ধিতা, দৃষ্টি প্রতিবন্ধিতা, বাক প্রতিবন্ধিতা, বুদ্ধি প্রতিবন্ধিতা, শ্রবণ প্রতিবন্ধিতা, শ্রবণ-দৃষ্টি প্রতিবন্ধিতা, সেরিব্রাল পালসি, ডাউন সিনড্রোম, বহুমাত্রিক প্রতিবন্ধিতাসহ মোট ১২ ধরনের প্রতিবন্ধিতাকে চিহ্নিত করা হয়েছে। সমাজকল্যাণ অধিদফতরের উদ্যোগে দেশের প্রতিবন্ধিতা শনাক্তকরণ জরিপ কর্মসূচি পরিচালিত হয়। গত ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত পরিচালিত এ জরিপে দেখা গেছে, দেশে মোট প্রতিবন্ধী ১৫ লাখ ৯ হাজার ৭১৬ জন। এর মধ্যে ৪৫ হাজার ৪০৪ জন হচ্ছে অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন। জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদের (সিআরসি) ২৩ ধারা অনুযায়ী, অন্যান্য স্বাভাবিক শিশুর মতো প্রতিবন্ধী শিশুরাও সমঅধিকার ও সমসুযোগ পাওয়ার অধিকারী।

২০০৬ সালের ১৩ ডিসেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে সর্বসম্মতিক্রমে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকারবিষয়ক একটি সনদ (সিআরডিপি) গৃহীত হয়। এ সনদ ২০০৮ সালের ৩ মে থেকে কার্যকর হয়। সিআরসি ও সিআরপিডি সনদে স্বাক্ষরকারী রাষ্ট্রগুলো প্রতিবন্ধী শিশুসহ সব শিশু যেন কোনো ধরনের বৈষম্য ছাড়াই তাদের অধিকার ভোগ করতে পারে, তা নিশ্চিত করবে। এ দুটি সনদে স্বাক্ষরকারী দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশও রয়েছে। জাতীয় শিশু নীতিমালায়ও প্রতিবন্ধী শিশুসহ সব শিশুর অধিকার সুরক্ষার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশের বাস্তবতা ভিন্ন। প্রতিবন্ধীদের প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি নেতিবাচক। তাদের মেধার বিকাশে যথেষ্ট উদ্যোগ নেই। প্রতিবন্ধীদের দিয়ে কিছুই হবে না, এই ভেবে তাদের বাতিলের খাতায় ফেলে রাখা হয়। এমনকি নিজ পরিবারেও প্রতিবন্ধী শিশুরা নিগৃহীত হয়। তাদের বোঝা মনে করা হয়। জীবনের প্রতি পদে তারা হয় অবহেলার শিকার।

জাতীয় শিক্ষানীতিতে প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য বিশেষ শিক্ষা নিশ্চিত করার ব্যাপারে জোর দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী কল্যাণ আইন, ২০০১-এও প্রতিবন্ধী শিশুদের শিক্ষাসেবা পাওয়ার কথা বলা হয়েছে। তার পরও শিক্ষা ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধী শিশুদের অংশগ্রহণ খুবই কম।

জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল (ইউনিসেফ) তার বিশ্ব শিশু পরিস্থিতি, ২০১৩ প্রতিবেদনে প্রতিবন্ধী শিশুদের উন্নয়নে কয়েকটি সুপারিশ করেছে। এগুলো হচ্ছে : প্রতিবন্ধী মানুষের অধিকার সনদ ও শিশু অধিকার সনদ অনুমোদন ও বাস্তবায়ন করতে হবে। বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে। সাধারণ মানুষ, নীতিনির্ধারক এবং শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সুরক্ষার মতো জরুরি সেবা যারা দেয়, তাদের মধ্যে প্রতিবন্ধী মানুষের বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে হবে।

অটিস্টিক শিশুদের সুরক্ষায় প্রধানমন্ত্রীর কন্যা সায়মা ওয়াজেদ হোসেন পুতুল আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করেছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ১ এপ্রিল তাকে দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় অঞ্চলে অটিজমবিষয়ক চ্যাম্পিয়ন হিসেবে মনোনীত করেছে। তার এই স্বীকৃতি নিঃসন্দেহে দেশের জন্য গৌরব বয়ে এনেছে।

শিশুদের অটিজম ও স্নায়বিক জটিলতা-সংক্রান্ত বিষয়ে ২০০৮ সালে কাজ শুরু করেন সায়মা ওয়াজেদ। এতে অল্প সময়ের মধ্যেই বিশ্বজুড়ে প্রশংসা অর্জন করে তার কাজ। তার উদ্যোগেই ২০১১ সালের জুলাইয়ে ঢাকায় অটিজম নিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ওই সম্মেলনের পরে গড়ে ওঠে সাউথ এশিয়ান অটিজম নেটওয়ার্ক। বলা যায়, তার উদ্যোগেই অটিজম সচেতনতায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্বাহী পরিষদে সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয় বাংলাদেশের একটি প্রস্তাব।

২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তাকে ‘অ্যাক্সিলেন্স ইন পাবলিক হেলথ অ্যাওয়ার্ড’ পদকে ভূষিত করে। তিনি যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান অটিজম স্পিকসের পরামর্শক হিসেবেও কাজ করেন। ২০১৩ সালের জুনে তিনি মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিশেষজ্ঞ পরামর্শক প্যানেলের অন্তর্ভুক্ত হন। তার এই আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি বাংলাদেশের জন্য অনেক বড় অর্জন। এতে সারা বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি আরও উজ্জ্বল হবে।

বাংলাদেশ ইতিমধ্যে অটিজম বিষয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যেসব কাজ করেছে, তা গর্ব করার মতো। অটিজম রয়েছে এমন শিশুদের মধ্যে ১০ থেকে ২০ শতাংশ চার থেকে ছয় বছর বয়সের মধ্যে মোটামুটি সুস্থ হয়ে ওঠে এবং সাধারণ স্কুলে স্বাভাবিক শিশুদের সঙ্গে পড়ালেখা করতে পারে। আরও দরকার তাদের বিকশিত হওয়ার সুযোগ তৈরি করা। দেখা গেছে, মেধা বিকাশের সুযোগ পেলে প্রতিবন্ধীরা সমাজকে অনেক কিছু দিতে পারে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অটিস্টিক শিশুদের বাংলাদেশের হয়ে পদক জেতার ঘটনা এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। পৃথিবীর বিখ্যাত কয়েকজন বিজ্ঞানী ও মনীষী জন্মগতভাবে প্রতিবন্ধী হলেও স্বীয় প্রতিভাগুণে বিশ্ববরেণ্য হয়েছেন, এমন দৃষ্টান্তও আমাদের সামনে রয়েছে। সঠিক প্রশিক্ষণ, সমন্বিত সেবা ও উদার দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে রাষ্ট্র, সমাজ এবং সামর্থ্যবান প্রতিটি ব্যক্তি ধর্মবর্ণগোত্রনির্বিশেষে অটিস্টিকসহ অন্যান্য প্রতিবন্ধীর পাশে দাঁড়াবে— এটাই প্রত্যাশা।

লেখক : অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট ও সভাপতি, সাউথ এশিয়ান ল-ইয়ার্স ফোরাম

e-mail : [email protected]

সর্বশেষ খবর